|| তাসনিফ আবীদ ||
গত চার বছরে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমেছে। এই সময়ে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বেড়েছে কয়েক লাখ। সরকারের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির ‘শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২৩’-এর খসড়া প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা জায়গায় মুষ্টি কয়েকজন উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
মাদরাসায় কেন দিন দিন শিক্ষার্থী বাড়ছে? কেন কমছে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ে? বিষয়টি নিয়ে অভিভাবক, মাদরাসা পরিচালক, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, বোর্ডের দায়িত্বশীলসহ অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে।
বনশ্রী ইকরা মডেল মাদরাসায় পড়াশোনা করছে বিন ইয়ামিন। আগে সে মেরাদিয়ার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতো। স্কুল থেকে ছেলে কেন মাদরাসায় নিয়ে এলেন জানতে চেয়েছিলাম তার বাবার কাছে। তিনি বলেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম নিয়ে এ বছর বেশ হইচই হয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আপত্তিকর অনেক বিষয় সেখানে যুক্ত করা হয়েছিল। তখন আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে বিন ইয়ামিনকে এখানে ভর্তি করাই।
‘আমার ইচ্ছে, সে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষাটাও পাক। আর এই মাদরাসায় সেটা পাচ্ছি। এখানে তাকে বিভিন্ন সুরা ও দোয়া আরবি ভাষায় শেখানোর পাশাপাশি বাংলায় সেটার অর্থ সেখানো হয়। ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করানো হয়। বাসায় এলে ইংরেজিতে সুরার অনুবাদ ওর মুখে শুনে খুব অবাক হই।’ –বলেন তিনি
যাত্রাবাড়ীর তালিমুল সুন্নাহ নুরানী মাদরাসায় স্কুল থেকে নিয়ে এসে সন্তানকে ভর্তি করিয়েছেন হিমেল মিয়া। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ইদানিং দেখছিলাম ছেলের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ কম। ওর মা বাসায় পড়া ধরে দেখে তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। পাশের বাসার এক ভাইয়ের ছেলে এই মাদরাসায় পড়তো। তাকে দেখে ওর মা এই মাদরাসায় ভর্তি করায় তানভিরকে।
‘মাদরাসার শিক্ষার্থীদেরকে আলাদা প্রাইভেট পড়তে হয় না। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই আত্মস্থ করে দেওয়া হয়। তাই আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকে। তাছাড়া যারা আমরা আর্থিকভাবে দুর্বল আছি তাদেরকেও মাদরাসায় বেশ সুবিধা দেওয়া হয়। বিবেচনা করা হয়। স্কুলে সেটা আমরা পাই না বললেই চলে। সরকারি স্কুলের একাডেমিক পড়ালেখায় খরচ কম হলেও প্রাইভেট পড়ানো এবং আনুষাঙ্গিক বিষয় মিলিয়ে অনেক টাকা চলে যায়।’ –জানান তিনি
দেশের উত্তরের জেলা রংপুরের জামিয়া কারিমিয়া নুরুল উলুম, জুম্মাপাড়া মাদরাসার নুরানি একাডেমিতে প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানের প্রায় কিন্ডার গার্টেন ও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই এখানে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এমনকি শহরের সরকারী অনেক কর্মকর্তার সন্তানদেরও এখানে ভর্তি করাতে দেখা গেছে। বর্তমানে এই নুরানি একাডেমি স্থানীয়দের কাছে মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক মাওলানা আনোয়ার হুসাইনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনাদের প্রতিষ্ঠানে এভাবে শিক্ষার্থী বাড়ার পেছনে কারণ কী? তিনি বলেন, অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে মানুষ এখন দিন দিন সচেতন হচ্ছে। এক সময় বলা হতো মাদরাসায় পড়লে চাকরি পাওয়া যাবে না। এসব বলে মানুষকে অনেকটা বাধ্য করা হতো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। কিন্তু এখন তারা দেখছে সন্তান স্কুলে দেওয়ার ফলে তারা শিক্ষা-দীক্ষায় তেমন এগুচ্ছে না। এমনকি নানা কারণে চারিত্রিকভাবে অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে। তাই অভিভাবকরা মনে করছেন, ‘মাদ্রাসায় পড়ালে সন্তান মুসলিম ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ নিয়ে বড় হবে। আর যাই হোক ধর্মীয় শিক্ষাটা ভালোভাবে পাবে।’
বাংলাদেশে শিশু শিক্ষা নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এর মধ্যে অন্যতম শাইখুল কুরআন আল্লামা কারী বেলায়েত হুসাইন রহ. প্রতিষ্ঠিত নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ড বাংলাদেশ। বোর্ডটির পরিচালক বিষয়টি নিয়ে বলেন, নুরানী ও সামগ্রিকভাবে মাদরাসায় শিক্ষার্থী বাড়ার বিষয় নিয়ে তাহলে এর পেছনে মূল কারণ হলো, মাদরাসার পড়ালেখার মান দিন দিন ভালো হচ্ছে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক বিষয়গুলোও গুরুত্ব পাচ্ছে। স্কুলে ছাত্র বাড়াতে হলে শিক্ষামান বাড়াতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর যত্নশীল হতে হবে। কুরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
‘আমাদের নুরানী বিভাগসহ কিতাব বিভাগে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানসহ প্রযুক্তি বিষয়ে পাঠদান করানো হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছে নিজ্স্ব কম্পিউটার ল্যাব। শিক্ষার্থীরা বাংলার মতো ইংরেজিতে কথা বলছে। পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাতো আছেই। আপনি শুনলে অবাক হবেন, আমাদের নুরানী থেকে একজন শিক্ষার্থী তৃতীয় শ্রেণি সম্পন্ন করে স্কুলে গিয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে অনায়াসে ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারে। এমনকি ধারাবাহিকভাবে যেসব শিক্ষার্থী স্কুলে পড়ে ৫ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে তাদের চেয়ে ভালো নাম্বার পেয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।’ –জানান তিনি
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম নিয়ে লাগাতার কয়েকবছর ধরে অবহেলা, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা কারণে অভিভাবকরা স্কুল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এর জন্য স্কুলগুলোর লেখাপড়ার মান বাড়ানো, শিক্ষাক্রমে যত্নশীল হওয়াসহ সামগ্রিক বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি মাদরাসাগুলোতে যে শিক্ষার্থী বাড়ছে, এর ধারাবাহিকতা মাদরাসাগুলো যদি ধরে রাখতে চায় তাহলে ধর্মীয় শিক্ষঅর পাশাপাাশি জাগতিক শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের সময়গুলোকে কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে পুরো বিশ্বব্যাপী কাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে।