
রাকিবুল হাসান :
গেলো অক্টোবরে তিউনিসিয়ার নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন কাইস সাইদ। তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তিত্ব নন তিনি। বরং তিনি একজন আইনের অধ্যাপক। কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। একাই লড়েছেন, স্লোগান তুলেছেন, ইশতেহার পেশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন ২৫ জন। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ‘হার্ট অফ তিউনিসিয়া’র নাবিল কারবি। অর্থ-কেলেঙ্কারির অভিযোগে কিছুদিন আগেই যিনি কারাবরণ করেছেন। কিন্তু কারাগারে থেকেও তার দল যে প্রচারণা চালিয়েছে মিডিয়ায়, তার শতভাগের দশভাগও করেননি কাইস সাইদ। তবুও তিনি ৭২ শতাংশ ভোট পেয়ে রেসের দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে গেছেন। ৬১ বছর বয়সী আইনের অধ্যাপকের এই জয় ছিল অপ্রত্যাশিত, ভাবনাতীত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে
তিউনিসিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক কাইস সাইদ। তাঁর ক্লাস মানেই প্রাণোচ্ছল এবং প্রাণোচ্ছ্বাসে ভরা। যে-কেউ যেকোনো প্রশ্ন করতে পারত যখন-তখন। তিনিও উত্তর দিতেন।
কাইস সাইদের বড়বোন সেমেহ সেলমি বলেন, অন্যান্য অধ্যাপকের চেয়ে তিনি একটু বেশি ঠাণ্ডা মেজাজের ছিলেন। ক্লাসের ফাঁকে ছাত্রদের সমস্যা শুনতেন, সমাধান দিতেন। এমনকি কাউকে কাউকে ইচ্ছে করে ডেকেও পরামর্শ দিতেন। তিনি শাস্ত্রীয় আরবিতে ক্লাস করাতেন। তবে কেউ যদি আরবি না বুঝত, তিনি ফ্রেঞ্চে বলে দিতেন। এতই জমজমাট থাকত তাঁর ক্লাস, দেরি করে এলে ক্লাসে জায়গা পাওয়া যেত না।
রাজনীতির ময়দানে
যেহেতু তিনি আইনের অধ্যাপক, আইন এবং সংবিধান বিশ্লেষণ করতেন। তিনি সর্বপ্রথম মানুষের চোখে পড়েন ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময়। তখন তিনি প্রায়শই টিভির টকশোগুলোতে জনস্বার্থের বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে উপস্থিত হতেন। তিউনিসিয়ার ক্ষমতায় থাকা দীর্ঘদিনের শাসক যাইনুল আবেদিন বেন আলির পতন ঘটে সেই ক্ষুব্ধ সময়ে।
মানুষ তখন নতুন করে স্বপ্ন বাঁধে। দুর্নীতি, বেকারত্ব এবার দূর হবে বলে আশা প্রকাশ করে। আর কাইস সাইদ জনগণের স্বার্থে আইন ও সংবিধানের বিশ্লেষণ করে তাদের সজাগ করতেন। তাদের সামনে তুলে ধরতেন তাদেরকে কতটুকু অধিকার দিয়েছে রাষ্ট্র, এখন তারা পাচ্ছে কতটুকু।
আরব বসন্তের মূল স্পিরিট-ই যেহেতু তরুণরা, কাইস সাইদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সেই তরুণদেরই কাছে টেনেছেন। তিনি কাছে টানেননি, বরং তরুণরাই তাঁকে কাছে টেনেছে। রাষ্ট্রীয় নির্বাচনে তরুণরা যে সব হিসেব উলটে দিতে পারে, তিউনিসিয়া তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
তরুণদের সমর্থন
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাইস সাইদের অধিকাংশ ভোটারের বয়স ১৮ থেকে ২৫-এর মধ্যে। তার মানে তরুণ এবং যুবকরাই তাঁকে বেশি সমর্থন দিয়েছে। যদিও তিনি একটু কনজারভেটিভ চিন্তা লালন করতেন, কিন্তু তরুণরা সে কারণে তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেনি।
তিনি পুরুষ ও মহিলাদের সমান উত্তরাধিকারের বিরোধিতা করেছেন এবং তিউনিসিয়ায় ১৯৯৪ সাল থেকে স্থগিত মৃত্যুদণ্ড পুনরুদ্ধারের পক্ষে ছিলেন। স্থানীয় একটি সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বিদেশি শক্তিগুলোকে দেশে সমকামিতাকে উৎসাহিত করার অভিযোগ তুলেছিলেন।
তিনি নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিলেন—তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। পানি এবং স্বাস্থ্যসেবা জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। শিক্ষাই সব চরমপন্থা দূর করতে পারে। তিনি বলেছেন, তিনি আইনে অন্তর্ভুক্ত সামাজিক স্বাধীনতাকে সম্মান জানাবেন।
তরুণরা তাঁকেই কেন সমর্থন দিলো?
