এনআরসি’র ফাঁদে হাঁসফাঁস করছেন আসামের মুসলমান

মুসান্না মেহবুব

ভারতের আসাম রাজ্যে দ্য ন্যশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস বা এনআরসি নামে পরিচিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে নাম না ওঠায় সেখানে বসবাসরত কয়েক লাখ মুসলমান তুমুল বিড়ম্বনা ও শঙ্কার ভেতর দিয়ে জীবনযাপন করছেন। অবৈধ অভিভাসী চিহ্নিত করার নামে তৈরি করা এ তালিকার প্রথম খসড়া প্রকাশ করা হয় গত বছরের জানুয়ারিতে। এতে দেখা যায় প্রায় ১ কোটি ৩৯ লাখ বাসিন্দা বাদ পড়েছেন তালিকা থেকে। ফলে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে ভারত সরকার। পরে খসড়ায় আরও সংযোজন করে গত বছরের জুলাই ও এবছরের জুনে দুই দফায় খসড়া প্রকাশ করা হয়। শেষ খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়ে ৪১ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৩৬ লাখ মানুষ নিজেদের বাদ পড়ার বিরুদ্ধে আপিল করেছেন আর প্রায় দুই লাখ মানুষের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি তোলে অন্যরা। এসব আপিল ও আপত্তির বিষয়ে শুনানি এখনও চলছে। এরই মধ্য ঘোষণা করা হয়েছে এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা আগামী ৩১ আগস্ট প্রকাশ করা হবে।

চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়াদের যদিও ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে যে, তারা ফরেনার্স ট্রাইবুনালে আপিল করবার সুযোগ পাবেন, কিন্তু খোদ ট্রাইবুনালই বিড়ম্বনা ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে আসামের জনগণের জন্য। ফলে চরম দুশ্চিন্তা ও দুর্বিপাকের মধ্যে পড়েছে আসামের বড় একটি জনগোষ্ঠী। মুসলিম ছাড়া হিন্দুরাও আছেন বাদ পড়ার এ তালিকায়।

ফরেনার্স ট্রাইবুনালের অবিচার

ফরেনার্স ট্রাইবুনালের সবচেয়ে বড় অবিচার হলো, বাদপড়া বাসিন্দাদেরকে নিজ থেকেই সেখানে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা ভারতের নাগরিক। অন্যথায় তারা বিদেশি অনুপ্রবেশকারী ও অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন এবং তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হবে। এনআরসি প্রক্রিয়ায় অবিচারের মূলে রয়েছে এই সিস্টেমটি। অথচ বেশির ভাগ অপরাধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রসিকিউশন যতক্ষণ না তার অপরাধ প্রমাণ করতে পারবে, ততক্ষণ ওই লোক নির্দোষ। কিন্তু এখানে প্রমাণ করার দায়দায়িত্ব বর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির। কেউ যখন প্রয়োজনীয় নথি আদালতে উপস্থাপন করতে না পারে, তখন অটোমেটিকলি সে দোষী সাব্যস্ত হয়ে যায়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারতের সর্বোচ্চ আদালতই প্রমাণ করার দায়দায়িত্ব ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।

ফলে আসামের এনআরসি লাখ লাখ লোককে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে গরিব মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে, তারা তাদের অতি সামান্য সম্পদও আইনজীবীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে যাতে তারা এনআরসির আমলাতন্ত্রের বৈরিতার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে বাঁচতে পারে।

আসামের মানবাধিকারকর্মী হার্শ মান্দের বলেন, আমি এমন শত শত মামলা দেখেছি যেখানে ইংরেজি বা বাংলা নামের বানানে সামান্য ভুল বা বয়সের সামান্য হেরফেরের কারণে এনআরসি কর্তৃপক্ষ ও ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তাদেরকে বিদেশি হিসেবে দণ্ডাদেশ দিয়ে দিয়েছে।

তিনি বলেন, আপনি যদি স্কুলে না গিয়ে থাকেন, তবে আপনার নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণপত্র নেই। আপনার যদি ভূমি না থাকে, তবে ভারতে আপনার অবস্থানের রেকর্ড থাকবে না। আবার নিজের জায়গা থাকলেও তাতে ভুলের কারণেও খেসারত দিতে হচ্ছে অনেককে।

উপায়ান্তর না দেখে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকে

এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাবার কারণে চরম হতাশা পেয়ে বসেছে অনেককে। তালিকায় নাম ওঠাতে না পারলে বিদেশি বলে ধৃত হতে হবে, অথবা ফরেনার্স ট্রাইবুনালে আপিল করে মামলায় জিততে হবে। কিন্তু মামলার খরচ চালানোর মতো পয়সাও যে নেই দরিদ্র এ জনগোষ্ঠীর কাছে! নেই মামলার প্যাঁচগোছ বুঝবার মতো ন্যুনতম শিক্ষাও। আবার মামলায় টাকা-পয়সা খরচ করেও ন্যায় বিচার পাওয়া যায় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এসব নানাবিধ জটিলতা অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলত কিছুদিন পরপরই আসাম থেকে আসছে আত্মহত্যার খবর। এই তো গত মাসে আশরাফ আলি নামক ৮৮ বছরের এক বৃদ্ধ খাবার সংগ্রহের কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন তিনি।

তারও কিছুদিন আগে বারপেতা জেলায় শামসুল হক নামের এক লোক আত্মহত্যা করেছেন। মার্চে উদলগিরি জেলার জনৈক দিনমজুর আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন একই কায়দায়। তাদের প্রত্যেকেই এনআরসি থেকে বাদ পড়া এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম হতাশায় ভুগছিলেন বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলো।

অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, ২০১৫ সালে নাগরিকত্ব তালিকা হালনাগাদ শুরুর পর নাগরিকত্ব হারিয়ে আটক হওয়ার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে বহু বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু।

সিটিজেন ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস সংস্থার জমশের আলী এ ধরনের ৫১টি আত্মহত্যার তালিকা দিয়েছেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে হালনাগাদ তালিকার প্রথম খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তাদের প্রত্যেকের আত্মীয়-স্বজন বলছেন, এসব মৃত্যুর জন্য এনআরসি কর্তৃপক্ষ দায়ী।

আগের সংবাদপুলিশের পোষাক পরে কলকাতায় ডাকাতি, তিন বাংলাদেশি গ্রেপ্তার
পরবর্তি সংবাদমিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে তুমুল সংঘর্ষ : ৩০ সেনাসদস্য নিহত