আবদুল্লাহ তামিম:
আমরা নবি কারিম সা. ও তাঁর সাহাবিদের দেখিনি। দেখিনি তাদের জীবন কেমন ছিলো। তবে হাদিসে নববি পড়েছি। জীবনী পড়েছি সাহাবিদের। মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব ঈদের বিষয়েও তাদের থেকে শিখেছি। কিভাবে পালন করতে হয়। কিভাবে উৎযাপন করতে হয়। শুনেছি নবি সা. এর ঈদ কেমন ছিলো। ঈদের আনন্দঘন মুহূর্ত কিভাবে কাটিয়েছেন তাঁরা।
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। বছর ঘুরে এ আনন্দ উৎসব আসে দু’বার। মহানবি হজরত মুহাম্মদ সা. ও সাহাবারা তাঁদের জীবনে দেখিয়েছেন এ উৎসবের তাৎপর্য। কীভাবে তাঁরা ঈদ পালন করতেন। আর কীভাবে ঈদের দিন সময় কাটাতেন।
হাদিসে নববির দিকে তাকালে আমরা দেখি, ঈদের দিনে নবীজি সা. দিনে বের হয়ে দুই রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করেছেন (সহিহ বুখারি: ৯৮৯)। ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করাকেও নবীজি সা. গুরুত্ব দিতেন। হজরত ইবনে উমর রা. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, ‘তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন (সুনান বায়হাকী: ৫৯২০)। আলী রাদি. থেকে বর্ণিত ‘সুন্নাত হলো ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া’ (সুনান আত-তিরমিযী: ৫৩৩)। উভয় পথের লোকদের সালাম দেওয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য যে পথে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা।
নবি কারিম সা. ও সাহাবিদের ঈদ সম্পর্কে জানতে আমাদের কাছে হাদিসের ভাণ্ডার রয়েছে। এ হাদিসে নববির মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি কিভাবে তারা ঈদের দিন অতিবাহিত করতেন। হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন’ (সহিহ বুখারি: ৯৮৬)। ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের নামাজ আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা উত্তম। হজরত বুরাইদা রাদি. থেকে বর্ণিত, ‘নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না।’
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘আল্লাহ রাববুল আলামিন তাঁর বান্দার ওপর তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন’ (সহিহ আলজামে: ১৮৮৭)। ইবনুল কায়্যিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন ‘নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন’ (যাদুল মায়াদ)।
হজরত আবদুল্লাহ বিন সায়েব রাদি. থেকে বর্ণিত ‘আমি নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের নামাজ শেষ করলেন, বললেন আমরা এখন খুতবা দেব। যার ভালো লাগে সে যেন বসে, আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে’ (সুনান আবু দাউদ: ১১৫৭)। ঈদের সময় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহু সা. বলেছেন, ‘যে আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে’ (সহিহ বুখারি: ৬১৩৮)।
মদিনায় নবি কারিম সা. যেভাবে প্রথম ঈদ উদযাপন করেছেন
মদিনায় রাসুল সা. এর হিজরতের পর দ্বিতীয় হিজরি মোতাবেক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ বা ৩১ মার্চ মুসলমানরা প্রথম ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেন। মহানবি সা. এর সঙ্গে এ আনন্দের দিন কাটাতে পেরে মুসলিমরা ছিলো সবচেয়ে বেশি খুশি। রাসুল সা. মদিনার ঈদের দিন ছোট-বড় সবার আনন্দের প্রতি খেয়াল করতেন। সবার আনন্দে ছিলো রাসুল সা.। মদিনার ছোট ছোট শিশু-কিশোরের সঙ্গে মহানবি সা. আনন্দ করতেন। শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত সব আনন্দ করার অনুমতি দিতেন তিনি। বালিকা বয়সী আয়েশা রা.-এর মনের বাসনাও রাসুল সা. পূরণ করতেন।
মদিনার ইতিহাসে একটি আলোকোজ্জ্বল দিন ছিলো প্রথম ঈদের দিন। ঈদের দিন সকাল বেলায় গোটা মদিনা জুড়ে ঈদউৎসবের আমেজ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। আর এ সব কিছুই মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে। মদিনার প্রত্যেকেই ঈদ উৎসবে নিজ নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করছিল। তারা সকলেই চাইত তাদের নিজ নিজ অনুষ্ঠান সম্পর্কে যেনো মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারেন। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালোবাসা ও সম্মানের খাতিরেই তারা এসব করেছিল।
