‘ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব’: ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে

মুনশী নাঈম:

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নারীরা তালাকের রেকর্ড করেছেন। পুরুষের তুলনায় বিচ্ছেদের বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বেশি নারীরা। বিচ্ছেদ প্রবণতার এই ক্রমবর্ধমান বিস্তারের পেছনে মূল কারণ হিসেবে ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবকেই দায়ি করছেন আলেমরা। তারা বলছেন, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবন-দর্শন ও জীবনধারায় ইসলামি অনুশাসন না থাকার কারণেই এত সম্পর্ক বিচ্ছেদের দিকে এগুচ্ছে। পরিসংখ্যানও বিষয়টিকে সমর্থন করে।

তালাকের আবেদনে এগিয়ে নারীরা

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) হিসাবে দেখা গেছে, ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ১২ বছরে করপোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট ৫৮ হাজার ৩০টি তালাকের আবেদন পড়েছে। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৭৯২টি আবেদন করেছেন নারীরা। আর পুরুষরা করেছেন ১৮ হাজার ৬৬৪টি। একইভাবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) গত ৩ বছরে তালাকের আবেদন পড়েছে ২১ হাজার ২৮৮টি। এরমধ্যে ১৪ হাজার ৯৯৪টি করেছেন নারীরা আর ৬ হাজার ২৯৪টি আবেদন করেছেন পুরুষরা।

ডিএনসিসি’র হিসাবে দেখা গেছে, ২০১১ সালে ২ হাজার ৮৬৪টি তালাকের আবেদনের মধ্যে ১ হাজার ৯১টি আবেদন পুরুষ ও ১ হাজার ৭৭৩টি নারীরা করেছেন। একইভাবে ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৮৪টি আবেদনের মধ্যে ১ হাজার ২৩টি পুরুষ ও ১ হাজার ৮৬১টি নারী। ২০১৩ সালে ৩ হাজার ২৩৮টির মধ্যে ১ হাজার ৭২টি পুরুষ ও ২ হাজার ১৬৬টি নারী। ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৪৪৫টির মধ্যে ১৪৭৯টি পুরুষ ও ২৯৬৬টি নারী। ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৭৭টি’র মধ্য ১ হাজার ৩০৩টি পুরুষ ও ২ হাজার ৭৭৪টি নারী। ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৮৪৭টির মধ্যে ১ হাজার ৪২১টি পুরুষ ও ৩ হাজার ৪২৬টি নারী। ২০১৭ সালে ৫ হাজার ৪৬টির মধ্যে ১ হাজার ৫৫৬টি পুরুষ ও ৩ হাজার ৪৯০টি নারী। ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৭৭৫টির মধ্যে ১ হাজার ৭২৪টি পুরুষ ও ৪০৫১টি নারী। ২০১৯ সালে ৬ হাজার ১৪৪টির মধ্যে ২৩২০টি পুরুষ ও ৩৮২৪টি নারী। ২০২০ সালে ৬ হাজার ১৬৮টির মধ্যে ২ হাজার ১১৫টি পুরুষ ও ৪ হাজার ৫৩টি নারী। ২০২১ সালে ৭ হাজার ৪১৬টির মধ্যে ১ হাজার ৭৬২টি পুরুষ ও ৪ হাজার ৮১টি নারী। ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ১২৬টির মধ্যে ১ হাজার ৭৯৮টি পুরুষ ও ৩ হাজার ৩২৭টি আবেদন নারীরা করেছেন।

একইভাবে ডিএসসিসি’র এক হিসাবে দেখা গেছে, ৩ বছরে করপোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলে তালাকের আবেদন জমা পড়েছে ২১ হাজার ২৮৮টি। এরমধ্যে ১৪ হাজার ৯৯৪টি আবেদন করেছেন নারীরা আর পুরুষরা করেছেন ৬ হাজার ২৯৪টি। এরমধ্যে ২০২০ সালের ৬ হাজার ৩৪৫টি আবেদনের মধ্যে ৪ হাজার ৪২৮টি নারী ও ১ হাজার ৯১৭টি পুরুষ। ২০২১ সালে ৭ হাজার ২৪৫টির মধ্যে ৫ হাজার ১৮৩টি নারী ও ২ হাজার ৬২টি পুরুষ এবং ২০২২ সালে ৭ হাজার ৬৯৮টির মধ্যে ৫ হাজার ৩৮৩টি নারী ও ২ হাজার ৩১৫টি আবেদন করেছেন পুরুষরা।

কী কারণে তালাকের আবেদন?

তালাকের নোটিশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে একই সমস্যার কথা উল্লেখ করে নারীরা আবেদন করছেন। দেখা যায়, তালাকের কারণগুলো আগেই আইনজীবীদের কাছে প্রিন্ট করা থাকে। শুধু নাম ঠিকানার স্থান খালি রাখা হয়। সেখানে তালাক দাতা ও গ্রহীতার নাম ঠিকানা হাতে লিখে দেয়া হয়।

তালাকের কারণ হিসেবে বেশির ভাগই থাকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়া। স্ত্রীর করা আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভরণ-পোষণ না দেয়া, স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহবন্ধনে আবব্ধকরণ, কাবিন না হওয়া, মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, স্ত্রীর ওপর নির্যাতন, যৌতুক, মানসিক পীড়ন, পরকীয়া, আর্থিক সমস্যা, ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত। অন্যদিকে স্বামীরাও তাদের নোটিশে উল্লেখ করেছেন, পরকীয়া, আর্থিক সক্ষমতা কমে যাওয়া, বেপরোয়া জীবনযাপন, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, অবাধ্য হওয়া, টিকটকসহ সামাজিক মাধ্যমে অবাধ বিচরণ করা, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী না চলাসহ বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, তালাকের যেসব আবেদন সিটি করপোরেশনে জমা পড়ে, তার সবগুলো একই রকম। মাঝে-মধ্যে দু’-একটি কারণ এদিক-ওদিক হয়। আইনজীবীরা শুধু সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নাম, পরিচয় বদলে একই ধাঁচে আবেদন করে থাকেন। যার ফলে তালাক নোটিশে ঘুরে-ফিরে একই কারণ দর্শানো হয়।

বিচ্ছেদের আবেদন পেলেই সংশ্লিষ্টকে নোটিশ করে সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কর্মকর্তারা। তবে এসব নোটিশের সাড়া দেয় না কোনো পক্ষই। স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে যে কেউ আবেদন করলে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তালাকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে নোটিশ দেয়া হয়। তবে নোটিশ পেয়েও অনেক সময় উভয়পক্ষই অনুপস্থিত থাকেন। অনেক সময় স্ত্রীর আবেদনের নোটিশে স্বামী উপস্থিত হন না, স্বামীর নোটিশে স্ত্রীও আসেন না। ফলে উভয়ের মধ্যে যে বিবাদ তা মীমাংসা হচ্ছে না। এতে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে তালাক কার্যকর হয়ে যাচ্ছে।

আলেমরা কী বলছেন?

বর্তমান সমাজে বিচ্ছেদ প্রবণতার এই ক্রমবর্ধমান বিস্তারের পেছনে মূল কারণ ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব বলে মনে করছেন মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ। তার মতে, এখন একক পরিবার হওয়ায় এবং বাইরে চাকরি-বাকরির ও সার্বিক স্বাধীনতার বিস্তার ঘটায় বাইরের মানুষের সাথে তাদের মেলামেশা বেড়েছে এবং স্বামীদের চেয়ে বাইরের বন্ধু-বান্ধবদের দিকে বেশি ঝুকছে। তাই পারিবারিক অবস্থা একটু খারাপ হলেই তালাকের চিন্তা করছে। আবার বর্তমানের মেয়েরা বিদেশী সিরিয়াল দেখে সাংস্কৃতিক দিক থেকে প্রভাবিত হচ্ছে।

এর সমাধান কী? প্রশ্নের উত্তরে তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘এখানে তিনটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।

প্রথমত, ইসলামে আয়-উপার্জন, জীবনমান ও জীবনধারার ক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টির শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অল্পেতুষ্টির পরিবর্তে যদি সম্পদ ও প্রাচুর্যের মোহ তৈরি হয়, বিপত্তি বাঁধা খুবই স্বাভাবিক। তদ্রূপ ইসলামী শিক্ষায় পারস্পরিক হক রক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের কর্তব্য পালন আর অন্যের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হলেই সবার শান্তি আসতে পারে।

দ্বিতীয়ত, পরিবারের ভরণ-পোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পুরুষের। কিন্তু এখন নারীর স্বাবলম্বিতার নামে নারীকে উপার্জনে বের করা হয়েছে। সমাজ-চিন্তকেরা বলছেন, বিবাহ-বিচ্ছেদের এক বড় কারণ, নারী বাইরে বের হওয়া এবং পর-পুরুষের সাথে মেলামেশা। কাজেই গোড়া থেকেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। একান্ত আর্থিক সমস্যা ছাড়া নারীদেরকে রোজগারের জন্য ঘরের বাইরে বের করবে না, বরং স্বামীরাই স্ত্রী-সন্তানের খরচাদির ব্যবস্থা করবে।

তৃতীয়ত, ইসলামী বিধানে তালাকের অধিকার পুরুষের হাতে ন্যস্ত করার পাশাপাশি পুরুষকে যে সকল গুণের অধিকারী হওয়ার এবং স্ত্রী ও পরিবার পরিচালনায় যে নীতি ও বিধান অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা পালনের মাধ্যমে কাঙ্খিত সুফল পাওয়া সম্ভব।’

তালাক বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের সালিশির নিয়মটি ইসলামের বিপরীত বলে মনে করেন মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘নোটিশ দেয়ার পর এই শালিশী কাউন্সিল একটি শরীয়ত-বিরোধী আইনের ফসল, যা ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইন নামে প্রসিদ্ধ। আইনটির বহুবিধ ত্রুটির মধ্যে এটিও একটি যে, এতে তালাকনামা লিখে নোটিশ পাঠাবার পর শালিসের কথা বলা হয়েছে। অথচ শরীয়া অনুযায়ী তালাকনামা লিখে দস্তখত করার পরই তালাক হয়ে যায়। তাহলে আর শালিস কিসের জন্য? আসলে শালিস হওয়া দরকার তালাকের পূর্বেই এবং তা হওয়া দরকার পারিবারিক ও সামাজিকভাবে। আইনের লোকদের দিয়ে নয়। এ সহজ কথাগুলো সংশ্লিষ্ট লোকজন যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই জাতির মঙ্গল হবে।’

আগের সংবাদ‘শুহাদা-পরিসংখ্যান’: মুসলিম ইতিহাসে ভূমিকম্প
পরবর্তি সংবাদতুরস্ক-সিরিয়া ভূমিকম্পে মৃত্যু ছাড়ালো ৪৫ হাজার