রচনা : ড. মাহমুদ আহমদ গাজী
তর্জমা : কাজী একরাম
ড. মুহাম্মদ হামীদুল্লাহ (১৯০৮-২০০২ খৃ.) ইসলামী ইতিহাসের সেইসব গৌরবময় পণ্ডিত শ্রেণীর একজন, যাতে আবু নসর ফারাবী, ইমাম গাযালী এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ এর ন্যায় প্রমুখ জ্ঞান-পৌরুষগণ শামিল রয়েছেন। ড. হামীদুল্লাহর ব্যক্তিত্ব সেসকল জ্ঞানী ও বিদ্বানদের জ্ঞানগত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, যার মূল উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে সত্যবাদিতা, নিঃস্বার্থতা, আত্মদান এবং জ্ঞানের নানা শাখায় ও বিষয়ে অসাধারণ অধিকার। ড. মুহাম্মদ হামীদুল্লাহকে মহান আল্লাহ দীর্ঘায়ু দান করেছিলেন। হিজরি বছর অনুসারে প্রায় ৯৯ বছর তিনি আয়ু লাভ করেন। এছাড়া বিবাহিত জীবনের ঝামেলা থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন। এই মুক্তি তাঁকে তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় পুরো জীবনকে জ্ঞান এবং গবেষণায় নির্বিঘ্নে উৎসর্গ করে দিতে পারার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। তাঁর উম্মুক্ত জ্ঞানচর্চা এবং গবেষণামূলক রচনা-সমগ্র (১৬৫ টিরও বেশি গ্রন্থ এবং প্রায় এক হাজার গবেষণা নিবন্ধ) বিভিন্ন এবং বিচিত্র বিষয়ের অনবদ্য ধারক। ইসলামী উলুম ও জ্ঞানকলার এমন কোনো শাখা সম্ভবত নেই, যা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর সত্তা এবং তাঁর শিক্ষার অন্তর্গত আর ড. হামীদুল্লাহ সে বিষয়ে লেখনী ধারণ করেননি! তবে, তাঁর বিশেষ আগ্রহের বিষয়ের মধ্যে সীরাতে রাসূল, তাদবীনে হাদীস বা হাদীস সংকলনের ইতিহাস এবং ইসলামের আন্তর্জাতিক আইন ছিল অগ্রগণ্য।
ড. হামীদুল্লাহর ইলমী ক্যারিয়ারের সূচনা হয় আইন এবং ইতিহাসের একজন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক হিসেবে। প্রথম থেকেই তিনি একজন আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে জ্ঞানের এলাকায় নিজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এবং আইনী বিষয়ে কার্যকর লেখালেখির কারণে অতি অল্প বয়সে তিনি জ্ঞানের দুনিয়ায় পরিচিত হয়ে ওঠেন। প্রারম্ভিকভাবে তিনি আইন দর্শন, আইন নীতি, এবং আন্তর্জাতিক আইনের ওপর লেখেন। ইংরেজি ও ফরাসী ভাষা থেকে উর্দু ভাষায় আন্তর্জাতিক আইন-সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি বই অনুবাদ করেন, যেগুলো মূলত উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম আর পাঠদান সংক্রান্ত জরুরতে সম্পাদিত হয়েছিল৷
আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে তাঁর এই প্রাথমিক কাজগুলো স্রেফ অনুবাদ বা পাশ্চাত্য লেখকদের চিন্তা-ভাবনা ও ধারণাকে নকল করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অনুবাদের সাথে সাথে পাশ্চাত্য চিন্তার সমালোচনামূলক অধ্যয়নের দিকেও তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন। অনূদিত এবং রচিত প্রথম দিকের বইগুলোর উপর তাঁর সমালোচনামূলক পাদটীকাসমূহ এবং তাতে বর্ণিত ধারণাসূহের উপর পর্যালোচনা–সেই সব তর্জমার এক স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য।
সাম্প্রতিক কালে ‘ইসলামাইজেশন অব নলেজ’ এর যে পরিভাষা প্রচলিত হয়েছে, তার স্পষ্ট আলোকপাত দেখতে পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক আইনের উপর লিখিত ড. সাহেবের প্রথম দিকের রচনায়। আন্তর্জাতিক আইনের উপর রচিত কয়েকটি বৃহৎ আকারের বইয়ের উর্দু অনুবাদ ছাড়াও এক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত এবং অপেক্ষাকৃত ছোট সাইজের প্রায় দেড় শতাধিক পৃষ্ঠার সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো “কানুন বাইনাল মামালিক কে উসূল আওর নজীরেঁ”। গ্রন্থটিতে আন্তর্জাতিক আইনের ধারণা এবং ধারণাগুলোর সমালোচনামূলক পর্যালোচনা, পাশাপাশি ইসলামী আইনের ধারণাগুলোর তুলনামূলক অধ্যয়ন রয়েছে।
ছোট্ট এই গ্রন্থ প্রকৃতপক্ষে ড. হামীদুল্লাহর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি হিসাবে বিবেচিত। এটি ইসলামী আইন অধ্যয়নের একটি নতুন ধারার বিবর্তনের সূচনা। সম্ভবত, এই প্রাথমিক অধ্যয়ন থেকে তিনি অনুপ্রাণিত হন এবং সিয়ার (সীরাতের বহুবচন) এবং আন্তর্জাতিক আইন বিষয়টিতে নিয়মিত নিষ্ঠা ও তিতিক্ষার সাথে কাজের শুরু করেন। এই ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ ছিল ১৯৩৩ সালে সুরবোন ইউনিভার্সিটিতে পঠিত হওয়া একটি গবেষণাপত্র, রচনার শিরোনাম ছিল Dei Neutralitat Im Islamischen Bolkerrecst. (বন, ১৯৩৫ লেপারে প্রকাশিত)। অর্থাৎ ইসলামের আন্তর্জাতিক আইনে নিরপেক্ষতার নীতিমালা। এই বিষয়ের উপর ইসলামের শিক্ষানীতি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ড. হামীদুল্লাহর প্রথম আনুষ্ঠানিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রচেষ্টা ছিল এটি।
রচনাকর্মটি বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ
প্রথমত, এর মাধ্যমে আইন বিজ্ঞানের এমন একটি দিক সামনে এসেছে, যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা এ পর্যন্ত এড়িয়ে গেছেন। দ্বিতীয়ত, গবেষণাটি এই গলতফাহমি ও ভুল ধারণা দূর করেছিল যে, ইসলামী যুদ্ধ-আইন ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ এবং যুদ্ধে মিত্রশক্তির মর্যাদা ব্যতীত অন্য কোনও সম্পর্ককে স্বীকার করে না। তৃতীয়ত, পশ্চিমা পণ্ডিতরা ইসলামী আইন ও রাজনীতির এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অবগত ছিলেন না, যা এ রচনা তাদের সামনে হাজির করেছে। এর চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো, এতে আন্তর্জাতিক ইসলামী আইনে নিরপেক্ষতার ধারণাগুলিকে সুশৃঙ্খলভাবে সংকলন করা এবং সেগুলিকে নিয়মতান্ত্রিক নীতি-পদ্ধতিতে বিন্যাস দেওয়ার সচেতন জ্ঞানদক্ষ প্রয়াস রয়েছে। এবং পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হলো, ইসলামী আন্তর্জাতিক আইনের ধারণামালা এবং তাদের জ্ঞানগত প্রয়োগকে ফিকহী ও নজরী তথা আইনশাস্ত্রীয় ও তাত্ত্বিক আলোচনার সাথে সাথে সমসাময়িক ঐতিহাসিক তথ্য-উপাদানের আলোকেও দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইলমি কীর্তি হলো তাঁর সেই প্রয়াস, যা সীরাতে রাসূলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। নিবন্ধের শিরোনাম ছিল La Diplomatie Musulmane ‘a l’epoch do prophete di l’ Islam et ses calipsh orthodoxes. যা তিনি ১৯৩৪ সালে সুরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপন করেছিলেন এবং ১৯৩৫ সালে প্যারিস থেকে দু’খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম খণ্ডে মহানবী সা. এবং তাঁর ন্যায়নিষ্ঠ খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলের ইসলামি কুটনীতি এবং আরব উপদ্বীপসহ আশেপাশের সমসাময়িক শাসকগণ ও গোত্র-প্রধানদের সাথে ইসলামিক স্টেটের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সীরাত রচনার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বইটিতে সমসাময়িক রাষ্ট্রগুলোর সাথে সূচনাকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের সম্পর্ক এবং এই বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ নিয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে মহানবী সা. ও ন্যায়পরায়ণ খলিফাদের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, আইনী এবং কূটনৈতিক দলিল-দস্তাবেজ সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রাচীন ঐতিহাসিক, ফিকহী বা আইনী, জীবনচরিত এবং সাহিত্যিক উত্সসমূহ থেকে সংগৃহ করা এই নথিগুলো ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে এবং সেগুলিকে উপযুক্ত বিন্যাসে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
পরবর্তিতে দ্বিতীয় খণ্ডে অনেক কিছু সংযোজন করা হয়েছে। এবং বিভিন্ন দলিল ও চিঠিপত্র যুক্ত করে সেটাকে “আল-ওয়াসাইক আল-সিয়াসিয়্যাহ” নামে আরবিতে একটি স্বতন্ত্র্য বইয়ের রূপ দেওয়া হয়। বইটি প্রথম ১৯৪১ সালে বৈরুত থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন পর্যন্ত প্রায় এক ডজন সংস্করণ বের হয়ে গেছে। উর্দু এবং ফরাসি অনুবাদও পাওয়া যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি মুসলিম রাজনীতি বিষয়ক অন্যতম প্রাথমিক উত্স হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু এই বিষয়ে সম্ভবত ড. হামীদুল্লাহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহদাকার কাজ হচ্ছে “দ্য মুসলিম কন্ডাক্ট অফ স্টেট” নামক গ্রন্থ (The Muslim Conduct of state)। মূলত এটি তাঁর এম এ এর গবেষণা আর্টিকেল ছিল, যা হায়দরাবাদের উসমানীয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপিত হয়েছিল এবং ১৯৪১ সালে লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থটিতে ইসলামের আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে ড. হামীদুল্লাহর অতি সাম্প্রতিক গবেষণা-অনুসন্ধান এবং পুরো জীবনের প্রচেষ্টাসমূহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি এ গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণগুলোতে তাঁর নতুন নতুন চিন্তা এবং গবেষণার ফলাফল সংযোজন করতে থাকেন। বর্তমান সংস্করণটি নবমতম। The Muslim conduct of state ইসলামের আন্তর্জাতিক আইন পুনর্গঠনের এক অনবদ্য উদাহরণ।
মুসলিম বিদ্বানরা বিংশ শতাব্দী থেকে ইসলামী আইনের পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে আসছেন। মহান চিন্তানায়ক আল্লামা ইকবাল ১৯২০ শতক থেকেই ইসলামী আইনের পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিতে থাকেন। তিনি নিজে থেকেই এই কাজটি শুরু করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর অভিপ্রায় ছিল সমসাময়িক ইসলামী পণ্ডিত এবং ফকীহদের সমর্থন লাভ করা। এক্ষেত্রে আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি ও মাওলানা আবুল আলা মওদূদীর সাথে তাঁর যোগাযোগ এবং এই কাজে তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করার ইচ্ছার ব্যাপারটি খুবই মশহুর। যদিও আমাদের জানা নেই এ বিষয়ে আল্লামা ইকবালের উসলুব এবং কর্মপন্থা কী ছিল এবং ফিকহে ইসলামীর নতুন বিন্যাস সম্পর্কে তাঁর কনসেপ্ট কেমন ছিল। তবে মনে হয়, তিনি যদি জীবিত থাকতেন এবং ড. হামীদুল্লাহর “দ্য মুসলিম কন্ডাক্ট অফ দ্য স্টেট” কিতাবখানি দেখতেন, তবে তিনি এটিকে তাঁর প্রস্তাবিত চিন্তা ও পন্থার খুব কাছাকাছিই অনুভব করতেন!
এমন মনে হয় যে, ড. হামীদুল্লাহ এ বইটি লেখার সময় আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কিত Oppenheim এর বিখ্যাত এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ বইটি উদাহরণ হিসেবে সামনে রেখেছিলেন। তিনি তাঁর বইয়ে সেই স্টাইল এবং বিন্যাস গ্রহণ করেছিলেন, যা ওপেনহিম তার বইয়ে অনুসরণ করেছিলেন। ড. হামীদুল্লাহ ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, উত্তর আফ্রিকা, সিরিয়া, তুরস্ক এবং হিজাজের গ্রন্থাগারসমূহে সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত হস্তগত করার জন্য সমস্ত উপায়-ব্যবহার করেছিলেন এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি ইতিহাস, তৎকালীন সাহিত্য, শিপিং বই, সফরনামা, ফৌজী, জীবনী, তাফসীর, হাদিস সম্পর্কিত ব্যাখ্যা-ভাষ্য থেকে পর্যাপ্ত রসদ গ্রহণ করেছিলেন। এবং এর ফলে তিনি ওপেনহিম দ্বারা উত্থাপিত প্রশ্ন এবং বিষয়গুলোতে প্রচুর ইসলামিক তথ্য সরবরাহ করতে সফল হয়েছেন।
আইনশাস্ত্র এবং এ সংশ্লিষ্ট সকল উৎস-উপাদান ব্যবহারের পাশাপাশি তিনি ইসলামের আন্তর্জাতিক আইনে কতিপয় আধুনিক ধারাও পরিচিত করিয়েছিলেন। সিয়ার এবং ইসলামের আন্তর্জাতিক আইনবিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে বেসরকারি (প্রাইভেট) আন্তর্জাতিক আইন কিংবা আইনসমূহের দ্বন্দ্ব-সংঘাত সম্পর্কে খুব বেশি আলোচনা পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা সুবিন্যস্ত জ্ঞানের শাখা হিসেবে একত্রে উপলব্ধ হয় না। ড. হামীদুল্লাহ এ বিষয়ে ফিকহের (ইসলামী আইনশাস্ত্র) অন্যান্য শাখা থেকে রসদ সংগ্রহ করে আইন শাখাটিকে সংকলিত করেন এবং আইনসমূহের দ্বন্দ্বের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণাগুলোকে একটি সুবিন্যস্ত ও শৃঙ্খলিত তত্ত্ব-কাঠামোর অবয়বে উপস্থাপন করেন। ইসলামের আন্তর্জাতিক আইনে নতুন গবেষণা ও নতুন ধারণাসমূহের পরিচায়নের পাশাপাশি ড. হামীদুল্লাহ বিভিন্ন ভাষ্য ও নীতি-মালার নতুন নির্মাণ ও আধুনিক ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করেন। তিনি আইনী এবং ফিকহী উসূল, তত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতাসমূহকে একে অপরের পরিপূরকরূপে উপস্থাপন করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি প্রশংসনীয় কীর্তি। এখন অবধি, ‘The Muslim conduct of state’ ইসলামী আইনের এই শাখাটির নব নির্মাণের উৎকৃষ্টতম উদাহরণ।
ইসলামের আন্তর্জাতিক আইনে এই সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টার পাশাপাশি ড. হামীদুল্লাহ আইনের পটভূমি সম্পর্কেও আমাদের জন্য এক প্রশস্ত জ্ঞানসম্ভার রেখে গেছেন। তিনি প্রাচীন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কাদির উপর উপলভ্য গুরুত্বপূর্ণ টেক্সটসমূহ সম্পাদনা করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বরকতময় জীবনের উপর ইবনে ইসহাকের প্রথম এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সীরাতু রাসূলিল্লাহ এবং আল-ওয়াকিদীর কিতাব আর রিদ্দাহ সম্পাদনা করেছেন। প্রথমবারের মতো তিনি ‘মদীনা সনদ’-এর প্রতি জ্ঞানী ও পণ্ডিতকুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, যাকে তিনি দুনিয়ার প্রথম লিখিত সংবিধান ঘোষণা করেন। ড. হামীদুল্লাহ অষ্টম শতাব্দীর হাম্বলি ফকীহ ইবনে কাইয়িমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি আহলু আয-যিমা (দুই খণ্ড) প্রকাশেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রাইভেট আন্তর্জাতিক আইনে ফিকহী উৎসের ক্ষেত্রে এটি সম্ভবত সেরা একটি গ্রন্থ।
ড. মুহাম্মদ হামীদুল্লাহকে কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই আধুনিক যুগে আন্তর্জাতিক ইসলামী আইনের পুনঃসংস্কারক ও পুনঃপ্রর্বতক হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। যদি ইমাম মুহাম্মদ বিন হাসান শাইবানী প্রাচীন ইলমে সিয়ারের (ইসলামী আন্তর্জাতিক আইন) এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হন, তবে ড. হামীদুল্লাহ অবশ্যই আধুনিক আন্তর্জাতিক ইসলামী আইনের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হবেন এবং যথার্থভাবেই, ‘বিংশ শতাব্দীর শাইবানী’ অভিহিত হওয়ার অধিকার রাখেন।
ড. হামীদুল্লাহর অবদানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রাসূল সা. এর পবিত্র জীবন-চরিত। মনে হয়, প্রাথমিক ইসলামী যুগের কূটনীতির বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সংকলনের সময় সীরাতশাস্ত্রের সাথেও তাঁর একটি ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এবং পরে বিষয়টির প্রতি সে সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হয়। তাঁর সত্তর বছরের জ্ঞান ও গবেষণার শেষ পয়ত্রিশ বছরের সময়কাল তাঁর অধিকতর মনোযোগ সীরাতের প্রতিই নিবদ্ধ ছিল। এই শেষের তিন-চার দশকে বোধহয় তিনি ইসলামের আন্তর্জাতিক আইনের উপর স্বতন্ত্রভাবে খুব কমই লিখেছেন।
অবশ্য তাঁর প্রাথমিক পর্যায়ের প্রকাশনাগুলোতে নতুন নতুন সংযোজনের ধারা, নতুন তথ্য এবং নতুন গবেষণার ফল যুক্ত করার সিলসিলা বরাবর জারি ছিল। যদ্দরুন তাঁর এ-সকল ইলমী কাজগুলোর মান-মূল্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। “আহদে নববী মেঁ নেজামে হুকুমরানি” সীরাত সংক্রান্ত তাঁর প্রথম গ্রন্থ। এটি মদীনা রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ে রচিত গবেষণা প্রবন্ধসমূহের সংকলন। ড. হামীদুল্লাহ এটিকে মদিনার নগর-রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেছেন। বইয়ের প্রারম্ভিক অংশে, মক্কার নগর-রাজ্য সম্পর্কে একটি জ্ঞানমূলক গবেষণাপ্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা প্রথমবার ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যান্য নিবন্ধগুলো ১৯৩০ এর দশকের শেষভাগে এবং ১৯৪০ এর দশকের শুরুভাগে রচিত হয়েছিল। বইটি রাসূল সা. এর শাসন ব্যবস্থার উপর ড. হামীদুল্লাহ এর প্রথম দিকের রচনা হলেও অসামান্য ভারী একটি কাজ। গ্রন্থটিতে সীরাতুন্নবীর বিভিন্ন নতুন দিককে অধ্যয়ন ও গবেষণার বিষয়বস্তু করা হয়েছে।
নবীজীবনের এই নতুন দিকগুলো সম্পর্কে এ বইয়ে এমন মূল্যবান তথ্য-সম্ভার মওজুদ রয়েছে, যেগুলোর প্রতি প্রাচীন সীরাত লেখকগণ ততটা গুরুত্ব দেননি। গ্রন্থটির প্রায় অর্ধ ডজন সংস্করণ এযাবৎ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি সংস্করণে নতুন সংযোজন এবং নতুন গবেষণার ফলাফল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ বইয়ের একটি ছোট্ট অংশ, যা পরবর্তীতে একটি স্বতন্ত্র্য কিতাবের রূপ দেওয়া হয়েছে, মদীনা সনদ সম্পর্কিত। মদীনা সনদ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক দলিল, যা সম্পর্কে প্রাচীন জীবনীবিদগণ খুব বেশি আলোচনা করেননি। ইবনে হিশাম ও ইবনে ইসহাক থেকে শুরু করে আল্লামা শিবলী নোমানী এবং কাজী মুহাম্মদ সুলাইমান মানসুরপুরি পর্যন্ত সকলেই এই দলিলটি কেবল সংক্ষেপে উল্লেখ করে সন্তুষ্ট হয়েছেন। এই গ্রন্থে প্রথমবারের মতো ড. হামীদুল্লাহ মদিনার সনদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পরে তিনি আলোচনাকে আরও বিস্তৃত করে, এই বিষয়ের উপর “দুনিয়া কা পহেলা তাহরীরী দস্তুর” (জগতের প্রথম লিখিত সংবিধান) শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ তৈরি করেন।
সীরাতে রাসূলের রাজনৈতিক দিক নিয়ে তাঁর প্রবন্ধের আরেকটি সংকলন হলো “রাসূলে আকরাম সা. কী সিয়াসী জিন্দেগী” (রাসূলের রাজনৈতিক জীবন)। এই বইয়ের সংকলন এবং সম্পাদনার কাজ এক দীর্ঘ সময়ে (১৯৩৫-১৯৫০খৃ.) পরিব্যাপ্ত। গ্রন্থভুক্ত বেশিরভাগ উপকরণ তাঁর ফরাসি বই থেকে সংগৃহীত। অবশ্যই, তাতে খুব গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনও সন্নিবেশিত হয়েছে। এই গ্রন্থের প্রায় এক ডজন সংস্করণ এযাবৎ প্রকাশিত হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে নতুন নতুন সংযোজনের সিলসিলা জারি ছিল। উপমহাদেশের অনেক সমসাময়িক সীরাতলেখক এই দু‘টি বইয়ের লেখন-শৈলী, বয়ানের স্টাইল এবং গবেষণার ফলাফল দ্বারা উপকার লাভ করেছেন। এবং এভাবে এই দু’টি কিতাব প্রকাশ পাওয়ার পর একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনকে অধ্যয়নের ধারা তৈরি হয়। এই দু’টি গ্রন্থ ছাড়াও তাঁর আরেকটি বিরল কাজ ছিল “আহদে নববী কেঁ ময়দানে জঙ্গ” (নববী যুগের যুদ্ধের ময়দান)। যার মধ্যে মহানবী সা. এর জীবনের শেষ আট বছরে লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে, লেখক ১৯৩০ এর দশকে ব্যক্তিগতভাবে মদীনা, মক্কা এবং তায়েফ ভ্রমণ করেন। ইতিহাসে সংরক্ষিত উপাদানের আলোকে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে সেই স্থানগুলির পরিমাপ করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রের মানচিত্র অঙ্কন করেন। যুদ্ধক্ষেত্র চিহ্নিত করার পাশাপাশি তিনি সেই যু্দ্ধসমূহের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পটভূমি সন্ধান করেন এবং তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও ফলাফল বিশ্লেষণ করেন। পরবর্তিতে লেখক নিজেই নতুন সংযোজনসহ বইটি ইংরেজী এবং ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
সীরাত বিষয়ে ড. হামীদুল্লাহর সর্বাধিক বিশদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থ তাঁর ফরাসি ভাষায় রচিত “পয়গম্বরে ইসলাম, জীবন ও কর্ম”। বইটির দু’টি বৃহৎ খণ্ড রয়েছে, যা লেখকের সকল গবেষণা-ফলাফলের একটি উত্তম এবং সংক্ষিপ্ত সারাৎসার হাজির করে। এই বইয়ের বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ প্রকাশনাটি ছিল পঞ্চম, যা ১৯৮৯ সালে প্রকাশ পেয়েছিল। বইটির প্রথম খণ্ডে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রাথমিক জীবন, তাঁর নবুওয়তের মিশন এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অত্যন্ত মুক্তমনে এই দাবি করা যেতে পারে যে, এই বইটি লেখকের সীরাত সম্পর্কিত তথ্য এবং অনুসন্ধান ও গবেষণার সর্বোৎকৃষ্ট বহিঃপ্রকাশ।
স্টাইল এবং তথ্য উপাত্তের বিচারে প্রথম খণ্ডটি ঐতিহাসিক ধরণের। অপরদিকে দ্বিতীয় খণ্ডে হযরত মুহাম্মদ সা. এর শিক্ষা এবং তাঁর পয়গাম সম্পর্কিত সুক্ষ্ম বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও, নববী যুগের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলি অত্যন্ত সবিস্তারে সংহত করে প্রদত্ত হয়েছে এতে। উভয় খণ্ডে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে আরবের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যবস্থাও বৈশিষ্ট্যপূর্ণভাবে বিবৃত হয়েছে। মহানবী সা. এর বরকতময় যুগে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যকার সম্পর্কও এই বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ হিস্যা। তাবলিগে রিসালাত বা দীন প্রচারের সাফল্যে বিভিন্ন গোত্রের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত এই বইয়ের সেই অন্যতম অংশ, যা লেখকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কীর্তিস্বরূপ বিবেচিত হতে পারে। এ অংশটি রাসূল সা. এর পদক্ষেপসমূহের পরিপ্রেক্ষিত এবং তাদের কার্যকারণসমূহ বোঝার পক্ষে বেশ সহায়ক। লেখক ইসলামের ক্রমাগত বিবর্তনে গোত্র প্রধানদের এবং যুদ্ধসমূহে তাদের ভূমিকা প্রমাণের সফল চেষ্টা করেছেন। এবং তিনি এ বিষয়ক গবেষণায়ও সফল হয়েছেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু গোত্রের সাথে চুক্তি করেছিলেন, কেন করেছিলেন এবং তাদের অনেকেকে তিনি উপেক্ষা করেছিলেন এবং কেন করেছিলেন!
রাসূল সা. তাঁর সমসাময়িক শাসকদের সাথে আচরণের ধরণ, মিত্র এবং প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রপতিদের সাথে সম্পর্কের কলা-কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিলাদির আলোকে পর্যালোচনা–এ গ্রন্থের সর্বাধিক তথ্যঋদ্ধ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
ড. হামীদুল্লাহর আগে পৃথিবী কেবল গ্রিসের নাগরিক রাষ্ট্র সম্পর্কে জানত। এক্ষেত্রে তিনি হলেন প্রথম ঐতিহাসিক এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ, যিনি বিশ্বকে মক্কা ও মদিনার নগর রাষ্ট্রের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সেই নগর রাষ্ট্রের তফসিলি বিবরণ সম্পর্কে প্রচুর পরিমাণে উপাদান এবং প্রামাণ্য তথ্যাদি সংগ্রহ করেছিলেন। যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মদীনা নগর-রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রকে ড. মুহাম্মদ হামীদুল্লাহ প্রথম উন্মোচন করেছিলেন। তিনি বিশ্বের এই প্রথম লিখিত সংবিধানের গুরুত্ব এবং ধারাসমূহের উপর উর্দু, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় স্বতন্ত্র্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সাক্ষ্য-প্রমাণের সাহায্যে তিনি এই সংবিধানের সংকলনের ইতিহাস এবং পর্যায়সমূহের নিরূপণ করেছিলেন।
কুরআন এবং হাদিসের ঐতিহাসিকতাও ড. হামীদুল্লাহর অধ্যয়ন ও গবেষণার একটি বিশেষ বিষয় ছিল। ফরাসি ভাষায় সীরাত সম্পর্কিত দ্বি-খণ্ডের বইটিতে, যার উল্লেখ উপরে হয়েছে, এ বিষয়ের উপর মূল্যবান তথ্য ও আলোচনা রয়েছে। এছাড়াও তাঁর বিখ্যাত বক্তব্য সংকলন ‘খুতবাতে বাহওয়ালপুর’-এ পবিত্র কুরআনের ইতিহাস এবং হাদিসের ইতিহাস সম্পর্কিত দু’টি খুতবা (বক্তব্য) শামিল রয়েছে। এই উভয় খুতবাতেই কুরআনের সংকলন এবং হাদীসের সংকলন প্রসঙ্গে বহু বিষয়ে মুল্যাবান এবং প্রামাণিক আলোচনা বিদ্যমান।
ড. হামীদুল্লাহ আবু দাউদের “কিতাবুল মাসাহিফ” এবং কুরআন সংকলন সম্পর্কিত অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলোকে প্রত্যাখ্যান না করে, তিনি বরং এই রেওয়ায়েতগুলোকে এমন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে হাজির করেন যে, রেওয়ায়েতগুলোও প্রত্যাখ্যাত হয় না আবার তাঁর নিজস্ব প্রামাণ্য দৃষ্টিভঙ্গিও অপ্রভাবিত বা অপরিবর্তিত থাকে।
হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর কাজগুলো এ দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিক গুরুত্বের ধারক যে, তিনি অন্যান্য গবেষকদের কাছে হাদীসের বিষয়বস্তুর ঐতিহাসিকতাকে পরিসংখ্যান-সহ অত্যন্ত কার্যকর এবং প্রামাণ্য আন্দাজে উপস্থাপন করেছেন। যদিও, তিনি না হাদীসের শিক্ষাদান করেছিলেন আর না ‘উলুমুল হাদীস’ এবং ‘শরহুল হাদীস’ সম্পর্কে তাঁর কোনো গুরুত্বপূর্ণ রচনা আছে, তথাপি জ্ঞানের এই ক্ষেত্রটিতে তাঁর ইলমি স্বাক্ষর একেবারেই অতুলনীয়! হাদীসশাস্ত্রে তাঁর বিশেষ আগ্রহের জায়গা ছিল হাদীসের সংকলন ও ইতিহাসকেন্দ্রিক বিষয়। বস্তুত, এটি সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নিয়ে ওরিয়েন্টালিস্টরা অনেক সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করেছেন।
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যপর্ব থেকে পশ্চিমা পণ্ডিতরা ইসতিনাদে হাদীস বা হাদীসের সূত্র-পরম্পরাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকে। তাদের ধারণা, হাদীসের মশহুর এবং প্রচলিত সংগ্রহগুলো তৃতীয় শতাব্দীতে সংকলিত হয়েছে। সুতরাং এগুলো খুব বেশি নির্ভরযোগ্য নয়। তাদের ধারণায়, এই সংগ্রহশালা কেবলই মৌখিক বর্ণনাধারার উপর নির্ভর করে হয়েছে। বিধায় এতে ভুল উপস্থাপনা, সংযোজন এবং পরিবর্তনের বহু অবকাশ বিদ্যমান ছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পশ্চিমা পণ্ডিত তথা প্রাচ্যবিদরা এত জোরালোভাবে পুনরাবৃত্ত করেছে যে, তাদের পাঠকদের অনেকেই তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়। বিশ্বাস করে যে, হাদীসের বিষয়বস্তু কেবলই শ্রুতিনির্ভর। এবং হাদীসসমূহের জ্ঞানগত পর্যায় এবং সূত্র-সত্যতা গাঁও-গ্রামের প্রবীণ মহিলা এবং পুঁথিকারদের বর্ণিত লোক-গাঁথার চেয়ে বেশি কিছু নয়!
ড. হামীদুল্লাহ উপলব্ধ তথ্য-সামগ্রীর আলোকে প্রাচ্যবিদদের এই পুরো দাবির পর্যালোচনা করেছেন এবং তাকে সম্পূর্ণরূপে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। আসলে ড. হামীদুল্লাহর প্রখ্যাত উস্তাদ মাওলানা মানাজির আহসান গিলানী (১৮৯২-১৯৫৬ খৃ.) প্রাথমিকভাবে এই মেধাবী ছাত্রের মানসে এই চিন্তার ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন। গিলানী অত্যন্ত পরিশ্রমের সাথে এ সত্যকে প্রমাণ করেন যে, রাসূল সা. এর সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহ এর নির্দেশ এবং উপদেশবলী লিখিতভাবে রেকর্ড করার কাজ শুরু করেছিলেন। ড. হামীদুল্লাহর জ্ঞানের এই শাখাটি তাঁর এই মহান উস্তাদের কাছ থেকে উপলব্ধ হয়েছিল। এরপর তিনি তাঁর স্বকীয় পণ্ডিতি তৎপরতা, আগ্রহ-অভিরুচি এবং অনন্য অসাধারণ চিন্তার আলোকে অনুসন্ধান ও গবেষণার এই ধারাটি অগ্রসর করেছিলেন। তিনি তুরস্ক, ফ্রান্স এবং জার্মানির লাইব্রেরিসমূহে বিদ্যমান হাদীসের সংকলনসমূহ সংগ্রহ করেন এবং সেগুলোর ভিত্তিতে তিনি হাদীস সমূহের শ্রুতিনির্ভর মৌখিক ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রাচ্যবিদদের উত্থাপন করা আপত্তির জবাব প্রদান করার প্রয়াস পান। তিনি প্রমাণ করেন যে, অনেক সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস সম্বলিত ব্যক্তিগত সংগ্রহ সংকলন করেছিলেন। এমন অনেক নথিপত্র ছিল, যা মহানবী সা. বিভিন্ন উদ্দেশ্যে লিখিতভাবে সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মহানবীর (সা.) হেদায়েত ও দিকনির্দেশনা মোতাবেক লিখিত এই দলিলগুলো সাহাবা, তাবিয়ীন এবং পরবর্তী ফকীহ এবং ঐতিহাসিকগণ সংরক্ষণ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে “মীসাকে মদীনা” (মদীনা সনদ) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যাতে মদিনা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, হুকুক ও অধিকার এবং দায়-দায়িত্ব সম্পর্কিত ২৫টির বেশি দফা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ডক্টর হামীদুল্লাহ কর্তৃক নববী যুগের যেসকল দলিল-দস্তাবেজ উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে আদমশুমারির রিপোর্ট, নেতা ও গোত্রপ্রধানদের নিকট লিখিত চিঠিপত্র, সমসাময়িক শাসকদের কাছে প্রেরিত দাওয়াতি-পত্রাবলি, গভর্নরদের নির্দেশনামা, যাকাত ও অন্যান্য কর সম্পর্কিত আইন এবং উপলব্ধ কর প্রভৃতির বিবরণীমূলক প্রস্তুতকৃত নথিপত্র অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ড. হামীদুল্লাহর মতে, সাহাবাগণের হাতে প্রস্তুত করা হাদীসের সংকলনসমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংকলন হলো আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস, আবু রাফি, আনাস বিন মালিক, উমর ইবনে হাজম ও আবু হুরায়রার (রা.) এর সংকলন। হামীদুল্লাহ এই সত্যকেও আবিষ্কার করেছিলেন যে, রাসূলের একজন সাহাবী, আবদুল্লাহ ইবনে আবী ‘আওফ রাদি. চিঠি-পত্রের মাধ্যমে হাদীস শরীফের তালীম দিতেন। এটি এ-ও নির্দেশ করে যে, দূরত্বে অবস্থান করে শিক্ষাগ্রহণের ধারাটিও সাহাবাগণের দ্বারা শুরু হয়েছিল। অপর সাহাবী সামুরা ইবনে জুনদুবও একটি সংকলন তৈরি করেছিলেন, যা পরে তাঁর পুত্র সুলায়মান ইবনে সামুরার কাছে হস্তান্তরিত হয়। এই সংকলনটিতে প্রচুর ইলমি উপাদান রয়েছে। সর্বমোট ড. হামীদুল্লাহ সাহাবীগণ দ্বারা প্রস্তুতকৃত ১৪ টি হাদীসের সংকলন আবিষ্কার করেন।
এই সংকলকগণের মধ্যে সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবু হুরায়রা সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন, যাঁরা মহানবী সা. এর পয়গাম ও হেকমতের সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসারণ এবং সেগুলোকে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের পঞ্চাশ বছর হাজারো শিক্ষার্থী ও শুভার্থীকে হাদীসের শিক্ষা দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। আবু হুরায়রা রা. তাঁর ডায়েরীর উদ্দেশ্যে হাদীসে নববীর বৃহদাকার সংগ্রহ সংকলন করে রেখেছিলেন, যেগুলি ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ। এবং শ্রোতাদেরকে তিনি সেগুলো ইমলাও (পাঠদান) করাতেন। যখনই কোনো সত্যায়ন বা স্বীকৃতির প্রয়োজন পড়তো, তিনি তাঁর লিখিত সংগ্রহ থেকে সাহায্য নিতেন।
এ উপলক্ষে ড. হামীদুল্লাহ একটি আকর্ষণীয় ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যা প্রতীয়মান করে যে, সরকারী আধিকারিকরা মহানবী সা. এর নির্দেশাবলীর হেকমত ও আসলিয়ত (প্রাজ্ঞতা ও মৌলিকতা) সংরক্ষণে এবং অনুধাবনে কত বেশি সংবেদনশীল এবং সতর্ক ছিলেন। হযরত আবু হুরায়রা রাদি. তাঁর অসম্ভব স্মৃতিশক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন, যা তাঁর প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ অনুগ্রহ ও দোয়ার ফলশ্রুতি ছিল। তাঁর স্মৃতিশক্তির খ্যাতি শুনে মদীনার গভর্নর মারওয়ান বিন হিকাম নিজ থেকে তাঁর এই খ্যাতি ও যোগ্যতার পরীক্ষা নিতে চাইলেন। তিনি আবু হুরায়রাকে ডেকে পাঠালেন এবং সূচনা বক্তব্যের পর, তিনি রাসূল সা. এর হাদীস সম্পর্কে আবু হুরায়রাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন এবং গোপনে একজন কাতিবকে এই নির্দেশ দিয়ে বসিয়ে দিলেন, যে হাদীস আবু হুরায়রা বর্ণনা করবেন, তা সে লিখে নিবে।
আবু হুরায়রা এই গোপন ব্যবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরিই বেখবর ছিলেন। উক্ত কাতিব বয়ান করেন, “মারওয়ান জিজ্ঞেস করছেন এবং আমি লিখছি। এবং হাদীসের সংখ্যা ছিল প্রচুর। এক বছর পরে, মারওয়ান আবু হুরায়রাকে আবার ডেকে পাঠালেন এবং আমি আবার একটি পর্দার আড়ালে বসে ছিলাম। তিনি সেই রেওয়ায়ত সম্পর্কে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। আমি এক বছর আগে তাঁর বর্ণনাকে আজকে বর্ণিত বর্ণনার সাথে তুলনা করতে থাকলাম। দেখলাম, আবু হুরায়রা রাদি. না একটি শব্দ বেশি বলেছেন আর না একটি শব্দ কম করেছেন।
এই ঘটনা হযরত আবু হুরায়রার স্মৃতিশক্তির প্রখরতা এবং তাঁর বর্ণিত হাদীসের সূত্র-সত্যতাকে প্রমাণ করছে শুধু নয়, বরং এ বিষয়টিও স্পষ্ট করছে যে, মারওয়ানের নির্দেশে আবু হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত অনেক হাদীস লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং এ কাজটি মূলের সাথে তুলনার পরে করা হয়েছিল।
আপন দৃষ্টিভঙ্গিকে– অর্থাৎ হাদীসের বর্ণনা মৌখিক এবং লিখিত উভয়ভাবে হয়েছে, সত্যিকার প্রামাণিকতার সাথে দালিলিক আন্দাজে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে ড. হামীদুল্লাহ হাম্মাম ইবনে মুনাব্বাহ এর হাদীসের সংকলনটিকে বেছে নেন, যিনি ছিলেন আবু হুরায়রার নিকটবর্তী শাগরেদ।
ড. হামীদুল্লাহ আবু হুরায়রা রাদি. কর্তৃক সংগৃহীত অসংখ্য রচনার সন্ধান করেছেন, যেগুলো পরবর্তীতে তাঁর শাগরিদগণ সংকলিত করেছিলেন। এই সংগ্রহগুলোর পান্ডুলিপি বার্লিন এবং এবং দামেস্কে পাওয়া যায়। এই পাণ্ডুলিপি দু’টির প্রাপ্যতার পরে ড. হামীদুল্লাহ সেগুলো বুখারী শরীফের পাঠ্যের (মতন) সাথে তুলনা করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, ইমাম বুখারীর অন্যতম শিক্ষক ইমাম আবদুর রাজ্জাক ইবনে হাম্মাম তাঁর স্বীয় সংকলনসমূহে এগুলোর বর্ণনা করেছেন। তাঁর সেই সংকলনকৃত কিতাবটি “আল মুসান্নাফ” নামে প্রকাশিত হয়ে উপলভ্য।
ইমাম আবদুর রাজ্জাক তাঁর শিক্ষক মা’মার ইবনে রাশিদের কাছ থেকে এই উপাদানটির কিছু অংশ লাভ করেছিলেন, যিনি আল-জামি নামে তাঁর নিজস্ব একটি সংগ্রহ রেখেছিলেন। আর মা’মার হাম্মাম ইবনে মুনাব্বাহ এর সরাসরি ছাত্র ছিলেন।
এভাবে ড. হামীদুল্লাহ প্রমাণ করেন যে, আবু হুরায়রার হাম্মাম ইবনে মুনাব্বাহকে হস্তান্তর করা হাদীসের সংগ্রহশালা মা’মার ও আবদুর রাজ্জাকের মাধ্যমে ইমাম বুখারীর কাছে মৌখিকভাবে এবং লিখিতভাবে হস্তগত হয়। লিখিত উপাদানের সাথে মিলিয়ে বুখারীর মতনের সম্পূর্ণ সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
এই প্রমাণ-পদ্ধতি হাদীসের ক্ষেত্রে অধ্যয়ন ও গবেষণার নতুন ধারা প্রবর্তন করে, যার ফলে শ্রুতিনির্ভর ও লোককাহিনী ভিত্তিক হাদীস সংগ্রহের দাবিটি বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীকালে এই প্রমাণ-পদ্ধতিটি অনেক মুহাদ্দিস দ্বারা গৃহীত হয়েছিল। এই সিলসিলায় তুরস্কের ডক্টর ফুওয়াদ সিজগিন, ডক্টর জিয়া-উর-রেহমান আজমি এবং ডক্টর মোস্তফা আজমি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শেষোক্ত জন এই ধারাটিকে পূর্ণতায় নিয়ে যান। ডক্টর মোস্তফা আজমির গ্রন্থসমূহ, বিশেষত তাঁর “Study in Early Hadith Literature” এই প্রমাণ পদ্ধতিকে সম্পূর্ণতা দান করে, সত্তর বছর পূর্বে ড. হামীদুল্লাহ এবং তাঁর শিক্ষক মাওলানা মানাযির আহসান গিলানী যার সূচনা করেছিলেন।
লেখক: নায়েবে সদর, আন্তর্জাতিক ইসলামী ইউনিভার্সিটি, ইসলামাবাদ।
অনুবাদক: শিক্ষার্থী, মাহাদুল ফিকরি ওয়াদদিরাসাতিল ইসলামিয়্যা, ঢাকা। ধর্মতত্ত্ব ও উচ্চতর ইসলামী গবেষণা বিভাগ।