তাবিজ-তদবির-রুকইয়া : প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে মানুষ

রাকিবুল হাসান নাঈম:

তাবিজ-তদবির-রুকইয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি প্রতারক চক্র। তাদের মনোহারী বিজ্ঞাপন, চটকদার ভাষায় মোহিত হয়ে শরিয়াসম্মত চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ছে শিরক ও বিদআতে। সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, এই প্রতারক চক্রের সহজ শিকার হচ্ছেন তারা, ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কে যারা অনভিজ্ঞ।

রাকিদের ভাষ্যমতে, ইসলামি শারিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে রুকইয়া হলো— কুরআনের সুরা বা আয়াত, হাদিসের দুআ এবং সালাফদের থেকে কোনো দুআ ইত্যাদির প্রয়োগ করে ফুঁ দেওয়া। রুকইয়ার সাথে কিছু সাপ্লিমেন্ট আছে, যা রোগীর কেইস ভেদে অতিব জরুরী, যেসব সাপ্লিমেন্ট ছাড়া রুকইয়ার অনেক কেইস যথাযথ সম্পন্ন হয় না। তার মধ্যে অন্যতম হলো—জমজম পানি, আজওয়া খেজুর, বরই ফুলের মধু, হিজামা, কালোজিরা দানা, যাইতুন তেল, ইন্ডিয়ান কস্টাস, সোনাপাতা, বরইপাতা ইত্যাদি। কিন্তু প্রতারক চক্র রুকইয়ার নামে শিরকি তাবিজ-কবজ, জ্বিন দিয়ে চিকিৎসা-সহ আরও বিভিন্ন ব্ল্যাক ম্যাজিকের মাধ্যম ব্যবহার করে৷

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই চক্রটি ফেসবুকে বেশ সক্রিয়। রুকইয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রুপে তাদের পদচারণা থাকে হরদম। তারা চটকদার ভাষায় পোস্ট করে, রুকইয়ার গুরুত্ব ও নিজেদের সফলতার গল্প শোনায়। গ্রুপে কেউ পরামর্শ চাইলে তাকে বাগে আনার চেষ্টা চলে আপ্রাণ। তাদের ভাষা ও রোগ আরোগ্যের আত্মবিশ্বাস দেখে বিভ্রান্ত হয় মানুষ।

কারা প্রতারক

রাকির পরিচয় ও জাদুকরের পরিচয় সম্পর্কে জানা না থাকার কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে বলে মনে করেন উরফা হেলথ কেয়ারের সিইও এবং সিনিয়র কনসালটেন্ট রাকি মাওলানা উসমান হারুন। ফাতেহকে তিনি বলেন, অনেক কবিরাজ, প্রতারক ও ধান্দাবাজ নিজেদেরকে রাকি পরিচয় দিচ্ছে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। সেসব ভন্ড, প্রতারক , তান্ত্রিক , যাদুকর রাকি নামধারী কবিরাজের কাছে সরলমনা ও সোজাসাপ্টা মানুষগুলো প্রতারিত হচ্ছে। যার ফলে রুকইয়া ও রাকিদের বদনাম হচ্ছে। অন্যান্য পেশেন্টরা রুকইয়া ও রাকিদের সম্পর্কে ভয় পাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো রাকির পরিচয় ও জাদুকরের পরিচয় সম্পর্কে জানা না থাকা।

প্রতারক রাকির চিহ্নগুলো কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা রোগী ও তার মা-বাবার নাম জানতে চাইবে। নিজেকে জ্বীন হুজুর পরিচয় দিবে। রোগীর কাছে তারা নিজের ব্যবহৃত কাপড়, চুল, পায়ের নিচের মাটি, শরীরের ময়লা , মৃত মানুষের মাথার খুলি, সাপের দাঁত, ফাঁসির রশি ইত্যাদি আরো অনেক কিছু চাইবে। পাশাপাশি রোগীর ছবি চাইবে। হাঁস-মুরগি, ছাগল -গরু জবাই করতে বলবে। তিন বা চার রাস্তার মাথায় খাবার দিতে বলবে। রোগীকে একা রুমে কিছু সময় থাকতে বলবে। কেউ কেউ নামাজ ও আমলের কথাও বলেন, পাশাপাশি তাবিজ কবজ দিয়ে থাকেন। তারা তুলারাশি দিয়ে কাজ করে বা তার উপর জ্বিন হাজির করে তথ্য নিবে ও চিকিৎসা করবে। এছাড়াও বিভিন্ন পদ্ধতিতে হাজিরা দেখবে । যেমন পানি, বদনা বা লোটা, সুতা , তাগী , কাইতন, বা কোনো পাত্রের পানিতে নাম দিয়ে। এছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের গোপন ও গোনাহের বিষয় ও কাজের কথা বলতে পারে।

