মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী : আলেম সাংবাদিকতার ধ্রুব নক্ষত্র

মুনশী নাঈম

ব্যাপকভাবে আলেমগণ সাংবাদিকতায় যুক্ত না হলেও যে কয়জন যুক্ত হয়েছেন, তারা একাই অনেকজনের কাজ করে গেছেন। তাদের রওনক ও রওশনে এখনও ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাদের তৈরি করে দিয়ে যাওয়া পথেই আমরা হাঁটছি, তাদের দিয়ে যাওয়া সাহসের গর্বে বুক ফুলাচ্ছি। এমনই এক সাহস ও স্বাধীনতাপূর্ব আলেম সাংবাদিকের নাম মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশে ১৮৭৫ সালের ২২ আগস্ট আরবি-ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত মুনশী মতিউল্লার ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাই আরবি-ফারসি ভাষাই ছিলো তার প্রধান শিক্ষা। বাংলাটা শেখেন নিজের ইচ্ছায়, নিজের কথাগুলো বলার প্রবল তাড়নায়। যে সময় আরবি-ফারসিই ছিল বাংলা মুলুকের আলেমদের জ্ঞান চর্চার একমাত্র মাধ্যম, তখন তিনি বাংলা শিখে কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন। শুধু বার্ষিক ওয়াজে নয়, তিনি জাগরণের বাণী নিয়ে মানুষের কাছে উপস্থিত হতে চেয়েছিলেন প্রতিদিন সকালে। তাই সাংবাদিকতার চেয়ে বড় কোনো মাধ্যম যে হতে পারে না তার, খুব বুঝে গিয়েছিলেন। ১৮৯৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি মাদরাসা থেকে সর্বোচ্চ পাঠ গ্রহণ করে সুপারিন্টেন্ডেন্টের দায়িত্ব নেন রংপুর হারাগাছি সিনিয়র মাদরাসার। এখান থেকে বদলি হয়ে চলে আসেন সীতাকুণ্ডের সিনিয়র মাদরাসার অধ্যক্ষ হয়ে। এ সময় থেকেই শুরু হয় তার লেখালেখির জীবন। শুরুতেই চট্টগ্রামে প্রকাশ করেন ‘মাসিক ইসলামাবাদ’।

বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় লেখা

লেখালেখির প্রথম হাত ঝালাই করেছিলেন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে। তিনি আরবি-ফারসি-উর্দু খুব ভালো পারতেন। তাই মিসর থেকে প্রকাশিত আল মিনার, আল ইহরাম এবং আল বিলাদে আরবি ভাষায় প্রবন্ধ লিখতেন। ফারসি দৈনিক হাবলুল মতিনে ফারসি ভাষায়, দিল্লি ও লখনৌর বিভিন্ন উর্দু পত্রিকায় উর্দু ভাষায় নিয়মিত লিখতেন কলাম। লিখতে লিখতে তিনি অনুভব করলেন, সাংবাদিকতা তার রক্তে মিশে যাচ্ছে। আদত এবং মহব্বত হয়ে উঠছে। আরও বড় পরিসর, আরও বড় প্লাটফর্মের সন্ধানে শিক্ষকতা ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমান মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী।

পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব

১৯০৩ সালে কলকাতায় সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজিকে নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক ছোলতান’। এ পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে শুরু হয় ইসলামাবাদীর কলকাতার সাংবাদিক জীবন। পরে ‘সাপ্তাহিক ছোলতান’ দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে পত্রিকার পরিচালনা কমিটির কর্তাব্যক্তি চট্টগ্রামের জনৈক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার হঠকারিতায় দৈনিক ছোলতানের পদ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি দায়িত্ব ছাড়ার পর খুব বেশিদিন পত্রিকাটি টিকেনি। এরপর ইসলামাবাদী ‘দৈনিক আমির’ প্রকাশ করেন। অর্থাভাবে কিছুদিন পর তা-ও বন্ধ হয়ে যায়।

তৎকালীন দুনিয়াজোড়া খ্যাতির শীর্ষে ছিল ফারসি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র ‘হাবলুল মতিন’। আল্লামা জামালুদ্দিন আফগানীর শিষ্য ইরানের আগা মঈদুল ইসলামের সম্পাদনায় কলকাতায় ইংরেজীতে ‘মিল্লাত’ ও উর্দু-ফারসিতে দৈনিক ‘হাবলুল মতিন’ প্রকাশিত হতো। মাওলানা ইসলামাবাদী ‘হাবলুল মতিনে’র বাংলা সংস্করণের সম্পাদক ছিলেন। এজন্য মাওলানা ইসলামাবাদীকে বলা হয় বাংলায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার প্রথম মুসলমান সম্পাদক।

১৯১১ সালে তার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় গঠিত হয় বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি। যে সভায় সমিতি গঠন হয়, সেখানে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, সাপ্তাহিক ‘দি মুসলমান’-এর সম্পাদক মৌলভী মুজিবুর রহমান, শেখ আব্দুর রহিম, মুনশী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ, শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক, ‘কোহিনূর’ সম্পাদক মোহাম্মদ রওশন আলী চৌধুরী প্রমুখ তৎকালীন বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিকবৃন্দ। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে মৌলভী আব্দুল করিম ও মৌলভী মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সমিতির যথাক্রমে প্রথম সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচন করা হয়।

১৯১৩ সালে ইসলামাবাদী ও অন্যান্যদের প্রচেষ্টায় গঠিত হয় আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাংলা। পাশাপাশি তিনি ছিলেন জামায়াতে ওলামায়ে হিন্দের বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আঞ্জুমানে ওলামায়ে ইসলাম বাংলা ও আসামের মুখপাত্র ‘আল-ইসলামে’র সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।

এই পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে তিনি অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের মাঝে আত্মজাগরণের প্রেরণা ছড়িয়ে দেন। তিনি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের অগ্রসর করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

রাজনৈতিক জীবন

তিনি ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সমর্থনে, ১৯০৮ সালে ত্রিপলী যুদ্ধ ও ১৯১২ সালে বলকান যুদ্ধে তুরস্কের সমর্থনে সমগ্র বাংলাব্যাপী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের প্রথমদিকে কংগ্রেসের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পরে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কৃষক প্রজা পার্টির মনোনয়নে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১৯৪২ সালের বাংলা-আসামের মুসলমানদের সহায়তায় তিনি গোপন বিপ্লবী দল প্রতিষ্ঠা করেন। ন্যায়নীতি ও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য মাওলানা ইসলামাবাদী ভারতীয় বিখ্যাত নেতা মহাত্মা গান্ধী, জওহর লাল নেহরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দিল্লির লাল কেল্লায় বন্দি ছিলেন।

গ্রন্থ রচনা

শুধু পত্র-পত্রিকায় লিখতেন এমন নয়, তিনি মুসলিম সমাজকে আলোর পথ দেখানোর জন্য অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এরমধ্যে তুরস্কের সুলতান, কনস্টান্টিনোপল, ভারতে মুসলমান সভ্যতা, ভারতে ইসলাম প্রচার, খাজা নেজামুদ্দীন আওলিয়া, সমাজ সংস্কার, বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের জাতীয় উন্নতির উপায়, কোরআনে স্বাধীনতার বাণী, ইসলামের শিক্ষা, সুদ সমস্যা ও মুসলমান সমাজ, ইসলাম জগতের অভ্যুত্থান, আওরঙ্গজেব, মোসলেম বীরাঙ্গনা, ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান, কোরান ও বিজ্ঞান, বাংলার ওলি কাহিনি, কোরান ও রাজনীতির বাণী, আসাম ভ্রমণ, আবে হায়াত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

ইনতেকাল

চট্টগ্রামের এ ক্ষণজম্মা আলেম সাংবাদিক মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ৭৫ বছর বয়সে ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর চন্দনাইশের বরমার তার নিজ বাড়িতে ইনতেকাল করেন। ইসলামাবাদীর শেষ ইচ্ছা অনুসারে চট্টগ্রাম শহরস্থ কদম মোবারক নবাব এয়াসিন খাঁর মসজিদ সংলগ্ন ও তারই প্রতিষ্ঠিত কদম মোবারক মুসলিম এতিম খানার সামনে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

মাওলানা ইসলামাবাদী আলেম সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক জ্বলজ্বলে নক্ষত্র। আমরা ভুলে গেলেও ইতিহাস ঠিকই মনে রাখবে। তার কিছু গোপন পাতায় ইসলামাবাদীর স্মৃতি জমিয়ে রাখবে পরম যত্নে। কিছু মানুষ হারিয়ে যাবার পথটা কর্ম দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে যান। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তাদেরই একজন। তাকে দেখতে গেলে তার সমাধির গায়ে পাবেন তারই লেখা একটি ফার্সি কবিতার অনুবাদ:

‘পথিক, ক্ষণেকের তরে বস মোর শিরে
ফাতেহা পড়িয়া যাও নিজ নিজ ঘরে।
যে জন আসিবে মোর সমাধি পাশে
ফাতেহা পড়িয়া যাবে মম মুক্তির আশে।
অধম মনিরুজ্জামান নাম আমার
এছলামাবাদী বলে সর্বত্র প্রচার।’

আগের সংবাদজাতীয় সংবাদমাধ্যমে আলেম সাংবাদিকদের সম্ভাবনার জায়গা
পরবর্তি সংবাদপর্যটন ভিসায় সৌদি গিয়ে যেসব কাজ করা যাবে না