আ লস্ট ডেকেইড : রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলামবিদ্ধেষের উত্থান

খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ

 

 

পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামবিদ্ধেষ :

নিছক মুসলিম হবার কারণে একজন ব্যক্তির প্রতি ভয়, ঘৃণা, শত্রুতা ছড়ানো, হয়রানি করা এবং অত্যাচারের মুখোমুখি করাই মুলত ইসলামোফোবিয়া। মুসলিমদের প্রতি পশ্চিমা-বিদ্ধেষের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাটলে দুই ধরনের বর্ণবাদ খেয়াল করবেন — এক. ডারউনিজমের biological superiority এর বিকাশ ঘটবার পর সাব-অল্টার্ন এবং ব্যাপকভাবে প্রাচ্যের মানুষের প্রতি পশ্চিমা ভদ্রলোকদের এক ধরনের ঘৃণাবোধ তৈরি হয়; যেখানে সাদা মানেই শ্রেষ্ঠ, কালো হচ্ছে অসভ্য। কালোদের চাইতে তাই স্বভাবতই সাদা জনগোষ্ঠী শাসন করবার বেশি উপযুক্ত। এজন্য দেখবেন দীর্ঘদিন যাবত, বিশেষত উনবিংশ শতকেও আমেরিকায় কালোমানুষদের বেচাকেনা হতো। চিরিয়াখানায় অন্যান্য পশুর সাথে বেধে রাখা হতো কালোমানুষদের। সাদা চামড়ার মানুষেরা দেখতো, আনন্দ-উদযাপন করতো। তখন নিছক আফ্রিকার কালো-মুসলিমরাই শুধু না বরং কালো-খৃষ্টান গোষ্ঠীসহ প্রাচ্যের সবাই তাদের বর্ণবাদের শিকার ছিল। এই সিচুয়েশনটা ছিল বিশেষত ৯/১১ এর আগে।  দুই.  ৯/১১ এর টুইনটাওয়ার হামলার পর পশ্চিমা-বিদ্ধেষে বড় ধরনের রুপান্তর ঘটে। উত্তর-নাইনএলিভেন পৃথিবীতে ওয়ার অন টেরর প্রজেক্টের ভেতর দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তিন ধরনের বর্ণবাদ বিকশিত হয় — ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সাংষ্কৃতিক। ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বর্ণবাদ তো মোটামুটি স্পষ্ট, আমি মুলত চাচ্ছি সাংষ্কৃতিক বর্নবাদকে হালকা ফোকাস করতে। কেননা, সাংষ্কৃতিক বর্ণবাদ কেবল পশ্চিমে সীমাবদ্ধ নেই, মুসলিম সমাজে যে ধরনের ইসলামোফোবিয়া দেখা যায়, তাকে সাংষ্কৃতিক বর্ণবাদের সাথে মিলিয়ে পাঠ করা সম্ভব। (১) সাংষ্কৃতিক বর্ণবাদ নিয়ে একটা আর্টিকেলের বরাতে সামান্য ধারণা দেই আপনাদের — A Working Definition of Islamophobia: A Briefing Paper নামের ব্রিফিংয়ে নিম্নোক্ত বরাতে অল্প বাক্যে সাংষ্কৃতিক বর্ণবাদকে হাজির করা হয়েছে, “Islamophobia can be interpreted through the lens of cultural racism whereby Islamic religion, tradition and culture are seen as a ‘threat’ to ‘British values’ and ‘national identity’, whilst ‘visible’ Muslims are viewed as ‘culturally dangerous’ and threatening the ‘British/Western way of life.” (২) পশ্চিম ভাবছে যে, মুসলিমরা এখানে বসবাস শুরু করলে আমরা সাংষ্কৃতিকভাবে হুমকির মধ্যে পড়ব। পশ্চিম তাদের জাতীয়, সাংষ্কৃতিক এবং ঐতিহ্যিক পরিচয়গত সংকট অনুভব করে নিজেদের মধ্যে যে বর্ণবাদ উৎপাদন করল তাই মুলত ইসলামোফোবিয়ার রুপ নিয়েছে, যা ওয়ার অন টেররের ভেতর দিয়ে ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। এটিই ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও আফগানে তাদের নিধনের বৈধতার বয়ান তৈরির পেছনে কাঁচামাল হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। পশ্চিমে বাহ্যত কিছু পরিবর্তন হয়তো এসেছে, কিন্তু ইতালি,ফ্রান্স এবং জার্মানির অনেক জায়গায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের বিচিত্র প্রকাশ দেখা যায় — দেখা যাচ্ছে আপনি রাস্তায় হাঁটছেন, পেছন থেকে হঠাৎ কেউ থাপড় দিয়ে জোরে বাইক চালিয়ে চলে গেল। অথবা আপনার পায়ে জুতো দিয়ে স্বজোরে গুতো দিল। অর্থ্যাৎ, মানসিকভাবে বর্ণবাদ এবং ইসলামবিদ্ধেষ গভীর ক্ষত হিসেবে রয়ে গেছে পশ্চিমা সমাজে।

CAIR (৩) আমেরিকায় মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সামাজিক সংস্থা হিসেবে পরিচিত, বেশ কয়েকটা প্রশ্নের উপর তারা একটা জরিপ চালিয়েছিল; বিভিন্ন বয়সের মানুষ ছিল তাতে, সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল —   ৯/১১ এর পর মুসলিমবিদ্ধেষী কোন ঘটনা তারা প্রত্যক্ষ করেছে কি না ?  ৬৮.৯৫ জন লোকের  ইতিবাচক জবাব ছিল , ১৯.১৮ নেতিবাচক এবং ১১.৮৭ বলছে I am not sure. এরমানে হচ্ছে অধিকাংশই কোন না কোনভাবে মুসলিমবিদ্ধেষী ঘটনার সাথে পরিচিত। আরেকটি সুআল ছিল, ব্যক্তিগত ভাবে কেউ এ ধরনের আচরণের মুখোমুখি হয়েছিল কি না, দেখা গেছে ৮২.৫৩ জন বলছে হ্যা! তারা নিজেরাও ভুক্তভোগী। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে ৯/১১ টুইনটাওয়ারে হামলার ঘটনার পর ব্যাপকভাবে মুসলমানদের উপর মানসিক এবং শারিরীক নিপীড়ন হয়েছে। (৪)

 

 বাংলাদেশে ইসলামোফোবিয়া :

বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় কিভাবে ইসলামবিদ্ধেষের উৎপাদন ও আমদানি হয়, তা বুঝতে হলে কয়েকটি নোক্তা মাথায় রাখতে হবে- প্রথমত, আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের সাপেক্ষে ইসলামের রাজনৈতিক ফিকহ, চর্চা ও অনুশীলন নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক বাহাস থাকলেও  ইসলামের শেকড় কিন্তু এ দেশে অত্যন্ত গভীরভাবে প্রথিত। ফলে এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে ইসলামবিদ্ধেষের পুরাতন কোন যোগসূত্র নাই। উত্তর-উপনিবেশিক আমলে ইসলামবিদ্ধেষ বাংলাদেশে হাজির হয়েছে মুলত সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চর্চার ভেতর দিয়ে। কথাটা বুঝিয়ে বলি, যেমন, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ এবং ‘শরিআ বিরোধী আইন হবে না’ মর্মে সংবিধানে যে অনুচ্ছেদ রাখা হয়েছে, তা কেবল শেকড়ের প্রতি লঘু-সমর্থন, এর মাধ্যমে আমজনতার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রন করা হয়েছে বটে, কিন্তু সংবিধানের বাকি (ফরাসি, জর্মান, ব্রিটেন ও আমেরিকান) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ইসলামের ভুমিকাকে তীব্রভাবে খাটো করা হয়েছে। ধর্মচর্চাকে প্রান্তিক করে ইসলামবিদ্ধেষের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটানো হয়েছে।

 

দ্বিতীয়ত, নাইন-এলিভেনের পর ইসলামবিদ্ধেষ বিশ্বব্যাপী নয়া রুপ লাভ করেছে। ক্রুসেডের সিলসিলায় পশ্চিমা সমাজে আগে থেকেই ইসলামবিদ্ধেষ হাজির ছিল; একে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে বাজারজাত করবার পেছনে সোসাল মিডিয়া, প্রিন্ট, ভার্চুয়াল এক্টিবিটিস সহ বিশেষভাবে পশ্চিমা একাডেমিয়া সমান্তরালে ভুমিকা রেখেছে। এভাবেই একসময় অন্যান্য মুসলিম সমাজের মতো বাংলাদেশেও তার আছর দেখা যায়। তবে পশ্চিম এবং প্রাচ্যের (বিশেষত মুসলিম সমাজে) ইসলামবিদ্ধেষের কাঠামোগত রুপ এক না — পশ্চিমের ইসলামবিদ্ধেষে আপনি হয়তো জুদীয়-খৃষ্টান ঐতিহ্যের সুক্ষ যোগসূত্র পাবেন ; যেখানে সবকিছু ক্রুসেডের চেহারা নিয়ে হাজির হচ্ছে, মুসলমানদের যেকোন সক্রিয়তাকে দেখা হচ্ছে এন্টিসেমিটিক লেন্সে। নতুবা দেখবেন, ইসলামবিদ্ধেষ উৎপাদিত হচ্ছে প্রাক-আধুনিক ইউরোপে চার্চ ও রাষ্ট্রের সংঘাতকে পুজি করে। মুসলমানদের যেকোন ধরনের রাজনৈতিক চর্চাকে দেখা হচ্ছে থিওক্রেসির মোড়কে। মুসলিম সমাজগুলোতে প্রথমটির প্রবনতা তেমন চোখে না পড়লেও ইসলামকে থিওক্রেসি হিসেবে দেখানোর মেছাল কিন্তু অহরহ। ফলে দেখবেন হেফাজতে ইসলামের মতো অরাজনৈতিক সংগঠনও তাদের বয়ানে হয়ে যাচ্ছে পোপতন্ত্র এবং থিওক্রেসি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিম (ওরিয়েন্টালিজম) ইসলামকে আমাদের মননশীল ও প্রগতিশীল সমাজের কাছে যেই রুপে হাজির করছে তারা ঠিক সেই নজরেই দেখছে।

 

শরিআ ল  :

 

উপনিবেশবাদের মুলে যে শুধু অধিকৃত রাজ্য ও এর সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার করার মেকানিজমই ছিল , তা নয় বরং এটি ছিল এমন এক প্রকল্প যার কেন্দ্রে ছিল উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে হীনমন্যতার ধারণা তৈরি করা এবং ইউরোপকেন্দ্রীক জ্ঞানতত্ত্বের শ্রেষ্ঠত্ত্ব জাহির করা। উনিশ শতকের শেষদিকে মুসলিম এলিটরা সেকুলার ইউরোসেন্ট্রিক জ্ঞানতত্ত্বের দিকে ঝুকে পড়ে। এর ফলে ইসলামের প্রতি বিরুপ ভাবাপন্ন চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটে। ইসলামের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তিকে খারিজ করে ইউরোসেন্ট্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তিকে কবুল করার মধ্য দিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামোফোবিয়ার প্রাথমিক গঠন হয়। (৫) এ ব্যাপারটা বোঝার জন্য আপনাকে উপনিবেশের চরিত্র নিয়ে বিচারবিশ্লেষণ করতে হবে। কিভাবে শরিয়া ল কে ব্রিটিশ আইন দিয়ে রুপান্তর ঘটানো হলো, কাজীর আদালত বদলে গিয়ে তৈরি হলো জজ কোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্ট ব্রিটিশরা আসার আগে উপমহাদেশে শরিয়া ল এর চর্চা ছিল। বোঝার সুবিদার্থে শরিয়া ল এবং ব্রিটিশ আইনের তুলনামুলক একটা আলাপ সামনে রাখতে হবে — ১. প্রাক-উপনিবেশ আমলে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবে একটা প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থা ছিল, স্বভাবতই এমন সমাজে আইনের প্রয়োগ থাকে যথাযথ। ফলে ক্রাইম থাকে কম। ২. বিচারের দায়িত্ত্ব একমাত্র রাষ্ট্রের ছিল না, বরং সমাজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল বিচার করার জন্য। পাশাপাশি ছিল কাজীর আদালত। ফলে স্বেচ্চাচারিতা কম হতো। ৩. সমাজে মানুষের স্থায়ী বসবাস ছিল, মোবিলিটি কম ছিল; ইটসেলফ মোবিলিটি খারাপ না, কিন্তু এর সাথে ক্রাইমের সম্পর্ক আছে। কিন্তু এখন আধুনিক সময়ে একটা অস্থায়ী সমাজ গড়ে উঠতেছে যেখানে সহজেই একজন মানুষ অপরাধ করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে, নতুন এলাকায় বসবাস শুরু করছে।  ৪. কোন কাজ অপরাধ আর কোনটা ন্যায় তার কোন সুনির্দিষ্ট আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোতে নাই, এখানে রাষ্ট্র যাকে অপরাধ বলবে সেটাই অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। ফলে রাষ্ট্র একধরনের জুলুম করবার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু প্রাক-উপনিবেশিক আমলে শরিয়া একটা ব্যাকাপ বা কাঠামো হিসেবে কাজ করতো, রাষ্ট্র চাইলেই কোন কাজকে অপরাধ বলতে পারতো না। ৫. বর্তমানে বিচার-প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের একটা চরম কর্তৃত্ব আছে, সে চাইলেই বিচারকে খায়েশমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এভেন মিশেল ফুকো সহ অনেক উত্তর-কাঠামোবাদি চিন্তক মনে করেন, আইন হচ্ছে জুলুমের সবচে বড় হাতিয়ার। অন্যদিকে মোগল আমলে শরিয়া ল এর অধীনে ভিক্টিম নিজেই তার বিচারপ্রক্রিয়ার তদারকি করতো। (৬) এছাড়াও আরও অনেক তফাৎ সৃষ্টি হয়েছে শরিআ ল গায়েব হবার কারণে। এই যে এতো ফারাক দুটি শাসনব্যবস্থার মধ্যে, তুলনামুলক উত্তম ব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে ধীরে ধীরে শরিআ ল গায়েব হয়ে গেল। এর প্রক্রিয়ার পেছনে কোন মেকানিজম কাজ করল সেটা পাঠ করা জরুরি। সাথে সাথে মনে রাখতে হবে, শরিআ ল এর স্থানে ব্রিটিশ ল প্রতিস্থাপিত হবার পর থেকেই কিন্তু এই দেশে ইসলামোফোবিয়ার বিকাশ শুরু হয়েছে; বিভিন্নভাবে, কখনও রজমের বিধানকে কেন্দ্র করে, কখনও হাত কর্তন কিংবা মুরতাদের শাস্তিকে ঘিরে। আরেকটা ঘটনা হচ্ছে,  ব্রিটিশরা মুলত আমাদের কনভিন্স করতে পেরেছিল যে তারা আমাদের শাসন করার যোগ্য; আমরা এখনও তাদের বয়ানে কনভিন্স। কেননা আমরা যখন সভ্যতা এবং জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করি তখন তার প্রকাশ দেখা যায়।  তারা বলতো, তারা আমাদের সভ্য করতে এসেছে, আমাদের অধিকাংশ মননশীল মানুষ কিন্তু এখনও তাই মনে করে। Abdulmumini Adebayo Oba তার এক আর্টিকেলে নাইজেরিয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নোক্তা তুলে ধরেছেন —  প্রথমত, the perfection of the common law system অর্থ্যাৎ পশ্চিমা লয়াররা ধরেই নিচ্ছে কমন ল শ্রেষ্ঠ ও বিশুদ্ধ, অথচ ইসলামি আইন সম্পর্কে তাদের মোটেও ধারণা নেই।  দ্বিতীয়ত, নিজেদের অবস্থান হারানোর ভয়ে তারা শরিয়া ল চাচ্ছে না। (৭) তার এই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, ইসলামের প্রতি মানুষের ভীতি আদতে নানা কারণে তৈরি হয়। নাইজেরিয়া, মিশর, ইরান এবং আফগা.নে সেকুলার আইনে দীক্ষিত লয়ারদের সমস্যা হচ্ছে, তারা ভীতসন্ত্রস্ত যে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠিত হলে যে নতুন ধরনের আইনি এবং রাজনৈতিক আবহ তৈরি হবে, সেখানে তো তাদের পেছনের অভিজ্ঞতা নিস্ফল হয়ে যাবে। নতুন যে শাসনকাঠামো সৃষ্টি হবে সেখানে চলবে নয়া আইন, নয়া লয়ার। এগুলো কোন না কোনভাবে পশ্চিমা আইনকে মেনে নেওয়ার অজুহাত, যা অতি সুক্ষভাবে তাদের মধ্যে ইসলামোফোবিয়া সৃষ্টি করে দিচ্ছে।

 

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা : 

বাংলাদেশে শাহবাগের ঘটনা ইসলামবিদ্ধেষের সবচে বড় নজির হওয়া সত্ত্বেও আমি সেটি নিয়ে আলাপ করব না। কেননা, শাহবাগ ইসলামবিদ্ধেষী চেহারা নিয়ে আমাদের সামনে সবসময়ই হাজির থাকে। কিন্তু এর বাইরে আরও বহু ফ্যাক্ট ছিল, যেখানে ইসলামবিদ্ধেষ খুজে পাবেন। আমি আদতে সেসব ঘটনা নিয়ে কিছু আলাপ হাজির করবো।

১. কাওয়ালী ও ইসলামোফোবিয়া : আপনারা অনেকে জানেন, কয়েকমাস আগে ‘টিএসসিতে কাওয়ালি’ নামে একটা অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কোন কারণে পরবর্তীতে সেটি ভন্ডুল হয়ে যায়। কাওয়ালী ইসলামি কি না এবং সেটা বৈধ নাকি অবৈধ, আপাতত সে আলাপে যাওয়ার দায় আমার নাই, কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করছেন কি না, এখানে কিন্তু ইসলামবিদ্ধেষের ভিন্নচরিত্র আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল্। এখন কাওয়ালীর বিরোধীতা কি ইসলামবিদ্ধেষ ? না, আমি আদৌ তা দাবি করছি না। কিন্তু বুঝতে হবে যে, এখানে একটা সাংষ্কৃতিক বর্ণবাদ এবং ইসলামোফোবিয়া তৈরি হয়েছিল। কিভাবে, আমি সেই ব্যাখ্যায় আসব।

প্রথম আলোর ১৩ জানুয়ারি ২০২২ এর প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছিল যে, টিএসসিতে কাওয়ালি আয়োজনের আগেই এর বিরোধিতা করে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা মো. আহসান আজিজ ফেসবুকে লেখেন, ‘বাঙালির ভাষা আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু ধ্বংসের উৎসব আজ। যেখান থেকে বাংলা ভাষার দাবি শুরু, পাকিস্তানের বিপক্ষে কথা বলা শুরু, সেখানেই হবে কাওয়ালি উৎসব! মাদ্রাসার আধুনিকীকরণের সময় হয়তো আর বেশি নেই, তবে আধুনিকতার মাদ্রাসিকরণ ২৫ বছর আগেই শুরু হয়েছে।’  এছাড়াও আরিফা রহমান (রুমা) নামে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কাওয়ালি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। শুনতে বেশ লাগে। সমস্যা হচ্ছে এর আয়োজকদের নিয়ে। আয়োজক কারা ছিল, কেন অনুষ্ঠান পণ্ড হলো—এগুলো সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নিন। ইসলামী শাসনতন্ত্র, হিযবুত তাহ্‌রীর আর ওসব অধিকারের কথা বলাওয়ালারা যে আমাদের নিছক বিনোদন দিতে চায়নি, এটা বুঝতে গবেষণার প্রয়োজন নেই। মদ সেই পুরোনোটাই, বোতলটা নতুন। এই আরকি! নয়া কৌশল।’ আপনাকে বুঝতে হবে যে, সাধারণ একটা কাওয়ালী অনুষ্ঠানকে যেরকম ফোবিয়া হিসেবে দেখা হয়েছে এবং একে ইসলামপন্থীদের উত্থান মনে করে হচ্ছে তাতে সহজেই বোঝা যায় ইসলামোফোবিয়ার শিকড় খুবই গভীর এবং শক্ত। অনুষ্ঠানের আগে কাওয়ালীর বিরোধীতা করলেও মঞ্চ ভাঙার ঘটনাকে কেন্দ্র করে  মীযান হারুন যে স্ট্যাটাস লেখেন, তাতে মনে হয়েছে তিনি সহ ইসলামপন্থীদের অনেকে ইসলামবিদ্ধেষের ইস্যু ধরতে পেরেছিলেন, তিনি ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘কাওয়ালির বিরোধিতা করি, কাওয়ালির মঞ্চ ভাঙারও বিরোধিতা করি। কাওয়ালির বিরোধিতার কারণ ইমান। মঞ্চ ভাঙার বিরোধিতার কারণও ইমান।’ এ সময় কাওয়ালীর একজন সংগঠক মীর হুজাইফা আল মামদুহকে নিয়েও ডেইলী স্টারে প্রতিবেদন হয়েছিল, বিশেষত সে একজন সংষ্কৃতিমনা হবার পরও মেইনস্ট্রীম কিছু শাহবাগী তাকে এবং মীর হাবীব আল মানজুরকে নাকি হেজবুত তাহরীর এবং জঙ্গী ট্যাগ দিয়েছিল। মানজুর বলল যে, কেউ কেউ (নাম প্রকাশ করছি না) নাকি কতলের হুমকিও দিয়েছিল। এসব ইস্যুকে কোনভাবেই ইসলামোফোবিয়া থেকে আলাদা করে পাঠ করা যায় না।

 

 

২. পোষাক সংস্কৃতি :

 

ফ্রান্স সহ নানাদেশে হিজাব ও বোরকা নিয়ে বিচিত্র ইসলামবিদ্ধেষ আছে; একে কেউ সরাসরি সমস্যা হিসেবে দেখাচ্ছে মুলত ইসলামের কারণেই। বোরকা কিংবা হিজাব পরলে মানুষকে নাকি চেনা যায় না, নারীরা গুপ্তচর টাইপের কিছু একটা হয়ে যায় । অপরাধপ্রবনতা তৈরি হয় এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই ধরনের প্রপাগান্ডা ফ্রান্সে শুরু হয়ে দুঃখজনকভাবে মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রে খুঁটি গেড়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ও অফিসে বোরকাকে দেখানো হচ্ছে ভীতিকর অবয়বে। এসব কথাবার্তাগুলো ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামবিদ্বেষের কারণেই হচ্ছে, সে ধরনের সরলীকরণ আমি করব না, তবে এটা যে ইসলামোফোবিক প্রপাগান্ডাকেই সার্ভ করতেছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

দেশে এতো এতো ডিজিটালাইজেশনের পর‌ও মানুষের নিরাপত্তা কেন মুখবায়বে / মুখ ঢাকা না থাকার মধ্যে থিতু হয়ে গেল বুঝি না। কিসব কথা যে, একজন নারী মুখ ঢাকলেই দেশ, সমাজ ও দেশের মানুষ অনিরাপদ হয়ে যায়। সিসি ক্যামেরার নিরাপত্তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বুয়েটের হেলমেটবাহিনী, মুখখোলা লোকজন আবরারকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করল তার পেছনে কোন হিজাব বা বোরকা উ‌ৎসাহিত করল, বলতে পারবেন ? এই দেশের মানুষের ভুতের ডর নাই, মুখোশের ভয়‌ও নাই, ভয় মুলত এক জায়গায়ই; সেখানে নজর দিন প্লিজ।

