‘আমাদের সময়’: আল্লামা সাজিদুর রহমানের মুখোমুখি

[জামিয়া দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিশেষ এক মজলিসে কয়েকজন সুহৃদের অনুরোধে অর্ধশতাব্দী আগের মুসলিম সমাজ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন দেশের বরেণ্য আলেমে দ্বীন শায়খুল হাদীস আল্লামা শায়খ সাজিদুর রহমান দামাত বারাকাতুহুম। এতে উঠে এসেছে তখনকার মুসলিম সমাজ এবং বর্তমান মুসলিম সমাজের তুলনামূলক পার্থক্য। অকপটে তিনি তুলে ধরেছেন এই পার্থক্যের আসল কারণ। আলোচনাটি সাক্ষাৎকার আকারে ফাতেহের পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন জামিয়া দারুল আরকামের শিক্ষক আনাস বিন সা‘দ।]

আনাস : প্রথমেই আপনাকে অনেক শুকরিয়া, অতি ব্যস্ততার মধ্যেও আপনি আমাদেরকে সময় দিয়েছেন। আপনার কাছ থেকে আমরা কিছু আলোচনা শুনবো, কিছু দিকনির্দেশনা লাভ করবো। আশা করি, আমাদের সম্মানিত পাঠকবর্গও আপনার আলোচনা ও দিকনির্দেশনা থেকে নিজেদের জন্য সরল পথ খুঁজে নিতে পারবে।

শায়খ: তোমাদেরকেও ‘জাযাকুমুল্লাহ’। আসলে আমাদের এই মজলিস, এই ধরণের আরো যত ধরণের উদ্যোগ আছে, সবকিছুরই মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, আমাদের সাধ্যের ভিতরে উম্মাহর সদস্যদের মধ্যে একটি দরদ, একটি ফিকির পয়দা করা। নিজেদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী করা। নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রত্যেকের মধ্যে ইসলাহ ও সংশোধনের প্রেরণা জাগ্রত করা। আল্লাহ যেন আমাদের সকল প্রচেষ্টা কামিয়াব করেন। ভরপুর কবুল করেন। আমীন।

আনাস : আমীন। আপনি তো কর্মমুখর বরকতপূর্ণ যিন্দেগীর অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। আমরা আপনার কাছে জানতে চাইবো, আপনার দেখা প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের  মুসলিম সমাজের সামগ্রিক চিত্রটা কেমন ছিল?

শায়খ: শুরুতেই তোমরা দেখি বিরাট প্রশ্ন করলে! ঐ সময়ের, আরো পঞ্চাশ বছর আগের মুসলিম সমাজের কথা বলতে গেলে অনেক কথাই আসবে। আমি কয়েকটা বিষয়ে একটু করে বলি।

আমি আসলে বড় হয়েছি একটা মফস্বল বা বলতে পারো, প্রায় মফস্বল এলাকায়। তো তখনকার মফস্বল এলাকাগুলোতে এখনকার মতো এত প্রাচুর্য, এত আধুনিকতা, এত প্রযুক্তি এবং সরঞ্জামের ছড়াছড়ি ছিলো না। সমাজের অধিকাংশ মানুষই ছিলো সাধারণ স্তরের। মানে ‘দিন আনে দিন খায়’ ধরণের মানুষই ছিলো বেশি। এজন্য আমার মনে হয়, আমাদের তখনকার সমাজে এত অস্থিরতা ও অশান্তি ছিলো না। আমাদের তখনকার জীবনে এত জটিলতা আর এত ঝাক্কি-ঝামেলা ছিলো না। সমাজে প্রায় সব স্তরেই মানুষ একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল ছিলো। যার কারণে পরস্পরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, সৌজন্যতাবোধ বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যেতো। আসলে এই দিকগুলো শান্তির অনেক বড় মাধ্যম।

তাছাড়া তোমরা এখনো দেখে থাকবে, গরীব মানুষ যারা, আর্থিকভাবে কিছুটা অসচ্ছল যারা তাদের  মধ্যে অন্যায়-অবাধ্যতার মাত্রাটা তুলনামূলক কম থাকে। ভালো মানুষির দিকটা বেশি থাকে। বুখারী শরীফের হাদীসে আছে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, اطَّلَعْتُ فِي الْجَنَّةِ، فَرَأَيْتُ أَكْثَرَ أَهْلِهَا الْفُقَرَاءَ ‘আমি গায়েবের জগতে জান্নাতে উঁকি দিয়ে দেখেছি। দেখলাম যে, অধিকাংশ জান্নাতী হলো গরীব মানুষেরা।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৪১) তিরমিযী শরীফের একটি হাদীসে আছে, يدْخُلُ الفُقَرَاءُ الْجَنَّةَ قَبْلَ الأَغْنِيَاءِ بِخَمْسِ مأَةِ عَامٍ ‘গরীবরা ধনীদের পাঁচশত বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৩৫৩)

