আরিফ মাহমুদ:
‘কলমের কালিতে লেখা চোখ বুলিয়ে পড়ে নেয়া যতটা সহজ, মানসপটে এঁকে নেয়া, মন ও মননে ধারণ করা এবং অনুভবের জগতে ঠাঁই দেয়া ততোটা সহজ নয়।’
জানি না—হুজুর যেখানে বসতেন, তার মাথার উপরে এই বাক্যটি লিখে কে লিখে টানিয়ে দিয়েছিলো। যতক্ষণ রুমে থাকতাম, সবচেয়ে বেশী চোখে পড়তোে এই লেখাটি। হয়তো লেখাটি হুজুরের কামরায় যাওয়া কারো দৃষ্টিই এড়াতে পারেনি। কিন্তু কজন ধারণ করতে পেরেছে। ধারণ করতে পারিনি আমিও। তবুও বলতে ইচ্ছে করে— হুজুর, আপনি আব্দুর রব। আপনার রব আপনার। আপনি আপনার রবের। তাইতো জীবনের প্রতিটি ক্ষণে রবকে ভালোবেসে, রবের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন।
আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কাঁদতে পারে অনেক বান্দা-ই। কিন্তু আপনার হু হু করে কেঁদে ওঠার দৃষ্টান্ত তো শুধু আপনিই। ইয়া হাইয়্যু, ইয়া কাইয়্যুম উচ্চারণ করতে পারে যে কেউ। কিন্তু এতোটা ভালোবাসা, এতোটা দৃঢ়তা ও নির্ভরতা নিয়ে উচ্চারণ করতে পারার দৃশ্য বিরল। আপনার হৃদয়ের গহীন থেকে যে দীর্ঘশ্বাস বেরুতো, কলমের কালিতে তা ফুটিয়ে তোলা কী সম্ভব! গাল বেয়ে সফেদ দাড়িগুলো সিক্ত করা অশ্রুফোঁটার চিত্র আঁকার সাধ্য কী আছে কোন শিল্পীর! মাহবুবে হাকীকীর প্রেমে আপনার ব্যাকুলতার তরজমা করতে পারবে কী কেউ কোনদিন!
আড়ালে-আবডালে, নীরবতা-নির্জনতায় সাধনা করে গেছেন সারাজীবন। অল্পেতুষ্টি আর অনাড়ম্বরতার জীবনে আমাদের শিখিয়ে গেছেন সত্যিকারের একটা মুসাফিরি জিন্দেগী। এ যেন রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সে বাণীরই পূর্ণ অনুসরণ—كن في الدنيا كأنك غريب او عابر سبيل
পুরো জীবন আপনার আবেগ এবং অনুভূতিতে মিশে ছিল রাসূলপ্রেম আর মদীনা। সৌভাগ্য হয়নি—আপনার দরসে বসে হাদীসে নববীর সারগর্ভ তাকরীরের সেই দুর্লভ দৃশ্যের সাক্ষী হবার। কিন্তু একদিন সৌভাগ্য হয়েছিলো এক আশেকে রাসূলের যবানিতে কাসিদা শ্রবণে আপনার আঁখিযুগলে টলটল করা অশ্রু অবলোকন করার। অশ্রুর ভাষা আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু স্মৃতির আয়নায় সেই দৃশ্যগুলো হাজার বছর বেঁচে থাকবে ইশকে রাসূলের এক জীবন্ত দাস্তান হয়ে। মদীনার নাম শ্রবণে-উচ্চারণে চক্ষু অশ্রুসিক্ত হতে পারে—হয়তো আপনাকে না দেখলে বিশ্বাস করা দুষ্কর ছিলো। মদীনার প্রেমে রাসূলে আরাবীর স্পর্শধন্য মাটি কাছে রাখা—এতো প্রেমের এক বিরল বহিঃপ্রকাশ! কজন বুঝার ক্ষমতা রাখে এই ভালোবাসা। কল্পনার দৃষ্টিসীমায় ভেসে উঠে আপনার ডান হাতের কাছে থাকা ছোট্ট কাঁচের শিশিটার গায়ে আপনার কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা ” مدینہ کا مٹی”। মদীনা থেকে হাদিয়া আসা আতরের শিশিটাকে মাথায় তুলে নেয়া। মদীনার খেজুরে পরম ভালোবাসা-মাখা কামড় বসিয়ে দেয়ার সময় আনন্দে চিকচিক করা চোখের চাহনি।
সুন্নতের প্রতি ভালোবাসা কেমন হয় বা কেমন হওয়া উচিত জানি না। তবে জীবনের প্রতিটি কদমে আপনার সুন্নতের অনুসরণ আমাদের জানিয়ে দিয়েছে, মদীনাওয়ালার প্রতি যার যত প্রেম সুন্নতে তার তত অনুসরণ। আপনি দেখিয়ে গেছেন। হাত ধরে শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু পারিনি গ্রহণ করতে। এ আমার ব্যর্থতা। কখনো হেসে কখনো ভালোবাসা-মাখা রাগে শাসনের সুরে বলেছেন। বুঝিনি। কানে ভাসে এক তালিবুল ইলমের মাথায় সুন্নতের বিপরীত চুল দেখে আপনার বলা কথাগুলো—‘যদি এখন তোর মরন আসি যায় কেমনে দাঁড়াইবি রাসূলের সামনে?’
