বলিউড থেকে কাশ্মীরের রণাঙ্গণে

মুনশী নাঈম

২০১৩ সালের ডিসেম্বর। কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী এবং ভারতীয় সেনাদের মাঝে একটি লড়াইয়ের উপর ভিত্তি করে বিশাল ভরদ্বজ নির্মাণ করছেন মুভি ‘হায়দার’। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করছেন টাবু এবং শহীদ কাপূর। পরিচালক খুঁজছিলেন একটি চকোলেট বয়, ১৫ সেকেন্ডের একটি দৃশ্যের জন্য।

আইজাজ তার ভাগ্নে, ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া, ১৩ বছরের সাকিবকে নিয়ে উপস্থিত হলেন সেন্টার লেক ভিউ হোটেলে। প্রথম দেখায় পরিচালকের চোখ শীতল। দুটো শটের এগ্রিমেন্ট সাইন করে সাকিবের হাতে পরিচালক তুলে দিলেন ১৪০০ রূপি।

অমর সিং কলেজে পরিচালক বিশাল ভরদ্বজের ক্যামেরার সামনে এই প্রথম দাঁড়ায় সাকিব। দৃশ্যটি হলো—অমরসিং কলেজে অনেক শিশু, তার মাঝে সাকিবও আছে। হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। অনেক শিশু মারা যায়। কিন্তু সাকিব চোখে ভয় এবং কাতরতা নিয়ে একাকী বেঁচে যায়। ১৫ সেকেন্ডের সংক্ষিপ্ত একটি শট দিয়ে সাকিবের জীবনে শুরু হয় এক নতুন জীবনের যাত্রা।

সংক্ষিপ্ত দুটি শটের জন্যই সাকিব দর্শক-নন্দিত হয়।

কাশ্মীরের বান্দিপোরার হাজিন এলাকার ছেলে সাকিব। বলিউড ব্লকবাস্টার ‘হায়দার’ মুভিতে ক্যামেরার সামনে প্রথম দাঁড়ালেও অভিনয়ে যুক্ত ছিলেন আরও আগে থেকেই। স্থানীয় থিয়েটারের অনেক নাটকেই অংশ নিয়েছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় তার প্রথম মঞ্চে অভিনয় ‘এই পথ’ নামের একটি শিশু নাটকে। নাটকটি শ্রীনগর ও ওড়িশায় প্রদর্শিত হয়েছিলো।

অভিনয়ের বাইরে

ফোক সং তথা লোকগানের প্রতি আলাদা একটা দুর্বলতা ছিলো তার। হাজিন এলাকায় কারো বিয়ে হলেই গীত গাওয়ার জন্য ডাক পড়ত সাকিবের। সাকিবের মামা আইজাজ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘২০১৬-এর নাজুক সময়। বুরহান ওয়ানির হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল কাশ্মীর। তখন আমার বিয়েতে বেশ কয়েকটি লোকসংগীত গেয়েছিলো সাকিব। শুধু সংগীত নয়, খাবারের প্রতিও আসক্তি ছিলো তার। প্রতিদিন ছয়টি করে ডিম খেতো।’

২০১৭ সালে এসএসসি পাশ করে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট সাকিব। সুম্বল নিউ গ্রিনল্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। তার বাবা, হাজিন পৌরসভার কর্মচারী, বেলাল আহমদ শেখ বলেন, ‘সাকিব ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতো। সারাক্ষণ ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ নিয়ে পড়ে থাকতো। ফুটবল খেলা তার প্রিয় ছিলো। মাঠে গিয়ে পড়ার ফাঁকে ফুটবল খেলতো।’
টার্নিং পয়েন্ট

একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় অন্য এলাকার এক ছেলের সাথে গভীর বন্ধুত্ব হয় সাকিবের। ছেলেটির নাম মুদাসির। হাজিন থেকে তিন এলাকা দূরে বসবাস করলেও, মুদাসির পড়ত বান্দিপোড়া জেলার হাজিনের সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে, নবম শ্রেণিতে। ফুটবল খেলার মাঠে দেখা হয় তাদের, বাড়ে বন্ধুত্ব, জমে ঘনিষ্ঠতা। কাছে আসে একে অপরের হৃদয়ের।

সাকিবের পরিবারে টানাপোড়েন ছিলো না। মুদাসির ছিলো তার উল্টো। পরিবারের টানাপোড়েন দূর করতে তাকে কাজ করতে হতো। তারপর স্কুল। মুদাসিরও ফুটবল-প্রেমী, নিজের অর্জিত টাকায় কিনেছিলো ফুটবল। তার বাড়িতে ছিলো অসুস্থ মা-বাবা, প্রতিবন্ধী ভাই এবং ১০ বছরের একটি বোন।

২০১৬ সালে ভারতীয় সৈন্যের ওপর পাথর নিক্ষেপের মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলো মুদাসির। তার বাবা রাশিদ এক সপ্তাহ দৌড়াদৌড়ি করে জামিন মঞ্জুর করিয়েছিলেন। পুলিশ তখন বলে দিয়েছিলো, ‘ভাবগতি ভালো না ছেলের। দেখে রাখবেন।’

মুদাসিরের সবচে আপন বন্ধু ছিলো, সবচে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলো ১৯ বছরের তরুণ আবিদ হামিদ মীর। মুদাসির একটা অন্যরকম অনুরাগ পোষণ করতো তার প্রতি। হাজিন থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সোপেরের অমরগরে ভারতীয় সৈন্যের এনকাউন্টারে নিহত হয় হামিদ মীর। ঘটনাটা মানতে পারে না মুদাসির। মারাত্মক আঘাত লাগে তার আবেগে, বিশ্বাসে, চিন্তায়, চেতনায়। আচ্ছা, আমাদের ভূমিতে আমরাই কেন বারবার মার খাই? আমরাই কেন এনকাউন্টারে মরি? হামিদ মীরকে হারিয়ে বড় একা হয়ে পড়ে মুদাসির। স্কুলে যায় মলিন মুখে, খেলার মাঠে অনুজ্জ্বল। ঠিক এই সময় পাশে দাঁড়ায় সাকিব। হাতে হাত রেখে ব্যক্ত করে একসঙ্গে এগিয়ে যাবার প্রত্যয়। বয়স এবং ক্লাসের তফাৎ সত্ত্বেও একে অপরের বন্ধু হয়ে ওঠে।

নিখোঁজ সংবাদ

২০১৮-এর ৩১ আগস্ট। দুপুরবেলা সাকিবের মা তাকে দোকানে পাঠালেন কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। রোদ মাথায় সাকিব বেরিয়ে যায়, আর ঘরে ফেরে না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধা। রব পড়ে যায় পরিবারে—সাকিব নিখোঁজ। সঙ্গে নিখোঁজ সাকিবের সবচে প্রিয় বন্ধু মুদাসির। কারো কোন খবর নেই৷ থানায় জিডি হলো।

সাকিবের মা পুলিশকে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘ছেলেটার কোন শখ অপূর্ণ রাখিনি, সব পূর্ণ করেছি। তবুও কেন ও চলে গেলো? পুলিশ সাহেব, একবার ছেলেটাকে খুঁজে এনে দিন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো, কিসের অভাব ছিলো তার?’

পুলিশ জানতে চায়, ঘরে স্বাধীনতা, পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হতো কিনা। সাকিবের বাবা স্পষ্ট জানান, ‘এসব নিয়ে কখনো কথা হতো না পরিবারে।’

সবার একটাই প্রশ্ন—কোথায় গেলো ছেলেটা! কী জন্য গেলো?

পুলিশ খুৃঁজে পেলে তাদের জানাবে বলে আশ্বস্ত করে।

শহিদ সাকিব

নিখোঁজ হয়ে যাবার পর নিজ গ্রাম হাজিনে কয়েকবারই এসেছিলো সাকিব। কিন্তু পরিবারের কারো সঙ্গে দেখা করেনি। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছে, আবার চলে গেছে। বন্ধুরাও বিষয়টি কাউকে জানায়নি।

৯ ডিসেম্বর, ২০১৮। শ্রীনগরের উপকণ্ঠে মুজগন্ড এলাকায় ভারতীয় সৈন্য এবং কাশ্মীর স্বাধীনতাকামীদের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হয়। টানা ১৮ ঘণ্টা চলে দমবন্ধ বন্দুকযুদ্ধ। এতে নিহত হয় তিনজন স্বাধীনতাকামী, আহত হয় একজন সেনা জওয়ান ও তিন বেসামরিক নাগরিক। স্বাধীনতাকামীদের পুলিশ চিহ্নিত করে—সাকিব, মুদাসির এবং আলী।

রণাঙ্গণে কেন এলো সাকিব?

বলিউড ব্লকবাস্টার ‘হায়দার’ মুভিতে সাকিব বেঁচে গেলেও, কাশ্মীরের ময়দানে বাঁচতে পারেনি। কিন্তু কথা হলো ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতো যে ছেলেটা, অভিনয়ে ছিলো যার মারাত্মক নেশা, হঠাৎ কী হলো তার—ছুটে এলো রণাঙ্গণে? এই কৈশোরে তুলে নিলো রাইফেল?

মুদাসিরের পরম আত্মীয় হামিদ মীর ভারতীয় সেনাদের এনকাউন্টারে নিহত হয়েছিলেন ২০১৭ সালে। বিষয়টি মুদাসিরের মনে জন্ম দিয়েছিলো ক্ষোভের। তার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিলো তখন—আমরাই কেন বারবার এনকাউন্টারের শিকার হই? মুদাসিরের পরিবারের বয়ান হলো—’মেন্টালি খুব এট্যাচড ছিলো সে হামিদ মীরের সাথে। তার মৃত্যুটা সে মেনে নিতে পারেনি। তার কাছে মনে হয়েছে এটা অন্যায়। এই চিন্তাটাই মুদাসিরকে অস্ত্র তুলে স্বাধীনতার শ্লোগান দিতে বাধ্য করেছে।’

হামিদ মীরকে হারিয়ে একা হয়ে পড়ে মুদাসির। তার এই একাকিত্ব পূর্ণ করে দেয় সাকিব। মুদাসির-ই সাকিবকে প্রভাবিত করে। তার চিন্তা ডায়ভার্ট দেয় অভিনয় থেকে স্বাধীনতার স্বপ্নে। সাকিবও হাতে তুলে নেয় রাইফেল।

এটিই প্রথমবার নয়, যখন কাশ্মীরি কিশোরেরা রাইফেল হাতে তুলে নিয়েছিলো। ২০১০ সালে কাশ্মীরে প্রতিবাদের এক নতুন জোয়ার এনেছিলেন বুরহান ওয়ানি। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১৫ বছর। ২০১৪ সালে স্বাধীনতার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলো ১৪ বছরের শেখ দাউদ। তার পরিবারের বয়ান—ভারতীয় সেনাদের চূড়ান্ত নির্যাতনই তাকে রাইফেল হাতে নিতে বাধ্য করেছিলো। ২০১৬ সালে শেখ দাউদ নিহত হন। ২০১৭ সালের ২৭ মে, নিহত হন কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী ১৫ বছর বয়সী ফয়জান আহমদ। তার পরিবারও রাইফেল হাতে তুলে নেয়ার জন্য ভারতীয় সেনাদের নৃশংসতাকে দায়ী করেছে।

জানাজা

সোমবার। হাজিনের ঈদগাহ প্রাঙ্গণে কাশ্মীরি মহিলা ও শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। তারা হাজির হয়েছে তাদের স্বাধীনতার দাবিতে প্রাণ দেয়া সাকিবের জানাযায় অংশ নিতে। সবার চোখে জল। একজন শহীদের জানাযায় অংশ নেয়ার চেয়ে বড় পূণ্য তাদের কাছে আর কিছু নেই।

সাকিবের বাবার মন স্মৃতিকাতর হয়। এই মাঠেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাকিব মুদাসির ফুটবল খেলতো। দৌড়াদৌড়ি করতো। আজ এখানেই হচ্ছে তার জানাযা। এমন কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে প্রতিদিন কাশ্মীরের সবুজাভ ভূমিতে? মানুষের সবচে বড় প্রয়োজন স্বাধীনতা। আমি তো আমার ছেলের সবচে বড় প্রয়োজনটাই পুরো করতে পারিনি।

চোখের জল মুছতে মুছতে সাকিবের বাবা বিলাল শেখ তাকবির তুললেন—আল্লাহু আকবার!

সূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস, স্ক্রল ডট ইন, নিউজ এইটিন

লেখক : তরুণ আলেম ও অনুবাদক 

আগের সংবাদঈসা খান : ভাটিবাংলার মহানায়ক
পরবর্তি সংবাদ‘আমি বড়ই হয়েছি শৈশব-কৈশোরের বন্ধুদের গুলি খেয়ে মরতে দেখে’