হামমাদ রাগিব
আজ থেকে ১০ বছর আগেও বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে কওমি মাদরাসার আলেমদের পদচারণা খুব একটা ছিল না। হাতেগোনা কয়েকজন কাজ করতেন পত্রিকাগুলোর ধর্মপাতায়। তারও আগে হাতে গোনার মতোও কেউ ছিলেন না। কিন্তু চলতি দশক বা গত দশকের গোড়ার দিক থেকে বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চার একটা স্রোত তৈরি হওয়ায় জাতীয় ধারার দৈনিকগুলোতে এখন কওমি পড়ুয়া আলেমদের পদচারণা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যদিও এ পদচারণা কেবল পত্রিকাগুলোর ধর্মপাতায় সীমাবদ্ধ।
ধর্মপাতায় কওমি পড়ুয়া আলেমদের এই লেখালেখি এবং জাতীয় ধারার সাংবাদিকতায় তাঁদের অংশগ্রহণ বিষয়ে আলাপ হয়েছিল দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহ-সম্পাদক মাওলানা আলী হাসান তৈয়বের সঙ্গে।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের ধর্মপাতা ও এর ব্যতিক্রমধর্মিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব বলেন, ‘দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশে আমি কাজ শুরু করার পর থেকে সপ্তাহের সাত দিনই ইসলাম বিষয়ে আলাদা একটা রঙিন পাতা থাকছে। যেটা আমার জানামতে বাংলাদেশের আর কোনো পত্রিকায় ইতিপূর্বে ছিল না। এখন অবশ্যি দু-একটি পত্রিকা এই ধারা অবলম্বন করতে শুরু করেছে, যেটা খুব প্রশসংসনীয় এবং আশাজাগানিয়া একটা ব্যাপার।’
তিনি বলেন, ‘এই পাতাটি প্রতিদিন প্রকাশিত হয় ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে। সরাসরি ইসলাম শব্দটা বেশিরভাগ শিরোনামেই নেই। যেমন নবীজীবন, তাসাউফ, অর্থনীতি, সভ্যতা, প্রকৃতি, ইসলামি সমাজ–এই সব শিরোনামে ইসলামের নির্দেশনাগুলোকে আমরা উপস্থাপন করি। পাশাপাশি সমসাময়িক টপিকেও এই বিষয়গুলোর আলোকে ইসলামের ভাবনাগুলো আমরা তুলে আনার চেষ্টা করি। মোটকথা ইসলাম যে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা–সাতদিনের এই সাতটি পাতায় আমরা সাধ্যমতো সে-বার্তাই উপস্থাপন করার চেষ্টা করি।’
আলী হাসান তৈয়ব আরও বলেন, ‘আরেকটা সুখের কথা বলি, ইসলাম বিষয়ে ব্যতিক্রমধর্মী এই আয়োজনের কারণেই আলোকিত বাংলাদেশ পাঠকরা পড়ে। এটা আমাদের সম্পাদক থেকে নিয়ে অফিসের সাধারণ কর্মচারী পর্যন্ত–সকলের কাছে স্বীকৃত। এবং এ পাতার দরুণই আলোকিত বাংলাদেশ টিকে আছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা অর্জন, আলহামদুলিল্লাহ, যে, শুধু ইসলাম বিষয়ক একটা পাতার জন্য পুরো একটা দৈনিক পত্রিকা দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে ভবিষ্যতে অন্যান্য পত্রিকাও উদ্বুদ্ধ হবার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
প্রায় প্রতিটা দৈনিকেরই তো সপ্তাহে একদিন ধর্মপাতা আছে, এখানে কওমি-পড়ুয়া অনেক তরুণ লিখছেন, তো ধর্মপাতাগুলোর সংকট এবং সম্ভাবনা নিয়ে একটু বলবেন?