২৩ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসমা সালেমি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি এবং আমার বন্ধু তিউনিসিয়ায় একদিন কাইস সাইদের কার্যালয়ে গেলাম। সেখানে খুব ভিড় এবং গার্ড ছিল। কাইস সাইদ যখন কার্যালয়ে প্রবেশ করলেন, তখন ছাত্র-ছাত্রীরা জিজ্ঞেস করল, নির্বাচিত হলে বেকারত্ব সমস্যা মুকাবিলায় আপনি কী করবেন? যে সমস্যা আরব বসন্তের পর না কমে বরং বেড়েই চলেছে? তিনি তার উত্তর দিলেন, একটুও বিরক্তিবোধ করলেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কৃষিক্ষেত্রে আপনি কী করবেন, আমার বন্ধুদের কেন আপনাকে ভোট দিতে বলব? তিনি তখন বললেন, আমাদের ভালো মাটি থাকা সত্ত্বেও কেউ কৃষিকাজ করছে না। এরপর তিনি কিছু আইনের কথা বললেন, যেগুলো তিনি বাস্তবায়িত করবেন। তার উত্তর আমার পছন্দ হয়েছে। আমি জানি তিনি সব ঠিক করতে পারবেন ন। তবে সংসদে দরকারি এমন কিছু প্রস্তাব করবেন, যা প্রশাসনকে ঠিক করে দেবে।
আরেক শিক্ষার্থী বলেছেন, আমি কারবিকে ভোট দিতে চেয়েছিলাম। কারণ তিনি উদ্ভাবনী এবং বিপণনের ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু আমি ভোট দিয়েছি কাইস সাইদকে। কারণ আমি মনে করে এই দেশে এখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতির অপসারণ দরকার। আমি বিশ্বাস করি, তিনি দুর্নীতির অবসান ঘটাতে এবং একটি শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা দাঁড় করাতে চেষ্টা করবেন।
মোদ্দাকথা হলো—তরুণদের একটি আশার জায়গা হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন কাইস সাইদ। তাদের ভরসা দিয়েছিলেন, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আইনের শিক্ষক আইনের রক্ষাটা ভালো করেই করবেন—এই প্রত্যাশায় মূলত তরুণরা তাঁকে জিতিয়ে দিয়েছে।
যে সুবিধা পেয়েছেন কাইস সাইদ
রাজনৈতিক নেতাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন কাইস সাইদ। অন্যান্যদের থেকে নির্বাচনে একটু এডভান্টেজ বেশিই পেয়েছেন তিনি। কারণ তিনি পুরোনো কোনো রাজনৈতিক দল থেকে আসেননি। তাঁর চরিত্রে দাগ নেই। পক্ষান্তরে অন্যান্য দল থেকে আসা, যেমন নাবিল কারবি অর্থকেলেঙ্কারির অভিযোগে অভিযুক্ত।
নাবিল কারবি যখন বন্দী, তখন কাইস সাইদ ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি এই সুযোগে প্রচারণা চালিয়ে সুবিধা নেবেন না। এই ঘোষণা তাঁকে প্রচারণার চেয়েও বড় সুযোগ করে দেয়। সবাই ভাবতে শুরু করে আসলেই তাঁর ভেতর ক্ষমতার লোভ নেই।
তিউনিসিয়ার এনজিও আল-বাওসালার সভাপতি সেলিম খারার বলেছেন, অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হওয়া একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সুস্থ করে তোলার ঘোষণা তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ তাঁর চরিত্রে অর্থনৈতিক কোনো কেলেঙ্কারির ঘটনা ছিলো না। তিনি বিদেশি কারও কাছ থেকে তহবিল পাননি। তাই কারও সাথে তাঁর লিঁয়াজো আছে এই সন্দেহ কারও হয়নি।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক স্লিম বাউস্কার বলেন, আমি তাঁকে দ্বিতীয় দফায় ভোট দিয়েছি। কারণ আমার মনে হয়েছে, আমাদের তরুণদের দাবি তিনি স্পর্শ করে যাবেন। এটা নতুন বিপ্লব নয়, বরং নতুন সূচনা আমাদের। আমরা বিকশিত হচ্ছি।