ফতোয়ার ছয় শহিদ : যাঁদের রক্তে অর্জিত হয়েছে ফতোয়ার হক

ফতোয়ার ছয় শহিদ: যাঁদের রক্তে অর্জিত হয়েছে ফতোয়ার হক

রাগিব রব্বানি:

সেদিন ছিল ২০০১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। হাইকোর্টের ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিলের দাবিতে পল্টন ময়দানে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বানে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. সমাবেশে যোগদানের জন্য লালবাগে তাঁর নিজস্ব কার্যালয় থেকে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পল্টনের সমাবেশে তাঁর আর যোগ দেওয়া হয়নি। এই দিনই শায়খুল হাদিস আজিজুল হক রহ.-এর প্রোগ্রাম ছিল দিনাজপুরে। রাতের বেলা প্রোগ্রাম শেষে ঢাকা ফেরার পথে গাজিপুর থেকে তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়-বিরোধী আন্দোলনের মূল কাণ্ডারি ছিলেন এ দুজন। আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সরকার ভেবেছিল আন্দোলনের এই দুই প্রাণপুরুষকে গ্রেপ্তার করলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু ফল দাঁড়াল ঠিক এর বিপরীতটা। জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দিলে যেমন হয়, পুরো বাংলাদেশ সেভাবে গর্জে উঠল তাঁদের গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে। ৩-৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। চলতে থাকে সরকারের দমন-পীড়নও।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড়হুজুর ও জামিয়া ইউনুছিয়ার তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা সিরাজুল ইসলাম রহ. ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারির হরতালের পর ঘোষণা দেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক এবং মুফতী আমিনীকে মুক্তি না দিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাগাতার আন্দোলন চলবে। ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি হরতালের ঘোষণা দেন। ৫ ফেব্রুয়ারিও মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর।

৬ ফেব্রুয়ারি ভোর হবার আগে আগেই পুরো শহরে বিডিআর ও পুলিশের বিশেষ ফোর্স মোতায়েন করা হয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এবং ৬ ফেব্রুয়ারির ৬ শহিদের শাহাদতের প্রত্যক্ষদর্শী মুফতী এনামুল হাসানের সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। তিনি সেদিনকার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ফজরের আগে আগেই বিডিআর ও পুলিশের বিশেষ ফোর্সের উপস্থিতিতে পুরো শহর ছেয়ে যায়। জামিয়া ইউনুছিয়া থেকে নামাজের আগে আগেই অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। ফজরের নামাজের পর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবকয়টি মাদরাসার ছাত্র-উসতাদ এবং শহরের ধর্মপ্রাণ তৌহিদি জনতা হরতাল কর্মসূচি পালনের জন্য রাস্তায় নেমে আসেন।

মুফতী এনাম বলেন, ফজরের পর জামিয়া ইউনুছিয়া থেকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সহকারে আমরা শহরের প্রাণকেন্দ্র টিএ রোড হয়ে কালিবাড়ির দিকে যাই। কালিবাড়ি পৌঁছুতেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের বাধা দেয়। আমরা পুনরায় ফিরে আসি টি এ রোডে। এবং এখানেই অবস্থান করে হরতাল কর্মসূচি পালন করতে থাকি।

যেভাবে ঝরে পড়ে ছয়টি তাজাপ্রাণ

মুফতী এনাম বলেন, ধীরে ধীরে বেলা বাড়তে থাকে। পুলিশ এবং বিডিআর সদস্যরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আমাদের ঘিরে রাখে। আমাদের নানাভাবে বাধা দিতে থাকে, ফলে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও বিডিআর যাকে পারছে, গ্রেপ্তার করছে।

এদিকে সেসময়কার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর মাদরাসার বর্তমান শিক্ষক মাওলানা বোরহানুদ্দীন জানান, বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এবং বিডিআর সদস্যরা আন্দোলনরত জনতার অবস্থানকে ক্রমশ সংকুচিত করে আনছিল। বেলা ১০টার দিকে তারা একটা লাল ব্যানার টাঙিয়ে ঘোষণা করে আন্দোলনকারীরা এই ব্যানার অতিক্রম করে যেতে পারবে না। উত্তেজিত জনতা তখন ব্যানার অতিক্রম করে আর তখনই শুরু হয় পুলিশ ও বিডিআরের নির্বিচার গুলি বর্ষণ।

মুফতী এনামুল হাসান বলেন, সারা শহরেই তারা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি বর্ষণ ও নির্যাতন শুরু করে। আন্দোলনে মাদরাসাছাত্র ছাড়াও সর্বস্তরের তৌহিদি জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। অসংখ্য মানুষ আহত হচ্ছিলেন। দুপুর পর্যন্ত এই তাণ্ডব চালিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় প্রশাসন। ততক্ষণে ছয়টি তাজাপ্রাণ ঝরে পড়েছে। প্রশাসনের নৃশংসতার শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন জামিয়া ইউনুছিয়ার ছাত্র হাফেজ তাজুল ইসলাম ও হাফেজ সাইফুল ইসলাম। সাধারণ তৌহিদি জনতার মধ্য থেকে প্রাণ দিয়েছেন শহিত মুখলিসুর রহমান, শহিদ সুজন, শহিদ আলাউদ্দিন ও শহিদ উসমান। এ চারজনই ছিলেন সাধারণ মানুষ। ধর্মীয় অনুভূতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা এ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।

মাওলানা বোরহানুদ্দিন ও মুফতী এনাম জানান, প্রশাসনের এ নৃশংসতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৌহিদি জনতা থেমে থাকেনি, শহীদদের রক্ত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরদিন থেকে আবারও আরও জোরদার আন্দোলনে নামেন তাঁরা।

কেমন আছে ৬ শহিদের পরিবার?

মাওলানা বোরহানুদ্দীনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ৬ শহিদের পরিবারগুলো সম্পর্কে। তিনি জানান, ফতোয়া আন্দোলনের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে এবং মুফতী আমিনী রহ. তখন এমপি হন। তিনি ছয় শহিদের প্রত্যেকের পরিবারকে সরকারিভাবে একটি করে বাড়ির ব্যবস্থা করে দেন।

শহরের পনিয়াউট এলাকায় ৩২ শতাংশ জায়গার ওপর টিনশেড ঘর নির্মাণ করে ছয় পরিবারের প্রত্যেকের জন্য তিন রুমের বাসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শহিদ মুখলেস ছিলেন বিবাহিত। তাঁর শাহাদতের পর তাঁর স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় এবং তাঁর বাবাও মারা যান। ফলে তাঁর নামে বরাদ্দ বাসা ভাড়া দিয়ে ভাড়ার টাকা নিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী। শহিদ সুজন অবিবাহিত, তাঁর বাবাও মারা গেছেন। বর্তমানে তাঁর মা বাসাটি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। আর বাকি চার শহিদের পরিবার তাঁদের নামে বরাদ্দ বাসাগুলোতেই অবস্থান করছেন।

শহিদদের রক্তের বিচার হয়েছে?

ফতোয়া আন্দোলনে শাহাদতবরণকারী এই ছয় শহিদের রক্তের বিচার কি হয়েছে? জানতে চেয়ে কথা বলেছিলাম ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও ফতোয়া আন্দোলনের অন্যতম নেতা মুফতী মুহাম্মদ তৈয়বের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ফতোয়া আন্দোলনের সেই সময়টা ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্ত। নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট তখন আওয়ামী লীগের ইসলাম-বিরোধিতা ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের কারণে তৈরি ধর্মপ্রাণ মানুষের সিম্প্যাথিকে কাজে লাগিয়ে বিজয়ী হয়েছিল। নির্বাচনে তারা ওয়াদা দিয়েছিল ফতোয়া-বিরোধী রায় বাতিল করার পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয় শহিদের বিচার ও তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে একটি করে বাড়ি তৈরি করে দেবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মুফতী আমিনী রহ.-এর প্রচেষ্টায় ছয় শহিদের পরিবারকে একটি করে বাড়ি দিলেও তাদের পাঁচ বছরের শাসনামলে শহিদের বিচার তো দূরের কথা, ফতোয়া-বিরোধী রায়টা পর্যন্ত বাতিল করেনি বিএনপি-জামায়াত প্রভাবিত জোট।

মুফতী তৈয়ব জানান, মুফতী আমিনী ও শায়খুল হাদীস রহ. বারবার অনুরোধ এবং নিজেদের সর্বাত্মক চেষ্টা দিয়ে সরকারকে বলেছেন এইসব বিষয়ে, কিন্তু বিএনপি তাঁদের কথা কানেই তুলতে রাজি হয়নি। মুফতি আমিনী রহ. তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আলেমদের সঙ্গে বিএনপির এই গাদ্দারি খুব শিগগির তাদের দীর্ঘ পতন ডেকে আনবে।

মুফতী তৈয়ব বলেন, আজ হয়েছেও তাই। বিএনপির বর্তমান যে দুর্দশা, অদূর ভবিষ্যতে আর কখনও তারা ক্ষমতায় আসতে পারবে কি-না, সন্দেহ। তবে ছয় শহিদের রক্ত বৃথা যায়নি। তাঁদের শাহাদাতের হয়তো বিচার হয়নি, কিন্তু যে আওয়ামী লীগ ফতোয়া-নিষিদ্ধের রায় দিয়েছিল, সে আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করেছে।

একদিন হয়তো এভাবেই ছয় শহিদের রক্তের বিচার হবে এই মাটিতে। বিচার হবে ইসলামি আন্দোলন-সংগ্রামে বিগত দিনে আরও যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, পান করেছেন শাহাদতের অমীয় সুধা, তাঁদের তপ্ত খুনের। এমনটাই আশা ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতী মুহাম্মদ তৈয়বের।

আগের সংবাদবিস্মৃত ছয় শহিদ: ফতোয়া বিভাগগুলোতে নেই কোনো স্মৃতি ও স্মরণ
পরবর্তি সংবাদএবার রাজশাহী সীমান্ত থেকে ৫ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