এমন প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব বলেন, ‘সংকটের কথা যদি বলি, তবে দু’ধরনের সংকট আছে জাতীয় দৈনিকগুলোর ধর্মপাতায়। প্রথম সংকটটা তৈরি হয়েছে পত্রিকার মূল সম্পাদক ও মালিকপক্ষ থেকে। তাঁরা ধর্মপাতার দায়িত্বশীলদের কাছে চান, ইসলামকে যেন তাঁরা পঙ্গু কিংবা কেবল আমল-ফজিলত সর্বস্ব একটা ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করেন। ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপনে বাধ সাধেন সম্পাদক কিংবা মালিকেরা, অথবা ইসলাম যে সার্বজনীন, পূর্ণাঙ্গ ও চমৎকার একটা জীবনব্যবস্থা সে ব্যাপারে তাঁরা জানেনই না।
‘আরেকটা সংকট হলো আমাদের দিক থেকে সৃষ্ট। আমরা যাঁরা ধর্মপাতাগুলোর দায়িত্বে থাকি বা ধর্মপাতায় লেখালেখি করি, তাঁদের অধিকাংশেরই ইলমি ইসতেদাদ ওভাবে নেই। গতানুগতিক আলেম হয়ে দু’কলম লিখতে পারার যোগ্যতা নিয়েই ওখানে চলে যাই। ইলমি যোগ্যতাসম্পন্ন আমাদের বোদ্ধা অংশ খুব কমই এ পাতাগুলোতে সম্পৃক্ত হন বা লেখালেখি করেন। এতে হয় কী, ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ ও চমৎকার জীবনব্যবস্থা সেটা আমরা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি না, বা মালিকপক্ষকে ভালোভাবে বোঝাতে পারি না। গতানুগতিক আমল-ফজিলত সম্পর্কিত কিছু লেখা লিখে পত্রিকায় পাঠিয়ে দিই বা ছাপি, যার দরুণ কেবল এইসব বিষয়েই ইসলাম সীমাবদ্ধ–এই ভুল ধারণার তৈরি হয়।
‘এই সংকট কাটাতে ধর্মপাতাগুলোতে আমাদের মেধাবী ও ইলমি যোগ্যতা সম্পন্ন বোদ্ধা শ্রেণির সম্পৃক্ততা ও লেখালেখি অতীব জরুরি। এটা করতে পারলে মালিকপক্ষ থেকে যে সংকটের তৈরি হয়েছে সেটাও কেটে যাবে। কারণ তখন যোগ্যদের প্রভাব ও ইসলামের যথার্থ উপস্থাপন মালিকপক্ষকে প্রভাবিত করবে এবং ধর্মপাতা বিষয়ে মালিকপক্ষ নিজেদের ভাবনা পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ হবেন।
‘তাই আমি মনে করি, ধর্মপাতাগুলোতে যাঁরা লেখালেখি করছেন, তাঁদেরকে গভীরভাবে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে ভালো যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। পাশাপাশি যোগ্য যাঁরা আছেন এই আওতার বাইরে, তাঁদেরও ধর্মপাতাগুলোতে নজর দেওয়া উচিত।’
মূলধারার সাংবাদিকতায় কওমি তরুণদের সম্ভাবনার কোনো ক্ষেত্র আছে কি-না জানতে চাইলে মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব বলেন, ‘অবশ্যই আছে। কওমি তরুণরা নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার কল্যাণে এম্নিতেই তিন-চারটা ভাষা আয়ত্ত করে ফেলেন। একটু চেষ্টা করে যদি ইংরেজিটাও তাঁরা শিখে নিতে পারেন, তবে জাতীয় দৈনিকগুলোর আন্তর্জাতিক পাতাগুলোতে তাঁদের কাজ করার সুযোগ অবারিত। কারণ, ওই ধারার সাংবাদিক যাঁরা, তাঁরা কিন্তু আরবি-উর্দু জানেন না। আন্তর্জাতিক পাতাগুলোর রিপোর্টার নিয়োগের সময় আপনি যেকোনো পত্রিকায় আবেদন করলে এবং আপনার অনুবাদের হাত মোটামুটি ভালো থাকলে পত্রিকা আলেম-ওলামা বা কওমি-বিদ্বেষী হলেও আপনাকে নিতে বাধ্য। কারণ, আপনি ইংরেজি অনুবাদের পাশাপাশি যখন বলবেন আল-জাজিরা থেকেও সরাসরি অনুবাদ করে দিতে পারবেন, বা ফার্সি কি উর্দু সংবাদমাধ্যম থেকে নিউজ উদ্ধার করে দিতে পারবেন, তখন অন্যদের তুলনায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনাকে অগ্রাধিকার দেবে। কারণ তাঁদের কাজ দরকার।
‘তাই আমাদের অঙ্গনের তরুণ যাঁরা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিতে চান, আমি মনে করি তাঁদের জন্য ধর্মপাতায় নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে মূলধারার সাংবাদিকতার এই অবারিত সুযোগটা গ্রহণ করা উচিত।’