ইফতেখার জামিল:
দক্ষিণ এশিয়ায় পঁচিশ শতাংশের মত মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। এর মধ্যে দক্ষিণ ভারতের কিছু অঞ্চলের কথা বাদ দিলে অধিকাংশ মুসলমানই হানাফি-মাতুরিদি ধারার অনুসারী। হানাফি-মাতুরিদি ধারা অনেকগুলো উপধারায় বিভক্ত, এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রধান দুই উপধারা হল দেওবন্দি ও বেরলবি সিলসিলা।
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসব ধারা-উপধারাগুলোর প্রভাব অপরিসীম, পাশাপাশি আধুনিক রাষ্ট্র ও পশ্চিমা প্রভাব-ধর্মনিরপেক্ষতার প্রেক্ষিতে এসব সিলসিলাগুলোর মধ্যেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। এই লেখায় বাংলাদেশে দ্বিতীয় দশকে বেরলবি ও বেরলবি ঘনিষ্ঠ সিলসিলাগুলোর মধ্যে যেসব টানাপোড়েন-পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, সেগুলোই দেখানোর চেষ্টা করবো।
প্রচলিত সিলসিলা-ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা
আমাদের সমাজে ধর্মীয় ধারা-উপধারার ইতিহাস সংকলনে (তারিখুল ফিরাক/ফিরাকে বাতেলা) দুটি বড়রকমের সরলীকরণ আছে। পশ্চিমা ব্যাখ্যায় সাধারণত সবকিছুকে বস্তুবাদীভাবে বুঝতে চেষ্টা করা হয়। যেনবা বস্তুগত ইতিহাস-রাজনীতি-অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতেই সবকিছু ঘটে চলছে। এতে ধর্মীয় বিতর্কের অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক-তাত্ত্বিক তাৎপর্য ঢাকা পড়ে যায়। মানুষ পরিণত হয় বৈষয়িক-বৈপরীত্যমুখর-স্বার্থবাদী যন্ত্রে। বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ নিছক জন্তু বা যন্ত্র নয়, মানুষ মাত্রই বিপুল সম্ভাবনার আধার। তাই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ ব্যতীত কোন ব্যাখ্যাই পরিপূর্ণতা পেতে পারে না।
অপরদিকে প্রথাগত ধর্মীয় ব্যাখ্যায় সবকিছুই হক-বাতিল/ ভালো-খারাপের দ্বন্ধ। বিবাদ-বিতর্কমাত্রই ফেরেশতা-শয়তানের মোকাবেলা, এতে ইতিহাস-রাজনীতি-অর্থনীতির কোন প্রভাব নেই। প্রচলিত ধর্মীয় ব্যাখ্যায় ঢাকা পড়ে যায় মানবিক স্বার্থ-লোভ-পরম্পরা-মনস্তত্ত্বের ভূমিকা। ইতিহাসকে নিছক ‘আকিদাগত’ ও ‘ফিকহি’ ব্যাখ্যায় পরিণত করা হয়, যেটি মৌলিকভাবে অনুচিত কাজ। এতে কোন ঘটনার বৈষয়িক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বুঝা যায় না। আমাদেরকে অবশ্যই ফিকাহ ও ফিকিরের মধ্যে পার্থক্য করতে জানতে হবে।
ঐতিহাসিক পরম্পরা : ব্রিটিশ ভারতে টানাপড়েন
ব্রিটিশরা উপমহাদেশ দখল করার পর মুসলিম সমাজে নেমে আসে এক অসহনীয় অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা। মুসলমানরা খুঁজতে থাকে বিকল্প নেতৃত্ব, ‘আমাদের পিছিয়ে পড়ার ব্যাখ্যা কী, কারা করবে এর সমাধান?’ তারা অনুসন্ধান করেন বিকল্প ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও বক্তব্য। এরই ধারাবাহিকতায় উনিশ শতকে মুসলিম সমাজে দানা বাঁধে এক বিশেষ বিতর্ক। যেটি পরবর্তীতে দেওবন্দি-বেরলবি বিতর্ক নামে পরিচিতি পায়।
বেরলবি ধারার পূর্বপুরুষরা ছিলেন প্রধানত রামপুর ও খাইরাবাদী সিলসিলার অনুসারী, যারা মূলত মুসলিম জমিদার-জোতদারদের আশ্রয়ে ধর্মপ্রচার করতেন। ব্রিটিশদের উত্থানে এই সিলসিলায় কিছু বিভ্রম তৈরি হয়, তারা ক্ষমতাসীন ব্রিটিশদের সাহায্য নিতে বাধ্য হন। বিশিষ্ট যুক্তিবাদী আলেম ফজলে ইমাম খাইরাবাদি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় প্রধান ধর্মীয় উপদেষ্টা (ইসলাম) হিসেবে কাজ করেন। যার প্রেক্ষিতে এই সিলসিলায় প্রকাশ্যে ব্রিটিশ বিরোধিতা করা অনেকটাই কঠিন ছিল। এরই মধ্যে বিকল্প প্রকল্পের প্রচারে নামেন এক তরুণ তুর্কি, বনেদি পরিবারের সন্তান শাহ ইসমাইল শহীদ।
ইসমাইল শহীদ ছিলেন শাহ ওয়ালি উল্লাহর নাতি, দিল্লীর সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবারের উত্তরাধিকার। মোগল আমলেই ওয়ালিউল্লাহর পরিবার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিকল্প অর্থনৈতিক কাঠামো প্রস্তাব করেন। ‘মাদরাসা, মসজিদ, আলেমরা হবেন স্বাধীন, তারা কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনস্ত হতে পারবেন না।’ ঠিক এ কারণেই ওয়ালিউল্লাহর সিলসিলাকে ফিরিঙ্গিমহল বা খাইরাবাদের পরিণতি বরণ করতে হয়নি। তারা খুব সহজেই মুসলিম সমাজে নতুন আন্দোলনের ডাক দিতে সক্ষম হন, যাকে ইতিহাস বালাকোট আন্দোলন নামে চিনে।
উনিশ শতকে অস্থির দিল্লী : বিবাদের সূত্রপাত
আন্দোলনের এক পর্যায়ে ফজলে ইমাম-ফজলে হক-ইসমাইল শহীদের মধ্যে বিরোধ মারাত্মক আকার ধারণ করে। ‘যুবক ইসমাইল আমাদের ধর্মীয় নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে?’, খাইরাবাদি ধারা ব্রিটিশ সাহায্যে ইসমাইল শহীদকে দিল্লী থেকে বিতাড়িত করে। আন্দোলন ছড়িয়ে যায় সারাদেশে, তৈরি হয় নতুন ‘তরিকা, তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া’, তাওহীদ যার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। টানাপোড়েন একসময় ধর্মীয় বিতর্কে রুপ নেয় : শাহ ইসমাইল শহীদ বলেন, আল্লাহর ক্ষমতা-গুণাবলী সার্বভৌম ; খাইরাবাদি বলেন, রসূলের গুণাবলী অসাধারণ, তিনি অতুলনীয়। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও রসূলের অতুলনীয়তার প্রতিতুলনা থেকেই জন্ম নেয় নতুন দুই সিলসিলা : দেওবন্দ ও বেরলবি ধারা।
দেওবন্দিরা অভিযোগ করেন, বেরলবিরা ‘শিরিকির সন্দেহমূলক’ কাজ করছেন, অনেক বিদআত সাদৃশ্য কাজ করছেন, তাই তারা বিদআতি। বেরলবিরা দাবী করেন, দেওবন্দিরা রসূলের ‘অতুলনীয়তা’কে অস্বীকার করেন, কাজেই তারা গুস্তাখে রাসুল। উনিশ শতকের এক ব্যক্তিগত বিরোধ ছড়িয়ে যায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটা গ্রামে, গত বিশ বছরে সেটা ওঠে আসে ইন্টারনেটের পাতাতেও। শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, যেখানেই উপমহাদেশের মানুষরা আছেন, সেখানেই ছড়িয়ে যায় এই বিবাদ। তারা একসাথে খানা খান না, এক মসজিদে পড়েন না নামাজ। তারা একে অপরের চেহারা দেখতেও বিব্রত বোধ করেন।
মাসলাকে আ’লা হজরত : দিল্লীর বিবাদের তত্ত্বায়ন
ইসমাইল শহীদ মারা যান বালাকোট যুদ্ধে, ছয়ই মে আঠার শো একত্রিশ খ্রিস্টাব্দে। ফজলে হক খাইরাবাদি মারা যান আরও ত্রিশ বছর পরে। খাইরাবাদি সিপাহী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দানের অভিযোগে ‘দোষী’ সাব্যস্ত হন, অবশ্য পরবর্তীতে ছেলে আব্দুল হকের আবেদনের প্রেক্ষিতে রানী ভিক্টোরিয়া খাইরাবাদিকে ক্ষমা করে মুক্তির আদেশ জারি করেন। আন্দামান পৌঁছার কিছু আগে, আঠারো শো একষট্টি খ্রিস্টাব্দের আঠারই আগস্ট ইন্তেকাল করেন ফজলে হক খাইরাবাদি।
খাইরাবাদির মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে, আঠারো ছাপ্পান্ন খ্রিস্টাব্দের চৌদ্দই জুন ব্রিটিশ ভারতের বেরেলি শহরে এক প্রতিভাবান শিশুর জন্ম হয়, যার নাম আহমদ রেজা খান কাদেরি। অনুসারীরা তাকে আ’লা হযরত নামে অভিহিত করে থাকে। আহমদ রেজা খান কর্ম-দ্বন্ধমুখর জীবনে খাইরাবাদি প্রচারিত ব্যাখ্যার তত্ত্বায়ন করেন। তিনি শেষনবি মুহাম্মদ (সাঃ) এর অসাধারণত্বকে বিভিন্ন সূত্রের সাহায্যে ব্যক্ত করেন। এই সূত্রগুলোই পরবর্তীতে মাসলাকে আ’লা হজরত নামে পরিচিতি পায়।
মাসলাকে আ’লা হজরত : প্রধান তত্ত্বসমূহ
– রেজা খান বিশ্বাস করতেন, নবিজি গায়েব জানেন। এক কবিতায় তিনি লেখেন, (যখন খোদ খোদা তা’আলা, ইয়া রসূলাল্লাহ্! আপনার নিকট থেকে গোপন থাকেননি, তখন আর এমন কি জিনিস থাকতে পারে যা আপনার থেকে গায়ব বা গোপন? অর্থাৎ কিছুই গোপন নেই। আপনার উপর কোটি কোটি দরূদ বর্ষিত হোক।)
– রেজা খান বিশ্বাস করতেন, নবিজি হাজির ও নাজির। প্রখ্যাত বেরলবি আলেম আবূ দাঊদ মুহাম্মদ সাদেক্ব লেখেন, ( সমগ্র বিশ্ব নবীজির দৃষ্টি বা চোখের সম্মুখে। রূহানিয়্যাত, নূরানিয়াত এবং সমস্ত বিশ্বের রহমত হওয়া তাঁর শানের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতা ও ইলম-এর বিশাল জগতে সর্বত্র তাঁরই উজ্জ্বলতা বিরাজিত। দুনিয়ার কোন স্থান ও বস্তু তাঁর নিকট থেকে অদৃশ্য নয়। তিনি যেখানে চান যতস্থানে চান একই সময়ে উপস্থিত হয়ে স্বীয় গোলামদেরকে স্বীয় দিদার এবং ফয়য ও বরকত দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতে পারেন।)
– রেজা খান বেরলবি বিশ্বাস করতেন, নবীজি মুখতারুল কুল। তিনি তার মালফুজাতে বলেন, (মহাপরাক্রমশালী প্রভু আপন দানের ভা-ার নিআমতের খাযানা হুযুরের কব্জায় দিয়ে দিয়েছেন। তিনি যাকে ইচ্ছা দিবেন যাকে ইচ্ছা দিবেন না। সমস্ত ফায়সালা কার্যকর হয় একমাত্র হুযুরের দরবার থেকেই। আর যে কেউ যখনই কোনো নিআমত কোনো দৌলত পায় তা পায় হুযুরের রাজ-ফরমান থেকেই।)
– রেজা খান বেরলবি বিশ্বাস করতেন, নবীজি ছিলেন নূরের তৈরি। প্রখ্যাত বেরলবি আলেম আহমদ ইয়ার খান নঈমী বদায়ূনী বলেন, ( নূর থেকে সৃষ্ট; বাহ্যিকভাবে মানবীয় সূরতে দুনিয়ায় তাশরীফ আনয়ন করেছেন। অন্যভাবে বলা যায়- তাঁর হাক্বীক্বত (মূল) হচ্ছে নূর; এ নূরী রসূল বাশারিয়াত বা মানবীয় আকৃতিতে দুনিয়ায় তাশরীফ এনেছেন। সুতরাং তাঁর যাত বা সত্তা মুবারকে দু’টি দিক রয়েছে- একটি হলো নূরানিয়াত, অপরটি হচ্ছে বাশারিয়াত।)
মাসলাকে আ’লা হজরত : প্রেক্ষাপট ও প্রতিক্রিয়া
ঠিক কেন ও কোন প্রেক্ষাপটে বেরলবি সিলসিলার জন্ম, সে নিয়ে অনেক বিপরীতমুখী বক্তব্য আছে। একদিকে অনেকে একে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেন। মুসলমানরা রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ধর্মীয় সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হন, অনেক গবেষক একে বিবাদের প্রধান প্রেক্ষাপট হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাদের মতে, মুসলমানরা রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের বিকল্প হিসেবে আল্লাহর একত্ববাদ ও রসূলের অসাধারণত্বকে সংস্কারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ভাবতে শুরু করেন।
দেওবন্দি অনেক গবেষক বেরলবিদেরকে ইসমাইলি শিয়া ও বাতিল সুফি চিন্তার সিলসিলা হিসেবে আখ্যা দেন। পাশাপাশি ব্রিটিশরা দেওবন্দি সংস্কার প্রকল্পের বিকল্প মুসলিম শক্তি দাড় করাতে চাচ্ছে, তারা বেরলবিদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও আরোপ করেন। বেরলবিদের মতে দেওবন্দিরা ওহাবি চিন্তার ভারতীয় সংস্করণ, দেওবন্দি রাজনৈতিক-সংস্কার আন্দোলন ব্রিটিশদের ‘কৌশলগত’ প্রচেষ্টা। ব্রিটিশরা বিকল্প রাজনীতি ও সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের ( পড়ুন, বেরলবিদের) দমাতে চাচ্ছে। অবশ্য নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এসব অভিযোগ কতটা সত্য, কতটা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব, সেটি বিশদ আলোচনার দাবী রাখে।
বেরলবি সিলসিলা নবী-রসূল-পীরদের অসাধারণ ক্ষমতা-প্রভাবে বিশ্বাস করে। তারা একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উৎসব-দোয়ার আয়োজন করে, উদযাপন করে। দেওবন্দিরা নির্বিশেষে এসব বিশ্বাস-আয়োজনকে ‘বিদআত’ বলে চিহ্নিত করে। দেওবন্দিদের কাছে তাই বেরলবি মাত্রই বিদআতি, পরিত্যাজ্য মুসলমান। বেরলবিরা এর চেয়ে আরও বেশী কঠোর। আহমদ রেজা বেরলবি হুসামুল হারামাইন শিরোনামে ফতোয়া সংকলন করেন, এতে দেওবন্দিদের কাফের আখ্যা দেন, ‘যারা তাদেরকে কাফের বলবে না, তারাও কাফের।’ এই শেষ বাক্যটি বেরলবিদের সর্বদা ভীতির মধ্যে রাখে, যদি আপনি তাকফির না করেন, তবে আপনি নিজেই কাফের হয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে বেরলবি সিলসিলা : শেরে বাংলা আজিজুল হক
তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া কেন্দ্রিক পরিচালিত বালাকোট আন্দোলন বাংলা অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, সাইয়েদ আহমদ শহীদের খলিফা কারামত আলী জৌনপুরী এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিহার-বাংলায় বালাকোট কেন্দ্রিক ধারাগুলোর বিস্তার ঘটে। কাছাকাছি সময়ে বাংলা অঞ্চলে তিতুমির ও হাজি শরিয়তুল্লাহর আন্দোলন দানা বাঁধে। এসব আন্দোলনের মূলকথা ছিল প্রায় কাছাকাছি। কাজেই এই অঞ্চলে খাইরাবাদি বা রেজভি সিলসিলার অনুসারী ছিল না বললেই চলে। অবশ্য বালাকোট কেন্দ্রিক ধারাগুলোর সাথে স্থানীয় সুফি ধারাগুলোর মধ্যে কিছু বিতর্ক তৈরি হয় : যেগুলোকে স্থানীয় ভাষায় শরিয়তি-মারেফতি বিবাদ বলে অভিহিত করা হয়। পরবর্তীতে বাংলা অঞ্চলে বেরলবি সিলসিলার আগমন ঘটলে মারেফতি ধারার সাথে তাদের বিশেষ সখ্যতা তৈরি হয়।
বাংলা অঞ্চলে বেরলবি ধারার সর্বপ্রথম প্রচারক ছিলেন শেরে বাংলা আজিজুল হক। হাটহাজারী আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম থেকে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে তিনি উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে দিল্লীর ফতেহ্পুর আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন, এখানেই তিনি বেরলবি সিলসিলায় দীক্ষা লাভ করেন এবং দেশে ফিরে নতুন চিন্তাধারা প্রচারে মনোযোগী হন। উনিশ শো বত্রিশ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রাম মেখল ফকিরহাটে এমদাদুল উলুম আজিজিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদরাসা ছাড়াও চট্টগ্রাম অঞ্চলে আরও বেশকিছু ‘বেরলবি মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেন।
এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয় : ক) বেরলবি ধারার প্রথম প্রচারক শেরে বাংলা চট্টগ্রাম অঞ্চলে দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়েছিলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামেই বেরলবি ধারার সূচনা ঘটে। খ) ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে এখনো চট্টগ্রামে বেরলবি সিলসিলা যথেষ্ট শক্তিশালী। দেশের প্রধান জশনে জুলুসের আয়োজন করা হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলেই। গ) শেরে বাংলা কওমি মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীতে চিন্তাধারা পরিবর্তন করার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে কওমি ও বেরলবি সিলসিলার মধ্যে মারাত্মক তিক্ততা সৃষ্টি হয়। যার রেশ এখনো কাটেনি। ঘ) শেরে বাংলা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, টানা সতের বছর স্থানীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রামের সুশীল সমাজের সাথেও ছিল তার ভালো সম্পর্ক, এসবের ভিত্তিতে পরবর্তীতে চট্টগ্রামে বেরলবি ধারা বিশেষ শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়।
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া : ‘ইয়ে মাদ্রাসা কি বুনিয়াদ মাসলাকে আ’লা হাজরাত পর হুই’
শেরে বাংলা আজিজুল হক বেরলবি ধারার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রচারক হিসেবে বিবেচিত হলেও তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুব বেশী সফল ছিলেন না। বস্তুত তার পক্ষে শূন্য থেকে সফল প্রতিষ্ঠান-সংগঠন চালু করা সহজ ছিল, সেটাও বলা যাবে না। ঘটনাচক্রে মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে ব্যবসায়ী পীর সৈয়দ মুহাম্মদ আহমদ শাহ সিরিকোটির সাথে শেরেবাংলার সাক্ষাত ঘটে। শেরেবাংলা সিরিকোটিকে চট্টগ্রামে দাওয়াত করেন।
আজাদি পত্রিকার তৎকালীন মালিক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেকের বাসায় জলসা-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সবাই বসে মিলাদ পড়ছে দেখে আহমদ শাহ সিরিকোটি বিস্মিত হন। তিনি আরও বিশুদ্ধ ‘সুন্নিয়ত’ প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মজার বিষয় হচ্ছে, শেরে বাংলার মত পীর সৈয়দ মুহাম্মদ আহমদ শাহ সিরিকোটিও কওমি মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। সিরিকোট পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের একটি অঞ্চল, সৈয়দ মুহাম্মদ আহমদ শাহ এই অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তিনি ছিলেন একইসাথে বেরলবি সিলসিলায় দীক্ষিত, পীরতান্ত্রিক সাংগঠনিকতায় দক্ষ। ইয়াঙ্গুনের ব্যবসায়ী হিসেবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সমাজের সাথেও ছিল তার বিশেষ সুসম্পর্ক।
উনিশ শো চুয়ান্ন সালে সৈয়দ মুহাম্মদ আহমদ শাহ সিরিকোটির উদ্যোগে, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা ও শেরে বাংলার পরামর্শে চট্টগ্রামের ষোলশহরে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা মুহূর্তে সিরিকোটি বলেন, ‘ইয়ে মাদ্রাসা কি বুনিয়াদ মাসলাকে আ’লা হাজরাত পর হুই। এই লাইনটি পরবর্তীতে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই মাদরাসাকেই বলা যায় বাংলাদেশে বেরলবি সিলসিলার প্রধান কেন্দ্র। সিরিকোটি মৃত্যুবরণ করেন উনিশ শো একষট্টি সনে, ফজলে হক খাইরাবাদির ইন্তেকালের ঠিক একশো বছর পর। সিরিকোটির পরে, তার ছেলে ও নাতি সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহে ও সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আরও অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান।
‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ : শাখা প্রতিষ্ঠানসমূহ
অভিভাবকত্বের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় সিরিকোট দরবার শরিফ। মূলত এই দরবার শরীফ সকল শাখা প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক। রেঙ্গুনে অবস্থানকালীন উনিশ শো পঁচিশ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ মুহাম্মদ আহমদ শাহ সিরিকোটি আনজুমানে শূরা-এ রহমানিয়া নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, উনিশ শো সাইত্রিশে চট্টগ্রামে এর শাখা কমিটি গঠিত হয়। উনিশ শো আটান্ন সালে এই আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানটি আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া নাম ধারণ করে। উনিশ শো আটাশি খ্রিস্টাব্দে ছেলে তৈয়্যব শাহ সংগঠন নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই কমিটিই হল গাউছিয়া কমিটি। আনজুমান ও গাউছিয়া কমিটি, এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে সিরিকোটি দরবারের প্রধান অঙ্গ সংগঠন আখ্যা দেওয়া যায়।
তৈয়ব শাহ উনিশ শো চুয়াত্তর সালে চট্টগ্রামে বারোই রবিউল আওয়াল উপলক্ষে জশনে জুলুসের প্রবর্তন করেন। উনিশ শো ছিয়াশি সাল পর্যন্ত তিনি এতে নেতৃত্ব দেন। এরপর থেকে তাঁরই ছেলে দরবারে ছিরিকোট শরীফের সাজ্জাদানশীন সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ জুলুসে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। জশনে জুলুসকে বলা যায় বেরলবি ধারার সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ। মূলত এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সালাফি-দেওবন্দি ধারার বাইরের সকল উপধারাগুলোর মধ্যে বেরলবি সিলসিলা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সাংগঠনিক দৃঢ়তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দরবার শরীফ ও অঙ্গসংগঠনের মাধ্যমে সমচিন্তার উপধারাগুলোর সমীহ আদায় করে নিতে সক্ষম হয় তারা।
বাংলাদেশে সিরিকোটি দরবার পরিচালিত বেরলবি সিলসিলা বরাবরের মতোই ছিল রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহী। খাইরাবাদি ও আ’লা হজরতের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তবে অব্যাহত রাজনৈতিক চাপের মুখে, দেওবন্দি আন্দোলন ও জামায়াত-শিবিরের বিকল্প হিসেবে সিরিকোট দরবারের সমর্থকরা উনিশ শো আশি সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত সিরিকোটি দরবারের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ও বিপক্ষ শক্তির মোকাবেলার অংশ হিসেবেই এই দলের সূচনা ঘটে, তাদের মধ্যে কখনোই এর চেয়ে বেশী রাজনৈতিক উচ্চাশা ছিল না। এই ছাত্র সংগঠনের ধারা রক্ষা করে উনিশ শো নব্বই সনে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক সংগঠনের পথযাত্রা শুরু হয়। এর অরাজনৈতিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নাম, বাংলাদেশ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত।
দ্বিতীয় দশকে বেরলবি সিলসিলা : আত্মদ্বন্ধ, সম্ভাবনা ও প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেরলবি সিলসিলা এখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সিলসিলা নয়। তবে বেশকিছু কারণে এর সম্ভাবনা অনেক বেশী।
– ঐতিহাসিক পরম্পরা
ঐতিহাসিকভাবে বাংলা অঞ্চলে শরীয়ত বনাম মারেফতের যে সামাজিক তর্ক জারি ছিল, বেরলবি সিলসিলা এর মধ্যে মারেফতি ধারা-উপধারাগুলোর পক্ষে যুক্তি দাড় করাতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ছোট উপধারা হওয়া সত্ত্বেও সালাফি-দেওবন্দি সিলসিলা বিরোধী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে আবেদন তৈরি করতে পেরেছে। তারা এই আবেদন কতটা কাজে লাগাতে পারবে, সেটা অবশ্যই প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়।
‘সবাইকেই বেরলবি সিলসিলায় ঢুকতে হবে, মেনে নিতে হবে মাসলাকে আ’লা হজরত’ : এ নিয়ে জোরাজোরি করলে অপরাপর সুন্নি ও মারেফতি উপধারাগুলোর মধ্যে বিরক্তি বৃদ্ধি পাবে, ইতিমধ্যে আসলে এটিই হতে চলছে। সম্প্রতি মাইজভাণ্ডারী ও আব্বাসির বক্তব্যে এসব আপত্তি ওঠে আসছে খোলামেলাই। আব্বাসি এক ওয়াজে বলছিলেন, ‘রেজা খানের যেসব বক্তব্য সুন্নিয়তের পক্ষে যায়, সেসব আমরা মানি। তবে তিনি ইমামে তরিকত নন, ইমামে আহলে সুন্নতও নন। এই নজদি-ওহাবিদের সাথেও আমাদের কোন সম্পর্ক নেই, এই মাজার পূজারী-পীর পূজারী-বিদআতীদের সাথেও আমাদের কোন সম্পর্ক নাই।’
– শিক্ষার প্রতি মনোযোগ
শিক্ষাগত ক্ষেত্রে বেরলবিরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারছে না, এই অনুভূতি কাজ করছে এই সিলসিলার অনেকের মধ্যেই। গত দশকে তো বটেই, বিগত বিশ বছর ধরে তারা এ নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে, বেরলবি সিলসিলা গত দুই দশকে অন্তত দুইশত মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই মাদরাসা-প্রকল্প যদি সফলতার মুখ দেখে, তবে বাংলাদেশের মতাদর্শিক রাজনীতির চেহারাই পাল্টে যাবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
তবে এর আগে চরমুনাই সিলসিলাতেও পীরতান্ত্রিক মাদরাসা চালু করার চেষ্টা করতে দেখা যায় এবং সেটি অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবী করেন অনেকে। নিছক ভক্তি-পীরালি দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়, কাজেই বেরলবিদের মাদরাসাগুলো বিদ্যমান শিক্ষাকেন্দ্রিক মানচিত্রে বিশেষ কোন পরিবর্তন তৈরি করতে সক্ষম হবে না বলেই আমার মনে হয়।
– রাজনৈতিক সুবিধা
উল্লেখিত ঐতিহাসিক সুযোগ ছাড়াও দ্বিতীয় দশকে বেরলবি সিলসিলা রাজনৈতিকভাবেও বিশেষ কিছু সুবিধা পেয়েছে। আমেরিকা পরিচালিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে বেরলবি সিলসিলাকে আঞ্চলিক ‘বন্ধু শক্তি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে RAND Corporation সহ আমেরিকান বেশ কয়েকটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে দেওবন্দি ও সালাফি ধারার বিপদের মধ্যে বেরলবিরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করেছে, সেটা বলাই বাহুল্য। ‘জঙ্গি’ হিসেবে বেরলবি সমর্থকদের গ্রেফতারির ঘটনাও বেশ বিরল। তবে পাকিস্তানে সাম্প্রতিক কিছু ‘হত্যাকাণ্ডের’ প্রেক্ষিতে বেরলবিদের প্রতিও পশ্চিমা সন্দেহ বাড়ছে।
বাংলাদেশে আওয়ামীলীগের সাথে জামায়াতে ইসলামি ও কওমি আলেমদের অব্যাহত দ্বন্ধের প্রেক্ষিতে বিশেষ কিছু সুযোগ পেয়েছে বেরলবি ও বেরলবি ঘনিষ্ঠ উপধারাগুলো। জাতীয় মসজিদের ইমামতি থেকে শুরু করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদ তারা দখল করতে পেরেছে। প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখেও সরকার জাতীয় মসজিদের সাবেক ইমাম সালাহুদ্দিনকে তার পদ থেকে সরায়নি। এর বিনিময়ে বেরলবি ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দল তরিকত ফেডারেশন ও ইসলামিক ঐক্য ফ্রন্ট সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে পাশে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ। জোটবদ্ধ এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে ২০টি আসন দাবি করেছিল দলটি, যদিও আওয়ামীলীগ তাদেরকে একটিও সিট দেয়নি।
– তীব্র প্রতিক্রিয়াশীলতা : ‘আমরা ছাড়া বাকিরা ওহাবি’
বেরলবি ধারা প্রধানত দেওবন্দি-সালাফি-জামায়াতকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে আখ্যা দেয়। বিপরীতমুখী এসব উপধারাকে আখ্যা দেয় ‘ওহাবি-সালাফি’ হিসেবে, যদিও খোদ দেওবন্দিদের সাথে সালাফি-জামায়াতের দূরত্ব কম নয়, তবে বেরলবি সিলসিলা মাসলাকের মূল প্রবক্তা আহমদ রেজা বেরলবির ‘চরমপন্থা’ থেকে বের হতে পারেনি, তারা এসব সিলসিলাকে ওহাবি আন্দোলনের সম্প্রসারণ হিসেবেই দেখে থাকে। সম্প্রতি সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ ও আওয়ামীলীগের সাথে প্রকাশ্য জোটবদ্ধতার অংশ হিসেবে বিরোধীদেরকে তারা ‘জঙ্গি’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবেও আখ্যা দিতে থাকে।
দুই হাজার সতের সালে সরকার কওমি মাদরাসার শিক্ষাকে স্বীকৃতি প্রদান করলে বেরলবিরা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতি ‘গভীর ষড়যন্ত্রমূলক আঁতাত’ বলে দাবি করে বেরলবিদের রাজনৈতিক দল ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের অরাজনৈতিক অঙ্গসংগঠন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত সমন্বয় কমিটি। সংগঠনের নেতারা দাবি করেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। এর ফলে দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর সাহস আরও বাড়বে। সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মকাণ্ডকে এই সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
কওমি মাদ্রাসাকে সরকারি সনদ দেওয়ার ঘোষণা প্রত্যাহার করে, দেশে একমুখী মাদ্রাসা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের দাবি জানান আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নেতারা। কোনো ধরনের সংস্কার না করে কওমি মাদ্রাসার সনদকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ায় উগ্রপন্থী ভাবধারা উৎসাহিত হবে। দুই হাজার একুশ সালে দলের নেতারা দাবী করেন, জঙ্গিবাদী সালাফি ও উগ্রবাদী হেফাজতের সাথে দীন ইমান ও শান্তিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা ইসলামের কোনো সম্পর্ক নাই। কওমী মাদ্রাসা মনিটরিংসহ হেফাজত ও সালাফি সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করতে হবে। পিস টিভি বন্ধের পরে সরকারকে স্বাগত জানিয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মোছাহাব উদ্দিন বখতিয়ার বলেন, ‘সেখানে যারা আলোচক ও উপস্থাপক রয়েছে, যাদের জঙ্গিবাদী বক্তব্যের কারণে জঙ্গি তৈরি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে তাদের উপর নজরদারি বাড়ানো দরকার। পিস টিভির বাইরেও তারা বক্তব্য রাখে।’
দুই হাজার তেরো সালের বিষয়েও বেরলবিদের অবস্থান অনমনীয়। দুই হাজার একুশের মে মাসে সরকারের কাছে উপস্থাপিত এক স্মারকলিপিতে তারা দাবী করেন, ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল। বায়তুল মোকাররমে কোরআন শরীফে অগ্নিসংযোগ, বাসে-দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে, আশেপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকার গাছপালা নিধন করে সেদিন এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এর সাথে ইসলামের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে কারও জান-মাল-ইজ্জতে আঘাত করা হারাম। সরকারের সময়োপযোগী সাহসী পদক্ষেপের কারণে জাতি সেদিন বিপদ থেকে রক্ষা পায়।
অবশ্য এসব প্রতিক্রিয়াশীল ধারার বাইরে কিছু সমন্বয়কামী আলেম আছেন। এদের মধ্যে ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
-প্রশ্ন ও সংশয় : ‘আমরা কেন সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ নই?’
অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার মধ্যে বেরলবি সিলসিলার অনেকের মধ্যেই তাদের মাসলাক নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। বিশেষত সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ ও আওয়ামীলীগের সাথে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে তাদের জনপ্রিয়তাতেও ভাটা পড়ে। দুই হাজার তেরো সালে হেফাজতের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বেরলবি সমর্থক-মুরিদদের অনেকের মধ্যে কিছু আত্মজিজ্ঞাসা তৈরি হয়, তারা বড়দের গোঁড়ামি নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেন। এতে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা মত, তারা আর আগের মতো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ নন। বেরলবি অনুসারীদের কেউ কেউ বলতে থাকেন, যদি আমরাই ‘হক মাসলাক হই, তবে কেন আমরা সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ নই?
এসব নিয়ে কিছু আত্মকোন্দলেরও তৈরি হয়। যারা প্রশ্ন করেন, তাদেরকে মূল মাসলাক থেকে একঘরে করে রাখার প্রবণতা তৈরি হয়। বেরলবিরা শুধু বিরোধী উপধারাগুলোর প্রতিই প্রতিক্রিয়াশীল নয়, নিজেদের মধ্যে যারা সমন্বয়কামী, প্রশ্ন-সংশয় প্রকাশ করেন, তাদেরকেও অঘোষিতভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। যেহেতু আ’লা হজরত অনেক দেওবন্দিকে কাফের বলেছেন, যারা তাদেরকে কাফের অস্বীকার করবে, তাদেরকেও কাফের বলে হুমকি দিয়েছেন, কাজেই বেরলবিদের দিক থেকে বিরোধী উপধারাগুলোর সাথে সম্পর্ক করা খুব সহজ নয়। এতে তারা নিজেরাই তাকফিরের হুমকিতে পড়ে যাবেন। বলাইবাহুল্য, এসব সংকীর্ণতার প্রেক্ষিতে অনেক অনুসারী-ছাত্রদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ।
নুরুল ইসলাম ফারুকী : বেদনা ও ক্রোধের আগুন
বেরলবিদের প্রতিক্রিয়ার জবাবে কওমি-দেওবন্দি-জামায়াতের মোকাবেলাও অনেক সময় নিরীহ থাকে না। বিরোধীরাও বেরলবিদের ‘ খারাপ মুসলমান’ হিসেবে আখ্যা দেন। এটি অনেক সময় রক্তারক্তি পর্যন্ত পৌছায়। বেরলবিদের প্রথম প্রচারক শেরে বাংলা আজিজুল হকও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হন। চট্টগ্রামে আশির দশকে শিবিরের সাথে সংঘর্ষে ছাত্রসেনা কর্মী লিয়াকত আলী নিহত হন। তবে দ্বিতীয় দশকের সবচেয়ে বড় ঘটনা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকাণ্ড। বস্তুত ধর্মীয় উপধারার কোন বিশিষ্ট নেতা গুপ্তহত্যার শিকার হবেন, এটি কোনভাবেই স্বাভাবিক নয়।
২০১৪ সালের ২৫ আগস্ট ফারুকীকে তার রাজাবাজার কার্যালয়ে ৮-১০ জন অজ্ঞাত হামলাকারী হত্যা করে। এর আগে একজন মহিলা, যিনি তাকে বারবার টেলিফোন করেছিলেন তাকে তার বাড়িতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, চল্লিশ বছর বয়সী মহিলা ফারুকির বাড়িতে দুই ঘণ্টা থাকার সময় নার্ভাস ছিলেন এবং অদ্ভুত আচরণ করেছিলেন। তার পরিবারের দাবি, বেশ কয়েকজন যুবক হজ নিয়ে কথা বলতে বাড়িতে এসে তাকে হত্যা করেছে। স্থানীয় এক ইমামের মতে, দুই যুবক রাত সাড়ে টার দিকে তার বাড়িতে আসে এবং ৬-৭ জন সশস্ত্র যুবক ঘরে তার কাছে থাকা সব টাকা দাবি করে।
ফারুকীর স্ত্রী দাবি করেন, রহস্যময়ী নারীকে গ্রেফতার করা হলে অপরাধীরা ধরা পড়বে। তার পুত্র আহমেদ রেজা ফারুকী একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে বলেছিলেন: “আমার বাবা ‘সুন্নি’ মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। যারা তার মতাদর্শের বিরোধিতা করেছিল তাদের কাছ থেকে তিনি মোবাইল ফোন এবং ফেসবুকে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন। চরমপন্থী বা খারেজি-ওহাবী আহলে হাদিস তাকে হত্যা করেছিল, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছিল।’’ তার সংগঠন আহলে সুন্নাতের সদস্যরা তাদের নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যার প্রতিবাদ করে চট্টগ্রামে মুরাদপুর মোড় অবরোধ করে। ২০১৪ সালের আগস্টে, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র সেনার প্রধান মুহাম্মদ নুরুল হক চিশতি এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, দলীয় নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে সারা বাংলাদেশে অর্ধদিবস ধর্মঘট পালিত হবে।
বস্তুত ফারুকি হত্যাকাণ্ড বেরলবি সিলসিলার মধ্যে গভীর বেদনা ও ক্রোধের তৈরি করে। তারা বিরোধী পক্ষগুলোকে দায়ি করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়াকে জরুরী/বৈধ বলে মনে করতে থাকেন।
‘জশনে জুলুস’ : ইসলামের সাংস্কৃতিক প্রচার
পৃথিবীর দেশে দেশে বারোই রবিউল আওয়াল উপলক্ষে অনেক অনুষ্ঠান-উৎসব পালিত হয়। দেওবন্দ-সালাফি-জামায়াতের মতো উপধারাগুলো এসব অনুষ্ঠান আয়োজনে অনাগ্রহী। এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে বেরলবি সিলসিলা। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত অনেক মানুষই ইসলামকে নিছক শিক্ষা-ইবাদত-রাজনীতি-সংস্কারের বাইরে উৎসব-সংস্কৃতির জায়গা থেকে দেখতে চান। দ্বিতীয় দশকে আওয়ামীলীগ সরকারের অব্যাহত চাপের মধ্যে বেরলবি সিলসিলা ইসলামের নিরাপদ উদযাপনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
এতে নিরীহ জনতার মধ্যে বেরলবিদের প্রতি একটা সাংস্কৃতিক আবেদন তৈরি হয়, লিবারেল শক্তিগুলোও বেরলবিদেরকে সমন্বয়কামী উপধারা হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে। আগেই যেমন বলেছি, জশনে জুলুসকে বলা যায় বেরলবি ধারার সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ। মূলত এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সালাফি-দেওবন্দি ধারার বাইরের সকল উপধারাগুলোর মধ্যে বেরলবি সিলসিলা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সাংগঠনিক দৃঢ়তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দরবার শরীফ ও অঙ্গসংগঠনের মাধ্যমে সমচিন্তার উপধারাগুলোর সমীহ আদায় করে নিতে সক্ষম হয় তারা। অনেকেই হয়ত বেরলবিদের মাসলাক-রাজনীতির সাথে একমত নয়, তবে তাদের প্রভাব-আয়োজনের আবেদন ছড়িয়ে যায় সহযোগী উপধারাগুলোর অনেকের মধ্যেই। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ফুরফুরা-ছারছিনা-ফুলতলি-আটরশিদের মধ্যে জশনে জুলুসের আবেগ ছড়িয়ে যায়।
দুই হাজার একুশ সালে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন নবী পালনের ঘোষণা দেয়। অনেকেই একে বেরলবিদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে দেখতে আগ্রহী।
– নতুন রক্ত : ‘আধুনিকতা, কট্টরপন্থী আশায়েরি ধারা ও লোকজ ইসলাম’
দ্বিতীয় দশকে বেরলবি সিলসিলায় অনেক আধুনিক কণ্ঠও সংযুক্ত হয়। তারা সিলসিলার সফল সাংস্কৃতিক রুপান্তর ঘটাতে সক্ষম হবার প্রেক্ষিতে ‘লোকজ ইসলামের’ প্রবক্তারা তাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। বেরলবিদের মধ্যেও নিজেদেরকে আধুনিক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো। করোনাকালীন সময়ে গাউছিয়া কমিটি সেচ্ছাসেবক সংগঠন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সারাদেশে প্রায় ৫ হাজার লাশ দাফন ও সৎকার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি অসুস্থদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ও আনায় অ্যাম্বুলেন্স সেবা, বিনামূল্যে ওষুধ প্রদান ও অসহায়-দরিদ্র মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। করোনার এই দুঃসময়ে তাদের সেবা কার্যক্রমে জোরালো হয়েছে অক্সিজেন সেবা।
এই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের কট্টর আশায়েরি সিলসিলার সাথেও তাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আজহার ফেরত আলেমরা। ঐতিহ্যবাহী আ’লা হজরতের মাসলাকের বদলে নতুন প্রবক্তারা কট্টর আশায়েরি বক্তব্যগুলোো প্রচার করতে থাকেন। তারা সবাই সালাফি প্রতিরোধে একমত, এই মর্মে বেরলবি সিলসিলার মধ্যে নতুন রক্তের সঞ্চালন ঘটেছে। এই নতুন রক্ত কেমন ভূমিকা রাখবে, সে নিয়ে এখনই নির্দিষ্ট মন্তব্য করা কঠিন। তবে মনে করা হচ্ছে, এই নতুন প্রবক্তারা বেরলবি সিলসিলার নতুন অভিমুখ নির্ণয় করতে সক্ষম হবেন। এর সাথে যদি নতুন করে প্রতিষ্ঠিত দুইশো মাদরাসার বিষয়টি যোগ করা হয়, তবে বলতে হবে, আগামী দশকেও বেরলবি সিলসিলা বাংলাদেশের ধর্মীয় অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।