রাকিবুল হাসান নাঈম:
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি হচ্ছে ঈদুল আজহা। প্রতিবছর এ দেশে ঈদুল আজহায় ত্যাগের মহিমায় লাখ লাখ পশু তথা গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া কোরবানি করা হয়। ইসলাম ধর্মের বিধান মোতাবেক, কোরবানিকৃত এসব পশুর চামড়ার টাকা গরিব, এতিম, অসহায়, দুস্থ কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য। অথচ কয়েক বছর ধরে এ দেশে কোরবানির সময় পশুর চামড়া ন্যায্যমূল্যে বিক্রি না হওয়ায় গরিব-দুঃখী, অসহায় ও দুস্থরা তাদের প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তার ৭০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় ঈদুল আজহার সময়। কিন্তু এ সময়টাতেই ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজি শুরু করে। আসলে কারা আছেন এই সিন্ডিকেটে? ব্যক্তি বা সংগঠনের কারসাজির কারণে দাম বাড়ে, নাকি রয়েছে আরও অন্য কোনও কারণ? সংশ্লিষ্টগণ একজন আরেকজনকে যেমন দোষারোপ করেন, তেমনি চামড়ার দাম কমার পেছনে বাইরের কিছু কারণকেও দায়ী করেন। তবে এবার চামড়ার দাম বাড়তে পারে, এমন আশার কথা শোনাতে পারেননি কেউ। বরং আরও কমবে বলেই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
অদৃশ্য সিন্ডিকেট: একজন আরেকজনকে দোষারোপ
ঈদুল আজহা এলেই চামড়ার বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটা উড়ে। কোরবানিদাতা থেকে শুরু করে ট্যানারি মালিক সব পক্ষই এজন্য কথিত ‘সিন্ডিকেট’কে দুষেন। ঈদের দিন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকার ঘোষিত চামড়ার দাম না পাওয়ায় কোরবানিদাতারা প্রথম ‘সিন্ডিকেট’ অভিযোগটি তোলেন। তাদের কাছ থেকে চামড়া কিনে আড়তদার বা পাইকারি চামড়া ব্যবসায়ীদের সামনে এসে দাম শুনে অক্কা পাওয়ার দশা হয় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। তারাও অভিযোগ করেন আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা ‘সিন্ডিকেট’ করে এবার চামড়ার বাজার কমিয়ে দিয়েছে। আবার, কাঁচা চামড়ার দাম কমানোর নেপথ্যে আড়তদারদেরই দায়ী করেছে ট্যানারি মালিকরাও।
বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, ঈদের দুদিন আগে থেকেই বেশি দামে চামড়া না কেনার জন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদের একের পর এক পরামর্শ দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন চামড়া খাতের সব নেতারা। এ সময় ‘বেশি দামে চামড়া কিনলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতি হতে পারে’, ‘আড়তদারদের হাতে চামড়া কেনার টাকা নেই’, ‘আড়তদাররা এবার সব চামড়া কিনতে পারবেন না,’ ‘কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করতে হতে পারে’, ‘লবণ ব্যবসায়ীরা ঈদের আগেই লবণের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, এজন্য কাঁচা চামড়া কম দামে কিনতে হবে’-এমন মন্তব্য করেছেন তারা। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কেনার ক্ষেত্রে। অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে তারা ৮০ হাজার টাকা দামের গরুর চামড়ার দাম ২০০ টাকার বেশি বলেন না। কিন্তু এত কম দামে চামড়া কিনেও তা আড়তদারদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে তারাই উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হন। লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা, তখন দেশের অনেক জায়গায় আড়তদাররা চামড়াই কিনতে চান না। আড়তদারদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিকরা তাদেরকে টাকা দেন না। তাই তারা সময়মত কিনতে পারেন না।
