|| তাসনিফ আবীদ ||
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে চলছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ। এবারের হামলাকে বিশ্লেষকরা বলছেন, হামাস কর্তৃক স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। নিজেদের স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনিদের এমন সংগ্রাম কিন্তু নতুন নয়। গত ৭৫ বছর ধরেই দখল হওয়া নিজেদের মাতৃভূমি উদ্ধারের জন্য লড়াই করছে মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিরা।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য এ পর্যন্ত সেখানে গিয়ে স্বশরীরে অনেক দেশের যোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশেরও ছিলেন অনেকে; যারা ১৯৮০’র দশকে ফিলিস্তিনের হয়ে ইসরাইলি আগ্রাসন ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শরীক হতে স্বেচ্ছায় ছুটে গিয়েছিলেন লেবানন। এছাড়া লেবাননে প্রবাসে থাকা অনেক বাংলাদেশীও শরীক হয়েছিলেন এই লড়াইয়ে। তাদেরই একজন হাফেজ মাওলানা জাফর আহমেদ ফারুকী রহ.। যিনি ছিলেন ঢাকার জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসার ছাত্র।
জাফর আহমেদ ফারুকীর জন্ম ১৯৫৭ সালে। লালবাগ মাদরাসায় তিনি হিফজুল কুরআন ও দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। এ সময় তিনি হজরত হাফিজ্জী হুজুর রহ. সোহবতও লাভ করেন। এরপর ১৯৮১ তিনি চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসার হিফজ বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে তিনি ১৯৮৩ সালের জুনে লেবাননের প্রবাস জীবন গ্রহণ করেন। সেখানেই ফিলিস্তিনি এক টহল টিমের সঙ্গে হঠাৎ তার পরিচয়। তখন থেকেই শুরু হয় ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অংশগ্রহণ।
জাফর আহমেদ ফারুকী রহ.-কে নিয়ে ফাতেহের একান্ত আলাপ হয় তার ছেলে শরীফুল ইসলাম ফারুকীর সঙ্গে। তিনি জানান, আব্বু জীবিকার জন্যই মূলত লেবানন যান। সেখানে যাওয়ার পর PFLP নামের একটি দল (যারা হামাসের সঙ্গে জোটবদ্ধ) তাদের একটি টহল টিমের সঙ্গে আব্বুর পরিচয় হয় লেবাননে। সেখান থেকেই তিনি জানতে পারেন প্রচুর বাংলাদেশি যুবক ফিলিস্তিনের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য দেশ ছেড়েছেন। আব্বু তখন পিএফএলপি’র সঙ্গে যুদ্ধের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তারা আব্বুকে প্রাথমিক সাক্ষাৎকারের পর ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচিত করে। ট্রেনিংয়ে আব্বুর দেখা হয় দলটির প্রধান জর্জ হাবশের সঙ্গে।
যুদ্ধে থাকাকালীন ঘটে যাওয়া বিভিন্ন স্মৃতিকথা নিজের ছেলেদের সঙ্গে প্রায়ই ভাগাভাগি করতেন মাওলানা ফারুকী। সেই স্মৃতিকথা ফাতেহের সঙ্গেও ভাগাভাগি করেন শরীফুল ইসলাম ফারুকী। তিনি বলেন, ১৯৮৩ সালের শেষদিকে আব্বুকে একটি বাংকারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত করা হয়। যেখানে পালা করে সৈন্যরা ডিউটি দিতেন। বেশিরভাগ সময় রাতে দায়িত্ব পালন করতে হত। আব্বুর সঙ্গী ছিল একটা রেডিও এবং চায়ের ফ্লাস্ক। সম্মুখ যুদ্ধে কখনোই তাঁকে পাঠানো হয়নি, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বলিষ্ঠদের প্রাধান্য দেয়া হত। এছাড়া জাতীয়তা এবং ধর্মীয় পরিচয়ও এখানে মুখ্য ছিল। (উল্লেখ্য, পিএফএলপি ছিলো বামধারার একটা দল, যে কারণে আব্বু তাদের সঙ্গে তেমন মিশতে পারছিলেন না। তিক্ত একটি অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সেখানে বেছে বেছে তাদেরই রিক্রুট করা হতো যারা বামধারার চিন্তাযুক্ত এবং এরাই লাইমলাইটে থাকতো সবসময়।)
‘১৯৮৪ সালে আব্বুর সঙ্গে শেখ সাবের নামে হামাসের এক কোম্পানি কমান্ডারের দেখা হয়। (শেখ সাবের নিজে একটি দল চালাতেন। পরে হামাস প্রতিষ্ঠিত হলে হামাসের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন।) আব্বু তার সঙ্গে হামাসের অফিসে দীর্ঘসময় থাকেন। শেখ সাবেরের সঙ্গে অনেকবার লেবানন এবং সিরিয়া যান আব্বু। এসময় ফেনীর একজন যোদ্ধার সঙ্গেও দেখা হয়।’ -যোগ করেন শরীফুল ইসলাম ফারুকী
তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালের শুরুতেই আব্বু দেশে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে উঠেন। কেননা যে চিন্তা নিয়ে তিনি ফিলিস্তিন গিয়েছিলেন তা পুরন হচ্ছিলো না। সরাসরি যুদ্ধে তিনি অংশ নিতে পারছিলেন না। এমনকি দেখা পাচ্ছিলেন না বাংলাদেশ থেকে আসা প্রচুর যোদ্ধারও। কারণ তারা ট্রেনিং এবং ভৌগলিক কারণে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ছিলেন। এর পাশাপাশি নানান দল উপদলের ব্যাপারও ছিল। শেষে, ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে শেখ সাবেরের সহযোগীতায় আব্বু দেশে ফেরেন।
‘আব্বু জীবনের শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিন সম্পর্কে কোনো খবর দেখলেই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতেন। এমনকি আমি যেহেতু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কথা জিজ্ঞেস করতাম, আমাকে বলতেন নানান খুঁটিনাটি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আব্বু চাইতেন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন।’ -জানান মাওলানা ফারুকীর ছেলে
হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর হাতেগড়া শাগরেদ, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী এই যোদ্ধা ২০২১ সালের ৮ আগস্ট চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ফারুকীয়া হাফেজিয়া মাদরাসা ও ফারুকীয়া দাখিল মাদরাসা নামে চট্টগ্রামের মিরসরাইতে তার প্রতিষ্ঠিত দু’টি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মাঝে ইলমে দ্বীনের আলো বিলাচ্ছে। এছাড়া তার স্মৃতি সংরক্ষণে কাজ করছে হাফেজ জাফর আহমদ ফারুকী ফাউন্ডেশন।