এসব হাদীস থেকেও বোঝা যায়, সম্পদ কম থাকলে মানুষের গোনাহ-অবাধ্যতা কম হয়। গরীবদের মধ্যে  ভালো মানুষ বেশি হয়। আমি বলছি না, ওদের সবাই ভালো। কিন্তু দরিদ্র হয়েও যারা আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতা করে, দ্বীন ও শরীয়তের বিষয়ে অবজ্ঞা ও অহংকার প্রদর্শন করে তারা সত্যি হতভাগা। সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে এই ধরণের লোকের সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন না, তাকে পরিশুদ্ধ করবেন না, তার দিকে নযর পর্যন্ত দিবেন না।

যাই হোক, আমি বলছিলাম, আমাদের শৈশব-কৈশোরে শান্তি-স্বাচ্ছন্দ্য বেশি থাকার বড় একটা কারণ ছিলো, তখন অর্থের এত অনর্থ ছিলো না।

আনাস : আচ্ছা, অর্থ-সম্পদও তো আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত। এর মাধ্যমেও অনেক নেক আমল ও অনেক বড় বড় খেদমত হতে পারে।

শায়খ : আরে, তোমরা তো অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলে। সম্পদ যে আল্লাহর নেয়ামত, এর মাধ্যমে যে অনেক নেক আমল হতে পারে, এটা কে অস্বীকার করতে পারবে? সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অর্থশালী যারা ছিলেন তাদের আদর্শ দেখো! কিন্তু এখানে তো কথা হচ্ছে অন্য বিষয়ে। সম্পদ নেয়ামত ঠিক আছে। এটা আবার মানুষের জন্য অনেক বড় পরীক্ষাও বটে। কুরআন মাজীদে পরিষ্কার এসেছে, وَاعْلَمُواْ أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلاَدُكُمْ فِتْنَةٌ: ٢٨ (অর্থ: আর তোমরা জেনে রেখো, নিঃসন্দেহে তোমাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি বিরাট এক পরীক্ষার বিষয়।)

তো এই শেষ যামানায়, এত এত ফেতনার ভীড়ে তুমি কয়জন সৌভাগ্যবান এমন পাবে, যারা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছে? সম্পদের হকগুলো যথাযথ আদায় করতে পারছে? এখানে অবশ্য আমি তোমাদেরকে বলবো, দ্বীনি দাওয়াতের মেহনতের এটাও কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। মানুষ যেন সম্পদ আহরণ ও সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলামের মহিমান্বিত শিক্ষার উপর উঠে আসতে পারে সেই মেহনত করা। যাক, এটা তো অনেক বিস্তৃত প্রসঙ্গ। চলো, আগের আলোচনায় ফিরে যাই।

আনাস: জ্বী শায়খ, আগের কালের সমাজের কথা বলছিলেন।

শায়খ : দেখো, আমি বলেছি, ঐ সমাজে পরস্পরের মাঝে সৌজন্যতাবোধ বিশেষভাবে জারি ছিলো। এটা তোমরা তোমাদের মা-বাবাদের সাথে কথা বললেও বুঝতে পারবে। ঐ সময় আত্মীয়তার অনেক কদর ছিলো। দূর-দূরান্তের আত্মীয়দের সাথেও সম্পর্ক রক্ষা করা হতো। বাড়ীতে কোনো আত্মীয় মেহমান হলে সেদিন যেন বাড়ীতে উৎসব বয়ে যেতো। মোরগ জবাই করা হতো। হাঁস জবাই করা হতো। পুকুর থেকে মাছ তোলা হতো। কত রকমের যে পিঠা বানানো হতো!   প্রচুর বাজার করা হতো। এ যেন একটা উৎসবের মত ছিলো।

আর ঐ সময় কেউ বেড়াতে আসলে একদিনের জন্য, দুদিনের জন্য আসতো না। অন্তত সপ্তাহ-দশদিনের জন্য বেড়াতে আসতো। কেউ কেউ মাসখানেকও বেড়াতো। তো এই দীর্ঘ সময়ে তাদের আদর-আপ্যায়নের কখনো কমতি হতো না। সমাজে যারা অবস্থাসম্পন্ন ছিলো, মেহমানদের জন্য তাদের আলাদা ঘরই থাকতো। সেই ঘরগুলোকে বলা হতো বাংলাঘর। ঈদ, বিয়ে-শাদী, অন্যান্য পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা যেতো দূরের-কাছের সব আত্মীয় উপস্থিত হতো। বেশ কয়েক দিন একসঙ্গে থাকা হতো। দিনগুলো সবারই কত যে ভালো লাগতো!

ঐ সময় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, আত্মীয়দের আপ্যায়ন করা—এসবে ক্ষেত্রবিশেষে আড়ম্বর অবশ্যই ছিলো, কিন্তু কৃত্তিমতা ছিলো না। সেই আপ্যায়নে আন্তরিকতার আশ্চর্য স্বাভাাবিক, অথচ মধুর এক প্রকাশ থাকতো। এর ফলে এতে ব্যয়-খরচ নিয়ে কখনো মন কালো হওয়ার প্রসঙ্গ আসতো না।

ঐ সময় তো যাতায়াত ব্যবস্থা এখনকার মত ছিলো না, যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিলো শুধু চিঠি। তো কারো যখন দূরে কোথাও কোনো প্রয়োজন হতো, তো সে ঐ এলাকার আশেপাশের কোনো আত্মীয়ের বাড়ীতে গিয়ে উঠতো। আগে জানানোরও অনেক সময় সুযোগ হতো না, আবার সেই আত্মীয়ও নিকটতম কোনো আত্মীয় না। কিন্তু এমন কখনো শোনা যেতো না, এই মেহমানের সেখানে অনাদর হয়েছে। ঐ সময়ে কেউ যদি তার কোনো আত্মীয়ের বাড়ীতে না গিয়েই এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করতো সেটা সেই আত্মীয় জানতে পারলে খুবই দোষণীয় মনে করা হতো।

তখন তো শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা এত সহজ ছিলো না। একেক অঞ্চলে একটা দুইটা স্কুল, মাদরাসা থাকতো। সেই স্কুল-মাদরাসার পাশের গ্রামে, বা এরও পাশের গ্রামে যদি কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয় থাকতো, তাহলে পরিবারের ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। বছরের পর বছর সে ঐ বাড়ীরই একজন সদস্য হয়ে থেকে পড়ালেখা করতো।

এখন যে আমাদের মধ্য থেকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার প্রেরণাটা হারিয়ে যাচ্ছে, এটা জাতি হিসাবে খুবই খারাপ কথা! ইসলাম তার অনুসারীদেরকে আত্মীয়তার হকের বিষয়ে যেভাবে গুরুত্বের সাথে বিস্তৃতভাবে বিধান দিয়েছে, অন্য কোনো ধর্মে এমন গুরুত্ব পাওয়া যাবে না। আত্মীয়তার হকের বিষয়ে কুরআনে নির্দেশ এসেছে। অসংখ্য হাদীসে এই বিষয়ে তাকীদ এসেছে। বুখারী শরীফের এক হাদীসে দেখো কী কঠোর উপস্থাপনা, লক্ষ্য করো!

إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ الْخَلْقَ حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ خَلْقِهِ قَالَتْ الرَّحِمُ هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنْ الْقَطِيعَةِ قَالَ نَعَمْ أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ قَالَ فَهُوَ لَكِ.

‘আল্লাহ তো সৃষ্টিকে সৃষ্টি করলেন। যখন সৃষ্টি করে ফারেগ হলেন তখন আত্মীয়তার সম্পর্ক [আপন ভাষায়] বলে উঠলো, এটা সেই ক্ষণ, যখন আপনার কাছে সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা হচ্ছে। আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ, তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, তোমার সাথে যে সম্পর্ক রক্ষা করবে, আমিও তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করবো। তোমার সাথে যে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো। সে জবাব দিলো, অবশ্যই হে আমার প্রতিপালক। আল্লাহ বললেন, তাই তুমি পাবে।’

বুখারী শরীফের আরেক হাদীসে এর ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে, مَنْ أَحَبَّ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ وَيُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ ‘যে পছন্দ করে তার রিযিকে প্রশস্ততা দান করা হোক, তাকে দীর্ঘায়ু দান করা হোক, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।’

আনাস : অনেক জরুরী একটা বিষয় বলেছেন। আসলে ঐ কালের অনেক সৌন্দর্য আমরা এখন হারিয়ে ফেলেছি। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এত পরিবর্তন! এরকম আরো কিছু দিক যদি বলতেন!

শায়খ: ঐ কালের সুন্দর আরেকটা দিক দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বা কমে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এই দিকটা না থাকাটাও সমাজে বেবরকতী বাড়তে থাকার বড় একটা কারণ। বিষয়টা হলো, আগে আমরা দেখেছি, মানুষের সকাল হতো অতি ভোরে, মোরগ ডাকের সাথেসাথেই। এখন মানুষের সকাল হয় কখন? সূর্য উপরে উঠে গেলেও অনেকের সকাল হয় না। শহরে তো এটা অনেক বেশি, এখন গ্রামে-গঞ্জেও ব্যাপক আকারে বাড়ছে। লোকজন সকাল বেলা ঘুমিয়ে থাকে। এটা একসময় ধনীদের মধ্যে বেশি ছিলো। এখন ধনী-গরীব, ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার মধ্যে বিস্তার লাভ করছে। এটা বড়ই মন্দ কথা। যিন্দেগীতে বরকত না হওয়ার অনেক বড় কারণ।

দেখো, দিনকে আল্লাহ বানিয়েছেন জীবিকা উপার্জনের সময়, আর রাতকে বানিয়েছেন ঘুম ও বিশ্রামের সময়। সূরা নাবায় আল্লাহ বলেছেন, وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا  (অর্থ: আর আমি রাতকে করেছি আবরণ, [যা তার অন্ধকার দিয়ে পৃথিবীকে আবৃত করে রাখে] আর দিনকে জীবিকা আহরণের সময় নির্ধারণ করেছি)। এই বিষয়টা কুরআন মাজীদে আরো অনেক আয়াতে এসেছে। এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দয়া ও করুণা, কুদরত ও ক্ষমতার অনেক বড় একটি নিদর্শন। সূরা কাসাসে কী সুন্দরভাবে আল্লাহ পাক বলেছেন, وَمِنْ رَحْمَتِهِ جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ  (অর্থ: তাঁর করুণার কারণেই তিনি তোমাদের জন্য রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা রাতে আরাম ও বিশ্রাম লাভ করতে পারো আর দিনে আল্লাহর অনুগ্রহ তথা রিযিক অন্বেষণ করতে পারো এবং যাতে তোমরা শোকর আদায় করতে পারো।)

তো রিযিক বা জীবিকার জন্য মানুষ দৌঁড়ঝাপ করতে পারে, চেষ্টা-তদবির করতে পারে; কিন্তু রিযিক দেবেন কে? জীবিকা দেওয়ার মালিক কে? একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।

দিন হলো রিযিক অন্বেষণ ও জীবিকা উপার্জনের সময়। আর দিনের মধ্যে সবচেয়ে বরকতপূর্ণ সময় হলো সকালবেলা। তিরমিযী শরীফের হাদীসে এসেছে, হজরত সাখর আলগামেদী রাদি. বলেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করেছেন, اللَّهُمَّ بَارِكْ لأُمَّتِي فِي بُكُورِهَا. ‘আল্লাহ, আপনি আমার উম্মতের সকালের মধ্যে বরকত দিয়ে দিন।’ এরপরে সাখর রাদি. নিজের ঘটনা শুনালেন, তিনি যখন ব্যবসার উদ্দেশ্যে কাফেলা পাঠাতেন তখন সকাল বেলা রওয়ানা করাতেন। দেখা যেতো ব্যবসায় অনেক লাভ হতো, সম্পদে অনেক বরকত হতো। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস ১২১২)

এই বরকতের সময়ে কেউ যদি নিয়মিত, প্রতিদিন ঘুমিয়ে থাকে তাহলে সে বরকত পাবে কীভাবে? অথচ আগে আমরা দেখতাম, লোকজন ভোরে উঠে যেতো। অনেকেই ফজর নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়তো। ঐ সময় কি অযু-ইস্তিঞ্জার ব্যবস্থা এখনকার মত আধুনিক ছিলো? এত ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে কত কষ্ট করে কল চেপে, ঘাটলায় গিয়ে …। ফজর নামাজ পড়ে লোকজন কাজে বের হয়ে যেতো। ভোরের পরিবেশটা কত সুন্দর! এই সময় কাজ করতে এমনিতেই তো অনেক ভালো লাগে। তো তাদের কাজে, তাদের সময়ে বরকত হতো।

আসলে তারা তো রাতে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে জেগে থাকতো না। আমরা দেখতাম, বিকালের দিকেই ঘরে রান্নাবান্না শেষ হয়ে যেতো। লোকেরা যার যার কাজ থেকে ফিরে এসে কেউ সন্ধ্যার আগেই, কেউ সন্ধ্যার পরপর খাবার খেয়ে নিতো। এরপরে ছোটরা হয়তো কিছু পড়ালেখা করতো। বড়দেরকে, বয়স্কদেরকে দেখতাম, তারা উঠানে বসে, বা অন্য কোনোখানে কথাবার্তা বলতেন। কত রকম কথা! এরপর এশার আযান দিলে নামাজ পড়ে দেখা যেতো পুরো গ্রামে কুপিবাতি, হারিকেন সব নিভে যেতো। ছোট বড় সবাই শুয়ে পড়তো।

আর এখনের অবস্থা তো তোমরা দেখছোই। এখন সবাই কি প্রয়োজনেই রাত জাগে? আর যুবক-বয়স্ক, তরুণ-তরুণী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার ঘরে ঘরে, হাতে হাতে মোবাইল, ফেইসবুক, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, ভিসিয়ার এগুলোর কথা কী আর বলবো? অনেক বড় একটা সংখ্যার তো ফজর নামাজের নামই নেই। কেউ কেউ ফজর পড়লেও নামাজ পড়ে আবার ঘুম। এখন তো মাদরাসার লোকদের মধ্যেও …।

এই জন্যই মানুষের জীবনে এত বেবরকতী। আমাদের হাটহাজারীর হযরত আল্লামা শাহ আহমদ শফী দামাত বারাকাতুহুম এই বিষয়ে কঠিন তাকীদ দেন। হযরত বলেন, ‘সকালের ঘুম রিযিকের ‘তঙ্গী’ ডেকে আনে।’

আনাস: ঐসময় তো মুসলিম সমাজে সকালে আরেকটা বিষয় ছিলো, ঘরে ঘরে কুরআন তিলাওয়াত। এই বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?

শায়খ: হ্যাঁ, অনেক সুন্দর কথা মনে করিয়ে দিয়েছো। শুকরিয়া। এটা তো এখন একেবারে দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। কিছু বছর আগেও কিন্তু এটা বেশ ভালো পরিমাণেই ছিলো। ঐ সময় তুমি যে কোনো মুসলমান ঘরের পাশ দিয়ে যদি যেতে অবশ্যই কুরআন তিলাওয়াতের গুঞ্জরণধ্বনি শুনতে। হাদীসে এর শব্দ হলো دَوِىٌّ كَدَوِىِّ النَّحْلِ। মৌমাছির গুঞ্জরণ। ঘরের বয়স্ক পুরুষেরা তো অবশ্যই, নারীরাও কুরআন তিলাওয়াত করে পরে সংসারের কাজে নামতেন। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে কায়দা-রেহাল নিয়ে সকালের মক্তবে যেতো।  এক্ষেত্রে ভালো পরিবারের সন্তান, সাধারণ ঘরের সন্তান এরকম কোনো ভেদাভেদ ছিলো না। সব বাচ্চাকেই মক্তবে পাঠানো হতো। যে ছেলেটা স্কুলে যেতো সেও মক্তবে যেতো। যে স্কুলে যেতো না, সেও যেতো। গ্রামে কোনো ছেলেকে মক্তবে যেতে দেখা না গেলে সমাজের পক্ষ থেকে ওকে, মানে ওর পরিবারকে অন্যরকম মনে করতেও দেখা গেছে।

দেখো, ঐ কালে সবাই যে খুব ভালো করে, সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে পারতো, এমন নয়। কিন্তু দেখা যেতো, এই মক্তবের পড়াটা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা নিয়ে যদ্দূরই হতো, এরা যখন বড় হতো, কুরআনের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখার ক্ষেত্রে, দ্বীন ও ঈমানের অন্তত মুহাব্বাতটুকু অন্তরে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত সহায়ক হতো। আরবিতে একটা প্রবাদ আছে, العلم في الصغر كالنقش في الحجر। ছোটোকালে কিছু শিখলে সেটা অন্তরে পাথরের মত খোদাই হয়ে যায়। ছেটোকালের ঐ পড়াটা দিয়েই কিন্তু পরবর্তী জীবনে কুরআন তিলাওয়াতটা ওরা ধরে রাখতো।

এখন তো মসজিদে মসজিদে মক্তব আর সেভাবে দেখা যায় না। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে দেখা যায় না টুপি মাথায় দিয়ে, ওড়না মাথায় দিয়ে মক্তবে যেতে। মক্তব থেকে ফেরার সময় ওরা যে সেদিনের শেখা পড়াগুলো জপতে জপতে আসতো, কী ভালো লাগতো! সেই দৃশ্যও আর চোখে পড়ে না। কোথাও কোথাও মক্তব চালু নেই তা নয়। কিন্তু সেগুলোর অবস্থা কি আর আশাব্যঞ্জক?

বেশ কয়েক বছর থেকে কিন্ডার গার্ডেনের ধারা শুরু হয়েছে, এটার উপকারিতা, কার্যকারিতা আপন জায়গায়; কিন্তু এর কারণে দেখা যাচ্ছে, ওই ছেলেমেয়েগুলো মক্তবের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। আবার এই বঞ্চনা কাটিয়ে ওঠার কোনো চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে না। মক্তবের শিক্ষা থেকে এই শিশুদের বঞ্চিত থাকা ওদের পরবর্তী জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিষয়টা কারো কাছে অস্পষ্ট হওয়ার কথা না।

আনাস : সত্যি, এটা অত্যন্ত বেদনার বিষয়। এভাবে আমাদের গোটা প্রজন্ম কুরআন থেকে, দ্বীন ও ঈমান থেকে অপিরিচিত হয়ে পড়ছে। নামের পরিচয় ছাড়া সামান্য বন্ধনটুকুও অনেকের অবশিষ্ট থাকছে না। অতি আশঙ্কার বিষয়। আল্লাহ যেন সবাইকে বোধোদয় দান করেন। আপনি আপনাদের ছোটসময়ের কথা আলোচনা করছিলেন …।

শায়খ: আসলে অনেকদিন পর ঐ সময়ের কথাগুলো বলতে গিয়ে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। আনন্দ-বেদনা, ভালো লাগা, খারাপ লাগার একটা মিশ্র অনুভূতি …। ভালো লাগা, আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই সুন্দর ছোটবেলাটার জন্য! খারাপ লাগা, এখন কী একটা যুগের মুখোমুখি আমরা!

ঐ সময়ের আরেকটা ভালো দিক, আমার মনে হয়, এটা এই প্রজন্মের ছেলেদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হওয়া কিছুটা কঠিন হতে পারে। সেটা হলো, তখনকার নারীদের লজ্জা, শালীনতা, দ্বীনদারি, ওফাদারি ইত্যাদি। সেই সমাজে তখন এমন অনেক নারী ছিলেন, মৃত্যু পর্যন্ত যাদের কণ্ঠস্বর কোনো পরপুরুষের কানে যায় নি। স্বামী-সংসারের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠা ও ওফাদারি সত্যিই এ যুগে অনেকটা গল্পের মত শুনাবে। এই বিষয়ে বললে অনেক কথা! আচ্ছা, একটু চিন্তা করো তো, এমন মায়েদের সন্তানেরা কেমন হওয়ার কথা! এই জন্যই কি ঐ কালের মানুষগুলো …।

আর এ যুগের কথা কি বলার দরকার আছে? না বললে শেষ হবে? শুধু মুসলিম শরীফের একটা হাদীস স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘দুটি দল যাদেরকে আমি দেখিনি, পরবর্তীতে তারা প্রকাশ পাবে। তারা জাহান্নামে যাবে। একদল হলো, এমন সব লোক যাদের হাতে গরুর লেজের মত চাবুক থাকবে। সেই চাবুক দিয়ে তার লোকদেরকে মারধর করবে। আরেক দল হলো, এমন কিছু নারী, কাপড় পরেও যাদের শরীর অনাবৃত থাকবে, অবৈধ পুরুষকে আকৃষ্ট করা ও তাদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া যাদের স্বভাব। তাদের মাথাগুলো উটের দোল খাওয়া কুঁজের মত। তারা পরপুরুষের দিকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে, মাথা বিভিন্ন দিকে দুলিয়ে তাকিয়ে থাকে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জান্নাতের খোশবুও পাবে না। অথচ জান্নাতের খোশবু এত এত দূর থেকেও পাওয়া যায়।’ (সহীহ মুসলিম হাদীস ৫৭০৪)

আনাস : ঐ সময় তো নারীদের শিক্ষার বর্তমানের মত এত আয়োজন, উদ্যোগ ছিলো না। তাহলে সেকালের অশিক্ষিত নারী আর বর্তমানের শিক্ষিত নারীর মধ্যে পার্থক্যটা এত বড় হওয়ার কারণ কী?

শায়খ: এটাই মনে হয় আমাদের আর তোমাদের প্রজন্মের মধ্যে পার্থক্য। তোমরা শুধু বর্ণমালার শিক্ষাকেই শিক্ষা মনে করো। ডিগ্রি হলেই, লেবেল লাগলেই তোমরা মনে করো শিক্ষিত। অথচ মানুষের মৌলিক শিক্ষাটা হলো, যা সে তার জীবনের জন্য তার পরিবার ও পরিপার্শ্ব থেকে গ্রহণ করে। সেই শিক্ষাটা তখন অনেক বেশি পরিমাণে ছিলো। আর তোমরা যে এখনের মেয়েদের শিক্ষার কথা বলছো, বাস্তব কথা হলো, মেয়েদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও তাদের পাঠ্যক্রম গোটা বিষয়টার মধ্যেই ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে তো বটেই, দ্বীনি শিক্ষার ক্ষেত্রেও অতীব প্রয়োজন। আর এটা আমাদের অস্তিত্বের তাগিদেই প্রয়োজন।

যাই হোক, এটা তো অন্য প্রসঙ্গ। অনেক দীর্ঘ বিষয়। চলো, আগের কথায় ফিরে যাই।

আনাস: জ্বি, ঐ সময়ের আর কোন দিকটা বর্তমান সময়ে …।

শায়খ: দিক তো অনেকই আছে। ঐ সময় একটা জিনিস আমরা দেখতাম, এটা ঐ সময় এতটা উপলব্ধি না হলেও এখন খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি হয়। আমরা দেখতাম, তখন সমাজের সাধারণ সাধারণ মানুষেরাও অন্তর থেকে আলিম-উলামাকে ইহতেরাম করতো। মন থেকে মসজিদ-মাদরাসাকে ভালোবাসতো। আমি বলছি না, এখন এই মুহাব্বাতটা একেবারে নেই। তা নয়। তবে আগে যেটা ছিলো সেটার মধ্যে অন্যরকম একটা কিছু ছিলো। আমি আগেও বলেছি, তখনকার মানুষের মধ্যে এখনকার মতো এতো সচ্ছলতা ছিলো না। তবু তারা তাদের সীমিত উপার্জন থেকে মাদরাসার ছাত্রদের, মসজিদের হুজুরদের বছরের পর বছর জায়গীর রাখতো। আমার তো মনে পড়ে, তখন একটা রীতিই ছিলো, মহিলারা যখন রান্নার জন্য পাতিলে চাল নিতো তখন সেখান থেকে এক মুষ্টি, দুই মুষ্টি চাল আলাদা একটা পাতিলে বা কলসে রেখে দিতো। প্রতিদিন এটা ওরা করতো। একসময় যখন সেই পাত্রটা ভরে যেতো, তারা সেটা মসজিদে, মাদরাসায় পাঠিয়ে দিতো। গাছের প্রথম ফল, পুকুরের প্রথম মাছ, গাভীর প্রথম দুধ এসব তারা সবার আগে হুজুরদের জন্য পাঠিয়ে দিতো।

এই যে সাধারণ মানুষদের মুহাব্বাত, এটার একটা ভালো প্রভাব ছিলো। শুধু এই মুহাব্বাতটুকুর ওসীলায়ও সমাজে ফেতনা-ফাসাদ কম হতো।

এখানে একটা প্রসঙ্গ বলতে মনে চাচ্ছে, সেটা কিছুটা তিক্ত হলেও আমি আমার বেরাদরির প্রতি কল্যাণকামনা থেকেই বলছি।

দেখো, তখন কিন্ত এত মাদরাসা ছিলো না। এত বড় বড় প্রতিষ্ঠান ছিলো না। এত শত শত ছাত্রও ছিলো না। আবার বর্তমানের মতো উন্নত ও সমৃদ্ধ সিলেবাসও ছিলো না। আসলে অনেক কিছুই ছিলো না। তখন সমাজের হাতে গোনা কজন আলেম হতেন, কিন্তু সমাজে তাদের ছিলো অভাবনীয় প্রভাব। তাদের দ্বারা তখন সমাজের অনেক অনেক খেদমত হতো। অথচ এখন …। এটা বাস্তব যে, বর্তমানের এই অবস্থার পিছনে বহিরাগত কিছু কার্যকরণও আছে। শত্রুদের বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা, মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন কারণ হয়তো তোমরা বলবে। কোনো সন্দেহ নেই যে, এগুলোও দুঃখজনক বাস্তবতা। কিন্তু আমাদের কি উচিত নয়, আমাদের নিজেদের অবস্থার দিকেও নযর দেওয়া? আমাদের নিজেদের সংশোধনের ফিকির করা?

আমি সংক্ষেপে শুধু আমার তালিবুল ইলম ভাইদেরকে এতটুকু বলবো, আমাদের নিজেদের যে ফরযে মানসিবী, অর্থাৎ ইলম হাসিল করা, ইলমের মধ্যে রুসূখ ও ইতকান হাসিল করা, তাফাক্কুহ হাসিল করা, ইনাবাত ইলাল্লাহ ও তাকওয়া-তাহারাত হাসিল করা, এই বিষয়গুলোতেই যেন আমাদের মনোযোগ, ধ্যান-ফিকির নিবিষ্ট থাকে। এর বাইরে যত বিষয় আছে, সেগুলোর জন্য তো পুরা যিন্দেগী পড়ে আছে। এখন তো নিজে কিছু হওয়ার সময়। এখন নিজেকে গড়ার সময়। এখন বিভিন্নমুখী কাজকর্ম, এদিক-সেদিকের ব্যস্ততা আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমাদের কাজের মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো বড় ধরণের অন্তরায়। বড় বেদনার সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি, এখনকার ছাত্ররা মোবাইল, ফেইসবুক, ইন্টারনেটের মত বিধ্বংসী জগতেও অবলীলায় লিপ্ত হয়ে পড়ছে। এসবের কারণে ইলমী ইস্তিদাদের ইনহিতাত, আখলাকের বরবাদী তো আছেই; সাথে সাথে মহামারি আকারে বদযবানী, বদগুমানী, বিভিন্ন বিষয়ে গলদ তাছীর গ্রহণ, ইত্যাদি মারাত্মক মারাত্মক ব্যাধি ব্যাপক আকারে তাদের মধ্যে বিস্তার লাভ করছে।

আনাস: আল্লাহ করুন, আপনার দরদভরা উপদেশ যেন আমাদের তালিবুল ইলম ভাইদের অন্তরের গভীরে রেখাপাত করে। তারা যেন এই মূল্যবান নসীহত থেকে উপকৃত হতে পারে। সত্যি, আপনাদের ছোটবয়সের দিনগুলোর এই সুরভিত স্মৃতি আমাদের অনেক ভালো লাগলো। কী সুন্দর দিনগুলো ছিলো তখন! যদি একটু বলতেন, ঐ জিনিসগুলো কী, যার মাধ্যমে সেই সমাজে এই সব সুন্দর ও চমৎকার দিকগুলো বিদ্যমান ছিলো?

শায়খ: দেখো, তোমরা যদি ভালো করে খেয়াল করে থাকো, কথা কিন্তু এগুলোই। অর্থাৎ প্রাচুর্যহীনতার কথা বললাম। ঐ সময় একে অপরের উপর নির্ভরশীলতার কথা বললাম। সকালের বরকতের কথা, সকালের মক্তব ও কুরআন তিলাওয়াতের কথা বললাম। অনেক কথাই তো বলা হলো। এগুলোই ছিলো আসলে সমাজে কল্যাণ ও বরকতের উৎস।

আমি এখানে আরেকটা বিষয় বলি। ঐ সমাজের দায়িত্বশীল শ্রেণীটা ছিলো অত্যন্ত দায়িত্বসচেতন। তাদের সচেতনতার কারণে, আবার সামাজিক যে বন্ধনগুলো ছিলো, সেগুলোর কারণেও সেখানে অদৃশ্য কিছু ‘অনুশাসন’ ছিলো। যেগুলোকে আরবীতে আমরা বলি, الوازع الطبعي সেগুলো অতি গুরুত্বের সাথে রক্ষিত হতো। এসব ক্ষেত্রে সামান্য ছাড়ও সেই সমাজ বরদাশত করতো না। এটাও কিন্তু ছিলো সেই সমাজের সুন্দর একটি বৈশিষ্ট্য। পরে ধীরে ধীরে মিডিয়া-অপসংস্কৃতি ইত্যাদির নগ্ন আগ্রাসনের শিকার হয়ে সেই অনুশাসনগুলো দুর্বল হতে শুরু করেছে। এখন তো মনে হয় অতি ক্ষীণ হয়ে গেছে।

আনাস: জাযাকুমুল্লাহ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বললেন। এবার অন্য একটা বিষয়ে জিজ্ঞাসা।

শায়খ: কথা তো অনেক হলো। আরো জিজ্ঞাসা?

আনাস: আমাদের সমাজে শিক্ষা ও আদর্শের দিক থেকে মোটা দাগে যে দুটো শ্রেণী আছে, জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণী আর দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণী। এক দেশে, এক সমাজে বাস করেও এই দুটি শ্রেণী চরম পর্যায়ে একে অপরের থেকে অপরিচিত থেকে যাচ্ছে। এই বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

শায়খ: এখানে শ্রেণী দুইটা। ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষিত শ্রেণীর করণীয় কী, সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে আমি আমাদের তরুণ আলেমদেরকে বলবো, আমাদের দাওয়াতের অঙ্গনকে আরো অনেক বিস্তৃত করা প্রয়োজন। শুধু এই শ্রেণীটি কেন, সমাজে আরো যত শ্রেণী ও মেযাজের মানুষ আছে, সবার জন্যই আমাদের দাওয়াতের কর্মসূচী থাকা প্রয়োজন। এবং সেই দাওয়াতকে প্রত্যেক শ্রেণীর উপযোগী করে তাদের সামনে উপস্থাপনের চেষ্টা করা প্রয়োজন। আর হ্যাঁ, অবশ্যই দাওয়াত যেন হয় দাওয়াতের উছুল ও মূলনীতির রেয়ায়েত করে এবং সাধ্যমতো সর্বোচ্চ সুচারুরূপে। আমার মনে হয়, দাওয়াতই হতে পারে তাদের মাঝে আর আমাদের মাঝে অনন্য সেতুবন্ধন। তখন পুরো উম্মতের মধ্যেই ইনশাআল্লাহ এর একটা ভালো প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হবে।

আনাস: ইনশাআল্লাহ।

শায়খ: আচ্ছা, তোমরা এত বিষয় জিজ্ঞেস করলে, কিন্তু একটা বিষয়ে তো কিছুই জিজ্ঞেস করলে না?

আনাস: কোনটা শায়খ?

শায়খ: তোমরা সম্ভবত এটা এড়িয়ে গেছো; ভেবেছো, আমি কি আর এই ময়দানের মানুষ? বিষয়টা হলো, বর্তমান সমাজে ইরতিদাদ ভয়াবহরূপে বিস্তার লাভ করছে। ধর্মত্যাগের বিষয়টা আগের চেয়ে এখন কেমন যেন অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে। চেতনে, সজ্ঞানে যেমন, আবার একটা শ্রেণী আছে, অবচেতনে তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের চরম শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। চিরস্থায়ী জাহান্নামের ইন্ধন হয়ে যাচ্ছে।

আনাস: জ্বি শায়খ, এই শ্রেণীটাও আছে। এদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। শায়খ সম্ভবত লক্ষ্য করেছেন, দেশের এক শ্রেণীর মিডিয়াও এই লোকদেরকে বলা যায় পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে। শায়খের মত প্রবীণ আল্লাহওয়ালা মানুষদের থেকেই আমরা এই বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা পাবো।

শায়খ: মূল কথাটা বলার আগে একটা কথা বলি। বর্তমান সময়ে মানুষের জীবন যান্ত্রিকতা ও প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ার কারেণ বড় একটা ক্ষতি মানুষের এই হয়েছে যে, মানুষের মধ্যে এখন অস্থিরতা অনেক বেড়ে গেছে। জীবিকা, জীবন, শিক্ষা-দীক্ষা, গোটা জীবনযাত্রা নিয়ে মানুষের মধ্যে কী রকম এক অস্থিরতা তৈরী হয়ে গেছে। মানুষ যে এখন স্বাভাবিকভাবে কিছু চিন্তা করবে, শান্ত হয়ে নিজের জীবন ও কর্ম নিয়ে কখনো আত্মজিজ্ঞাসায় মনোনিবেশ করবে, এই দিকটা মানুষের মধ্য থেকে দিন দিন কমে যাচ্ছে। মানুষ এখন সবকিছুতেই অস্থির। আমার মনে হয়, এই ইরতিদাদের পিছনে মানসিক এই অস্থিরতাও বড় এক কারণ।

এখন মূল কথাটা যেটা বলতে চাচ্ছি, সেটা হলো, আমাদের দ্বীনি ঘরানায় তো মাশাআল্লাহ লেখালেখি, রচনা, সংকলনের ভালোই একটা চর্চা শুরু হয়েছে। অবশ্যই এটা অত্যন্ত প্রশংসিত বিষয়। তবে তরুণ আলেমদের মধ্যে একদলের করণীয় হলো, যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে নিজেদের লেখালেখির শক্তিকে উম্মাহর এই শ্রেণীটির দাওয়াতের জন্য উৎসর্গ করা।

আনাস: জ্বি, আশা করছি, অবশ্যই একটা দল আপনার এই আহ্বানে সাড়া দেবে।

শায়খ: আল্লাহ যেন তাই করেন। আচ্ছা, কথা অনেক হলো। আজকে শেষ করো তাহলে!

আনাস: জ্বি শায়খ, আপনাকে অসংখ্য শোকরিয়া। আপনি আমাদেরকে সময় দিয়েছেন। অত্যন্ত জরুরী সব বিষয়ে আপনি আলোচনা করেছেন। আবারো আপনাকে জাযাকুমল্লাহু খায়রান।

শায়খ: ওয়া ইয়্যাকুম। আল্লাহ যেন এই মজলিসকে কবুল করেন। ওয়া আখিরু দাওয়ানা আনিল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।

আগের সংবাদ‘আল্লাহ কেন দেন বিপর্যয়?’ : বিপর্যয়ের নৈতিক ব্যাখ্যার সন্ধানে
পরবর্তি সংবাদইসলাম ও সায়েন্স ফিকশন