অদৃশ্য সিন্ডিকেটের নাম প্রকাশ করতে রাজি না হলেও ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ফাতেহকে বলেছেন, ‘চামড়ার বাজার আবদ্ধ মওসুমি ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের হাতে। তাদের হাত পেরিয়ে আমাদের হাতে আসে। আমরা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দিয়ে কখনও চামড়া কিনি। দাম যা কমার কমায় মওসুমি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা।’
চামড়ার দাম কমার নেপথ্য কারণ ‘টাকা’
চামড়ার দাম কমে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা পরস্পরকে দায়ী করলেও তাদের একটি বক্তব্য অভিন্ন। তারা বলছেন, ব্যাংক থেকে ‘টাকা’ না পাওয়াটাই চামড়ার দাম কমার অন্যতম প্রধান কারণ।
এ প্রসঙ্গে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ফাতেহকে বলেন, ‘বাংলাদেশে চামড়ার বাজার আছে ১২০০ কোটি টাকার। কিন্তু এ বছর সরকার দিচ্ছে মাত্র ১৬৫ কোটি টাকা। যেটা দিচ্ছে, বাজার অনুযায়ী সেটা কিন্তু অপ্রতুল। আমরা চাইলেও সব চামড়া কিনতে পারব না। সেই সক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা যেটা করি এবং করব, সেটা হলো, প্রথমে আড়তদারদের থেকে কিছু চামড়া কিনব। সেগুলো বিক্রি করে টাকা আসবে। তারপর আবার কিনব। কুরবানির চামড়া বেচাকেনা কিন্তু তিন থেকে চারমাস চলে। একসাথে সব চামড়া কেনার ক্ষমতা আমাদের নেই।’
ডলারের দাম বাড়ার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘দেখেন, এখন ডলারের দাম বাড়া। চায়নাতে চামড়া বিক্রি করতে গেলেও দামদর করতে হয়। সেখানেও সময় লাগবে। যেটা বিক্রি করে আগে ১ ডলার পেতাম, সেটা বিক্রি করে এখন ৮৫ সেন্ট পাব। বাংলাদেশের চামড়া ব্যবসা মূলত চীনকে ঘিরে। সুতরাং, এর প্রভাব কিন্তু চামড়ার বাজারেও পড়বে। তাছাড়া লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় ইউরোপের চামড়ার বাজার ধরতে পারছি না আমরা।’
ফেনি টেনারির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. রাসেল আহমদ ফাতেহকে বলেন, ‘কয়েক হাত হয়ে আমাদের হাতে চামড়াটা আসে। প্রতিজন ৫০ টাকা লাভ করলেও দাম অমাদের কাছে এসে বেড়ে যায়। একটা হিসাব তুলে ধরি। মওসুমি ব্যবসায়ী চামড়াটা কিনে ২০০ টাকা দিয়ে। সেটা আড়তাদরদের কাছে যখন আসে, সেটাতে লবন দিতে হয়। কেমিক্যাল দিতে হয়। সেখানে খরচ হয় দেড় থেকে দুইশ টাকা। মোট হলো ৪০০ টাকা। তারপর পরিবহন, জায়গা ভাড়া মিলিয়ে সেটা দাম আরও বাড়ে। এভাবেই কিন্তু দাম বাড়ে। ট্যানারি মালিকরা আবার একসাথে সব কিনে না। সরকার তাদেরকে একসাথে কেনার টাকা দেয় না। তিন-চার মাসে কয়েক দফায় কিনে। চামড়াটা কোল্ড স্টোরেজে রাখতে আরেকটা খরচ হয়।’
দাম কমার আরেকটি কারণ লবণ ও কেমিক্যাল
ট্যানারি ও আড়তদার ছাড়াও এর সঙ্গে আরও একটি ‘সিন্ডিকেট’ যোগ হয়। সেটি হচ্ছে ‘কতিপয় লবণ ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট’। ঈদের রাতে বস্তাপ্রতি কয়েকশত টাকা বেড়ে যায়। অথচ এক সপ্তাহ আগে এর দাম থাকে অর্ধেক। হুট করে লবণের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই সংরক্ষণের জন্য চামড়া কিনতে পায় না। চামড়ার বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয়ের এটাও একটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
গত বছর লবণ দেওয়ার আগে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বনিম্ন ৩০০ আর সর্বোচ্চ ৯০০ টাকায়। গড়ে এসব চামড়া ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এছাড়া লবণযুক্ত চামড়ার দর ছিল ৯০০ থেকে ১ হাজার ৫০ টাকা। চামড়ার মোট মূল্যের ২০ শতাংশই যায় লবণ আর কেমিকেলে।
তবে এবার লবনের বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে এখন তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টন লবণ মজুত আছে। সেখানে এই ঈদে লবণের প্রয়োজন হবে ৫৫ থেকে ৫৬ হাজার টন। তাই চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণের কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়। আবার সরকার লক্ষাধিক টন লবণ আমদানির অনুমতি দিতে যাচ্ছে। সেটা ঈদের পরপরই বাজারে আসবে। তাই সরবরাহ নিয়ে চিন্তা নেই।
লবণের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাজারে অভিযান চালানো হবে বলে জানান ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, সারা বছরের চামড়ার অর্ধেক এই ঈদে পাওয়া যায় এবং এটা জাতীয় সম্পদ। তাই এটি সংরক্ষণে সবাইকে সচেতন হতে হবে। লবণের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকায়। বলা হচ্ছে, এই দাম যৌক্তিক। চাষিদের সুরক্ষারও প্রয়োজন আছে। তবে ঈদকে কেন্দ্র করে দাম বাড়ানোর অভিযোগ এলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু এই দামকেও অনেক বেশি বলছেন ট্যানার মালিকরা। ফেনি টেনারির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. রাসেল আহমদ ফাতেহকে বলেন, এবার তো এখনই হাজারের উপর লবনের বস্তার দাম। পরে কী হবে জানি না। এটাও তো অনেক বেশি। বিগত বছরে লবনের দাম ছিল বস্তাপ্রতি ৭০০-৮০০ টাকা। এবার সেটা সাধারণ বাজারেই হাজার পেরিয়েছে।’
কেমিক্যালের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, লবনের চেয়ে বেশি খরচ হয় কেমিক্যালে। বিগত বছরের তুলনায় এবার কেমিক্যালের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে। লবণ লাগানো থেকে শুরু করে চামড়া ফিনিশিং পর্যন্ত ৯২ ধরনের কেমিক্যাল প্রয়োজন হয়। দেশি-বিদেশি প্রতিটি কেমিক্যালের দাম বেড়েছে। বাড়তি লবণের দামও। যে কারণে প্রতি বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ ৪৮ থেকে ৫২ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগে ৩০ থেকে ৩২ টাকার মধ্যে ছিল। প্রতিটি গরুর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে গড়ে ৮ কেজি লবণ লাগে। চামড়া কেনার পর সেটা রফতানিযোগ্য করতে কত খরচ পড়ছে, সেটা বিবেচনায় নিয়েই কিন্তু চামড়া কিনব। আমরা তো চাইবোই, যত কম দামে কেনা যায়।’
সামধান কী
চামড়ার বাজারের এই অবনতি ঠেকাতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানান ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ। ফাতেহকে তিনি বলেন, এই অবনতি ঠেকানোর একটাই উপায়, চামড়া সরাসরি ট্যানারী মালিকদের হাতে তুলে দিতে হবে। মালিকরা তো সরাসরি চামড়া কালেকশন করবে না। সেজন্য থানা ও জেলায় স্টোর তৈরী করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগী না থাকলে গরিবরা বঞ্চিত হবে না।
বাজারে ধস আর সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, যদি ধরে নেই মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিচ্ছে তাহলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কি করছেন? এর পেছনে কোনো চক্র যদি কাজ করে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত। পরিস্থিতি যে পর্যায়ে তাতে বোঝা যাচ্ছে, বাজার পর্যবেক্ষণ ঠিকমতো হচ্ছে না:
উল্লেখ্য, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি সরবরাহ মেলে কোরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এবার ছোট-বড় খামারিদের উৎপাদিত গবাদিপশুর সংখ্যা বর্তমানে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। ঈদুল-আযহায় দেশে ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে, যার মধ্যে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি গরু-মহিষ, ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৭১৫টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে।