রাগিব রব্বানি
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারির মধ্যদিয়ে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব স্টাফ লেফটেনেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
তারপর টানা ৯ বছর রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দেশ শাসন করেছেন। ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়া এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা নিয়ে সমালোচনা থাকলেও তাঁর এই শাসনামলে দেশের রাস্তাঘাট, নৌ-যোগাযোগ, বিমান ও টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুত, জনশক্তি রপ্তানি ইত্যাদি খাতে উল্লেখযোগ্য কাজ করে গেছেন তিনি। পাশাপাশি দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রাণের কিছু দাবিও পূরণ করে গেছেন। তারমধ্যে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা, সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববার থেকে পরিবর্তন করে শুক্রবারে নিয়ে আসা, মসজিদ-মন্দির ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের বিদ্যুৎবিল মওকুফ করা উল্লেখযোগ্য।
রেডিও-টেলিভিশনে নামাজের আগে আজান সম্প্রচারের কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশে ছিল না। এরশাদের নির্দেশেই রেডিও এবং টেলিভিশনে সর্বপ্রথম আজান সম্প্রচার চালু হয়েছিল। সে ধারাবাহিকতায় এখনও নামাজের আগে দেশের রাষ্ট্রীয় রেডিও-টেলিভিশনে আজান দেয়া হয়।
১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ যখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন, তাঁর ক্ষমতার পতন-উন্মুখ এই সময়েও ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে নিরঙ্কুশ ভালোবাসা এবং প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি।
এবং ইসলাম ও মুসলিম-বান্ধব তাঁর এসব কাজের কারণে সমস্ত বিতর্ক এবং সমালোচনা একপাশে রেখে ধর্মপ্রাণ মানুষ এরশাদকে আলাদা একটা মূল্যায়ন করে এসেছেন। বিশেষত গত রোববার (১৪ জুন) এরশাদ যখন ইন্তেকাল করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নির্দ্বিধায় শোক প্রকাশ করেছেন ধর্মীয় সমাজ।
তাঁরা বলছেন, এরশাদ তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অশ্লীলতা আমদানি করলেও ইসলাম ও মুসলমানের সুবিধা ও কল্যাণে স্থায়ীভাবে কিছু ভালোকাজ করে গেছেন। তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে অনেকেই প্রার্থনা করেছেন–আল্লাহ যেন তাঁর এসব ভালোকাজের ওসিলায় তাঁর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত এক মন্তব্যে ইসলাম বিষয়ক বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক মাওলানা আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদই সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার আমলে যতটা উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছিল, তার আগে-পরে কেউ সেটা ছাপিয়ে যেতে পারেনি। ইসলামের পক্ষে তিনি যতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, অন্য কাউকে ততটা নিতে দেখা যায়নি। আমি বলছি না, তিনি ইসলামের নিখাদ সেবক ছিলেন; তবে অন্তত তাঁর সমকালের অন্যদের চেয়ে আন্তরিক ছিলেন।’
সিলেটের ইসলামিক ফিকহ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মুফতি জিয়াউর রহমান তাঁর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘তুলনামূলকভাবে আ.লীগের চেয়ে বিএনপিই মরহুম এরশাদের প্রতি বেশি ক্ষ্যাপা৷ এর কারণটাও রাজনৈতিক৷ বিএনপি এরশাদের কাছ থেকে ততটা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে পারে নি, যতটা ফায়দা নিয়েছে আ.লীগ৷’
মুফতি জিয়া বলেন, ‘আমরা মরহুম এরশাদকে বিএনপির চোখেও দেখতে চাই না, আ.লীগের চোখেও দেখি না৷ রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে নিজস্ব বিবেচনাবোধ থেকে আমরা তুলনামূলক একজন সফল রাষ্ট্রনায়ককে মূল্যায়ন করব৷ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁকে অনেক নাটকীয়তার মধ্যে চলতে হয়েছে৷ সবগুলো সিদ্ধান্ত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিতে হয়েছে৷ আমার কাছে মনে হয়েছে এর পেছনে বড় দুটি কারণ–এক. তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলাসমূহ৷ দুই. তাঁর দলের প্রায় সবাই তাঁর আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্ন পথে চলা৷’
তিনি আরও বলেন, ‘আরও অনেক বাধ্যবাধকতা, সীমাবদ্ধতা ও শৃঙ্খলাবদ্ধতার এক কঠিন জীবন পার করেছেন সাবেক এই প্রেসিডেন্ট৷ যেহেতু তিনি আজ নেই৷ তাঁকে নিয়ে ট্রল কিংবা বাজে মন্তব্য না শরিয়ত সমর্থন করে, না বিবেক সায় দেয়৷ আল্লাহ তাঁর ভালোকাজগুলোর ওসিলায় তাঁকে ক্ষমা করুন।’
এরশাদের ইন্তেকালের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন ইসলামি ঘরানার বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও ইসলাম টাইমস সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদও।
রোববার রাতে পোস্ট করা ওই স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, ‘এরশাদ ইন্তেকাল করেছেন। ‘৮৪ সালের পর থেকে তার ভূমিকার কথা মনে পড়ে। ৮৬ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত শীতকালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন জমে উঠতো। পুলিশি দৌড়, টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ বিষয়গুলি তখনই চিনেছি। ক্ষমতার বাইরে তাঁর রাজনীতি ও জীবনটাও আমাদের সামনে। নানা রকম শিরোনাম, সিদ্ধান্ত, সিদ্ধান্তহীনতা।’
মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘এরশাদের ক্ষমতাকালটা ছিল টিনএজার বাংলাদেশের। ক্রম বর্ধমান শহুরে জীবন। আর আমাদের কৈশোর জুড়েও ছিল সেই কাল। তিতা-মিঠার মিশেল। স্মৃতির যে একটা মায়া থাকে, সেই মায়াটা ওই সময়টা নিয়েই। তাঁর সময়ে এরশাদ কঠোর ও কৌশলী ছিলেন। আজকের দিন পর্যন্ত দেখলে তাঁর সময়টাকে অত কঠোর ও কৌশলী মনে হয় না।’
তিনি বলেন, ‘এরশাদের সুবিধা ছিল, তাঁর কোনো ‘মতাদর্শ’ ছিল না। এজন্য কোনো পক্ষের প্রতি তাঁর কোনো বাড়তি জেদ ছিল না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যা যা করা দরকার, কৌশলে কঠোরতায় শুধু তা তা করেছেন। অপরদিক থেকে এটা তাঁর একটা বড় অসুবিধাও ছিল।’
মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘এরশাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধাটা ছিল, তিনি জিয়ার পরপর এসেছেন। মানুষের তাজা স্মৃতি জিয়ার সঙ্গে তুলনায় তাকে বারবার ফেলেছে। এতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে, না চাইতেও হেরে যেতে হয়েছে। ২০০৩ সালে একবার তাঁর টেবিলের সামনে ৪/৫ জনের সঙ্গে বসেছিলাম। একটি স্মারকগ্রন্থে লেখার আমন্ত্রণ নিয়ে। আধা ঘণ্টা খানেক কথাবার্তা-চা খাওয়া হয়। বৈঠকে তার আচরণ ছিল ভদ্রজনোচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘নানাভাবে শুনেছি, ব্যক্তিগত আচরণ, কথাবার্তায় এরশাদ অত্যন্ত সৌজন্যশীল ছিলেন। কত মানুষের কত যৌক্তিক কষ্টই তো আছে, তাঁকে নিয়ে। জানি এবং বুঝি। তবু আমার কথাটা বলি, আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন।’