 

ইসলামবিদ্ধেষ জানতে হলে শুধু ভয় বোঝাটাই যথেষ্ট নয়, ইসলামকেও জানতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ‘ইসলাম’ কি জিনিস তাই বোঝে না। ফলে সে যে ইসলামবিদ্ধেষী আচরণ করতেছে তা অনুভব করতে পারে না। দেখেন, আপনি হয়তো চোখ-মুখ-হাত-পা আগাগোড়া ঢেকে রাখার বিরোধিতা করতে পারেন ফিকহি মতভিন্নতার অযুহাতে, সেটাকে আমি ইসলামবিদ্ধেষ বলছি না, বলার অধিকার‌ও নাই। কিন্তু আপনি যখন গোটা পর্দার বিধানকেই সমস্যা হিসেবে দেখছেন, তা তো নিঃসন্দেহে ইসলামবিদ্বেষ। কারণ পর্দার সঙ্গে ইসলামের সংযোগ খুবই মৌলিক। পাপবোধের সাথে নিজে পর্দা করতেছেন না তাতে বিদ্ধেষ বা বেঈমানির কিছু নাই, কিন্তু পর্দাকে সন্দেহের চোখে দেখা অবশ্যই ইসলামবিদ্ধেষের শামিল।  ইসলামবিদ্ধেষ দেখানোর জন্য এতো সুক্ষ্ম ইস্যুর‌ও আসলে দরকার পড়ে না। নিছক ইসলামকেই সমস্যা হিসেবে দেখানোর নজির তো কম না। ০৯ অক্টোবর ২০১৯ সালে বাংলা ট্রিবিউনের খবরে ‘ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের না চিনলে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চলতো’ শিরোনামে আমানুর রহমান রনি ও রাফসান জানি দেখাচ্ছে, কেউ নিয়মিত নামাজ রোজা করলে তাকে শিবিরকর্মী হিসেবে সন্দেহ করা শুরু হয়। এমনকি সেই ছাত্রের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য থাকলেও। এগুলোকে আপনি সরাসরি ইসলামবিদ্ধেষ না বললেও আচরণ অবশ্যই ইসলামোফোবিক।

 

 

 

৩. নেপাল-বাংলাদেশ ফুটবল ম্যাচকে ঘিরে ইসলামবিদ্ধেষ :

আমি যে সময়ে প্রবন্ধটি মুসাবিদা করতেছি, তখন সাফফুটবলে নারী টিমের জয়কে কেন্দ্র করে ইসলামবিদ্ধেষের কিছু চিত্র সামনে এসেছে। বিশেষত কিশোরের আকা চিত্রে জঘন্যভাবে ইসলামবিদ্ধেষ যাহির হয়েছে; তিনি নারী এবং খেলাকে দাড় করিয়েছেন ইসলামের খেলাফে। আমি একে মোল্লাতন্ত্রের বিরোধীতা না বলে সচেতনভাবেই ‘ইসলামবিদ্ধেষ’ বলছি, এক্ষেত্রে আমি ত্বাহা আব্দুর রহমানের এপ্রোচকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি — তিনি বলেন ইসলামোফোবিয়া এবং সেকুলারিজম মুলত দুইভাবে যাহির হয়; এক. (আরকানে দ্বীন) ধর্মের মৌলিক ভ্যালুজকে প্রত্যাখ্যানের ভেতর দিয়ে। দুই. (আরবাবে দ্বীন) ধর্মবেত্তাদেরকে অবজ্ঞা এবং মূল্যহীন করার মধ্য দিয়ে। (৮) ইউরোপের সেকুলারিজমে ধর্মবেত্তাদের মূল্যহীন হবার আগেই খৃষ্টধর্মের মৌলিক ভ্যালুজ মানুষের কাছে গুরুত্ত্বহীন হয়ে পড়েছিল। মুসলিম সমাজের অভিজ্ঞতা পুরোপুরি উল্টো — এখানে ইসলামবিদ্ধেষ শুরু হয় ধর্মাবেত্তাদের প্রতি নির্বিচার অবজ্ঞা দিয়ে। কেননা, ইউরোপে খৃষ্টীয় বিশ্বাসের চাইতেও দুর্দান্ত প্রতাপশালী হয়ে উঠেছিল চার্চ এবং ধর্মবেত্তারা। অপরদিকে মুসলিম ইতিহাসে ব্যক্তি এবং প্রাতিষ্ঠান কখনও প্রতাপশালী হয়ে উঠতে সক্ষম হয় নি — তাই ধর্মবেত্তাকে অবজ্ঞার ভেতর দিয়ে ইসলামোফোবিয়ায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা তুলনামুলক সহজ। একটা জরুরি নোক্তা দিয়ে রাখি, নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির চিন্তাকে এনকার করা এক জিনিস আর টোটাল হুজুর শ্রেণিকে নাই করে দেওয়া কিন্তু ভিন্ন জিনিস; তথা এজেন্সকে নাই করে ফেলা। কিশোর তার চিত্রের মাধ্যমে আদতে গোটা হুজুর শ্রেণিকে উধাও করে দিতে চাইছে, এখানে সিম্বলিকভাবে হুজুর মুলত ইসলামের‌ই প্রকাশ।

 

 

তথ্যসুত্র :

 

১. বাংলাদেশে আমরা যে ধরনের ইসলামবিদ্ধেষ নিয়ে আলাপ করি, তার প্রধান উৎস কিন্তু সাংষ্কৃতিক। আপনি ইসলাম পালনের প্রশ্ন হাজির করলেই তারা দেখাবে, কিভাবে ইসলাম বাঙালি কালচারের বাইরের জিনিস। ইসলামের বিরুদ্ধে গিয়ে তারা একটা হিন্দু-বাংলা সংষ্কৃতির প্রস্তাব দিবে। এখানে তাদের সমস্যা মুলত ইসলাম নিয়ে, কালচারের আলাপ নিয়ে আসে জাস্ট প্রটেকশন হিসেবে।

২.  A Working Definition of Islamophobia: A Briefing Paper Imran Awan and Irene Zempi – November 2020 , তারা আরো দেখান যে, The notion ofcultural racism is largely rooted in frames of inclusion and exclusion, specifyingwho may legitimately belong to a particular national, or other community whilst,at the same time, determining what that community’s norms are and therebyjustifying the exclusion of those whose religion or culture assign them elsewhere. From this premise, there is such a strong attachment to ‘our’ way of life that creates boundaries between ‘them’ and ‘us’ founded upon difference rather than inferiority

৩. CAIR is America’s largest Muslim civil liberties and advocacy organization. Its mission is to

enhance the understanding of Islam, encourage dialogue, protect civil liberties, empower

American Muslims, and build coalitions that promote justice and mutual understanding

৪. Remembrance and resilience: American Muslims 20 years after 9/11

৫. মুসলিম সমাজে ইসলামোফোবিয়া : দীন বিনির্মাণ এবং পররাষ্ট্রনীতি, হাতেম বাজিয়াান (ইশরাক অনুদিত)

৬. ফৌজদারি আইনের ঐতিহাসিক রুপান্তর ও বর্তমান বাস্তবতা, মাহবুবুর রহমান, বোধিচিত্ত লেকচার।

৭.   The reasons behind the objections of legal practitioners to the court are multifarious, but also mundane. Having been raised intellectually to believe in the perfection of the common law system, they cannot contemplate or tolerate the existence of a rival law within the Nigerian legal system, a law which they are totally ignorant of. Above all, they fear for both their livelihood and prestige. (The Sharia Court of Appeal in Northern Nigeria: The Continuing Crises of Jurisdiction, ৮৯৭ পৃ,)

৮. বুসুস দাহরানিয়া, ত্বাহা আব্দুর রহমান ৩৬ পৃ.

 

আগের সংবাদআজানের সময় পূজামণ্ডপে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ সহনীয় রাখার নির্দেশ
পরবর্তি সংবাদএবছর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের অভিযানে ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত