কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড : একটি পর্যালোচনা

আশরাফ উদ্দীন খান

ধারাবাহিক প্রবন্ধটির আগের পর্ব পড়ুন : কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড : একটি পর্যালোচনা

আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষাধারার অবকাঠামো ও মেয়াদ

কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ১৭৮০ সালে যখন শুরু হয়, তখন তা ৭ বছরে সমাপ্তিযোগ্য কোর্সের মাধ্যমে শুরু হয়। ১৭৯১ সালে মাদ্রাসার সার্বিক ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে গঠিত কমিটি কিছু আইন-কানুন প্রবর্তন করে, তার মধ্যে একটি আইন এই ছিল যে, ‘মাদ্রাসার কোন ছাত্রকেই সাত বছরের অধিক সময় মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে দেওয়া হবে না’। (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১২৫)। পরে ধীরে ধীরে, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পর্যায়ক্রমে আরো দুটি বিভাগ চালু হয়ে মোট তিনটি বিভাগ হয়–

১. প্রথম থেকে প্রবর্তিত মূল শিক্ষা কাঠামো যা আরবি বিভাগ নামে পরিচিত ছিল, যা ছিল দারসে নিজামি পদ্ধতির অনুসরণে পরিচালিত। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৮২৬ সাল থেকে মাদ্রাসায় আরবি-ফার্সীর পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার উদ্দেশ্যে একটি ইংরেজি ক্লাস খোলা হয়।

২. ইংরেজি বিভাগ, যা ১৮২৯ সাল থেকে চালু হয়। এই বিভাগকে ইংরেজি শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় বলা যেতে পারে।

৩. ১৮৪৯ সালে থেকে প্রবর্তিত এংলো এরাবিক বিভাগ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৩৮)

প্রথম দিকে মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারের পরিকল্পনা ও চেষ্টা করা স্বত্ত্বেও এই ক্ষেত্রে ইংরেজরা তেমন কোন সাফল্য অর্জন না করতে পেরে, ভিন্ন নামে ও ভিন্নভাবে ইংরেজি শিক্ষা চালু করার পরিকল্পনা করে। ফলে মাদ্রাসার উভয় বিভাগ–ইংরেজি ও ইংলো-এরাবিক বিভাগ–বাতিল করে ‘১৮৫৩ সালে ‘এংলো পার্সিয়ান’ নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ চালু হয় এবং এখানে মাদ্রাসা শিক্ষার মূল কাঠামোকে ঠিক রেখে আধুনিক আরবী, ফার্সী, ইংরেজি এবং উপমহাদেশের ভাষা হিসাবে উর্দু ও আঞ্চলিক ভাষা হিসাবে বাংলার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই বিভাগকে জুনিয়র স্কলারশিপের মর্যাদা দেওয়া হয়। উক্ত বিভাগের নির্ধারিত নীতিমালার মধ্যে ছিল ১০-১১ বছর বয়সে এই বিভাগে ভর্তি হতে হবে এবং ৫-৬ বছর পড়ার পর উত্তীর্ণদের জুনিয়র স্কলারশিপের মর্যাদা দেওয়া হবে। এই কোর্স শেষ করার পর ছাত্ররা ইংরেজি অথবা আরবি নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করতে পারবে। যারা আরবী পড়বে তারা আলিয়া মাদ্রাসাতে ভর্তি হবে, আর যারা ইংরেজি পড়বে তারা ইংরেজি কলেজে ভর্তি হতে পারবে।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৩৯)

‘১৯০৩ সালের দিকে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় দুইটি বিভাগে শিক্ষা চালু ছিল। ১. এংলো পার্সিয়ান বিভাগ যা ছিল একটি সাধারণ হাই স্কুল মানের। ২.মাদ্রাসার মূল আরবিসহ কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইত্যাদি শিক্ষার মূল বিভাগ।’ (প্রগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৬১)

‘১৯০৭ সালে ভারত সরকার মুসলমানদের শিক্ষা সম্পর্কিত একটি চূড়ান্ত সম্মেলনের আয়োজন করার জন্যে ডি পি আই আরসেল আর্লকে বিশেষ দায়িত্ব প্রদান করেন। উক্ত সম্মেলনে মাদ্রাসা শিক্ষায় একটি মৌলিক পরিবর্তন আসে। পূর্বের ৭ বছর মেয়াদী পাঠ্যসূচীর পরিবর্তে ১১ বছর মেয়াদী পাঠ্যসূচী প্রবর্তিত হয়। ৬ বছরের জুনিয়র কোর্স এবং ৫ বছরের সিনিয়র কোর্স ও সেই সাথে ৩ বছরের উচ্চতর টাইটেল কোর্স চালু করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

আর্ল কমিটি ১৯০৮ সালে বাংলা সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। সরকার তাদের সমুদয় প্রস্তাব অনুমোদন করেন। ১৯০৯ সালে টাইটেল ক্লাসের হাদিস ও তাফসীর বিভাগ চালু হয়। সংশ্লিষ্ট কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী জুনিয়র ৬টি, সিনিয়র ৫টি মোট ১১ টি এবং টাইটেলের ৩টি ক্লাসসহ মোট ১৪টি ক্লাস চালু হয়।

আর্ল কমিটির সুপারিশ অনুসারে জুনিয়র মাদ্রাসার শেষ বর্ষে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, যা বর্তমানে আলিম স্তরের পরীক্ষার সমান, এবং জুনিয়র তৃতীয় স্তরে আরবি-ফার্সীকে বাধ্যতামূলক এবং উক্ত শ্রেণীর যেসব ছাত্ররা ইংরেজিসহ আরবি পড়বে তাদের ফার্সিকে ঐচ্ছিক করা হয়। মুলত এর মাধ্যমে ফার্সীর ঐতিহ্যকে বিদায় করা হয়।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৬৭-১৭৩)

অন্যদিকে আর্ল কমিটির রিপোর্টের বিরোধিতাকারী ও মাদ্রাসা শিক্ষার আমূল সংস্কারের প্রবক্তা শামসুল উলামা আবু নছর ওহিদ ১৪ বছরের শিক্ষা ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ১৮ বছরের আরেকটি শিক্ষাধারার প্রস্তাব করেন। তিনি ১৪ বছরের কোর্সের সাথে ৪ বছরের মক্তব কোর্সের পক্ষপাতি ছিলেন। এবং তিনি আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষাকাঠামো সম্পর্কে বিস্তারিত রূপরেখা পেশ করেন। (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৭৯)

‘১৯২১ সালে শামসুল হুদা কমিটি প্রস্তাব করে যে, মক্তবের পরে এই মাদ্রাসায় কোর্স ১২ বছরের বেশী হবে না, জুনিয়র ৬ বছর, সিনিয়র ৪ ও টাইটেল ২ বছর। ১২ বছরের কোর্সের মধ্যে ৩টি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা থাকবে। সিনিয়র ২য় বর্ষ শেষে আলিম পরীক্ষা, ৪র্থ বর্ষ শেষে ফাজিল পরক্ষা এবং টাইটেল ২য় বর্ষ শেষে বিষয় অনুসারে হাদিস, ফিকাহ, আদব, দর্শন ও চিকিৎসা গ্রুপে পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। ১৯২৮-২৯ শিক্ষা বর্ষে এই কোর্স চালু হয়।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৯২-১৯৩)

‘১৯৪৬ সালের মুয়াজ্জিম উদ্দীন কমিটির সুপারিশে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা সমাপ্তির পর ওল্ড স্কীম মাদ্রাসার শিক্ষাবর্ষ হিসাবে নিম্নলিখিত স্তরে বিন্যাস করা হয়–১. জুনিয়র স্তর : ৪ বছর। ২. আলিম স্তর : ৪ বছর। ৩. ফাজিল স্তর : ২ বছর। ৪. কামিল স্তর : ২ বছর।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ২০৪)

‘১৯৫৫ সালের আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী কমিটিতে শিক্ষামেয়াদের বিন্যাস করা হয় নিম্নরূপ– ১. দাখিল ৬ বছর। ২. আলিম ২ বছর। ৩. ফাজিল ২ বছর। ৪. কামিল ২ বছর। অর্থাৎ এই বিন্যাসে পুর্বের আলিম স্তরের ৪ বছরকে ২ বছর করে আর ২ বছর দাখিল স্তরের সাথে সংযুক্ত করে দাখিল স্তরকে ৬ বছর করা হয় ‘ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ২২৭)

১৯৭২ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন ছিল ‘কুদরত-ই-খুদা’ শিক্ষা কমিশন। মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে এখানে বলা হয় যে, বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষাস্তরের বিন্যাস হচ্ছে নিম্নরূপ– ১.ইবতেদায়ি বা প্রাথমিক ৪ বছর। ২. দাখিল ৬ বছর। ৩. আলিম ২ বছর। ৪. ফাজিল ২ বছর। এখানে বলা হয় যে, ফাজিল পাসের পর, ছাত্ররা সরাসরি উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে ভর্তি হতে পারবে।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ২৬০)

বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠিত হওয়ার পর, বোর্ডের প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুনভাবে স্তর বিন্যাস করা হয়। ‘মাদ্রাসা শিক্ষাকে প্রাথমিক (ইবতেদায়ি), নিম্নমাধ্যমিক (৮ম শ্রেণী) ও মাধ্যমিক (১০ম শ্রেণী)-কে দাখিল স্তরে, উচ্চমাধ্যমিক মানের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীকে আলিম স্তরে, স্নাতককে ফাজিল স্তরে ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীকে কামিল স্তরে বিন্যাস করা হয়। ফলে দাখিল মাদ্রাসায় ১ম শ্রেণী হতে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত ১০ বছরের কোর্স কারিকুলাম ১০টি শ্রেণী। আলিম মাদ্রাসায় আলিম ১ম বর্ষ ও ২য় বর্ষ অর্থাৎ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীসহ মোট ১২টি শ্রেণী। ফাজিল মাদ্রাসায় দাখিল ১০টি, আলিম ২টি সহ ফাজিল ১ম ও ২য় বর্ষ (স্নাতক) ২টি শ্রেণীসহ মোট ১৪টি শ্রেণী এবং কামিল মাদ্রাসায় ইবতেদায়ি, দাখিল, আলিম ফাজিল ও কামিল (১ম বর্ষ ও ২য় বর্ষ) ২টি শ্রেণীসহ মোট ১৬টি শ্রেণী থাকবে।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ৩১১)

এইভাবে দেখা যায় যে, বর্তমানে আলিয়া মাদ্রাসার কোর্স কারিকুলাম ১৬ বছরে পরিচালিত হচ্ছে, যার বিন্যাস হচ্ছে–প্রথম শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী, ১০ শ্রেণীতে দাখিল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, এরপর আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরে ২ বছর করে ৬ বছরের শিক্ষা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার মাধ্যমে যখন এই শিক্ষাধারা সুচনা হয়েছিল তখন তদানীন্তন প্রচলিত প্রসিদ্ধ শিক্ষাধারা দারসে নিজামির অনুসরণে ৭ বছরের শিক্ষা কোর্স নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। বিভিন্ন কমিটি, কমিশনের প্রস্তাব ও সুপারিশের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এই শিক্ষা বিন্যাসে এসে উপনীত হয়।

এই অংশের শুরুর দিকের আলোচনায় দেখা যায় যে, আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার মধ্যে ইংরেজি ভাষা সংযুক্ত করার চেষ্টা বেশ কয়েকবার করা হয়। এবং যখনই একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, ঠিক তখনই আরেক নামে ও পদ্ধতিতে ইংরেজি শিক্ষা চালু করার চিন্তা ও চেষ্টা করা হয়। তাই এখানে এই বিষয়ে আলোচনা করা দরকার যে, ইংরেজি চালু করার পিছনে ইংরেজরা কেন এত আগ্রহী ছিলেন আর এই অঞ্চলের মুসলমানগণ কেন বারবার সেই বিষয়ে নিজেদের অনাগ্রাহ প্রকাশ করে আসছিলেন।

১৮২৬ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিকের নির্দেশক্রমে আলিয়া মাদ্রাসায় ইংরেজি ক্লাস খোলা হয়েছিল। এই ইংরেজি ক্লাস ১৮৫১ সাল অবধি চালু ছিল। এই দীর্ঘ ২৫ বছরে সর্বমোট ১৭৮৭ জন ছাত্র এই বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে। তবে এই খাতে ইংরেজদের বিশেষ অর্থ ব্যয় ও অনেক চেষ্টা স্বত্ত্বেও এই ফলাফল তাদের কাছে সন্তোষজনক ছিল না। তাই দেখা যায় যে, ইংরেজি ক্লাস চালু করার পরে ইংরেজি বিভাগ, এংলো এরাবিক বিভাগ চালু করে। শেষ পর্যন্ত এই সকল বিভাগ বন্ধ করে দিয়ে এংলো পার্সিয়ান বিভাগ নামে একটি আলাদা বিভাগ চালু করে। এবং সেই সাথে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণকারীদের জন্যে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ঘোষণা করে।

ইংরেজি শিক্ষা চালু করার পরিকল্পনা কেন ব্যর্থ হয়?

কিন্তু ‘পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও মুসলমানগণ ইংরেজির প্রতি তেমন আগ্রহী ছিলেন না। আলিয়া মাদ্রাসায় ইংরেজি ক্লাসের ব্যর্থতার কারণ ছিল মূলত ইংরেজদের প্রতি মুসলমানদের অনাস্থা। তারা সবসময় সন্দেহ পোষণ করত–এই ইংরেজি শিক্ষার নামে আবার মুসলমানদের নিজস্ব ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার না বিনষ্ট হয়ে যায়। মুসলমানদের এই সন্দেহ ও মনোভাব সঠিক ছিল, যার প্রমাণ ইংরেজদের লিখিত বক্তব্য থেকেই পাওয়া যায়। চার্লস গ্রান্টের (১৭৯২-১৭৯৭ প্রবন্ধের সময়কাল) লিখিত প্রবন্ধে পাশ্চাত্য ও খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষা প্রচারের ধারণা পাওয়া যায়।

চার্লস গ্রান্টের পরিকল্পনা ১৭৯৩ সালে পার্লামেন্টে পেশ করা হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারী শিক্ষা ইশতিহারে এই বিষয়ে আরো দুটি ধারা সংযোজন করা হয়। তা হলো ১. বৃটিশ শাসিত ভারতের লোকদের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য সব রকম সম্ভাব্য প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। ২. ভারতে প্রোটেষ্টাইন ধর্মভিত্তিক মতবাদ অনুযায়ী উপাসনা ও শিক্ষার পথ সুগম করতে হবে এবং এই জন্যে শিক্ষক প্রেরণ করতে হবে।

কিন্তু বিলাতের পার্লামেন্টের অনেক সদস্য এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন যে, এতে আইনগতভাবে কতগুলি অসুবিধার সৃষ্টি হবে। এই পরিকল্পনা খুবই বিপদজনক এবং রাজনীতির পরিপন্থী। এতে দেশের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে, এমনকি রাজত্বের ভিত্তিমূল নড়ে যেতে পারে। এই শিক্ষা-নীতি দেশে বিপ্লবের সূত্রপাত করতে পারে। তাছাড়া একটি ধর্ম যখন প্রবর্তিত হয়, লোকদের উদ্দেশ্য তখন সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। ভিন্ন ধর্মী লোকদের নিজেদের ধর্মে আকৃষ্ট করার এই প্রায়াস অষ্টাদশ শতাব্দীতে সম্পূর্ণ শান্তিবিরোধী। কিছু সংখ্যক লোক যদি এই অভিযানে সংক্রমিত হয় এবং কয়েক লক্ষ লোক খৃস্টান হয়ে যায় তাতে এমন বেশী কিছু লাভ হবে না, বরং এতে চরম সংকটের সম্মুখীন হতে হবে। কোন ভারতীয় ছাত্র যদি আসলেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় আকৃষ্ট হয়, তাহলে সে বিলাতে এসেই লেখাপড়া করতে পারবে।

তীব্র বিরোধিতার মাঝে পার্লামেন্ট এই শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করল। তবে চার্লস গ্রান্ট এই ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হল না। পার্লামেন্টের এই বিরোধিতার মাঝে তিনি আশার আলো দেখতে পেলেন। এবং এই ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য তিনি কোম্পানির একজন ডিরেক্টর নির্বাচিত হওয়ার প্রচেষ্ঠা চালান। অবেশেষে ১৭৯৪ সালে তিনি কোম্পানির ডিরেক্টর এবং ১৮০২ সালে বিলাতের পার্লামেন্টের সদস্য হলেন। এরপর তিনি নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মারিয়া হয়ে উঠলেন। এই প্রচারণার জন্যে তিনি একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। এই পত্রিকায় তিনি ভারতীয়দের নীচ জীবন সম্পর্কিত মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরতেন এবং বলতেন এই অসভ্য বর্বরদের দেশে শীঘ্রই আমাদের শিক্ষাবিদ ও পাদ্রীদের প্রেরণ করা উচিত। এইভাবে আট-দশ বছরের প্রচারণায় তিনি লোকদেরকে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনুপ্রাণিত করতে সমর্থ হলেন। পরিবেশ অনুকুলে আসার পর গ্রান্ট তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে উক্ত বিল পার্লামেন্টে পেশ করে এবং পার্লামেন্ট উক্ত বিলে নিম্নোক্ত বাড়তি ধারাটুকু সংযোজন করে সংশোধনী শিক্ষা বিল পাস করে–

‘ভারতীয়দের উৎকৃষ্ট শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য সব রকম উপকরণ ও উপাদানের বন্দোবস্ত করতে হবে। তাদের চারিত্রিক ও ধর্মীয় উন্নতির জন্য যারা এই ব্যাপারে পথপ্রদর্শন করার জন্য ভারতে অবস্থান করতে চায় তাদের জন্যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করতে হবে।’

বাস্তবে এই বিলে নিহিত আসল উদ্দেশ্য ছিল এই দেশের লোকদের খ্রিস্টান বানানো। এখানে যাদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‘এই দেশের লোকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যে যারা ভারতে এসে অবস্থান করবে ও যারা সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে’ মূলত তারা ছিল খ্রিস্টান পাদ্রী।

১৮১৩ সালে এই শিক্ষা-নীতি যখন পাস হল, তখন ইংল্যান্ডের শিক্ষা ছিল গীর্জাকেন্দ্রিক। তাই উৎকৃষ্ট শিক্ষার অর্থ ছিল খৃস্ট ধর্মের প্রপাগান্ডা ও যারা ভারতে থাকতে চায় তাদের অর্থ পাদ্রী সম্প্রদায়। এই নতুন শিক্ষানীতি পাদ্রীদের জন্য ভারতের দ্বার উন্মুক্ত করে দিল এবং তারা ভারতে এসে নানাস্থানে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ছোট ছোট স্কুল খুলে বসল।

এই সময় কলিকাতার একজন জমিদার রাজা রামমোহন রায় ‘এংলো ইন্ডিয়ান কলেজ’ নামে একটি পাবলিক কলেজের ভিত্তি পত্তন করেন। ইংরেজি শিক্ষার জন্যে এটাই ছিল কলিকাতার প্রথম কলেজ। অতঃপর কেরী নামক জনৈক পাদ্রী বেনারসে জয়নারায়ণ কলেজ নামে অপর আরেকটি কলেজের ভিত্তি পত্তন করে। এরপর এই ধরণের কলেজ তৈরির রীতিমত হিড়িক পরে যায়। ১৮২১ সালে পুনার হিন্দু কলেজ ও ১৮২৩ সালে আগ্রা কলেজের পত্তন হয়। এর পরেই ১৮২৬ সালে গভর্নর জেনারেলের আদেশক্রমে আলিয়া মাদ্রাসা ও হিন্দু কলেজে ইংরেজি ক্লাসের প্রবর্তন করা হয়। (আলিয়া মাদরাসার ইতিহাস, পৃঃ ৫৮-৬৩)

ভারতে শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে ইংরেজদের কী অভিসন্ধি ছিল তা চার্লস ট্রভল্যান নামক জনৈক অফিসারের প্রদত্ত বিবরণে আরো স্পষ্ট হয়। ১৮৫৩ সালে পার্লামেন্টের সাব-কমিটিতে প্রদত্ত সেই বিবরণের অংশবিশেষ ছিল এমন– ‘দেশের বর্তমান প্রচলন ও রেওয়াজ অনুযায়ী মুসলমানরা আমাদেরকে অভিশপ্ত কাফির ও বিধর্মীদের দলভুক্ত মনে করে, এবং মনে করে যে আমরা বলপূর্বক একটি সম্পৃদ্ধশালী ইসলামী সাম্রাজ্যের আধিপত্য দখল করে নিয়েছি। এবং হিন্দুরাও আমাদের সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখাকে অসমীচীন মনে করে। অর্থাৎ এই উভয় জাতিই মনে করে যে, আমরা বলপূর্বক তাদের রাজ্য কেড়ে নিয়েছি। এই অবস্থায় এদেরকে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রদানের অর্থ হবে তাদের মানসিকতা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেওয়া। যারা আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করবে তারা পূর্বেকার ধারণা অনুযায়ী প্রচলিত নিয়মে স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করবে না। বরং তারা তখন দেশের সকল পর্যায়কে পাশ্চাত্য রঙ্গে রঙ্গিন করার প্রচেষ্টা চালাবে। এই শিক্ষার প্রসার হলে, ক্রমান্বয়ে তারা আমাদেরকে জবরদস্ত শাসনকারী হিসাবে আর মনে করবে না। বরং তারা আমাদেরকে বন্ধু হিসাবে জ্ঞান করবে এবং আমাদেরকে তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে জানবে। … এদের মাধ্যমে বর্তমানে একটি ছোট দলের সৃষ্টি হয়েছে। তারা আমাদের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে চলবে এবং দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্যে আমাদের সাহায্য কামনা করবে। আগামীতে এদেরকে অনুপ্রাণিত করতে হবে, যাতে তাদের দল ক্রমশ ভারি হয়।’ (আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ৬৪-৬৫)

অনুরূপভাবে ১৮৩৫ সালের ২৮শে জুন লার্লস ট্রি ভলেন দ্বিতীয় বারের মতো এই মর্মে বিশেষ কমিটির নিকট আরো একটি বিবরণ পেশ করেন। নিম্নে উক্ত রিপোর্টের চমকপ্রদ অংশ পেশ করা হল–

‘যদিও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সরকারী কলেজসমূহের পাঠ্য তালিকায় বাইবেলের অন্তর্ভুক্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাই খৃষ্ট ধর্মের প্রচারের প্রশ্নে এক্ষেত্রে একটি অহেতুক বাধার সূত্রপাত করা হয়েছে বলে আমরা এর প্রতিবাদ করে বসতে পারি। কিন্তু আমার মতে এই অভিযোগ অমূলক এবং সম্পূর্ণ অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। কারণ বিভিন্ন কলেজের জন্যে ইংরেজি বইয়ের লাইব্রেরী পত্তন করা হয়েছে এবং প্রত্যেক লাইব্রেরীতে বাইবেলের কপি রাখা হয়েছে। এখন তো আমি এই খবর শুনেছি যে, লোকেরা বাইবেলের ব্যাখ্যা-পুস্তকও অনুসন্ধান করছে। এখন লাইব্রেরীতে বাইবেলের ব্যাখ্যা-পুস্তকও রাখতে হবে। সেই সঙ্গে অন্য ধর্মের ভাল গ্রন্থাবলীও রাখা উচিত। আমি যেমন আগেই বলেছি, বাইবেল যদিও পাঠ্য পুস্তক হিসাবে পড়ানো সম্ভব নয়, কিন্তু সরকারী কলেজসমূহে ইংরেজি সাহিত্য তো পড়ানো হয়। যথা মিল্টন, বেকন, এডিসন, জনসন প্রমুখের কাব্য ইত্যাদি। এদের সকল পুস্তকেই বাইবেলের শিক্ষার সমাহার রয়েছে এবং ছাত্রদেরকে বুঝানোর সময় বার বার বাইবেলের উদ্বৃতি ও বাইবেলের শিক্ষা সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে হবে। এই ভাবে ছাত্র এবং শিক্ষকদের মাঝে সাহিত্য পর্যায়ে বাইবেলের চর্চা প্রচলিত হবে। ছাত্রদের পরীক্ষার খাতা দেখেই বুঝা যাবে খৃষ্ট ধর্ম সম্পর্কে তাদের জানাশুনা কতটুকু অগ্রসর হয়েছে।’ (আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ৬৫)

উল্লেখিত এই বিবরণের উপর ‘আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক একটি গভীর অর্থপূর্ণ মন্তব্য করেন। তাঁর মতে–‘এই বিশিষ্ট ইংরেজ নাগরিক (লার্লস ট্রি ভলেন) দেশের সর্বোচ্চ পরিষদের সদস্য ও গভর্নর ছিলেন। তাঁর উপরোক্ত মতামতে ধর্মীয় নিরপেক্ষতার জিগির সুস্পষ্ট, কিন্তু অন্যদিকে এই ব্যক্তি খৃষ্টধর্ম প্রচারের ব্যাপারে কতখানি আশাবাদী ছিলেন, তা তার বর্ণনা থেকেই অনুমান করা যায়। তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার আসল উদ্দেশ্য ছিল স্কুল-কলেজে হিন্দু ধর্ম বা ইসলাম ধর্মের কোন শিক্ষা দেওয়া চলবে না, বরং সেই স্থানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খৃষ্টধর্মের অনুশীলন চলবে। এই প্রয়াস ধর্ম নিরপেক্ষ নয় এই কথাও বলা যায় না। এই উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন শিক্ষানীতিতে ধর্ম শিক্ষা ব্যাপার উহ্য রয়েছে। ফলে (প্রথমত) শিক্ষার্থীরা নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবে। দ্বিতীয়ত পুরনো রীতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বার বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং এই শিক্ষানীতির দোষ-ত্রুটি বের করা শুরু করবে, ফলে জনসাধারণ এই শিক্ষাধারার বিরোধিতা করতে শুরু করবে। কেননা জনসাধারণ যখন দেখবে এই শিক্ষার বাস্তব কোন লাভ নেই, তখন স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতি তারা অনিহা প্রদর্শন করবে। এর পরেও ধর্মপ্রাণ যেসব ব্যক্তি এই শিক্ষার স্বপক্ষে সংগ্রাম করবে তাদেরকে নিরস্ত করার জন্যে এই শিক্ষার দোষ-ত্রুটি প্রমাণ করার জন্যে তারা নিজেদের ভাষার আশ্রয় গ্রহণ করবে। এরপর যুবক শিক্ষানবীশরা নিজেদের ধর্মের প্রতি আরো বীতশ্রদ্ধ হবে এবং জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে খৃষ্ট ধর্মের জালে আকৃষ্ট হবে।

ইংরেজদের এই পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ের সাফল্য সম্পূর্ণ সন্তোষজনক এবং এটা এখন চতুর্দিকে ডালপালা বিস্তার করেছে, তাদের পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে পুরনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সংস্কার। এই ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি সবার আগে আলিয়া মাদ্রাসার উপর পড়ল। (আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ৬৬-৬৭)

পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা

১৮২০ সালে মাদ্রাসা পরিচালনার বিষয়ে কিছু নীতিমালা জারি করা হয়। ভর্তি পরীক্ষা ও সাধারণ পরীক্ষার বিষয়টি এখানে আলোচিত হয়। এই নীতিমালা গৃহীত হয় যে, ভর্তির পুর্বে ছাত্রদের উপযুক্ততা যাচাইয়ের জন্য একটি ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে, ভর্তির পর ষান্মাসিক পরীক্ষাও দিতে হবে। ইতিপুর্বে মাদ্রাসা শিক্ষায় বিধিবদ্ধ পরীক্ষা গ্রহণ করার কোন প্রচলন ছিল না। কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর পরীক্ষার কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। ছাত্রদের মেধা যাচাইয়ের জন্যে পুর্ব হতেই গুরুনির্ভর এক জাতীয় পরীক্ষা গ্রহণ করা হত। নির্দিষ্ট কোন কিতাব পড়া শেষ হলে শিক্ষক নিজেই ব্যক্তিগতভাবে নিজস্ব কায়দায় পরীক্ষা গ্রহণ করতেন। শিক্ষক যদি কোন ছাত্রকে সেই বিষয়ে উপযুক্ত মনে করতেন তাহলে তাকে পরীক্ষা পাসের সনদ প্রদান করতেন।

১৮২১ সালের ১৫ই আগস্ট কলিকাতা টাউন হলে আলিয়া মাদ্রাসার প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২য় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৮২২ সালের ৬ই জুন। শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ পরীক্ষার হল পরিদর্শন করেন। (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১২৭-১২৮)

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের দিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পুর্ব বাংলা প্রদেশের মাদরাসাসমূহের পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই হিসাবে ১৯৪৮ সালের আলিম ফাজিল ও কামিল শ্রেণীর পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করে। পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। যার ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পুর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকার ১৯৪৯ সালের ৩রা মে মাদ্রাসার পরীক্ষাসমূহের দায়িত্ব থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অব্যাহতি দিয়ে ‘মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুর্ববাংলা’ নামে একটি শিক্ষা বোর্ড গঠন করে। পরীক্ষা পরিচালনার সাথে সাথে এই বোর্ডকে ওল্ড স্কীম মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন এবং নতুন মাদ্রাসা মঞ্জুরির ক্ষমতাও প্রদান করা হয়। ১৯৪৯ সালে প্রথম আলিম, ফাজিল ও কামিল পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। ১৯৫০ সালে জুনিয়র ৪র্থ শ্রেণীতে (হাপ্তম শ্রেণী) কেন্দ্রীয় বা বোর্ড পরীক্ষা শুরু হয়, যা পরবর্তীতে দাখিল পরীক্ষা নামে প্রবর্তিত হয়। (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ২১৩-২১৪)

১৯৭৮ সালে ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’’ নামে একটি স্বায়ত্বশাসিত শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই বোর্ডের অধীনে ‘পরীক্ষা কমিটি’র নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষা পরিচালিত হয়ে আসছে।
১৯৮৫ সালে দাখিল পাস করা ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণ শিক্ষার এস.এস.সি পাসের সমমান লাভ করে। ১৯৮৪ সালে দাখিল পাস করা ছাত্র-ছাত্রীরা ১৯৮৫ সালের দাখিল পরীক্ষার্থীদের সাথে শুধু বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে দাখিল বিশেষ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। অনুরূপভাবে ১৯৮৬ সালে আলিম পাস ছাত্র-ছাত্রীরা ১৯৮৭ সালের নিয়মিত আলিম পরীক্ষার্থীর সাথে শুধু বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে আলিম বিশেষ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।

বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে তদানীন্তন রেজিস্টার আব্দুল আজিজ স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। বিজ্ঞপ্তির ভাষ্য ছিল–‘এতদ্বারা সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, বাংলাদেশ মাদ্রাসা বোর্ড হইতে যাহারা ১৯৮৫ সালে দাখিল স্পেশাল পরীক্ষায় (বাংলা ও ইংরেজি) পাস করিয়াছে এবং ১৯৮৭ সালে আলিম স্পেশাল (বাংলা ও ইংরেজি) পরীক্ষায় পাস করিয়াছে তাহাদের সার্টিফিকেট সাধারণ দাখিল ও সাধারণ আলিম সার্টিফিকেটের সমতুল্য বলিয়া গণ্য হইবে।’

মাদ্রাসা শিক্ষার প্রশাসনিক সংহতির জন্যে আরো সুপারিশ করা হয় যে, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাসমূহ অবিলম্বে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা দরকার। এই উদ্দেশ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্সে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। এই ব্যবস্থায় নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন আবশ্যক হবে।

ফাজিল ও কামিল শ্রেণীকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর সমমান দেওয়ার জন্য মাদ্রাসা বোর্ড কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়। সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার সমমানের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করার জন্য তা মঞ্জুরি কমিশনে পাঠান।

প্রথম দিকে আলিয়া মাদ্রাসায় পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন কড়াকড়ি বা ধারাবাহিকতা ছিল না, ফলে অনেকেই আলিয়া নেসাবের শ্রেণীসমূহের ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে সরাসরি আলিম, ফাজিল বা কামিল পরীক্ষায় অংশ নিত। অতঃপর বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা ও মাদ্রাসার শিক্ষিতদের সনদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছর আলাপ-আলোচনার পরে ৬/৬/১৯৮৮ তারিখে বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ৭১তম সভায় একটি বিশেষ ‘মানবিক সিদ্ধান্ত’ গৃহীত হয়। ফলে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আলিম পরীক্ষা ব্যতীত ফাজিল ও ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দাখিল পরীক্ষা ছাড়া আলিম পরীক্ষার সনদ বৈধ বলে বিবেচিত হবে।

বিজ্ঞপ্তির ভাষ্য ছিল এই–‘এতদ্বারা সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, যে সকল ছাত্র/ছাত্রী দাখিল/আলিম পরীক্ষা ছাড়া পরবর্তী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে তাহাদের বিষয় গঠিত সাব-কমিটির বিগত ১৫-৬-৮৭ ইং তারিখে সভার সুপারিশক্রমে ৬-৬-৮৮ ইং তারিখে অনুষ্ঠিত ৭১তম বোর্ড সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আলিম পরীক্ষা ছাড়া ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং ১৯৮৬ ইং সাল পর্যন্ত দাখিল পরীক্ষা ছাড়া আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সনদ বৈধ বলিয়া গণ্য করা হইবে। স্বাঃ/চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ৩৪৭-৩৪৮)।

অসমাপ্ত

আগের সংবাদমিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে তুমুল সংঘর্ষ : ৩০ সেনাসদস্য নিহত
পরবর্তি সংবাদকাশ্মীরে স্বাধীনতাকামীদের বন্দুকযুদ্ধ : পুলিশসহ নিহত ২