মরু-প্রাসাদের ধূসর দেশে

হুজাইফা আওয়াদ

রাজস্তান। রুপালি মরুভূমি, ঐতিহাসিক সব স্থাপত্য, রাজকীয় ইমারত-প্রাসাদ, গোলাপি নগরী, এবং বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত এই স্থান। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে রুক্ষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি আকর্ষণীয় সংমিশ্রণ ঘটেছে এখানে। আবেগপূর্ণ গান, প্রাণবন্ত নৃত্য, প্রাচীন লোকঐতিহ্য ও হস্তশিল্পসমৃদ্ধ রাজস্তান মানেই উষ্ণ ও সরল জীবনধারা, যেকোনো ভ্রমণ পিপাসুকেই দূর থেকে আকর্ষণ করে হিন্দুস্তানের এই বর্ণময় ভূমি।

বহু আগ থেকে রাজস্তানের প্রতি একটা অজানা টান অনুভব করতাম, যা আরও প্রবলতর করে তোলে ইরানি আদলে নির্মিত এক মারাঠি আর্ট ফিল্মের চিত্রায়ন। শিল্পী তাঁর এ শিল্পকর্মে পূর্ণরূপে মরু-সংস্কৃতির ভাবাবেগ ফুটিয়ে তুলেছেন। ইন্ডিয়া আসার পরে শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, এবার বলা চলে হঠাৎ করেই মিলে গেল সে ফুরসত। সিদ্ধান্ত হলো আমাদের চারজনের। শীতই রাজস্তান ভ্রমনের উত্তম সময়, গ্রীষ্মকালীন কাটফাটা তীব্র রোদ্রে মরু সফর যে সুকঠিন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অতএব আর কিছু না ভেবে চটজলদি বের হয়ে পড়লাম আমরা।

প্রথম গন্তব্য আজমির। রাজধানী জয়পুর থেকে আরও দেড়শ কিলো দূরে অবস্থিত আজমির।সর্বমোট ছয়শ’ কিলোমিটারের সফর, অতএব মানসিক প্রস্তুতিও ছিল তেমনই। রাত সাড়ে নয়টায় দেওবন্দ স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে বসলাম, সারারাত ঘুমেই কেটে গেল, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, হারিয়ানা পাড়ি দিয়ে সকাল সকাল রাজস্তানে পৌঁছে গেল আমাদের ট্রেন। তবে এখান থেকে আজমির আরো চার-পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা।

আয়তনের দিক থেকে ইন্ডিয়ার সর্ববৃহৎ স্টেট রাজস্তান । ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর প্রসারিত থর মরুভূমি এই রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে। আর পুরো রাজ্যকে ঘিরে রেখেছে প্রাচীনতম পর্বতমালা ‘আরাবল্লি’।মরুময় অঞ্চল আর পাহাড়ি উপত্যাকা দিয়ে ট্রেইন ছুটে চলেছে, ফসলহীন ধূ ধূ ময়দানে কোথাও ময়ুর পেখম মেলে আছে, আবার কোথাও উটের পাল চড়ে বেড়াচ্ছে। আমি যেন এক কল্পনার রাজ্যে এসে গেছি, আরব মুলুকের মরুভূমির কল্পনা করেছি, আর এসব চিত্র মনের মাঝে এঁকেছি সারাজীবন, কিন্তু আজ আমি সত্যিই এগুলো সচক্ষে দেখছি! অদ্ভুত, অকল্পনীয় সব দৃশ্য চোখে পড়বে আপনার; এক সময়ের রাজপুত বংশের দ্বারা শাসিত এ মরু প্রান্তর। চার-পাঁচ ঘণ্টা অসাধারণ এক উপলব্ধির মধ্য দিয়ে চলে গেল।

দুপুর দুইটায় আমরা আজমির স্টেশনে নামলাম। সুফী সম্রাট হযরত মুইনুদ্দিন চিশতি রহ.-এর পুণ্যভূমি আজমির। পুরা শহরেই তাঁর ছাপ রয়েছে। স্টেশনটিও এর ব্যতিক্রম নয়, মাজার কিংবা কোনো মুসলিম স্থাপত্যের আদলে নির্মিত এ ষ্টেশনের স্ট্র‍্যাকচার। অপজিটে রয়েছে একটি ঘড়ি সম্বলিত সুউচ্চ মিনার, যা এই শহরের ঐতিহ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে। স্টেশনের পাশেরই এক মসজিদ থেকে ফ্রেশ হয়ে হোটেলে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। রাজস্তানি খাবারের খুব খ্যাতি আছে, অন্যান্য রাজ্যের চাইতে এ অঞ্চলের খাবারের স্বাদ আলাদা, ক্ষুধার্ত পেটে রাজস্তানি রুটিসহ ‘থালি’ খুব মজা করেই খাওয়া হলো (থালি বলা হয় এক প্লেটে সাজানো রকমফের সবজির বাহারকে)।

এবার ভ্রমণ আরম্ভের পালা। সিদ্ধান্ত হলো প্রথমেই আমরা ‘পুস্কর’ যাব, তারপর রাতে মাজার যিয়ারত হবে। একটা মারুতি গাড়ি ঠিক করলাম পুস্করের উদ্দেশ্যে। ‘পুস্করের’ সৌন্দর্য্য সম্পর্কে খুব একটা জানাশোনা ছিল না।আজমিরের নিকটেই; মাত্র ১৮ কি:মি: দূরত্ব।যাহোক, অন্তত এতটুকু বলতে পারি—আজমির এসে পুস্কর না দেখলে তিনি অবশ্যই গ্রেট কিছু মিস করলেন…।

পুস্কর ‘বাসাড্ডা’ (বাসস্ট্যান্ড) পর্যন্ত গাড়ি যায়।মরুভূমি অবধি উট যোগে যেতে হয়, আমরা চারজন মিলে একটা উটের গাড়ি ভাড়া করলাম, ভাড়া যদিও চড়া ছিল একটু, তবে লাইফের ফার্স্ট উটভ্রমণ বলে কথা, সেটাও আবার মরুভূমিতে, তাই ওসব কিছু না ভেবেই গাড়িতে উঠে পড়লাম। এখান থেকে গন্তব্য পাঁচ কি:মি:। শহুরে কোলাহল পেরিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই উট পাহাড় আর মরু প্রান্তরে ঢুকে পড়ল। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে আমাদের সবার মাঝেই, নিজের অজান্তেই চিৎকার করে উঠছি, আর আমাদের কাণ্ড দেখে মিটিমিটি হাসছে রাজস্তানি উটচালক। বয়সে খুব বেশি নয়, হালকা-পাতলা গড়নের ছেলেটি, আঞ্চলিক পাঞ্জাবি আর হিন্দির মিশেলে একটা ভাষা বলছে, বুঝতে একটু কষ্ট হলেও খুব ভালো লাগছে।

কিছুদূর যেতেই সে আমাদেরকে একটা প্রাচীন স্থাপনা দেখাল; পাথরের কারুকার্যমণ্ডিত একটি স্টেইজ। সামনে পঞ্চাশ-ষাট জন বসার মতো সমতল জায়গা। এটা সম্রাট আকবরের হাতে নির্মিত চবুতরা, বাদশা আকবর তাঁর অবকাশযাপনে এখানে আসতেন, রাতে আঞ্চলিক গানের আসর বসত, শানদার কাওওয়ালদের কাওয়াকিতে মাতোয়ারা হতো সবাই। কাশ্মীর থেকে শুরু করে সুদূর পাঞ্জাব, দিল্লি আর রাজস্তান পর্যন্ত কোনো সুন্দরতম স্থান তার হাত থেকে রেহাই পায়নি সম্ভবত।

যাহোক, মোঘলীয় স্থাপনাগুলোই তো আজ ইন্ডিয়ার অর্থনীতির বড় একটি অংশের চালিকাশক্তি বলা যায়।

দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। পুস্করের প্রতিটি স্থান বিস্ময়ে অবাক করে দেওয়ার মতো। মরুভূমির সাদা পাহাড়, পুস্কর লেক, গোলাবের বাগান, সবশেষে সূর্যাস্ত! সবই অপূর্ব। আপনি চাইলে রাজস্তানি পোশাক পরে উটে চরে ঘুরে দেখতে পারেন মরুভূমি। আমরাও এই অদ্ভুত পোশাক পরেছিলাম।দেখতে পুরা লেডিস পোশাক হলেও এটাই তাদের সুতীব্র গরমে রোদ থেকে সামান্য স্বস্তি লাভের মাধ্যম। মরুভূমিতে উট-ভ্রমণের আনন্দ আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, সে এক অন্যন্য স্বাদবোধ । এ ছাড়া সন্ধায় উঁচু পাহাড় থেকে পুস্কর শহর দেখে মনে হয় যেন আকাশের তারাগুলো মাটিতে নেমে এসেছে।

যাহোক, ধীরে ধীরে আধার ঘনিভূত হলো, আমরাও ক্লান্ত শরীর নিয়ে আবার ফিরে এলাম আজমির শহরে…

২.

রাত প্রায় নয়টা, শহরের এপাশটা নীরব হয়ে গেছে।ল্যাম্পপোস্টর হলদে আভায় পিচঢালা রাস্তা আর স্পাতের আইল্যান্ড জ্বলজ্বল করছে। কুয়াশাদের মিলনোৎসব আর শীতের প্রকোপ অনেকটা কম এখানে। কিছু প্রাইভেট ও অটো রিকশা ছাড়া রোডে তেমন কোনো চাঞ্চল্য নেই। আমরা চারজন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি, ‘জয়সালমির’ যাবো নাকি আজমির রাতে থাকবো—এ নিয়ে একটা শলা পরামর্শ হচ্ছিল আমাদের। এক ভদ্রলোক বিষয়টা সহজ করে দিলেন; সাশ্রয়ী মূল্যে মাজার সংলগ্ন কোন হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করবেন জানালেন। আদতে তিনি একজন অটো চালক, তবে আজমির শরিফের পার্শ্ববর্তী আবাসিক হোটেলগুলোর সাথে তার একটা চুক্তি আছে; ষ্টেশন কিংবা বাসস্ট্যান্ড থেকে কাস্টমার ম্যানেজ করে দিলে তাদেরও যৎসামান্য পকেট খরচ মিলে যায় এই আরকি।তাঁর কথা মতো আমরা দরগাহে চলে এলাম।

আজমির শরিফ

সপ্তম শতাব্দীর প্রখ্যাত বুজুর্গ, গরিবে নেওয়াজ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির রহ.-এর শহর। কথিত আছে তিনি ইরান থেকে আপন মুরশিদের হুকুমে বিশ্বময় দীন প্রচারে ব্রতী হন। তারই ধারাবাহিকতায় আফগান লাহোর হয়ে আজমির আসেন। প্রায় সাড়ে ৮০০ মিটার-সুউচ্চ একটি পাহাড়ের পাদদেশে শাগরেদ দসহ একটা আস্তানা গড়ে তোলেন, এবং এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে আজকের আজমির মাজার।

হিন্দুস্তানের মুসলিম ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও হাজার বছর ধরে সুফি-সাধকদের পূণ্যভূমি বলে পরিচিত এই শহরটি নানা দিক থেকে পর্যটকদের কাছে ব্যাপক আকর্ষণীয়। মাজার ও তার পার্শ্ববর্তী মনোরম পরিবেশের সাথে আরবল্লি পর্বত-শ্রেণী ও আনা সাগরের মিশেলে এক অদ্ভুত নৈসর্গিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে এখানে। মাজারকে কেন্দ্র করে পরিপাটি ছিমছাম একটা ছোট্ট শহর গড়ে উঠেছে, আবাসিক হোটেল থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, শপিং মল-মার্কেট সবই রয়েছে। প্রতিনিয়ত এখানে প্রচুর লোকসমাগম ঘটে। অর্ধরাত পর্যন্ত সমানতালে শহুরে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়।

আরিফ ভাই এলাকারই মানুষ। লম্বা গোলাপি রঙের কোর্তা আর মাথায় টকটকে লাল টুপি।দেখেই বুঝা যাচ্ছে দরবারভক্ত কেউ হবেন।তবে মানুষ হিসেবে খুবই আন্তরিক। তাঁর হোটেলেই আমরা থাকব সিদ্ধান্ত নিলাম। ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে আরিফ ভাইয়ের সাথে মাজার যিয়ারতে বের হয়ে পড়লাম। শৈশব থেকেই আজমির দেখার একটা ইচ্ছে ছিল।মাজারভক্তির কারণে না, তাদের কীর্তি-কলাপ কিছু দেখার জন্য। এবার সে ইচ্ছেটা পূর্ণ হলো।

‘পবিত্র’ স্থান, তাই চপ্পল-জোড়া বাইরে জমা দিয়ে যেতে হবে। প্রবেশপথের দুধারে হরেক রকমের মিঠাই, গোলাপ, আতর, সবুজ চাদর—আরও কত কিছুর দোকান! মিঠাই বা গোলাপ ছাড়া আমাদেরকে খালি হাতে যেতে দেখে অনেকেই অবাক হচ্ছে। মুসলিম এলাকা হলেও অনেক কিছুই অস্বাভাবিক এখানে, শুরুতেই একটা হোঁচট খেলাম; পূর্ণ মার্বেল আর মর্মর পাথরের আলিশান রাজকীয় প্রধান তোরণ। খোদাই করে ‘ভর দে ঝুলি’ টাইপের বিভিন্ন কাওয়ালি লেখা আছে, প্রশস্ত সিড়ি, সেখানেই কিছু লোক সেজদায় লুটিয়ে বাবার নাম ধরে আর্তি তুলছে। বড্ড অদ্ভুত! সব কিছুই মেনে নিতে হচ্ছে।

সামনে এগোলাম, আরিফ ভাই আমাদের গাইড হিসেবে সাথে আছে, এবং মওকা বুঝে সব বলে যাচ্ছে। গেটের মুখেই দুটি বিশালকায় সপ্তাশ্চর্যীয় ডেগ। এক সাথে পনেরো-বিশ হাজার মানুষের রান্না হয় এই ডেগে। এটা হলো বাবার পক্ষ থেকে আম যিয়াফত, মানে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত আতিথেয়তা।প্রতিদিন একবারই রান্না হয় এই ডেগে, যা বাদ মাগরিব খানকাহের শাহি লংগরখানায় পরিবেশন করা হয়। এখানে যাঁরা বিভিন্ন মান্নত পুরা হবে এই নিয়তে আসেন, তাঁদের কাছে এই খানার অনেক মূল্য!

রান্না ছাড়া বাকি সময় ডেগ দুটি ফাঁকা থাকে দানবক্স হিসেবে; চাল, ডাল, সেমাই, সুজি, হালুয়া রুটি—যার যা মান্নত সবই এতে দান করে। রান্নার আগে মই দিয়ে আট-দশজন এতে উঠে মান্নতের দান সেখান থেকে সরিয়ে আনে।খোদার কী ইচ্ছা, আমাদেরও সে আজিব দৃশ্য দেখার তওফিক হয়েছে।

আস্তানায়ে মামুল তথা হযরত চিশতী রহ.-এর খাস এবাদতগাহ রাত নয়টা বাজেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মূল কবর যিয়ারত করা সম্ভব না, তবে আস্তানার তিন পাশেই খোলা আকাশের নীচে সামিয়ানা টানিয়ে কাওয়ালির আসর বসেছে, ঢোল, তবলা, সিতারার সুরতানে খুব ভক্তির সাথে কাওয়ালি পাঠ করা হচ্ছে—

‘ভর দো ঝুলি মেরি ইয়া মুহোম্মোদো.. ”

হৃদয় ভরে শুনছে সবাই, কারও মন চাইলে উঠে যেয়ে কাওওয়ালের সামনে বিছানো শুভ্র চাদরে নজরানা পেশ করে আসছে।

দক্ষিণ পাশে একটা বড় সড় কামরা দেখিয়ে আরিফ ভাই বললেন, এটা খাছ মহল, মহিলাদের জন্য! কিন্তু অবস্থা খুবই বেগতিক দেখলাম, পুরুষ-মহিলা একসঙ্গে বসে বেশ মৌজ নিয়ে কাওয়ালি শুনছে! শ্রেণিভেদে কোনো ইয়ত্তা নেই কারো। এখানে এলে যেন সব একাকার হয়ে যায়। খোদা জানে এসব মারেফতি তত্ত্বের ভেদ রসহ্য! যতই দেখছি অবাক হচ্ছি।

আরিফ ভাই আমাদেরকে মসজিদে নিয়ে গেলেন। মাজারের ভেতরেই তিনটি মসজিদ রয়েছে। একটা সম্রাট আকবরের নির্মিত, আরেকটা তাজমহল-স্থপতি সম্রাট শাহজাহানের, শেষটা মহল্লারই মসজিদ। আমরা শাহজাহানের মসজিদে বসলাম। আগ্রার তাজমহল যে আঙ্গিকে একাধিক দেশের মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত, এটাও ব্যতিক্রম নয়। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত একেবারে পুরোটাই পাথুরে কারুকার্যময়। কিন্তু দুঃখজনক হহলেও সত্য, মসজিদগুলো রীতিমতো বিরানই পড়ে থাকে; এখানকার জনপদের কার্যকলাপ সেরেফ মাজার-কেন্দ্রিক।

মাজারের উত্তর পশ্চিম কোণে হযরত রহ.-এর পুকুর আছে, এখান থেকে তিনি অজু-গোসল সারতেন। এটাকে খুবই গুরুত্ববহ মনে করা হয়। পহেলা রজব থেকে ১০ই রজব পর্যন্ত এখানে বাৎসরিক ওরস হয়, কয়েক লক্ষ মানুষের আগমন হয় তখন। পুকুরটা সে মৌসুমেই কেবল খোলা হয়, আর ‘তা’যিয়া মোবারক’ এখানেই শুকানো হয়।

মোটকথা যেসব জাহেলি রেওয়াজ-রুসুমের কথা দেখলাম বা শুনলাম, এগুলো দেখে যেকোনো মুসলিম হৃদয়ই ব্যথিত হবে। মাজারভক্তির নামে এদের সেজদা আর শিরকি কর্মকাণ্ড দেখলে যে কেউ মর্মাহত হতে বাধ্য! উপলব্ধি করলাম, এখানে কর্তব্যরত প্রত্যেকের ভেতরে-ই বিভৎস এক পাশবিক রূপ রয়েছে।টাকার প্রতি প্রবল উৎসুক ও লোভী তারা। টাকা ছাড়া মানুষ তাদের কাছে মূল্যহীন!
(আল্লাহ আমাদেরকে দীনের সঠিক বোধ দান করুন)

আমাদের সাথে আরিফ ভাই বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছেন, কতদিন থাকব জিজ্ঞেস করলেন। আমরা বললাম কাল ভোরেই জয়পুর রওয়ানা দেওয়ার ইচ্ছা।

তিনি বললেন,মূ ল আজমিরের আকর্ষণের জায়গুলোই তো দেখেননি! এখনই যাওয়ার নাম নিচ্ছেন! ওই যে পাহাড়ের উপরে সুসজ্জিত আলোকস্তম্ভ দেখছেন, ওইটা হলো ‘গাওসুল আজম কা চিল্লা’। আর তারও উপরে একটা মিনারায় বাতি জ্বলতে দেখছেম, সেটা ‘তারাগারহ’। এখান থেকে পায়ে হেঁটে সাড়ে বারো কি:মি: পাড়ি দিতে হয় ওখানে যেতে হলে। তবু আপনাদেরকে যেতেই হবে, পথেই পড়বে সম্রাট আকবরের ‘ঢাঈ দিন কা ঝুপড়ি’ তথা মাত্র আড়াই দিনে নির্মিত প্রাসাদ। এসব না দেখলে আফসোস রয়ে যাবে আজীবন, আর তিন পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ‘আনা সাগরের’ জলতরঙ্গ; শেষ বিকেলে নীলাভ আনা লেকের পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত অবলোকন করার অনুভূতিই তো আলাদা।

অতএব আমাদের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন এলো…।

আঁধারের সকল ঘনঘটা পেছনে ফেলে সুবহে কাজিবকে পরাস্ত করে সুবহে সাদিকের আগমন। প্রভাত-সমীরণে মৃদু বায়ু আর রৌদ্রস্নাত পরিবেশে ধীরে ধীরে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে শহর। এবারের মিশন পাহাড় ট্র‍্যাকিং। সুদীর্ঘ সাড়ে বারো কিঃমিঃ পাহাড়ি পাথুরে পথ পাড়ি দিতে হবে,ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে! জীবনে এই প্রথম এতো দীর্ঘ পায়দল ভ্রমণ। সাথে পর্যাপ্ত পানিয় ও হালকা নাশতা নিয়ে নিলাম। ট্র‍্যাকিং ‘সু’ পড়ে সবাই প্রস্তুত। আলাদা এক অনুভূতি সবার মাঝে। মাজারের ঠিক বা হাতে একটা সরু গলি চলে গেছে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে। এটাই আমাদের গন্তব্যের পথ। ভিন্ন পথে যান চলাচলের ব্যবস্থাও রয়েছে, তবে অনেকেই এ পথে হেটে যায়, আমরাও হেটেই যাবো পাহাড় ও পাহাড়িয়া সংস্কৃতি সঠিক উপলব্ধির জন্য।

সকাল আটটা। আমাদের অভিযান শুরু হলো। আঁকাবাকা সরু রাস্তা ধরে চলেছি আমরা চারজন। কিছুদূর পর্যন্ত পীচঢালা মসৃণ, সমভূমি,তবে খুব বেশী দূর যেতে হলো না,শুরু হয়ে গেলো প্রকৃত পাহাড়ি রাস্তা। জগদ্দল সব পাথারের স্থায়ী স্থাপনে ধাপে ধাপে অধিরোহণী সোপান তৈরী করা হয়েছে,দেখেই বুঝা যাচ্ছে আজ থেকে কয়েকশ’ বছরের প্রাচীন নির্মাণ এসব। হাজার বছরের জনবসতি, আর শত কালপরিক্রমার সাক্ষী এ শহর।

কালই শুনেছি ঢাঈ দিন কা ঝুপরির কথা।এবার খুব কাছ থেকে দেখছি। দেড় কিঃমিঃ মাথায় পড়বে এটা। অন্যসব স্থাপনার চেয়ে এটা একটু আলাদা,নেপথ্যের ইতিহাসটাও অদ্ভুত। মোঘল সালতানাতের প্রতাপশালী সম্রাট আকবরের যুগ। সম্রাটের প্রাথমিক পর্যায়ে কোন সন্তান ছিলো না। শত চেষ্টা তদবিরেও কোন কাজ হচ্ছিলো না। একবার তিনি আজমির শরীফে এসে তৎকালীন সুফি সম্রাট সালিম চিশতির দ্বারস্থ হন,এবং দ্রুত-ই এর সুফল পান। মানে আকবরের বাচ্চা জন্ম নেয় দৈবক্রমেই, কিন্তু তিনি এর ক্রেডিটটা দেন সুফি মহাশয়কে। যাহোক,এ সুবাদে সম্রাট প্রতি বছরই দরগাহে মান্নত পূরণে আসেন।পাহাড় ভ্রমণ কালে এ স্থানটি হৃদয়ে আটকে যায়,মনের ফ্রেমে একটা স্বপ্নের প্রাসাদ আঁকেন তিনি,যেই কথা সেই কাজ। খাদেম খুদ্দামদের এই মর্মে আদেশ করেন যে-আমি এই স্থানে অবস্থান করবো মাত্র তিনদিন,অতএব এর মাঝেই নির্মাণকর্ম পূর্ণ রূপে সমাধা করতে হবে।

হাজারো শ্রমিক-মজদুরের পরিশ্রমে মাত্র আড়াই দিনেই নির্মিত হলো আকবরের স্বপ্নের প্রাসাদ।এ জন্য আজও মানুষের কাছে প্রাসাদটি ‘ঢাঈ দিন কা ঝুপড়ী’ (আড়াই দিনের স্থাপনা)নামেই পরিচিত। প্রাচীন এ প্রাসাদটা মোঘল সালতানাতের চিহ্ন হিসেবে আজও আপন রূপে দাঁড়িয়ে আছে।

পাহাড়ি উপত্যকা। বিভিন্ন মতবর্ণের বসতি। তবে অধিকাংশই মুসলিম, হিন্দু উপজাতিও আছে কিছু। সাপের মত বেয়ে চলা আঁকাবাঁকা সরু পথেরও শেষ নেই। জিজ্ঞাসা করে করে পথ এগুচ্ছি। অনেকে আবার আবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকছে আমাদের দিকে। কিছুদূর চলার পর যাত্রা বিরতি হচ্ছে,হালকা নাশতা করে আবারও আরোহণ। পথ যেন শেষ হতে চায় না, বিশেষত আমার একটু বেশীই কষ্ট হচ্ছিলো। আমাকে রেখেই ওরা এগিয়ে যাচ্ছে, আবার ক্ষণিক ঝগড়া করে ওদেরকে আটকে রাখছি। এভাবেই চলছি।

এবারও  রাস্তায় অন্তত পক্ষে ক্ষুদে বড় মিলিয়ে পনেরো থেকে বিশটা মাজার চোখে পড়েছে। কোথাও মাইকিং করে ইনাম চাওয়া হচ্ছে,আবার কোথাও বাবা স্বয়ং বসে গেছে ‘নজরানা’ আদায় করতে। ইসলামকে খোরাক বানিয়ে টাকা উসুলের কত কৌশল ও ভেল্কিবাজি হতে পারে- না দেখলে বোঝা সম্ভব না।সবারই লক্ষবস্তু একটাই। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে,ঘোড়ার কবরকে কেন্দ্র করেও মাজার বানিয়ে রমরমা ব্যাবসা চলছে এক শ্রেণীর।

আমাদের এক সাথী তো রীতিমত বিব্রতকর পরিস্থিতিতেই পড়ে গেলো। জনৈক সাধু বাবা তাকে ডেকে মহা সম্ভবনার কথা বলতে শুরু করলো-

“বাবা! তেরে আনদার নুর দেখা মেই নে!খাজা বাবা তুঝে মানযিলে মাকসাদ তাক পৌহচা দেগা,জিন্দেগি মে কাময়াবি তেরে পীছে ভাগে গি”

সমুদয় বাতাস দিয়ে শেষে বললো-বাবার হাতটা খালি ফিরিয়ে দিস না। আজীব ব্যাপার! টাকা কামাতে এতো ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে হয়! কিছুই বলার নেই। পাহাড় আর উপত্যকার সৌন্দর্য্য দেখে যতটা মুগ্ধ হচ্ছি, এদেরকে দেখে ঠিক ততটাই মর্মাহত হচ্ছি।

বহুপথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত শরীরে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে আমরা গন্তব্যে পৌছলাম ‘তারাগারহ’। মোঘল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত একটি তীর্থস্থান। তবে এটা শীয়া সম্প্রদায়ের।পাহাড়ের এই চূঁড়াতে বারো হাজার শহীদের সমাধি রয়েছে। ১১৯২ সনে সুলতান মোহাম্মদ শিহাবুদ্দিন ঘুরির ভারত অভিযানকালে তৎকালীন দিল্লি ও আজমির অধিপতি, রাজপুত বংশের সর্বশেষ ও প্রতাপশালী রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। সেখানে বারো হাজার মুসলিম শহিদ হন। এদের সবার সমাধিই আজমিরের এই সকল পাহাড়ে।মুজাহিদ বাহিনীর অন্যতম সিপাহসালার ছিলেন হযরত মিরা সায়্যেদ শহিদ রঃ।

তিনি ছিলেন হযরত হুসাইন রাঃ এর বংশপরম্পরার। তারই মাজারকে কেন্দ্র করে শত শত বছর যাবৎ শীয়া সম্প্রদায় কাছে এ স্থানটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ।ভেতরের পরিবেশটা খুবই সুন্দর,মনোমুগ্ধকর।চারোদিক সুসজ্জিত।বড় সড় একটা মসজিদ, ডানে শত শত শহিদের কবর,আর সামনে প্রশস্ত খোলা আঙিনা। আরিফ ভাই আগে থেকেই বলে দিয়েছিলেন, এখানে এসে কোন প্রকার উচ্চবাচ্য না করতে, কারণ শীয়ারা খুবই বদ মেজাজি হয়ে থাকে, রূঢ় আচরণ নাকি তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। আমরা চুপচাপ সব দেখে বের হয়ে এলাম।

সম্পূর্ণ বাইরে পাথর বসানো একটা খোলা বিশালাকৃতির কপাটবিহীন জানালা। এখান থেকে পুরো শহরটা দৃষ্টিগোচর হয়।সামনে খোলা প্রান্ত,সেখানে পর্বতারোহণের জন্য ব্যাবহৃত উট ঘোড়াগুলো বাধা রয়েছে।

হাজার হাজার ফিট উপরে পাহাড়ের চূড়ায় প্রাচীন পাথুরে মহলের সামনে উট, ঘোড়া আর এপাশে খোলা বাতায়ন পানে চাইলেই ঐ দূরে পর্বতে ঘেরা শুভ্রমৌলি শহর, মধ্যকার নীলাভ আনা সাগর,এর বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ কি সম্ভব!মুগ্ধতার মায়াজালে বিভোর আমি! জাদুমন্ত্রে আচ্ছন্ন আমি!
আমি মুগ্ধ! শুধুই মুগ্ধ!প্রকাশের আর কোন ভাষা নেই আমার কাছে।।

অবতরণে ভিন্ন রাস্তা ধরলাম, এটা তূলনামূলক শর্টকার্ট। তবে আফটার অল সমস্ত সৌন্দর্য্য ধারণ করে আছে আগের রাস্তাটাই। এ রাস্তাটা আমাদেরকে এক নতুন জিনিসের সন্ধ্যান দিলো, তা হল হরিণের মৃগনাভি।

হিন্দিতে বলে কস্তুরি আর উর্দুতে মেশক।আল্লাহর আজিব কুদরত, একটা গোস্তপিণ্ডের মাঝে পৃথীবির শ্রেষ্ঠতর খুশবু দিয়ে রেখেছেন তিনি। এটা হরিণের বৈশিষ্ট্য। শিকারকালে এ অংশটা কেটে রাখা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন রকমের মোডিফাই করে মেডিসিনের সাহায্যে হাজার হাজার টাকা মূল্যের আতর বানানো হয়। এতো সহজেই এ জিনিস পেয়ে যাব কল্পনাও করিনি। আনুখা জিনিস, আর কখনো নাও পেতে পারি, তাই সবাই কয়েকটা করে নিয়ে রাখলাম কাছে।

দুপুর প্রায় দুটো। দীর্ঘ পাহাড় ট্র‍্যাকিং শেষে আমরা অনেকটা ক্লান্ত। তবে ভ্রমণ বলে কথা, বিশ্রাম নিতে গেলেই অনেক কিছু মিস। যতই ক্লান্তি আসুক না কেন, নিজ গতিতেই চলতে হবে।

এবার আমাদের গন্তব্য বহু প্রতীক্ষিত আনা সাগর। খাওয়া-দাওয়া শেষে রওয়ানা হলাম; শহরের উপকণ্ঠেই। হেঁটেই চলে এলাম আনা সাগরে। সাগর নাম হলেও মূলত এটা বিশালায়তনের হ্রদ। ‘তারাঘড়’ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এ হ্রদটি তৈরি করেন দ্বাদশ খৃষ্টাব্দে দিল্লি ও আজমির-অধিপতি পৃথ্বিরাজ চৌহানের পিতামহ আনাজি তুষার । তাঁর নামেই হ্রদের নামকরণ। দ্বাদশ শতাব্দীতে ১৩ কিলোমিটার বিস্তৃত এ হ্রদ তৈরি করা হয় লুনি নদীতে বাঁধ দিয়ে অভ্যন্তরীণ পানির চাহিদা মেটানোর জন্য।

হ্রদের মাঝে রয়েছে একটি ছোট্ট দ্বীপ নৌকা ও স্পিডবোটে সেখানে যাওয়া যায়। ভারতীয় খাবারের রেস্তোরাঁ ও বিশ্রামাগার আছে।

হ্রদটি সম্পর্কে এক আজিব তথ্য স্থানীয়দের মুখ থেকে শুনতে পেলাম। হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী রহ. ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আজমীর আসেন। স্থানীয় জনগণ তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের হ্রদের পানি ব্যবহারে বারণ করেন। তিনি হ্রদের এক কাপ পানি দিতে তাঁদের অনুরোধ করলে তাঁরা সম্মত হয়ে পানি দেন। পরদিন হ্রদের পানি শুকিয়ে যায়। স্থানীয় জনগণের মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তাঁরা বুঝতে পারেন হযরত খাজা সাহেব রহ. অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দরবেশ ও আল্লাহর ওলি। তাঁর কাছে তাঁরা ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করেন এবং ওই কাপের পানি হ্রদে ফেলে দেয়ার হুকুম দেন। আল্লাহর কৃপায় পরদিন হ্রদ পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। এটা ছিল হযরত খাজা সাহেবের কারামত।

আনা সাগরের নৈসর্গিক পরিবেশ, মৃদুমন্দ হাওয়া ও স্থির নীলজলরাশি মন ভরে দেয়। চারদিকে পানিতে নানা প্রজাতির মাছের জলকেলি ও মুক্ত হাঁসের অবাধ বিচরণ হৃদয়ে দোলা দেয়, চোখ জুড়ায়। কিছু মানুষকে দেখলাম মাছকে আগ্রহভরে খাবার দিচ্ছে।আমরাও খাবার কিনে উৎসব করে খাবার ছিটালাম, খাবার দেওয়া মাত্রই পানিতে পড়ার আগেই শুভ্র পায়রাগুলো এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। অসাধারণ অনুভূতি।

এই শহরের সাধারণ মানুষ নগরজীবনের কোলাহল ছেড়ে সকালে-বিকেলে ব্যস্ততার ফাঁকে প্রাকৃতিক ছোঁয়ায় উৎফুল্ল হওয়ার বাসনায় ‘আনা সাগর’-এর তীরে এসে ভিড় জমায়। পর্যটকদের বিশ্রাম ও অবকাশ সুবিধা নিশ্চিত করে মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গির আনা সাগরের তীরে ‘দওলতবাগ’ নামে একটি সবুজ উদ্যান এবং সম্রাট শাহজাহান মর্মর পাথরের ৫টি পাকা প্যাভিলিয়ন তৈরি করেন। এ বাগানেই দু তিন ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম।আজকের বিকালটা খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। আনা সাগর তার আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে সূর্যাস্তের সময়,তখন মনে হয়, অনাদি অনন্তকাল এই পাহাড় আর স্বচ্ছ জলরাশির পাশে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিলেও খুব অল্পক্ষণই মনে হবে।

আর জোৎস্নালোকিত রাতে হৃদের হৃস্বতর তরঙ্গে আলোকজ্জ্বল শহরের প্রতিদীপ্তি যেভাবে মনে পুলক শিহরণ জাগায় হয় তা অনুভব করা যায় কিন্তু ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।

ওহে পর্বতকন্যা! কেন এতো মায়া তোমার!কেনই বা এতো রূপবতী তুমি!
স্বপ্নের রং-তুলি দিয়ে মনের মাধুরে একে রাখবো তোমায় আজীবন,ভুলবো না কখনো…..

(আনা সাগর সম্পর্কিত কিছু তথ্য উইকিপিডিয়া এবং প্রফেসর ড. আ ফ ম খালিদ সাহেবের ভ্রমন-বৃত্তান্ত থেকে নেওয়া)

৩.

নিথর মরুর এই বিরান প্রান্তর,বিচিত্র সংস্কৃতি, আর আরবাল্লী পার্বত্যভূমির যাপিত জীবন খুব কাছ থেকে দেখা হলো,হাজার বছরের প্রাচীনত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আজমির শহরের অলিগলি প্রায় সবই চষে ফেলা হলো এ দুদিনে। এবার রাজধানী জয়পুর বিজয়ের পালা,এখান থেকে ট্যুরিস্ট বাসের ব্যবস্থা রয়েছে, প্রতিনিয়ত ভোরে ছেড়ে যায়;পুরা জয়পুর শহর,পিংক নগরী, আরো কেল্লা প্রাসাদ সব দেখিয়ে ফের বিকেলে এখানে পৌছে দেয়।এই বাসেই আমরা টিকিট করলাম আরিফ ভাইয়ের কথামতো।

তৃতীয় দিন। ফজরের নামাযের পর পরই বাস ছেড়ে যাবে,আমরাও আরিফ ভাইদেরকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। রাজস্থান বলে কথা, ভোরের শীতটাও গায়ে লাগার মত না।পাতলা একটা শাল গায়েই গাড়িতে চেপে বসলাম। সাড়ে সাতটায় আমাদের বাস ছাড়লো।

কিছুক্ষণের মাঝেই শহুরে রোডঘাট ছেড়ে চলে এলো সুবিশাল হাইওয়েতে, সাটানো পিচঢালা সুবিস্তৃত রাস্তা,কোথাও থ্রি বাই থ্রি,কোথাও বা ফোর বাই ফোর লেন।দু ধারে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুরে ধু ধু ময়দান,আর দূর আরবল্লির কুয়াশাঘন দানবীয় পরিমণ্ডল। পর্বত ভেদ করে সূর্যের আলোকছটা হাইওয়েতে পড়ছে,আর প্রতিফলিত আলোর বিচ্ছুরণ মরীচিকার রূপ নিচ্ছে।

শাঁ শাঁ করে ছুটছে গাড়ি। কখন যেন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি।

হঠাৎ আমাদের গাইডের আওয়াজ! এর মাঝেই দু আড়াই ঘণ্টা চলে গেছে। ট্যুরিস্ট বাস, তাই প্রতি বাসেই কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত একজন করে গাইড থাকেন। আমাদের গাইড ছিলেন মুসলিম।

ওয়াসিম ভাই, খুব সরল, সজ্জন মানুষ। তাকে অবিরত বিরক্ত করেছি, কিন্তু সে সাদরে সাবালীলভাবে উত্তর দিয়ে গেছে।

শহরে ঢুকে পড়েছি। প্রবেশমুখেই বিশাল ক্যান্টনমেন্ট, রাজপুত সামরিক শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিলো আবার। কৌশলগত কারণেও দিল্লির নিরাপত্তার জন্য জয়পুর একটা বড় ঘাটি ছিলো তখন।৷ গাড়ি থামিয়ে বা দিকে তাকাতে বললেন গাইড, এটা হলো রাজমন্দির, এশিয়ার সর্ববৃহৎ ও শত বছরের প্রাচীন মন্দির এটি। একসাথে সাড়ে সাতশ’ত মত মানুষ বসে উপভোগ করতে পারে এখানে।সুবিশাল গেইট, আর রাজকীয় প্রাসাদের আদলে তৈরী ইমারত খানা বাইরে থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকলাম।গাড়ি আবার সামনে ছুটলো…।’

ওয়াসিম ভাই আমাদের নিয়ে এলো স্যুভেনির শপে। গাড়ী রিজার্ভ করে ট্যুরিস্ট হিসেবে ঘুরলে এই এক ভ্যাজাল। দোকানের যা কিছু আছে সব কিছুর অসাধারণত্ব আর গুণগান শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। রেজায়ী, শাল, জুতা, জয়পুরী রেশমী শাড়ী আরো কত কী! আমি তো একখানা রাজস্থানি রাজপুতানা পাংশু চয়েজ করলাম,কিন্তু দাম শুনে অবাক বিস্ময়ে মনে মনেই শুধু তৃপ্ত হতে হলো…

মহাসড়ক গুলোর ডানে বামে তাকালে অবাক বিস্ময়ে শুধু চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দু পাশের ইমারতগুলো একই শৈলীতে নির্মিত, অর্থাৎ বা’ দিকে যদি মন্দির থাকে তবে ডানে তাকালেও একই কাঠামোর আরেকটি মন্দির মিলবে,ডানে বড়সড় একটি মসজিদ থাকলে,বায়েও ঠিক অনুরূপ শৈলীর আরেকটি মসজিদ চোখে পড়বে,মোট কথা ২৫ কিঃমিঃ এর পিংক নগরীকে রাজা রাম সিং যেন শিল্পীর রং-তুলি দিয়ে অাঁকা স্বপ্নের একটি শহরকে বাস্তবেই এঁকে রেখেছেন..

দু’পাশের সুরম্য ভবনগুলোর অধিকাংশই উজ্জ্বল গোলাপী বা ফিকে পিংক বর্ণে রঞ্জিত,যা দেখে মনে হলো, এই নগরীর নামকরণ সার্থক হয়েছে।সমস্ত কাঠামো নির্মাণের জন্য বিশেষভাবে ব্যবহৃত পাথরের রঙের কারণে জয়পুরকে পিঙ্ক সিটি নামে অভিহিত করা হয়।

আর এই গোলাপী রঙের নিজস্ব একটা ইতিহাস রয়েছে। ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস এবং রানী ভিক্টোরিয়া ভারত সফরকালে জয়পুর আগমন করেন। যেহেতু গোলাপি আতিথেয়তার রংকে নির্দেশ করে, জয়পুরের মহারাজা রাম সিং রাজকীয় অতিথিদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য পুরো শহরটি গোলাপী রং করেন। শত বছরের ঐতিহ্যটি আজও অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে, জনসাধারনের জন্য নাকি গোলাবী রঙ আইনতঃ বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে…

বাস চলছে,আমরা দেখছি, ভাবছি, মাঝে মাঝে কল্পনার অদ্ভুত আন্দোলনে ডুবে যাচ্ছি।
এভাবেই হঠাৎ শেষ হয়ে এলো আমাদের সময়। ক্ষান্ত করতে হলো সুন্দরতম এ যাত্রা। অদ্ভুত ভালোলাগা আর সুখানুভূতি নিয়ে আবারও দেওবন্দের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চেপে বসলাম….।

লেখক : তরুণ আলেম 

আগের সংবাদইসলামিক স্টাডিজ : আমার ছোট্ট অভিজ্ঞতা
পরবর্তি সংবাদরোজা : আমেরিকান দাস মুসলিমদের সংগ্রামের প্রতীক