মুজিব হাসান:
ফিলিস্তিন-ইজরাইলের এবারের সংঘাতে মারাত্মক প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে ইজরাইল; যা ভয়ংকর তথ্যসন্ত্রাসেরই নামান্তর। গাজায় প্রতিদিনই চলেছে ধ্বংসযজ্ঞ, ঘটেছে প্রাণহানি। এর জবাবে হামাস প্রতিরোধ হামলা করেছে। কিন্তু ইজরাইল একে ফিলিস্তিনের ‘আত্মঘাতী হামলা’ বলে অপপ্রচার চালিয়েছে এবং ইজরাইলের ওপর ‘সাংঘাতিক আক্রমণ’ হিসেবে দেখিয়েছে। মূলত ইজরাইল ফিলিস্তিনের ওপর এই হামলাকে সহনীয় করে তুলতে বিশ্বের চোখে ধুলো দিতে চেয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে অনেক ভুল তথ্য ও ভুয়া খবর। এমন কিছু তথ্য ও খবর যাচাই করেছে বিবিসি। তাদের ভাষ্যমতে, এমন উসকানিমূলক অনেক ভিডিও, ছবি ও বক্তব্য ছড়িয়েছে, যেগুলো ভিন্ন ঘটনার বা আদৌ ঘটেনি। দুনিয়াজুড়ে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এরকম কয়েকটি ভুয়া খবরের ফ্যাক্ট চেক নিচে পেশ করা হলো :
রকেট ছোড়ার নকল ভিডিও
গাজা থেকে ইজরাইলের দিকে লক্ষ্য করে ছোড়া রকেট বিস্ফোরণে ফিলিস্তিনিরা নিহত হয়েছে–এরকম দাবি করেছেন ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মুখপাত্র অফির গেনডেলম্যান। টুইটারে একটি ভিডিও শেয়ার করে গেনডলম্যান বলেছেন, গাজার ঘনবসতি এলাকা থেকে ইজরাইলকে লক্ষ্য করে রকেট ছুড়েছে হামাস। তাদের ছোড়া ২৫০-এর বেশি রকেটের এক তৃতীয়াংশ পড়েছে গাজায়। এর বিস্ফোরণেই নিহত হয়েছে ফিলিস্তিনিরা।
কিন্তু বিবিসির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই ভিডিওটি অনেক আগের এবং এটি গাজার নয়, সিরিয়ার। ২০১৮ সালে দেরা শহরে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী অভিযান চালিয়েছিল। তখন তাদের রকেট ছোড়ার যে ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল, এটি সেই ভিডিও।
টুইটার কর্তৃপক্ষ এই টুইটকে ‘ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফ্যাক্ট চেকে ক্লিপটি নিশ্চিন্ত হয়েছে সিরীয় যুদ্ধের বলে। পরে সমালোচনার মুখে পড়ে গেনডেলম্যান টুইটটি মুছে ফেলেছে
আয়রন ডোমের ধাপ্পাবাজি
ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ হামলা ঠেকাতে ইজরাইল গড়ে তুলেছে অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘আইরন ডোম’। এবারের আক্রমণে ইজরাইলি আইরন ডোমের প্রচুর তারিফ শোনা গেছে। ইজরাইলের দাবি, ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে তাদের এই আইরন ডোম কার্যকর। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই?
আল-জাজিরা গবেষকদের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদন দেখিয়েছে, আইরন ডোমের কার্যকারিতা মাত্র ১০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সীমিত। বাকিটা ইজরাইলি প্রোপাগান্ডা।
এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ, এবার ইজরাইলি হামলার জবাবে গাজা থেকে ৪ হাজারের বেশি রকেট ছুড়েছে হামাস। ১১ দিনের সংঘাতে হামাস আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ হারে রকেট ছুড়েছে। ফলে দেখা গেছে, হামাসের ছোড়া অনেক রকেটই ইজরাইলের আয়রন ডোমকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে। অনেক রকেট আঘাত হেনেছে ইজরাইলি ভূখণ্ডে। এতে ইজরাইলের জানমালের ক্ষতি হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বেরিয়ে এসেছে আয়রন ডোমের দুর্বলতা।
আয়রন ডোমের এই দুর্বলতার কথা ইজরাইলের সামরিক বাহিনীর বিবরণেই উঠে এসেছে। এটা তাদের জন্য একটা বড় ধাক্কাই বটে। এমনকি ইজরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পর খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বক্তব্যেও এসেছে আয়রন ডোমের দুর্বলতার প্রসঙ্গ। আয়রন ডোম প্রতিরক্ষব্যবস্থা পুনরায় গড়ে তুলতে ইজরাইলকে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছে। ‘ভরসার’ জায়গা থেকে ধাক্কা লাগায় চোটটা একটু বেশিই পেয়েছে ইজরাইল।
জানাজা মিছিলের ভুয়া ভিডিও
ফিলিস্তিনে ইজরাইলি হামলায় কেউই নিহত হয়নি এবং নিহতদের যে জানাজা মিছিল দেখানো হয়, এর পুরোটাই ভুয়া–সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব অনেক ইজরাইলি নেটাগরিক এরকম একটি জানাজা মিছিলের ভুয়া ভিডিও শেয়ার করে এই দাবি তুলেছে। তাদের বক্তব্য হলো, গাজায় ইজরাইলি বিমান হামলায় এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে দাবি করে ফিলিস্তিনিরা তার ভুয়া জানাজা মিছিল করেছিল বিশ্ববাসীর সহানুভূতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে। ইজরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উপদেষ্টাও ওই ভিডিও শেয়ার করেছে। তাতে দেখা গেছে, একদল তরুণ কাফনে মোড়ানো একজনের লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সাইরেনের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তারা লাশ নিচে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে গেল। তখন একা পড়ে থাকা লাশটিও উঠে কাফনের কাপড় সরিয়ে হাঁটা শুরু করল।
বিবিসির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই ভিডিও ২০২০ সালের মার্চ মাসে পোস্ট করা হয়েছিল। তখন খবর বেরিয়েছিল, কোভিড-১৯ রোধে দেওয়া বিধিনিষেধ এড়ানোর কৌশল হিসেবে জর্ডানের একদল তরুণ ভুয়া জানাজা মিছিলের অভিনয় করেছিল। এই ভাইরাল ভিডিওকেই গাজার ভুয়া জানাজা মিছিলের প্রমাণ হিসেবে হাজির করার চেষ্টা করেছে ইজরাইল।
গাজায় ইজরাইলি জঙ্গি বিমান থেকে ফেলা বোমায় যখন শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছিল, সেইসময়ে এই ভিডিও প্রধান সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাপফর্মগুলোতে কয়েক শ বার শেয়ার করেছে ইজরাইলি আগ্রাসনের সমর্থক নেটাগরিকরা। ওই পোস্টগুলোতে ‘প্যালিউড’ (প্যালেস্টেনিয়ান হলিউড) হ্যাশট্যাগ দিয়েছে তারা।
ডামি ক্ষেপণাস্ত্রের ভুয়া ফুটেজ
ইহুদিদের হত্যা করার জন্য হামাস ফিলিস্তিনের বেসামরিক লোকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে এবং ফিলিস্তিনিরা ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ইজরাইলবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে–এরকম একটি টুইট ব্যাপকভাবে শেয়ার করেছে ইজরাইলি আগ্রাসনের সমর্থক নেটাগরিকরা। একটি ভিডিও ফুটেজ-সংবলিত টুইটে এ মর্মে দাবি করা হয়েছে, গাজার রাস্তায় ট্রাক-বেসড ক্ষেপণাস্ত্র এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নিচ্ছে ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র গ্রুপ হামাস। ভিডিওটিতে একটি শিশুকেও কথা বলতে শোনা গেছে। পোস্টদাতা ওই ইজরাইল সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। তার পোস্টে লেখেছে, আবারও আমরা দেখছি, ইহুদিদের হত্যা করার জন্য হামাস বেসামরিক লোকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
বিবিসির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ডামি ক্ষেপণাস্ত্রের এই ফুটেজ হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার নয়। ভিডিওটি ফেসবুকে প্রথম আপলোড করা হয়েছিল ২০১৮ সালে ২৫ নভেম্বর। সেখানে ক্যাপশন লেখা ছিল, ইজরাইলের গ্যালিলির আবু সান শহর থেকে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে। ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে বিশেষায়িত ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বেলিংকাটের গবেষক এরিক টোলের বিবিসিকে বলেছে, ক্ষেপণাস্ত্রের ডামিগুলো ইজরাইলের সেনাবাহিনীর মহড়ায় ব্যবহার করা হচ্ছিল বলে তার ধারণা। পরে টুইটার থেকে ভিডিওটি মুছে ফেলা হয়েছে এবং ভুল তথ্যের জন্য ক্ষমাও চাওয়া হয়েছে।