মহানবি সা. ঈদের দিনে গোসল করতেন, সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে উত্তম পোশাক পরতেন। ঈদুল ফিতরে কিছু মিষ্টি দ্রব্য খেতেন।
ঈদের দিনের এক স্মৃতি সম্পর্কে আয়েশা রা. বলেন, ঈদের দিন আবিসিনিয়ার কিছু লোক লাঠি নিয়ে খেলা করছিল। মহানবি সা. আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আয়েশা! তুমি কি লাঠিখেলা দেখতে চাও? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি তখন আমাকে তাঁর পেছনে দাঁড় করান, আমি আমার গাল তাঁর গালের ওপর রেখে লাঠিখেলা দেখতে লাগলাম। তিনি তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন, হে বনি আরফেদা! লাঠি শক্ত করে ধরো। আমি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। তিনি তখন বলেন, তোমার দেখা হয়েছে? আমি বললাম, জ্বি না। এরপরে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়শা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা তৃপ্ত হওয়া পর্যন্ত খেলা দেখান।
উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা রা. ঈদের দিনের আরেকটি ঘটনা বর্ণনা করেন ‘রাসুলুল্লাহ সা. ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন। তখন আমার নিকট দুটি ছোট মেয়ে গান গাচ্ছিলো। বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। ইতোমধ্যে আবু বকর রা. ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন’ (সহিহ বুখারি: ৯৫২)।
একবার ঈদের দিন মহানবি সা. রাস্তার পাশে একটি ছেলেকে কাঁদতে দেখে তার কাছে যান। ছেলেটি বলল, তার মা ও বাবা কেউই নেই। মহানবি সা. ছেলেটিকে গৃহে এনে বলেন, আমি তোমার পিতা আর আয়েশা তোমার মা, ফাতেমা তোমার বোন আর হাসান-হোসাইন তোমার খেলার সাথি।
সাহাবিদের ঈদ কেমন ছিলো
মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শের চমৎকার নিদর্শন সাহাবায়ে কেরামের ঈদ কেমন ছিলো তা থেকেও আমরা ঈদ উদযাপনের ধারণা নিতে পারি। সাহাবায়ে কেরাম সর্বক্ষেত্রে মহানবি সা.-এর অনুসরণ করতেন। তাঁরা এ বাক্যের মাধ্যমে ঈদের দিন শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থাৎ মহান আল্লাহ আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন।
সাহাবায়ে কেরাম মাহে রমজানে গুনাহ মাফ হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে বেশি চিন্তিত থাকতেন। তাই আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর ফারুক রা. ঈদুল ফিতরের নামাজে ইমামতি করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে বলতে থাকেন, আমার গুনাহ মাফ না হলে আমি ঈদগাহে গিয়ে কিভাবে ইমামতি করতে পারি।
তাঁদের ঈদে নতুন জামা, জুতা ও খাওয়াদাওয়ার ধুমধাম ছিল না। তবে আনন্দও কম ছিল না। মহানবি সা.-এর সান্নিধ্য লাভ করা, তাঁকে কাছে পাওয়া, তাঁর নির্দেশ পালন করাই ছিল তাঁদের প্রকৃত আনন্দ। ঈদের দিন অনেক দূর থেকে সাহাবায়ে কেরাম ছুটে যেতেন মহানবি সা.-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। তাঁর পেছনে দুই রাকাত ঈদের নামাজ পড়ার জন্য।
এক ঈদুল ফিতরের দিনে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কাঁদছেন। খুব অঝোরে। সবাই যার যার মত করে আনন্দ করছেন। হঠাৎ সাহাবারা খেয়াল করলেন ওমর ফারুক রাদি. কাঁদছেন। অবাক হয়ে সাহাবারা জিজ্ঞাস করলেন, আপনি কাঁদছেন? এই ঈদের দিনেও? তখন ওমর রা. জবাব দিলেন, আমি রাসূল সা.কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল কিন্তু ইবাদাত করে গুনাহ মাফ করে নিতে পারল না, সে ধ্বংস হোক। এখন রোজা শেষ হয়ে আজ ঈদের দিন। আমি এখনও জানি না আমার গুনাহ মাফ হয়েছে কি না? আমি কিভাবে নিশ্চিত হয়ে ঈদ আনন্দ করি?
বছরে পাঁচটি রাতে আল্লাহ তায়ালা ইবাদত কবুল করেন, দোয়া কবুল করেন। তারমধ্যে দুই ঈদের রাত। এ রাত্রীগুলোতে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। আমরাও যদি তাদের পথে চলি, তাদের পথে হাঁটি, আল্লাহ আমাদের ওপরও রাজি-খুশি ও সন্তুষ্ট হবেন।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম
atamim05@gmail.com