ইসলামে আকল ও নকলের প্রশ্ন

আবদুল্লাহিল বাকি : 

) ইসলামে আকল নকলের সমতা

পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল ধর্মের মধ্যে একমাত্র ইসলামেই আকল তথা যুক্তি-বুদ্ধির গুরুত্ব ও চাহিদা বাস্তবানুগ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। কোরান ও রাসূলে খোদা সা.এর বাণীতে আমরা দেখতে পাই, আকল ব্যবহার করা ও গভীরভাবে বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। কোরান বিশেষজ্ঞগণের মতে, কোরানে ‘ইলম’ শব্দ অথবা এর ধাতুমূল থেকে নির্গত অন্যান্য শব্দ নয়শ’রও অধিকবার উচ্চারিত হয়েছে। এ থেকে ইসলাম ধর্মে জ্ঞান, যুক্তি ও চিন্তা-ভাবনার একটা গুরুত্ব ফুটে উঠে।

কোরানে আকল সম্পর্কে যে ইতিবাচক ধারণা দেওয়া হয়েছে, ইসলামী ইতিহাসে তার যথাযথ প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। ফলে ব্যপকভাবে ইসলামী জ্ঞানমহলে প্রামান্য উক্তি ও সঠিক যুক্তির মাঝে বিরোধজনিত কোন সংকট তৈরি হয়নি; যেই সংকট ও সংঘর্ষ খ্রিস্টীয় ইতিহাসকে অন্ধকার কালো করে রেখেছে।  বাইবেলীয় ঐতিহ্যের অধীনে যে খ্রিস্ট সমাজ ও মণ্ডলী গড়ে উঠেছে, তার শেকড়ের রক্তজলেই ছিল মানবীয় জ্ঞান, বুদ্ধি ও যৌক্তিকতার প্রতি ঘৃণা। সেন্ট পল করিন্থীয়দের নিকট প্রেরিত প্রথম পত্রে বলেছেন, ‘ইশ্বরের যে মূর্খতা তাহা মনুষ্যদের অপেক্ষা অধিক জ্ঞানযুক্ত (১: ২৫) (the foolishness of god is wiser than men) । এই যুক্তি-বিমুখতার ফল দাঁড়িয়েছে যে, মধ্যযুগ অতিক্রান্ত হবার পর থেকে বাইবেলীয় শিক্ষাধারার সাথে একটা সংঘর্ষের সূচনা হয় ‍যুক্তির। এর দরুন যাজকীয় ভাবধারার বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠে। জ্ঞানী বিজ্ঞানীরা ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন। জেন কম্বাই তার বিখ্যাত গ্রন্থ How to Read Church History-তে লিখেছেন, ‘সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন বিজ্ঞানের সাধিত অগ্রগতি কিছু সংখ্যক প্রত্যাদিষ্ট সত্যকে প্রশ্নের সম্মুখীন ক’রে তোলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দর্শনশাস্ত্রের (কাণ্ট) মতে যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অধিকন্তু ঈশ্বরের ধারণা একেবারে স্বভাব-বিরুদ্ধ না হলেও এটা কোন আগ্রহের বিষয় নয়।

ওগ্যস্ত কঁতের কাছে ধর্ম ও অধিবিদ্যার (মধ্যযুগীয় দর্শনের) যুগ পেরিয়ে গেছে। মানব জাতি এখন বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষবাদের যুগে পদার্পণ করেছে। প্রকৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিজ্ঞান যখন ভাল ও দ্রুত অগ্রগতি সাধন করছে, এমন একটি শতাব্দীতে বিজ্ঞানপন্থীরা জ্ঞানের সীমাহীন অগ্রগতিতে ও ধর্মের চূড়ান্ত বিলুপ্তিতে বিশ্বাস করে।’

এর বিপরীতে আমরা ইসলামের ক্লাসিক যুগ থেকে নিয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ইসলামী সাহিত্যে ধর্ম ও দর্শন, উক্তি ও যুক্তির মাঝে পারস্পরিক নির্ভরতা, অটুট বন্ধন ও হাম-আহাঙ্গি দেখতে পাই। ইসলামের এই অনন্য বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়েই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. রচনা করেছেনদারউতাআরুদির আকলি ওয়ান নাকলি(যুক্তি ও বর্ণনার মাঝে বৈপরিত্য খণ্ডন)। ইমাম গাজালী এ উদ্দেশ্যেই লিখেছেন আলকিসতাসুল মুস্তাকিম(সঠিক নিক্তি) গ্রন্থ। আর দার্শনিক আল্লামা ইবনে রূশদ (৫৯৫ হি.) লিখেছেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ফাসলুল মাকাল ফিমা বাইনাল হিকমাতি ওয়াশ শারীয়াতি মিনাল ইত্তেসাল(দর্শন ও ধর্মের মাঝে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বিষয়ে চূড়ান্ত বক্তব্য)।

ইলমে কালামের ভিত্তি ধর্ম ও দর্শনের সমন্বয়ের উপরে। মুতাকাল্লিম মানেই এমন এক চিন্তক, যে ধর্মীয় বর্ণনার উপর প্রথমে বিশ্বাস করে। পরবর্তীতে তার বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে যুক্তির মাধ্যমে। এবং যুক্তির আলোকে বিশ্বাস-সংক্রান্ত আপত্তি খণ্ডন করে। এ মর্মেই আল্লামা ইবনে খালদুন (৮০৮ হি.) আল মুকাদ্দিমায় লিখেছেন, ‘ইলমে কালাম এমন একটি জ্ঞান, যার মধ্যে আকলি প্রমাণাদির সাহায্যে ধর্মীয় আকিদা বিশ্বাসকে শক্তিশালী করা হয়। এবং ভ্রান্তদের খণ্ডন করা হয়।’

) আকলনকল প্রশ্নে মুতাকাল্লিমদের শ্রেণিবিন্যাস

আকল ও নকলের পারস্পারিক প্রয়োগ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রশ্নে ট্রাডিশনাল মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। কারো কারো মৌলিক কথা ছিল, শরীয়ার অগ্রে থাকতে হবে আকলকে। এটা মু’তাযেলাদের বক্তব্য। এর বিপরীতে কোন কোন চরমপন্থী দল আবার বলেছে, শরীয়ার বিধি বিধানের ক্ষেত্রে আকলের কোন প্রবেশাধিকার নেই। জাহেরিয়া ও হাশভিয়াদের মধ্যে কেউ কেউ এই বিশ্বাস লালন করে। কিন্তু মধ্যপন্থী আহলে সুন্নাহর মতে, শরীয়া যে আকলের উপর প্রাধান্য পাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু শরীয়াকে বোঝা ও ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আকলের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

এর মানে এই নয় যে, মু’তাযিলারা মৌখিক বর্ণনাকে কোন গুরুত্বই দেয় না। বরং ইতিহাসে দেখা যায়, শরীয়ার জন্য তারা ভিন্ন ধর্মমতালম্বীদের বিরুদ্ধে তর্ক বিতর্ক করেছে। অন্যদিকে জাহেরীদের ব্যাপারেও একই কথা। তারা আকলকে একেবারেই মূল্য দেয়না, তা বলা হবে সত্যের প্রতি অবিচার। তাদের প্রথম দিকের প্রভাবশালী ইমাম ইবনে হাজম আন্দালুসিও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আকলকে টেনে এনেছেন।

) মুতাযেলা আশায়েরাদের অবস্থান

শাহরাস্তানী আল মিলাল ওয়ান নিহালেমুতাযেলাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘মুতাযেলাদের কথা হলো, ধর্মের আগেই যুক্তি ফায়সালা করবে, কী ভাল আর কী মন্দ? যুক্তির মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানলাভ করা আবশ্যক। সকল জ্ঞান বিজ্ঞান আকলের মাধ্যমেই অর্জন করতে হবে। ওহি নাজিলের পূর্বেই আল্লাহ আকলের দরুন নেয়ামতের শুকরিয়া বান্দার উপর ওয়াজিব করে দিয়েছেন।’ এর দলিল দিতে গিয়ে তারা সূরা আনফাল, আয়াত নং-৪২ উদ্ধৃত করে। যার একাংশের অর্থ, ‘যার ধ্বংস হওয়ার, সে সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখেই ধ্বংস হয় আর যার জীবিত থাকার, সেও সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখেই জীবিত থাকে।’

কাজি আবদুল জাব্বার মুতাযেলীর মতে শরীয়তের ভিত্তি চারটি বিষয়ের উপরে। ১. আকল, ২. কোরান, ৩. সুন্নাহ, ৪. ইজমা। আকলকে অগ্রে রাখার ক্ষেত্রে তার ব্যাখ্যা হল, আকল দ্বারাই তো কোরান সুন্নাহ বুঝতে হয়। আকলহীন কোরান সুন্নাহ কিভাবে বুঝতে পারবে।

অন্যদিকে আশয়ারীদের মত হলো, বান্দার উপর যত আবশ্যকীয়তা আরোপিত হয়, সবগুলোর সংশ্লিষ্টতা কোরান হাদিসের বর্ণনার সাথে। পাশাপাশি সকল বিদ্যা-জ্ঞান-শাস্ত্রের সম্পর্ক হলো আকলের সাথে। আকল কোন জিনিসের ভাল-মন্দ নির্ধারণ করে দিতে পারে না। কোন ধর্মীয় চাহিদা ও দাবি সে নিজে থেকে আবিষ্কার করতে পারে না। কোন বিষয়ের শরীয়াগত আবশ্যকীয়তা বুঝতে পারে না। কারণ, ওয়াজিব বা ধর্মীয় আবশ্যকীয়তা ধারণার অর্থই হলো এই কাজ ত্যাগ করলে শাস্তি পেতে হবে। শরীয়া আগমনের পূর্বে শাস্তি প্রদানের কোন মানে হয় না। এজন্যই আল্লাহ কোরানে বলেছেন, ‘আমি কাউকে শাস্তি দেইনা, যতক্ষণ না তাদের মাঝে রাসূল প্রেরণ করি।’ (বনী ইসরাইল: ১৫)

) ইমাম গাজালীর অবস্থান

ইমাম গাজালী রহ.এর মাআরিজুল কুদসগ্রন্থে আমরা দেখতে পাই, তিনি আকল ও নকলের প্রতি সমানভাবে জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘জেনে রাখো, ধর্ম ও শরিয়ত ছাড়া আকল সঠিক পথে পরিচালিত হয় না। আর আকল ছাড়া শরিয়ত বোঝা সম্ভব নয়। সে হিসেবে আকল হলো একটা ভবনের মূল ভিত্তি-সদৃশ। আর শরিয়ত হলো সেই ভিত্তির উপর গড়ে উঠা সুদৃশ্য প্রাসাদ। ভবনই যদি গড়ে না উঠল, তাহলে মজবুত ভিত্তি-প্রস্তরের কিইবা ফায়দা? আর ভিত্তি যদি নড়বড়ে হয়, তাহলে প্রাসাদ যত সুরম্যই হোক না কেন, তা জানের হুমকি ডেকে আনবে।’

) ইবনে তাইমিয়ার অবস্থান

সালাফি চিন্তা-ঘরানার শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াও (৬৬১ – ৭২৮ হি.) আকল ও নকলের পারস্পারিক বোঝাপড়ার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। এ বিষয়ে লেখালেখিও করেছেন। তার মতে, আকলের গুরুত্ব স্বস্থানে স্বীকৃত। কিন্তু শরিয়তের কিছু সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে তা আকল ‍ও যুক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। এ বিষয়ে তিনি দারউ তাআরুদির আকলি ওয়ান নাকলিতে লিখেছেন, ‘যে কথা সঠিক যুক্তি দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে, বিশুদ্ধ বর্ণনার সাথে তার বিরোধ হতেই পারে না। আমি বিরোধপূর্ণ মাসআলাগুলো নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, যেসব যুক্তিকে বিশুদ্ধ বর্ণনার বিপরীত মনে করা হয়, তা নিছকই ধোয়াশামূলক অস্পষ্টতা, তলিয়ে দেখলেই এর অযৌক্তিকতা ফুটে উঠে। এর বিপরীতে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে শরীয়ার যৌক্তিকতাই প্রতিভাত হয়ে যায়।’

বোঝা যাচ্ছে, ইসলামে আকল ও নকলের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। যুক্তি ও বর্ণনাকে ইসলাম সমদৃষ্টিতে দেখে। ইসলামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যে, মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের চিন্তায় এর যথাযথ প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই। এই সমতাকে রক্ষা করতে না পারার দরুণই আমরা আজ পিছিয়ে পড়ছি। শহিদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম সূরা তাওবার তাফসীরমূলক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এক ইংরেজ পণ্ডিত মিসরের প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মুফতি মুহাম্মদ আবদুহুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা (খ্রিস্টানগণ ) যে বর্তমান পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, কালচারে সবচে’ উন্নত জাতি আর আপনারা (মুসলমানগণ) যে পিছিয়ে পড়া জাতি— এর হেতু কি বলে আপনি মনে করেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা দু’জাতি একই কাজ করেছি। আমরা আমাদের ধর্মের শিক্ষা ছেড়ে দিয়েছি। আপনারাও আপনাদের ধর্মের শিক্ষাকে পরিত্যাগ করেছেন। কিন্তু ফলাফল হয়েছে ভিন্ন। আমাদের ধর্ম, যা যুক্তি ও শরীয়ার মাঝে সমন্বয়ের কথা বলে, সেই ধর্মের শিক্ষা ত্যাগ করার দরুণ আমরা পিছিয়ে পড়েছি। আর আপনাদের ধর্ম, যা ‍যুক্তিকে অগ্রাহ্য করেছে, তা ত্যাগ করে র‌্যাশনালিজমকে জীবনে স্বাগত জানানোর কারণে আপনারা এগিয়ে গিয়েছেন জাগতিক ময়দানে।’

আমাদের আগামী বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে কিভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত, তা অনুধাবন করতে মুফতী মুহাম্মদ আবদুহুর বক্তব্যটা সিদ্ধান্তমূলক।

আগের সংবাদপ্রতি উপজেলা থেকে অন্তত দুজনের নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
পরবর্তি সংবাদবিপর্যস্ত স্পেন, মৃতের সংখ্যা ছাড়ালো ১০ হাজার