মুনশী নাঈম:
ইসলাম প্রচারের দায়ে বিশ্বখ্যাত ভারতীয় মুবাল্লিগ ও নন্দিত ইসলাম প্রচারক মাওলানা কালিম সিদ্দিকীর গ্রেফতারের এক বছর পার হলেও এখনও তিনি মুক্তি পাননি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে গ্রেফতার করে উত্তর প্রদেশের ‘সন্ত্রাস দমন ইউনিট’ । তার আগে একই অভিযোগে দিল্লির মাওলানা ওমর গৌতম ও মুফতি জাহাঙ্গীরকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তারাও মুক্তি পাননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজেপির ভয়াবহ অসাংবিধানিক কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে সরাসরি বাধা প্রদান। তারা চায় হিন্দুত্ববাদের একক উত্থান। তাদের সেই চাওয়ার পথে বাধা হয়েছিলেন বলেই মাওলানা কালিম সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করা হয়।
মাওলানা কালিম সিদ্দিকী ভারতের বিখ্যাত আলেম ও দাঈ। দেশটির হাজার হাজার অমুসলিম বিভিন্ন সময়ে তার আলোচনা ও প্রচেষ্টায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কাজে জড়িতসহ বিভিন্নভাবে মুসলমানদেরদের ওপর নির্যাতনকারী বহু অমুসলিমও তার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
নিজের ধর্মপ্রচার কি অপরাধ?
মাওলানা কালিম সিদ্দিকীকে যে কয়টি অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারমধ্যে অন্যতম হলো, তিনি ইসলাম প্রচার করেন। মানুষকে জান্নাতের সুখ এবং জাহান্নামের আজাবের কথা শোনান। তার কথায় ভিন্নধর্মাবলম্বীরা ইসলাম গ্রহণ করে। ইতোমধ্যেই তার দাওয়াতে হাজার হাজার অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছে।
তাহলে ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রচার কি অপরাধ? দ্য কগনেটকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, ডাঃ জাফরুল-ইসলাম খান বলেন, না, এা অপরাধ না। বরং সংবিধানেই এই অধিকার দেয়া আছে। ‘ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা’ শিরোনামে সংবিধানের ২৫(১) নং ধারায় বলা হয়েছে, বিবেকের স্বাধীনতা এবং ধর্মস্বীকার, ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা সব নাগরিকের রয়েছে। এই স্বাধীনতার ভিত্তিতে হাজার হাজার মানুষ এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে যাচ্ছে। কোনো ধর্মগুরুকেই তো গ্রেফতার করা হচ্ছে না। যদি ধর্মপ্রচার গ্রেফতারের মতো অপরাধ হয়, তাহলে সব ধর্মগুরুরাই অপরাধী হবে।
জাদিদ খবরে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ভারতীয় এক সাংবাদিক লিখেছেন, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ক্ষমতায় আসার পর এমন অসংখ্য কাজ করেছে, যা সরাসরি অসাংবিধানিক ও দেশের আইন বিরুদ্ধ। তাদের ভয়াবহ একটি অসাংবিধানিক কাজ হলো, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে সরাসরি বাধা প্রদান। বর্তমান বিজেপি সরকার চায়, ভারতে এক ধর্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি হয়ে যাক। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ও অনুসারীরাই প্রাধান্য লাভ করুক, নিরাপদ থাকুক। আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলমানদের ধর্ম প্রচারের অনুমতি না থাকুক। এ কারণেই মুসলমানদের যেকোনো অধিকার-বিষয়কে গেরুয়া শিবিরের লোকজন ‘জিহাদ’ নাম দিয়ে পদদলিত করার চেষ্টা করছে। ‘ধর্মান্তকরণের’ ধুয়া তুলে দেশের প্রসিদ্ধ ওলামায়ে কেরামকে গ্রেপ্তার প্রমাণ করছে, দেশে আইনের রাজত্ব শেষ হয়ে গেছে।
সমাজকল্যাণমূলক কাজে বিদেশী তহবিল অপরাধ?
যে কয়টি অভিযোগে মাওলানা কালিম সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারমধ্যে একটি হলো, ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্টে বিদেশ থেকে পাঠানো ৩ কোটি রুপির ফান্ড পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, মাওলানা কালিম সিদ্দিকীর প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল পিস সেন্টার’ এবং ‘জামিয়া ইমাম ওয়ালিউল্লা ‘ পরিচালনা এবং সমাজকল্যানমূলক কাজে এই টাকা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে তিনি অপরাধী। তাদের ভাষ্য, এ টাকা তিনি ধর্মান্তর কাজে ব্যয় করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ম প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠান করার অধিকার সংবিধানই দিয়েছে। জাদিদ খবরের প্রতিবেদনে ওই সাংবাদিক বলেন, ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ধর্মীয় গােষ্ঠীগুলির স্বাধীনতা শিরোনামে সংবিধানের ২৬ নং ধারায় ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গােষ্ঠীকে কয়েকটি অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেগুলি হল: ১. ধর্ম বা দানের উদ্দেশ্যে সংস্থা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ। ২. নিজেদের ধর্মীয় কার্যকলাপ নিজেরাই পরিচালনা করা। ৩. স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন ও ভােগদখল করা। ৪. আইন অনুযায়ী নিজস্ব সম্পত্তি পরিচালনা করা। এ স্বাধীনতা ও অধিকারের কল্যানে মুসলমানরাও ধর্মপ্রচারের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং তার জন্য অর্থ উত্তোলন করার অধিকার রাখে। কিন্তু বিজেপি সরকার তা দিতে চায় না। অথচ আরএসএসের অঙ্গসংগঠনগুলো বিপুলভাবে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে যুগের পর যুগ।
রাজনীতির দুষ্ট চক্রান্তের শিকার
বিশেষজ্ঞদের দাবি, তাকে গ্রেফতারের মধ্যে রাজনীতি আছে। এটা হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি বা সুসংহত করার একটি কৌশল। যখনই নির্বাচন ঘনিয়ে আসে বিজেপি এই বিষয়গুলো নিয়ে মাঠে নামে। ডা. জাফরুল ইসলাম খান বলেন, হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার ষড়যন্ত্র এবং এর জন্য বিদেশী তহবিল পাওয়ার বিষয়ে মিথ্যা বলে বিজেপি হিন্দুদের মধ্যে ফোবিয়া তৈরী করেছে। এই ফোবিয়া হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করার জন্য বিজেপির রাজনীতির অংশ।
বাংলাদেশি গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, বর্ণপ্রথা থেকে উদ্ধার পেতে বহু যুগ থেকে স্বেচ্ছায় দলিতদের বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও মুসলমান হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে ভারতে। বিজেপি সেই প্রবণতা থামাতে চেষ্টা করছে। কারণ, এতে উত্তর ভারতে তাদের সামাজিক আধিপত্য কমার শঙ্কা রয়েছে। সে লক্ষ্যে বিভিন্ন আইনগত উদ্যোগের পাশাপাশি এখন সরাসরি সামাজিক বলপ্রয়োগকেও রক্ষাকবচ হিসেবে গ্রহণ করেছে তারা। বিজেপির তাত্ত্বিকেরা অনেক সময় মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধিকে ‘জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী’ ঘটনা হিসেবেও তুলে ধরেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে ন্যায্যতা দিতে বিজেপি-সমর্থক কাগজগুলোয় প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জেলায় অহিন্দু জনসংখ্যার ‘বিস্ফোরণ’ এবং হিন্দু জনশক্তি ‘শুকিয়ে মরা’ সম্পর্কে ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’ প্রকাশ পায়। মুসলমান জনসংখ্যা বাড়ার তথ্যকে আক্রমণাত্মকভাবে উপস্থাপন করে তাদের ওপর নিপীড়নের পটভূমি তৈরি করা হয়।
উল্লেখ্য, গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, ১০ কোটি বাসিন্দার দুই রাজ্য গুজরাট ও কেরালায় বছরে গড়ে ৯০০ লোক ধর্ম পাল্টাতে আবেদন করছে। এই হিসাবে পুরো ভারতে বছরে ধর্ম পাল্টাতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা ১২ থেকে ১৩ হাজার, যা দেশটির পুরো জনসংখ্যার .০০০০০৯৩ শতাংশ! এদের সবাই আবার হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্মে যাচ্ছে, তা-ও নয়। সব ধর্ম মিলেই এ রকম পরিসংখ্যান। কিন্তু বিজেপির হিন্দুত্ববাদি প্রকল্প বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেন সব হিন্দু মুসলমান হয়ে যাচ্ছে। নগণ্যসংখ্যক ধর্মান্তরিত হওয়ার এ ঘটনাই ভারতজুড়ে রাজনীতির বড় এক বিষয় করে তোলা হয়েছে। এই ভীতিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে রাজ্যে রাজ্যে ধর্মান্তরকরণবিরোধী বিল পাসের মাধ্যমে নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে নেওয়া হচ্ছে চিরস্থায়ীভাবে। কেউ ধর্মান্তরিত হলেই অভিযোগ উঠছে তাকে জোরপূর্বক বিশ্বাস পাল্টাতে বাধ্য করা হয়েছে।