মানুষ প্রতারিত হয় কিভাবে

এ বিষয়ে কথা হয় সুকুন-লাইফের ফাউন্ডার এবং ইবাদা রুকইয়া সেন্টারের সিনিয়র কনসালটেন্ট মাওলানা মারুফ তাকির সঙ্গে। রাকিদের কাছে মানুষ প্রতারিত হবার বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন তিনি।

১. রাকিরা নিজের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাধারণ মেডিকেল ও মানসিক সমস্যাকে রুকইয়ার সমস্যা বলে চালিয়ে দেয়। কিছুটা কবিরাজের মতো, কেউ গেলেই তাকে জিনের বা নজরের রোগী বলে অভিহিত করে। এ-কথা অনস্বীকার্য, অনেক রোগী এমন আছেন যাদের রোগের সূত্রপাত এ জাতীয় সমস্যা থেকে হলেও পরবর্তী সময়ে তা বাস্তবে শারীরিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। তখন এই দুইয়ের সমন্বয় ছাড়া সুস্থতা সম্ভব হয় না।

২. কিছু রাকি মূলত কবিরাজি প্রেক্টিস করে। মানুষ যেহেতু নতুনভাবে রুকইয়ার প্রতি ঝুঁকছে তাই তারা এটাকে অপব্যবহার করে৷ জিনের কাছে সাহায্য চায়, আবার কখনো বিভিন্ন হারাম ও শিরকি মাধ্যমে চিকিৎসা করে। এই সময় তারা রোগী, তার স্বামী বা পিতার নাম জিজ্ঞেস করে। কখনো নিজস্ব জ্বিন রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে ভেল্কিবাজি দেখায়।

৩. রাকিদের কাছে প্রতারিত হওয়ার আরেকটি বড় কারণ, যার কাছে রুকইয়া করছে তার ব্যাকগ্রাউন্ড না জানা। ইদানীং জেনারেল থেকে দীন প্রেক্টিস করা অনেক ভাই হালাল ইনকাম সোর্স ভেবে রুকইয়া ফিল্ডে কাজ করছেন। যাদের উলুমুশ শরীয়াহ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নাই, সনদ নাই এবং তাদের কোরআন তেলাওয়াতও অনেক সময় শুদ্ধ হয় না।

৪. রাকিদের মধ্যকার কিছু ঝামেলা দেখে মানুষ প্রতারিত হয়। বাস্তবে টেকনিক্যালি মতপার্থক্য তাদের ভিতর। কেউ বিদআতে হাসানা নামে নতুন উদ্ভাবিত জিনিস প্রেক্টিস করছে যা মাঝেমধ্যে ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। অন্যদল কেবল সুন্নাহ ও সালাফগণের আমলের উপর সীমাবদ্ধ থাকার চেষ্টা করছে৷ তাই রোগীরা এই দুইয়ের মাঝে ধোকায় পরে।উভয় দলের সমস্যাকে ইখতিলাফি মাসালা না ভেবে কখনো দেখা যায় তারা রুকইয়া-ই ছেড়ে দিচ্ছে।

প্রতারণা থেকে বাঁচব কিভাবে

তাবিজ-তদবির-রুকইয়া সঠিক হওয়ার সর্বপ্রথম মাপকাঠি শরিয়ত। এই মাপকাঠির নিক্তিতেই সবকিছু মাপতে হবে। না মাপতে পারার কারণেই অনেকে প্রতারিত হন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর প্রসিদ্ধ একটি রুকইয়া সেন্টারের ডিরেক্টর ফাতেহকে বলেন, প্রতারণা থেকে বাঁচতে সর্বপ্রথম রুকইয়া সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। জিনিসটা মূলত কী, চিকিৎসা কিসের মাধ্যমে হয়। দ্বিতীয়ত, অভিজ্ঞ কনসালটেন্টের সাথে সবসময় পরামর্শ করতে হবে। তৃতীয়ত, রুকইয়ার লক্ষণগুলো জানা থাকতে হবে। সন্দেহ হলে লক্ষণগুলো মেলাতে হবে। এ তিনটা জিনিস ঠিক থাকলে প্রতারিত হবার সুযোগ অনেকাংশে কমে যাবে।’

আগের সংবাদবন্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তানকে সহায়তার ঘোষণা এরদোগানের
পরবর্তি সংবাদস্কুলে ছাত্র নেই, নূরানী মাদরাসা বন্ধে চাপ বাড়ছে রাউজানে