আমরা তো পারি না এভাবে ভাবতে। আফসোস হয় নিজের জন্য। মনে পড়ে একদিন জুতার মাপ নেয়ার জন্য একটা সেন্ডেল নিয়ে আসা হয়েছিলো আপনার কাছে; জুতাটা পায়ে দিয়ে শুধু মাপ দিবেন। কিন্তু জুতাটা বাম পায়ের ছিলো। একটু উত্তপ্ত স্বরে সতর্ক করে বললেন, ‘জুতা বাম পায়ের কেন। পড়ার সময় সুন্নত ডান পা আগে পরা।’
ছোট থেকে ছোট। কিন্তু সেই সুন্নত পালনে আপনি বরাবরই তৎপর ছিলেন। যখন আপনি বার্ধক্যের দুর্বলতার শেষ সীমায় উপনীত, ফজরের আগে হাঁটতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছেন। রক্ত ঝরছে। ভ্রুক্ষেপ নেই। নামাজের সময় হয়ে গেছে। রক্ত তো থেমে যাবে। কিন্তু নামাজের সময়টা যদি সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। অযুর আগে মিসওয়াকের সুযোগ যদি না হয়। তাই সেই রক্তাক্ত অবস্থায় মিসওয়াক হাতে আপনি। জুমার দিন আগে আগে মসজিদে যাওয়া সুন্নত। জুমার ওয়াক্ত হয়ে গেছে আর আপনি কামরায় রয়ে গেছেন— মসজিদে যাওয়ার মত সুস্থতা যতদিন আপনার ছিলো এমন ইতিহাস হয়তো কেউ দেখেনি । মাথায় টুপি পড়া সুন্নত সবাই জানে। কিন্তু আমল কতটুকু! কোনদিন আপনাকে দস্তরখানায় দেখিনি মাথা টুপিবিহীন।
সবার প্রতি আপনার ভালোবাসা ছিল ঠিক রাসূলের মতো। রাসূল সা. সব সাহাবির প্রতি এমন ভালোবাসা প্রকাশ করতেন, প্রত্যেকে ভাবতেন, রাসূল সা. বুঝি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। এমনি ছিলো সবার প্রতি আপনার ভালোবাসা। এমনকি কেউ কেউ বলতো, হুজুর হয়তো নিজের সন্তানদের চেয়ে তাদের বেশী ভালোবাসেন। নিশ্চিন্তেই আপনার কাছে থাকা সবাই দাবী করতে পারতো, অন্যজনের তুলনায় আপনি তাকেই বেশী ভালোবাসেন। হুজুর, আপনি কী করে পারতেন! প্রতিটি কদমে আপনার ইচ্ছার বিপরীতে, আপনার নির্দেশ অমান্য করেছি। কিন্তু কোনদিন রাগ চেপে রাখেননি। কখনো শাসনে, কখনো গোপনে মাফ করে দিয়েছেন। আপনার সান্নিধ্যের নেয়ামতের কদর করতে পারিনি। তথাপি যখনই গিয়েছি কাছে টেনে নিয়েছেন। পরম ভালোবাসায় মাথায় হাত বুলিয়ে দুআ দিয়েছেন।
আপনি ছিলেন আপনার উপমা। আপনার ভালোবাসার কোন ব্যাখ্যা হয় না। মনের আয়নায় ভেসে ওঠে আপনার অতীতের স্মৃতিচারণ। সাহারানপুর থেকে যখন আপনি বিদায় নিয়ে ফিরছিলেন, আপনার শায়খ জাকারিয়া কান্ধলভী রহ. দাঁড়িয়ে সবাইকে বিদায় দিচ্ছিলেন। আপনিও দাঁড়িয়ে ছিলেন। সবার শেষে শায়খের বুকে আপনার মস্তক। শায়খ শাগরেদের নয়নভরা জল। শুধু যবানে নয়, কাজে-কর্মেও যে আপনি ফিরে যেতেন আপনার শায়খের অতীতে। কান্ধলভী রহ. ছাত্র যামানায় যেরূপ কোন কিতাব শেষ করার পর কিছু পয়সা পেতেন মিষ্টি খাওয়ার নামে, আপনার শাগরেদরাও আপনার কাছ থেকে পেতো কিতাব শেষ হওয়ার পর। সেদিন সবকের শেষে রাকিব নামের একজন তালিবুল ইলম এসেছিলো আপনার হাত ধরে। আমাকে বলেছিলেন আপনি, ‘ব্যাগডা ল।’ ব্যাগটা এগিয়ে দিতেই চেইনটা খুলে কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘ধর তোরা সবে মিলি চকলেট খাইস।’
আ’ম বয়ানে আপনার মুখে আপনার শায়খের বরাতে একটি শে’র কতবার শুনেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই।
چشم بند و گوش بند و لب بند
گر ندیدی نور حق بر من بخند
আপনি চোখ বন্ধ রেখেছেন। কান বন্ধ রেখেছেন। মুখ বন্ধ রেখে অন্তর খুলে দিয়েছিলেন। আপনার ভালোবাসা প্রসারিত হয়েছিলো আরশে আযীম থেকে মদীনা মুনাওয়ারা পর্যন্ত। আপনার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলো নিকট থেকে নিকটতম, দূর থেকে দূরতম ব্যক্তিটিও। কারো প্রতি রাগ অভিমান গোস্বা নয়। শুধু বিলিয়েছেন প্রেম। কারো নূন্যতম ক্ষতি আপনার স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে হয়েছে তা কল্পনাও করা সম্ভব নয়। আপনি ছিলেন জগতের ঝঞ্ঝাটমুক্ত এক নীরব সাধক। যশ-খ্যাতি ধন-সম্পদের মোহ আপনার কল্পনার দেড়গোরার কাছাকাছিও কোনদিন ঘেঁষতে পারেনি। স্বার্থ নামক তুচ্ছ বস্তুটা কোনদিন আপনার স্বপ্নের জগতেও অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। আপনি ছিলেন আপনার ব্যক্তিত্বের উপমায় প্রথম এবং শেষ।