মুনশী নাঈম:
শীতের মওসুমকে বলা হয় ওয়াজের মওসুম। শীত যত কনকনেই হোক, কুয়াশা যত ঘনই হোক, মাহফিলের আয়োজন হবেই। এই মওসুম এলে ওয়ায়েজদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। প্রতিদিন তাদের ছুটে যেতে হয় দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। মাহফিলের জন্য দেয়া নির্দিষ্ট তারিখে তাদের উপস্থিত হতে হয় যেকোনো মূল্যে। মানুষ অনেকদিন অপেক্ষা করে থাকে, আমাদের গ্রামে বড় মাওলানা আসবেন। তার ওয়াজ শুনতে যাব। তারপর নির্দিষ্ট দিনে, সবকাজ একটু আগে গুছিয়ে, সুয়েটার-চাদর গায়ে দিয়ে, মাফলারটা গলায় শক্ত করে বেঁধে উপস্থিত হয় মাহফিলের ময়দানে। অপার মুগ্ধতা নিয়ে শুনে বয়ান, দোয়ায় হাত তুলে কাঁদে ঝরঝর। সেই ঝরঝর কান্না কুয়াশার ভারী পর্দা ভেদ করে পৌঁছে যায় আরশে আজিমে।
কী এমন কারিশমা থাকে বক্তার ওয়াজে। কী যাদু থাকে তার শব্দে-বাক্যে। যারা সুর ছাড়া বয়ান করেন, তাদের ওয়াজ শুনতেও কেন মানুষ রাত জাগে, অপেক্ষা করে। এত মতের এত বর্ণের মানুষকে এত দীর্ঘ সময় মুগ্ধ করে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়।
আল্লামা মুফতি মুশতাকুন্নবি সাহেবের বয়ানে ঝরে পড়ে বিনয়। অনুতাপ তৈরী হয় ইসতিগফারের। তিনি যখন বয়ান করেন, চোখ বন্ধ করে মানুষ নিজেকে শুদ্ধ করার কথা ভাবে। জাহান্নামের বর্ণনা শুনে শিউরে উঠে; জান্নাতি কাজ করার প্রত্যয় নেয়। তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘আসলে কারিশমাটা শব্দে থাকে না, থাকে হৃদয়ে, থাকে নিয়তে। যে সুর দিয়ে কথা বলে, তার না হয় সুরের কারিশমা আছে। কিন্তু যার সুর নেই, তার কিসের কারিশমা? তার কারিশমা হলো সহিহ নিয়ত। তিনি আল্লাহ তায়ালাকে রাজি-খুশি করা, নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা এবং মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকার জন্য ওয়াজ করেন। মানুষের বাহ্ বাহ্ কুড়ানো, অর্থ উপার্জন করা এবং মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য ওয়াজ করেন না। তিনি মানুষের কল্যান এবং ইসলাহের কথা ভাবেন বলেই আল্লাহ তার শব্দে এবং বাক্যে যাদু তৈরি করে দেন। এটা তার ইখলাসের বরকত।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত মানুষের সামনে কথা বলা বিশাল এক যোগ্যতার ব্যাপার। আপনি কি ওয়াজের ময়দানে কাজ করার জন্য আলাদা কোনো শ্রম দিয়েছেন? যেমন প্র্যাকটিস করা, কাউকে অনুসরণ করা ইত্যাদি। এত মানুষের কাছে বরিত আপনি, তার জার্নিটা কেমন ছিল? তিনি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে স্বভাবসুলভ ইতস্ততা বোধ করছিলেন। তবুও জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘আমি মনে করি, কথা বলার যোগ্যতা একান্তই আল্লাহ প্রদত্ত। এর জন্য আলাদা ট্রেনিংয়ের দরকার নেই। যারা ট্রেনিং নিয়ে কথা বলে, তাদেরটা কেমন মেকি। আমার মতের সঙ্গে হয়ত অনেকে একমত হবেন না। আপনি জিজ্ঞেস করায় বলছি। আমাদের সব কাজের আগে দেখতে হবে, কাজটা আল্লাহর জন্য কি না? এজন্য কখনও বক্তব্যের সুযোগ এলে মনে মনে এ দোয়া করা, ‘ইয়া আল্লাহ! একনিষ্ঠভাবে সুন্নত অনুযায়ী আপনার সন্তুষ্টি মোতাবেক বলিষ্ঠ কণ্ঠে কিছু কথা বলার তওফিক দান করুন, যাতে আপনার বান্দাদের উপকার হয় এবং তৃপ্তি লাভ হয়।’ এ দোয়ার বরকতে আল্লাহ বক্তার হৃদয়ে কল্যানকর কিছু কথা ঢেলে দেন।’
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভীর সঙ্গেও কথা হয় বক্তৃতা ও ওয়াজের ময়দানে তার জার্নি নিয়ে। যখন কথা হয়, তিনি তিখন গাড়িতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা জামিয়া ইসলামিয়া ইউসুছিয়ার বার্ষিক সম্মেলনে যাচ্ছেন। কোনো বিষয়ে তিনি কথা শুরু করলে আর কিছু বাকি রাখেন না। বিষয়টির নাড়ি-নক্ষত্র তিনি তুলে ধরেন। তার মতে, দৈনিক তাকে কমপক্ষে দুই জায়গায় কথা বলতে হয়। কখনো মাহফিলে, কখনো সেমিনারে, কখনো দরসে, কখনো বিশেষ মজলিসে। তিনি ছুটে চলেন অবিরাম।
তিনি বললেন, আমি খুব সফল বক্তা না। তবুও প্রিয়জনদের অনুরোধে, বড়দের নির্দেশে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলতে হয়। এই কথা বলার চর্চাটা শুরু হয়েছিল সেই কৈশোরে, মাদরাসায় পড়াকালীন। দেওবন্দে যখন পড়তে গেছি, সেখানে প্রতি বৃহস্পতিবার বক্তৃতার মজলিস অনুষ্ঠিত হতো। সেখানে বাংলা, উর্দু এবং আরবিতে বক্তৃতা করতাম। তারপর যখন উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছি, গবেষণা করেছি, তখনো; বিভিন্ন জায়গায় কথা বলতে হয়েছে বড়দের নির্দেশে। এভাবে কথা বলতে বলতে একটা সাহস তৈরি হয়েছে, আত্মবিশ্বাস তৈরী হয়েছে। যতটুকুই শিখেছি, বলতে পারার গুণের কারণে ততটুুকু মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারছি। অনেকে আছেন, খুন জ্ঞান রাখেন। কিন্তু বলার চর্চা না থাকার কারণে তেমন বলতে পারেন না। ওয়াজের মঞ্চে বসিয়ে দিলে ক্লাসের মতো করেই কথা বলেন।’
কথা বলা বা ওয়াজের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ? জানতে চাইলে তিনি বললেন, এটা সবচে গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল সা.-এর হাদিসের দিকে তাকালে এর যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়। রাসূলের একেকটি হাদিস বয়ানের একেকটি উদাহরণ। তিনি মানুষ বুঝে, সময় বুঝে কথা বলতেন। ফলে দেখা যায় বিষয় এক, কিন্তু রাসূল দুজনকে দু’রকম কথা বলেছেন, সমাধান দিয়েছেন। ওয়াজের ময়দানে দেখতে হবে, শ্রোতা কারা। কোন সময়ে বয়ান করছি। সাধারণ মানুষকে যে ওয়াজ করা যাবে, আলেমদের একই করা যাবে না, ছাত্রদের ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকবে। ওয়াজ করতে গিয়ে কখনও এ কামনা না করা, আমার ওয়াজ সুন্দর হোক। আমার ওয়াজ উচ্চমানের হোক। এটা মনে আনা যাবে না। বরং একথা কামনা করতে হবে, আমার কথাগুলো যেন মানুষ বুঝতে পারে। যেভাবে বললে মানুষ বুঝবে ওইভাবে বলতে হবে। দেড়-দুই ঘন্টা বয়ান করলাম, কিন্তু সেখানে শেখার কিছু নেই; এমন যেন না হয়। আমি চিৎকার করলাম, ওরাও চিৎকার করলো, এটা নবীজির তরিকা নয়। যেখানে নম্র ভাষা ব্যবহার করতে হবে, সেখানে তাই ব্যবহার করতে হবে। সবসময় গরম বক্তৃতা চলবে না। সবসময় কৌতুক এবং অভিনয় করা চলবে না। কথার প্রেক্ষিতে কৌতুক শোনানো যাবে। কিন্তু এতবেশি যেন কমেডি না করে, যেন ওয়াজের মূল বিষয়ের চেয়ে কমেডিই প্রাধান্য পেয়ে যায়। ’
বক্তাদের কর্তব্য নিয়েও কিছু কথা বললেন মাওলানা নদভি। তিনি বললেন, বক্তাদেরও উচিত এমন কিছু না করা, যাতে অলেম সমাজের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। বক্তার হাদিয়া নিয়ে এখন অনেক ক্যাচাল হয়। আমার মনে হয়, বক্তাদের উচিত এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রাখা। যতটুকু প্রয়োজন দাবি করা। উদাহরণত, এখনো অনেক মাদরাসা জনতার অনুদানে চলে। মাদরাসায় বড় কোনো মেহমান বা সরকারি লোক এলে তাকে তো আমরা হাদিয়া দেই না। বরং তার সামনে খাবার দিতেও ইতস্ততা বোধ হয়। বরং তার কাছে আরও মাদরাসার জন্য অনুদান চাই। এ বিষয়গুলো ভাবতে হবে। আমি লাখ টাকা দাবি করলে করতেই পারি, আয়োজকরাও দিতে পারে যেকোনোভাবে, তবে তা শোভনীয় নয়। আমাদের আকাবিররাও ওয়াজ করতেন। তারা কষ্ট করে পায়ে হেঁটে মাহফিলে যেতেন। হাদিয়ার বিষয়ে বেশ চৌকান্না থাকতেন। এটাকে মূল ভাবতেন না। আমিও তেমনটাই অনুসরণ করার চেষ্টা করি। কোনো দাবি-দাওয়া থাকে না আমার। বছরে ৬০০ মাহফিলের দাওয়াত আসে। কিন্তু আমি বেছে বেছে ১০০টা গ্রহণ করি। তাও একান্তই যাদের দাওয়াত ফেলতে পারি না, তাদেরটা। হাদিয়া যতটুকু পাই, তাতে ৬০ শতাংশ খরচ উঠে যাতায়াতের। বাকি ৪০ শতাংশ খরচ আমি নিজেই বহন করি। তবু বলি না কখনো, আমাকে বেশি দিতে হবে। এর কারণ একটাই, দ্বীনি দাওয়াতের ক্ষেত্রে আমারও কন্ট্রিবিউশন থাকছে। আমিও খরচ করতে পারছি। আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু যাদের সে সক্ষমতা নেই, তারা চাইলে পুরো খরচটুকু নিতে পারে। তবে তা যেন বাড়াবাড়ি না হয়ে যায়।’
একেকজনের বেড়ে উঠার গল্প একেকরকম। একেক জনের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাও একেকরকম। যে যেভাবে বেড়ে উঠে, তার দৃষ্টিভঙ্গিও সেভাবে গড়ে উঠে। উম্মতের ইসলাহের জন্য কেবল গলার সুর এবং কথা বলার যোগ্যতাই যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে দরকার ইলম ও আমল। এ তিনের সম্মিলনেই একটি ওয়াজ আদর্শ হয়ে উঠে, একজন ওয়ায়েজ হাজারো মানুষের হেদায়াতের কারণ হয়ে দাঁড়ান। ওয়াজ মানুষের কানে দ্বীনের বাণী পৌঁছে দেয়ার অন্যতম একটি মাধ্যম। ওয়াজ ও নসিহতের এ কল্যাণ ধারা রাসুলুল্লাহ সা. থেকে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের যুগ অতিক্রম করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত উম্মতের আলেমদের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে। যদিও যুগ, স্বভাব ও পরিবেশের পরিবর্তনে এতে ব্যবস্থাপনাগত কিছু বৈচিত্র্য এসেছে। তবে বর্তমান পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে এবং থাকাও অপরিহার্য।