ফজলে রসুল বাদায়ুনীর চোখে বালাকোট : বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা

খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ

ফজলে রাসুল বাদায়ুনী ১২১৩ হি. সফর মাস মোতাবেক ১৭৯৮ সালে ভারতের বাদায়ুন অঞ্চলে জন্মগ্রহন করেন। বাবা আব্দুল হামিদ এবং দাদা আব্দুল মাজিদ থেকে নাহু-সরফ সহ প্রাথমিক তালিম সম্পন্ন করেন। বাড়তি পড়াশোনার জন্য ১২ বছর বয়সেই তিনি লাখনো চলে যান এবং সেখানে ফিরিঙ্গি মহলের আলেম মৌলভী নুরুল হক থেকে বিভিন্ন শাস্ত্রে দক্ষতা হাসিল করেন। পিতার আহবানে সাড়া দিয়ে গ্রামে ফিরে এসে কাদেরিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অনবরত পিতার হাতে বাইয়াত লাভের জন্য আবেদন করলেও ইজাযত মেলে নি; আখের তিনি বুঝলেন যে, দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে নতুবা ইজাযত মিলবে না। নিজেকে জাগতিক চাহিদা ও খায়েশ থেকে অবমুক্ত করে হাজির হলেন বাবার সামনে। পিতা আব্দুল হামিদ তাকে ফুসুসুল হিকাম এবং মাসনবীয়ে রুমির পাঠ দিয়ে উপযুক্ত করে বাইয়াত প্রদান করেন। ফজলে রাসুল বাদায়ুনী ছিলেন বেরেলভী মাসলাকের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী । ওয়াজ, দরস-তাদরিস এবং লেখালেখির মাধ্যমে বেরেলভী চিন্তাকাঠামোকে হেফাজত করার চেষ্টা চালিয়েছেন; তাঁর রচিত ‘সাইফুল জাব্বার’ এবং ‘বাওয়ারেকে মুহাম্মাদিয়া’ এই ধারার বিশেষ সংযোজন। ৮ আগস্ট ১৮৭২ সালে তিনি ওফাত লাভ করেন। ১

তার ব্যাপারে রাজিউদ্দিন বাদায়ুনী একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণনা করেছেন- একবার ফজলে রাসুল মশহুর দরবেশ কুতুবুদ্দিন কা‘কী রহি. এর কবরের পাশে ছিলেন, হঠাৎ মদিনায় রওজায়ে আতহার জিয়ারতের আগ্রহ জাগল, তিনি খরচপাতির চিন্তা না করে তাৎক্ষণিক পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন। সপ্তম দিনে মুম্বাই পৌছে সফরের ইজাযত চেয়ে তিনি বাবাকে চিঠি লিখলেন, পিতা খুশি হয়ে অনুমতি দিলেন। ২ অতপর তিনি পায়ে হেটেই রওনা করেন। সবকিছুর পরও এ কথা সত্য যে, নজদি আন্দোলনের প্রতি অতি-বিদ্ধিষ্ট মনোভাব তাকে চিন্তা প্রকাশে বেশকিছু ক্ষেত্রে প্রান্তিক অব্স্থানে ঠেলে দিছে। বিশেষত বিদ্যমান নিবন্ধে বালাকোট আন্দোলনের ব্যাপারে তার থেকে প্রকাশিত বিকৃতি দেখিয়ে সত্য সঠিক অবস্থান প্রকাশ করব।

ওহাবী তাহরিক বইয়ে ফজলে রাসুল বাদায়ুনী শাহ ঈসমাইল শহীদ এবং আহমদ বেরেভীর জিহাদি আন্দোলনের ব্যাপারে মন্তব্য করে বলেন, “এই নব্য-ধর্ম নতুন রুপ ধারণ করেছে, মৌলভী ঈসমাইল যুদ্ধের জন্য ওয়াজ আরম্ভ করল, কথাগুলো সাধারন মুসলিমদের মনপুত হলে তারা জানমাল নিয়ে তার খেদমতে হাজির হয়, তারপর ঈসমাইল শহীদ তাদের জমা করে আফগানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সে সাইয়েদ আহমদকে আমীরুল মুমিনিন ঘোষণা করে। এবং বিভিন্ন কারামতের কথা বলে এবং দেখিয়ে মানুষকে দলে ভিড়ায়।… ৩ ফজলে রসুল আরো বলেন, বর্তমানে সাইয়েদ আহমদের অনুসারীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে- কেউ মনে করে সাইয়্যেদ আহমদ পুনরায় ফিরে আসবেন, তার প্রদত্ত ওয়াদা পুরণ করবেন। কেউ বলে, তিনি পাহাড়ে দুনিয়ার মানুষ থেকে গোপন হয়ে জীবিত আছেন, সাইয়্যেদ আহমদের অধিকাংশ অনুসারী মনে করেন তিনি ফিরে আসবেন। কেউ তো বিশ্বাস করে যে তার ফিরে আসার কথা অস্বীকার করা কুফুরি। যারা অস্বীকার করে তারা কাফের। সাইয়েদ আহমদ শহীদ এবং ইসমাইলের ইন্তেকালের পর এই নব্য-ধর্মের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। তাকবিয়াতুল ঈমান কিতাবটিও লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। স্বর্বোপরি এই ছিল ওহাবীদের হালত, যা আমি তুলে ধরলাম। ৪

ফজলে রসুল বাদায়ুনীর উপরোক্ত বরাতে মোটাদাগের ৩ টি আলাপ আছে – প্রথমত, শাহ আহমদ শহীদের আন্দোলনকে জাদিদ দ্বীন বা নব্য-ধর্ম হিসাবে বিবেচনা। দ্বিতীয়ত, শহীদ ঈসমাইলের অনুসারীরা তার পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস রাখে বলে দাবি । তৃতীয়ত, বালাকোট তথা: আহমদ শহীদ এবং শাহ ঈসমাইল শহীদের আন্দোলন কি ওহাবী আন্দোলন ছিল ?

*আহমদ শহীদের আন্দোলন কি নতুন ধর্ম ?

এই ধরনের আলোচনা পদ্ধতির মৌলিক সমস্যা হচ্ছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং বিদ্ধেষমুলক মানসিকতা; এটি যেকোন আলাপকে তার সীমার বাইরে নিয়ে যায়। এই টপিকে আমরা আলাপ করবো না, কারণ আমার মনে হয় না, বাদায়ুনীর চিন্তা-মতামতকে পছন্দ করেন, যোগাযোগ রাখেন এবং তার মাসলাকের সাথে সংযুক্ত আছেন এমন কেউ তার এই দাবীকে একালে মেনে নেবেন। আর যদি মেনে নেন, তাহলে দুঃখজনকভাবে তার চিন্তার ভ্রান্তি দূর করার ক্ষমতা আমার নাই। তাছাড়া আপনি তখন আসলে আলাপের মুলস্রোতে থাকছেন না। তখন আপনার সাথে আমাকে আলাপ করতে হবে কুফরের পরিচয় নিয়ে, ঠিক কি কারণে একজন মানুষ কাফের হয় তা নিয়ে এবং ঠিক কি কি বৈশিষ্ট্য থাকলে ইসলামের মধ্যে একটা দল ‘নতুন ধর্ম’ রুপে আবির্ভুত হতে পারে; কিন্তু সে আলাপের জন্য আপাতত এই প্রবন্ধে আমরা প্রস্তুত নই। এবং প্রতিশ্রুতিশীলও নই।

*শহীদ ঈসমাইলের অনুসারীরা কি তার পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস রাখে ?

এক্ষেত্রে ফজলে রসুল সাহেবের যে বিচ্যুতি ঘটেছে, তার পেছনে দুইটি প্রসঙ্গকে আমরা দায়ী করতে পারি- এক. সেকেন্ডারি কিছু তথ্যমতে বালাকোট প্রাঙ্গনে আহমদ শহীদের শাহাদতের পর তার কিছু কিছু ভক্ত ও অনুরক্ত মাজযুব হয়ে যান। তারা উদভ্রান্তের মতো হয়ে যান এবং বলতে থাকেন শাহ আহমদ আবার আসবেন এবং দেশ স্বাধীন করবেন। আদতে এই খন্ডিত ঘটনাকে সামগ্রিক চিত্র দিয়েছেন তিনি। দুই. আরেকটি সম্ভাবনা হচ্ছে- মাহদিবাদি আন্দোলন। অতিতেও মুসলিম উম্মাহ যখন বড় ধরনের জাতীয় সংকটে নিপতিত হয়েছে তখনই মাহদীবাদের ধারণা তাদের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আব্বাসী শাসনের সূচনাকালে, তাতারীদের আক্রমনের মূখে, ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগে সুদানে মুহম্মদ আহমদ এবং সবশেষে উপনিবেশিত ভারতেও কাদিয়ানী সহ অনেকে নিজেদের মাহদি দাবী করেছিল। ৫ সে সময়ে মাহদীবাদে প্রভাবিত মুসলমানদের মধ্যে কেউ তাকে মাহদী মনে করেছিল কি না, এ ব্যাপারেও বিশুদ্ধ বা অশুদ্ধ কোন ধরনের বরাত আমি পাই নি, সম্ভাবনা হিসেবে বললাম। তবে মৌলিকভাবে ফজলে রসুল বাদায়ুনীর এ দাবী ভিত্তিহীন।

* বালাকোট তথা: আহমদ শহীদ এবং শাহ ঈসমাইল শহীদের আন্দোলন কি ওহাবী আন্দোলন ছিল ?

সৌদি আরবের নজদ এলাকায় ১৭০৩ সালে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী নামক ইতিহাসখ্যাত সংস্কারকের জ্ন্ম হয়। সে সময়ে আরবে বিভিন্ন বিদআত ও কুসংস্কারের প্রচলন ছিল। তিনি মুলত ইবনে তাইমিয়া এবং ইবনুল কাইয়ুমের চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিলেন। আবু যুহরা তার ইবনে তাইমিয়া বইয়ের শেষদিকে ওহাবী আন্দোলন সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ইবনে তাইমিয়া এমন একজন লোক, জীবদ্দশা থেকেই যার পক্ষ-বিপক্ষ দুই ধরনের লোক ছিল, তার পক্ষের লোকেরাও তাকে নিছক একজন মুজতাহিদের চেয়ে বেশিকিছু মনে করতেন না – কিন্তু আঠারো শতকে মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী সবচে আগ্রাসী কাজ করেছেন, তিনি দীর্ঘদিন তাদের কিতাবপত্র মুতালা করেন; ইবনে তাইমিয়াকে রীতিমতো আবু হানিফা, শাফিঈ, মালেক ও আহমদ রাহি. এর অবস্থানে এনে দাড় করান, এবং ইবনে তাইমিয়াকে ঘিরে গড়ে উঠে সালাফি / নজদী আন্দোলন। ফিকহ ও আকিদায় চার মাযহাব সহ উম্মাহর সকলকে ঠেলে দেওয়া হয় বিপরীত মেরুতে। ৬ মৌলিকভাবে এই হচ্ছে ‘ওহাবী আন্দোলন’।

কথা হচ্ছে, বৃটিশ শাসনে ওহাবী আন্দোলন সম্পর্কে বিচিত্র তথ্য ও সংবাদ হিন্দুস্থানের মুসলমানদের কাছে পৌছতো। সবমিলিয়ে তখন একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছিল উপমহাদেশে; এবং এই মিশ্র প্রতিক্রিয়া থেকে আলেম সমাজও প্রভাবমুক্ত ছিল না। ৭ ইংরেজরা যখন শাহ আহমদ শহীদ রাহি. এর তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়ার ব্যাপকতা এবং দলে দলে মানুষের অংশগ্রহন দেখে ইংরেজ শাসক ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে গেল, তারা তখন ওহাবী আন্দোলনের ব্যাপারে হিন্দুস্থানের এই মিশ্র আবহকে কাজে লাগিয়ে কর্মীদের উদ্দীপনাকে নিস্তেজ করার জন্য প্রথমত প্রচার করল যে, সৈয়দ সাহেব ইংরেজদের শুভাকাঙ্খি ও বন্ধু । দ্বিতীয়ত সৈয়দ সাহেবের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তারা বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালালো এবং এই আন্দোলনকে ওহাবী বলে প্রচার চালালো। বিশেষত, উইলিয়াম হান্টার এ বিষয়টিকে আরও ধোয়াশাপূর্ণ করেছে তার দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস বইয়ে। ৮

হান্টারের দেওয়া তথ্যের নাকামি বোঝার জন্য আপনাদের জন্য একটা উক্তি তুলে ধরছি, সে লিখেছে “আব্দুল ওহাব সর্বপ্রথম এইসব জঘন্য কাজকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। ক্রমান্বয়ে তার মতাবলী একটি ধর্মীয় মতবাদের রুপ ধারণ করে এবং ওহাবী মতবাদ নামে বিস্তার লাভ করে। ভারতীয় মুসলমানদের অধিকাংশ-ই এখন এ মতাবলম্বী। ৯ খেয়াল করেন, হালামলে সালাফি ইসলামের এতো বেশি প্রচারণা এবং সৌদি রাষ্ট্রের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতার পরও সালাফিরা উপমহাদেশে সংখ্যালঘু। দুইশো বছর আগে কিভাবে তারা ‘অধিকাংশ’ হয় ! সুতরাং বালাকোটকে ‘ওহাবী’ বলে হান্টার ঠিক কি ধরনের ওহাবী চিন্তার কথা বলছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। আদতে আমরা যতদূর অনুমান করতে পারি, তাতে মনে হয়- আরবে সৌদ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা থেকে হান্টারের একটা বদহজম হয়েছে, সে মনে করতে শুরু করছে যে, যেকোন বিপ্লবী ও আন্দোলনবাদি চিন্তাই ওহাবী চিন্তা।

মুলত হযরত ঈসমাইল শহীদ ছিলেন শাহ ওলীউল্লাহী খান্দানের লোক। ইমামে রাব্বানীর পর উপমহাদেশের অন্যতম মুজাদ্দিদ হচ্ছেন শাহ ওলীউল্লাহ রাহি.। এই অঞ্চলে হাদিসপাঠে ব্যাপকতা, কুরআনের ফারসি অনুবাদ, তাসাউফ, অর্থনীতি এবং মাযহাব সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে সংষ্কারমুলক মতামত ছিল তার; তার ব্যাপারেও (লা-মাযহাবী) মাযহাব বিরোধীতার গুজব তুলেছিল অনেকে, কুরআনের অনুবাদের জন্য অনেকে তাকে রীতিমতো কাফের আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে- শাহ ঈসমাইল ওলীউল্লাহী খান্দানের একজন সদস্য হবার সুবাদে সংষ্কারমুলক বিপ্লবী চিন্তার উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন, শিরক-বেদআত, কু-সংষ্কারের বিরুদ্ধে তাজদিদী প্রস্তাব পেশ করেছেন। অবশেষে দুঃখজনকভাবে তিনিও ওহাবী হিসেবে সমালোচিত হলেন। উবাইদুল্লাহ সিন্ধি সহ বেরেলভী ধারার একটা বড় অংশ তাকে এবং বালাকোট আন্দোলনকে ওহাবী হিসেবে সমালোচনা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাওলানা সিন্ধীর মতে, বালাকোট আন্দোলন সফল না হবার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে- এতে শাওকানিয়াত, ওহাবিয়াত অথবা আরো পরিষ্কার করে বললে গায়ের মুক্বাল্লিদিয়াতের সংমিশ্রণ ঘটেছিল’।

মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নাদভী মাওলানা সিন্ধীর এ মত সম্পর্কে বলেন, ‘এই আন্দোলনের ঝান্ডাবাহীদের মধ্যে ফিক্বহী ঝগড়া-ঝাটি অথবা জোরে আমীন ও রাফ‘উল ইয়াদায়েনের মাধ্যমে বিদ‘আত উৎখাতের চিন্তা কখনোই স্থান পায়নি। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ ও অন্যান্য যারা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের লেখা বই-পুস্তক, বক্তৃতা-বিবৃতি, তর্ক-বিতর্ক, পত্রাবলী ইত্যাদি মওজুদ আছে। সেসব থেকে দলীল দিতে হবে। জিহাদ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল আক্বীদা-বিশ্বাসের সংস্কার, আমল সংস্কার, তাওহীদের প্রচার-প্রসার, বাতিল খন্ডন, অবৈধ রসম-রেওয়াজের অবসান ঘটানো এবং ইসলামী বিধি-বিধান চালু করা। বাকী যেসব কথা তাদের নামে বলা হয় তা দু’একজনের কথা, যা এ ক্ষেত্রে দলীল হওয়ার উপযুক্ত নয়। … তবে এটা হ’তে পারে যে, এ আন্দোলন ইত্তেবায়ে সুন্নাতের যে জজবা সৃষ্টি করেছিল তার প্রভাবে হয়তো অনেকে ওহাবী আন্দোলনের সমর্থক হয়ে যায়। ১০ সুলাইমান নদভীর বিশ্লেষণ বাস্তবসম্মত ; এ ধরনের ফলাফল ইতিহাসে ঢের বেশি। নিকট অতিতে আজাদ সুবহানী, ওবাইদুল্লাহ সিন্ধীর চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে মাওলানা ভাসানী এবং আবুল হাশিমরা যে ধরনের কৃষক-শ্রমিক-প্রজাদের অধিকার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা দিনশেষে মার্ক্সবাদী/ বামপন্থীদের অধিকারে চলে যায়, ইভেন ‘ইসলামের মর্মকথা’ বইয়ের লেখক আবুল হাশিমের ছেলে হয়ে উঠে প্রখ্যাত বদরুদ্দীন উমর। ভাসানীর ছেলেরা এখন বামপন্থী আন্দোলনের ক্রীড়নক। বালাকোট আন্দোলনে সুন্নতের ইত্তেবা, কুসংষ্কার দূরীকরণ, তাওহীদের প্রচার ইত্যাদি বিষয় ছিল মৌলিক প্রেরণা, যেখান থেকে তৎকালীন বহু আহলে হাদিস অনুসারীরাও শরিক হয়েছিল আন্দোলনে। এই ব্যাপারটা কিছু কিছু সালাফিদের নজরে এসেছে, অনেক ব্রেলভীদের লেখাও এই সত্য প্রকাশিত হয়েছে- মাসিক আত-তাহরীরে একটা প্রবন্ধে ‘বালাকোটে সালাফিদের অংশগ্রহন’ বিষয়ে আলাপ করতে এসে লেখক দেখাচ্ছেন যে, এছাড়া খালীক আহমাদ নিযামীও ওহাবী মুজাহিদদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার কথা যারা তুলেছেন তাদের দাবী প্রমাণসহ খন্ডন করেছেন। তিনি ‘১৮৫৭ সাল কা তারিখী রোযনামচা’ (১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক দিনলিপি) গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আন্দোলনে (অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের আন্দোলনে) কার্যকরীভাবে অংশগ্রহণকারী অনেককেই সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয়। বখত খাঁ আলেমদের সাথে যেভাবে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখতেন তাতেও এটা ফুটে ওঠে যে, তিনি সাইয়েদ ছাহেবের আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ১১ সালাফি ওয়েবসাইট মাজলিসুত তাহকিকিল ইসলামির ‘মুহাদ্দিস ফোরামে’ এক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে, বাবা-দাদা সুত্রেই শাহ ঈসমাইল শহীদ হানাফি ছিলেন। তিনি নিজেও একথা অকপটে স্বীকার করতেন। সমস্যা হচ্ছে, অনেকে রাফউল ইয়াদাইন এবং তাকলিদ সংক্রান্ত তার কিছু মতামত দেখে সংশয়ে পড়ে গেছে, কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে উনি হানাফিই ছিলেন। ১২

ফতোয়ায়ে দারুল উলুমে এক লোকের সুআলের জবাবে বলেন, তিনি সুন্নতের অনুসারী অনেক বড় হানাফি আলেম ছিলেন। শাহ ওলিউল্লাহর নাতি ছিলেন এবং শাহ আব্দুল আজীজের ভাতিজা। গাইরে মুকাল্লিদরা অনেক সময় দাবি করেন যে, ঈসমাইল শহীদ হানাফি ছিলেন। কিন্তু এ তথ্য ঠিক না। ১৩ তাদের সম্পর্ক ছিল মুলত শাহ আব্দুল আজীজের সাথে। এ ব্যাপারে নদভী তার বইতে লেখেন, “আহমদ শহীদ হযরত শাহ আব্দুল আজীজের খেদমতে হাজির হন। সৈয়দ সাহেবের বুযুর্গদের সাথে বহু থেকেই রুহানী ও জ্ঞানগত সম্পর্ক ছিল। সৈয়দ সাহেবকে পেয়ে প্রথমে মুসাফাহা, কোলাকুলি ও পারষ্পরিক পরিচয়ের পর তিনি অত্যন্ত আনন্দ ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। অতঃপর তাকে আপন ভাই আব্দুল কাদিরের নিকট অবস্থান করার ব্যবস্থা করেন। হযরত শাহ আব্দুল আজীজ এবং শাহ আব্দুল কাদির এর সোহবত ও খেদমতে থেকে তিনি এরুপ আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করেন যা বড় বড় মাশায়েখে কেরামের বিরাট রিয়াজত ও মুজাহাদা দ্বারা হাসিল হয়ে থাকে। কিছুকাল পর শাহ আব্দুল আজীজের থেকে খেলাফত ও এজাযত নিয়ে তিনি নিজের জন্মস্থান রায়বেরেলিতে ফিরে আসেন।” ১৪

সর্বপরি, মুসলিম ইতিহাসে মুজাদ্দিদ বা সংষ্কারকদের একটা জিনিস খেয়াল করবেন, প্রায়ই তাদের উত্তরাধিকার নিয়ে পরবর্তীদের মধ্যে বিতর্ক জারি থাকে। প্রত্যেকেই তার সাথে এক ধরনের আত্মীয়তা অনুভব করেন। শাহ ওলীউল্লাহ দেহলভী এর বড় প্রমান; কারণ তাদের গোটা চিন্তাপ্রকল্পকে একত্রে ধারন করাবর মতো সক্ষম মানুষ পরবর্তীতে খুব কমই জন্মে। ফলে পরবর্তীতে তাদের চিন্তাকাঠামো ঘিরে গড়ে উঠে নানা মত ও পথ। তেমনি কিছু লোক থাকে যারা তাদের সংষ্কারকাঠামোকেই প্রশ্ন করতে উদ্দ্যত হয়।

তথ্যসূত্র:

১. নূর নূর চেহরে, ২৯৭ পৃ.

২. তাযকিরাতুল ওয়াসিলিন, মুহাম্মাদ রজিউদ্দিন বাদায়ুনি, ২৫২ পৃ.

৩. ওহাবী তাহরিক, গোলাম রাসুল বাদায়ুনী, ৫৪ পৃ.

৪. প্রাগুক্ত, ৫৫ পৃ.

৫. আল-মাহদি ওয়াল মাহদাবিয়া, আহমদ আমিন পৃ. ২৩

৬. ইবনু তাইমিয়া ফিকহুহু ওয়া আরাউহু, আবু যুহরা, ৪৩০ পৃ.

৭. এজন্য মওলানা মনজুর নোমানী ‘আব্দুল ওহাব কে খেলাফ প্রপাগান্ডে আওর ওলামায়ে দেওবন্দ মে উন কি আছারাত’ নামে একটি কেতাব লেখেন; এখানে তিনি বিশেষভাবে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর বিপরীতে যেসব অন্যায় অভিযোগ সমাজে এবং আলেমদের মধ্যে হাজির ছিল, সেগুলোর অপনোদন করেন।

৮. উইলিয়াম হান্টার লিখেছে, “ধর্মীয় নেতারা ১৮২২-২৩ সালে মক্কা সফরের পর অনাড়ম্বর নিষ্ঠাবান জীবনযাপনের নীতিমালা নিরুপিত ও প্রচারিত হয়। সফরকালে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, পবিত্র নগরীতে মরুভূমির জনৈক বেদুঈনের প্রচেষ্টায় ব্যাপক সংস্কার প্রবর্তিত হয়েছে। তার নিজের চিন্তাধারার সঙ্গে এ সংস্কার নীতির মিল ছিল। … দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, ৪৩ পৃ.

৯. দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, উইলিয়াম হান্টার, ৪৫ পৃ.

১০. মাসিক মা‘আরিফ, আযমগড়, ফেব্রুয়ারী ১৯৪৩, পৃ. ৯৯

১১. মাসিক আত-তাহরির, আগস্ট ২০১৪

১২. মাজলিসুত তাহকিকিল ইসলামি, সালাফি ওয়েবসাইট

১৩. ফতোয়ায়ে দারুল উলুম, ৩/ ১৪৩২ পৃ.

১৪. ঈমান যখন জাগল, আবুল হাসান আলী নদভী, ২৮ পৃ.

আগের সংবাদ‘পরিবার পরিকল্পনার বিষবৃক্ষ’ : রাষ্ট্র যেভাবে বন্ধ্যাত্বকরণে উৎসাহিত করছে
পরবর্তি সংবাদরোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করতে পারছে না মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলো