শিল্প ও সুফ সুফি তাসাউফ

মওলবি আশরাফ:

শুনো বাঁশরির আর্তস্বর

মানুষের তৈয়ারি যা কিছু নান্দনিক— তা-ই শিল্প। শিল্প মনঃবহিস্থ ধারণা নয়, শিল্পের ইতিহাস মানুষের ইতিহাসেরই সহজাত। আমরা যে মানুষকে বুদ্ধিমান প্রাণী বলি, এর কারণ মানুষ তার জ্ঞান অভিজ্ঞতা চিন্তাদর্শন ও খেয়াল অন্য মানুষের মাঝে ছড়াতে পারে এবং পারে বংশপরম্পরায় তা ধারণ করে গতি-প্রগতি জারি রাখতে। এই বুদ্ধিগ্রাহ্য জ্ঞানের একটি প্রকার জীবন ও জগতের হাকিকত ও রহস্য প্রকাশ করে, আমরা যার নাম দিয়েছি বিজ্ঞান। আর অপর প্রকার হলো শিল্প— যার কাজ ভাবগত বিষয়ের শক্তি ও সৌন্দর্য প্রকাশ এবং মানবমনের অনুভূতিগুলো জাগিয়ে তার প্রতিক্রিয়ার উন্মেষ ঘটানো।

আল্লাহ নান্দনিক আর তিনি ভালোবাসেন নান্দনিকতাকেই। কবি অর্থ করা হলেও আরবি ‘শায়ির’ শব্দটির (বহুবচন ‘শুআরা’) আক্ষরিক অর্থ নান্দনিক ভাব প্রকাশকারী। কুরআনে যে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর ভ্রান্তরাই কেবল নান্দনিক ভাব প্রকাশকারীদের (মানে কবি বা শিল্পীদের) অনুসরণ করে, তুমি কি দেখনি তারা উপত্যকায় উপত্যকায় উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায়।’ (সুরা শুআরা:২২৪-২২৫)— একথা বলে আল্লাহ মূলত কবি বা শিল্পীদের প্রকৃতি উল্লেখ করেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ‘ভ্রান্ততার’ সম্বন্ধ সরাসরি কবি বা শিল্পীদের ওপর নয়, বরং করেছেন তাদের অনুসারীদের ওপর। অনুসারীরা ভ্রান্ত এই কারণে যে, কবি-শিল্পীরা সবসময় ‘র’ জিনিস দেয়, আর ‘র’ জিনিস ‘পিওরিফাই’ না করে ব্যবহার করা বিপজ্জনকই বটে! শিল্প মূলত ব্যক্তিক তৎপরতা, একজন কবি বা শিল্পীর কাজ নয় নবী-রসুলের মতো সমাজনীতি ও জীবনব্যবস্থার রশি সামলানো, তারা বরং কথা বলবে জীবন ও জীবনের বিকাশের, যেখানে সত্য-মিথ্যা দুটোই সমানে সমান আর থাকবে খামখেয়ালিপনা, তবু তা শেষমেশ ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের সমঝদারিতে যোজন করবে নতুন মাত্রা। কবিতায় একজন কবি শব্দের নতুন একটি অর্থ দেয়, নিখাদ স্বর্ণ তুলনীয় কোরআন নিত্যদিনের ব্যবহার্যে এলে প্রয়োজন পড়ে খাদ মেশানোর, জরুরি হয়ে পড়ে নির্দিষ্ট কোনো শব্দের বহুমাত্রিক ব্যবহারের, কবির কবিতা তখন মসিহ (উদ্ধারকর্তা) হয় তার। হজরত ওমর (রাদি.) তাই জাহেলি যুগের কবিতা পাঠ করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। এবং হতে পারে একারণেই তরফা ইবনুল আবদের কবিতার সাথে আল্লাহর রসুল (সা.) যোগ করেছিলেন— ويأتيك بالاخبارمن لم تزود —‘এমন কেউ তোমার জন্য খবর নিয়ে আসবে, যার পথখরচা তোমার দিতে হয়নি!’

No description available.

 

বসনিয়ান মুসলিম দার্শনিক আলিয়া ইজেদবেগোভিচ শিল্প ও ধর্ম বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘ধর্মের সাথে শিল্পের সখ্যতা শুরুসূত্রেই। বিষয়গত ও ঐতিহাসিক— উভয় দৃষ্টিকোণই নাটকের ধর্মীয় উৎপত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মন্দিরগুলোই প্রথম মঞ্চ। চার হাজার বছর আগে প্রথম অভিনীত পৃথিবীর প্রথম নাটক ছিল এক ধর্মাচার।… ধর্মতত্ত্ব নয়, শিল্পের মাধ্যমেই মানুষের সত্যিকার ধর্মীয় ও নৈতিক সমস্যা প্রকাশিত হয়েছে।…আঁরি বার্গসোঁর ভাষায় বিজ্ঞান যেমন জ্যোতির্বিদ্যার মানসকন্যা, তেমনই শিল্প ধর্মের মানসকন্যা।…ধর্ম আত্মার কথা বলে, শিল্প বলে চরিত্রের কথা এবং তা একই ভাবনাবিন্দুর দুটি প্রকাশ প্রক্রিয়ামাত্র। ধর্ম আত্মায় আপতিত হয়, শিল্প সেখানে পৌঁছাতে চায়, তাকে আমাদের চোখের পর্দায় তুলে ধরতে হয়। শিল্প সবসময় এই আত্মাকেই খুঁজতে চেয়েছে মানবমুখের আড়ালে।… ’

ইজেদবেগোভিচের আলাপ সহজ করে বুঝতে আমরা ধর্ণা দিতে পারি সুফি শিল্প সাহিত্যে। এবং বলতেই হয় মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র সুফিরাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রসর। চরিত্রের মুখ দিয়ে কিভাবে আত্মা পর্যন্ত পৌঁছা যায় তার প্রকৃষ্ট নমুনা সুফিদের বহুল আলোচিত দুটি চরিত্র— লাইলি ও মজনু। মজনুর প্রকৃত নাম কায়স বিন মুলাওয়াহ৷ কায়স লাইলির প্রেমে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে গেলে লোকে মজনু বা পাগল ডাকতে শুরু করে। এরপর সে যখন লাইলির বাবার কাছে লাইলির হাত প্রার্থনা করে, লাইলির বাবা মাহদি বিন সাদ তখন লোকলজ্জায় মজনুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং মেয়েকে সাকিফ গোত্রের জনৈক সম্পদশালীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। এই কাণ্ডের পর মজনু আরও বেশি পাগলপারা হয়ে যায়, মরুভূমিতে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে, নিরুদ্দেশ হয়ে পড়ে। অবশেষে একদিন মজনু লাইলিকে একান্তে ফিরে পায়, কিন্তু লাইলি তখন আর কথা কয় না, নড়েচড়েও না, মজনুর বিরহে কাঁদতে কাঁদতে সে ততদিনে দুঃসহ এই পৃথিবী ত্যাগ করেছিল।

No description available.

 

এই যে দুই মানবমুখ, সুফিরা এদেরকে আত্মার রূপক হিশেবে ব্যবহার করে তাদের কবিতায় শিল্পে প্রচার করতে থাকেন। সাধারণ মানুষ মানবাত্মা পরমাত্মার জটিল সম্পর্ক বোঝে না, বোঝে লাইলি-মজনু, মজনুকে তাই মানবত্মার রূপক আর লাইলিকে বানালেন পরমাত্মার রূপক। আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক বোঝাতে সুফিরা লাইলির প্রতি মজনুর তুমুল ভালোবাসাকে প্রথমে উপস্থাপন করেন এভাবে :
پائے سگ بوسید مجنوں خلق پرسد ایں چہ سود
گفت ایں سگے در کوئے لیلی گاہے گاہے رفتہ بود
(উচ্চারণ : পায়ে সাগ বুসিদ মজনুঁ, খলক পুরসিদ ইঁ চেঃ সোদ/ গুফত, ইঁ সাগে দর কুয়ে লাইলি গাহে গাহে রফতা বোদ)

‘পথের কুকুরের পায়ে মজনু চুমু দিচ্ছিল, লোকে জিগ্যেস করল— এমন করছ কেন? মজনু বলল, এই কুকুর লাইলির বাড়ির অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায়।’ (মওলানা রুমি)

তারপর খোদাপ্রেমের প্রসঙ্গ এনে বলেন :
عشق مولی کی کم از لیلی بود
(উচ্চারণ : ইশকে মওলা কায় কম আজ লাইলি বোদ)

‘পরমের প্রতি মানবের ভালোবাসা লাইলির প্রতি মজনুর ভালোবাসার চেয়ে কম কিসে?’ (মওলানা রুমি)

সর্বশেষ ইতি টানেন একথা বলে :
در ره منزل لیلی که خطرهاست در آن
شرط اول قدم آن است که مجنون باشی
(উচ্চারণ : দর রাহে মনজিলে লাইলি কেঃ খতরাহাস্ত দর আঁ/ শর্তে আও-ওয়াল কদমে আঁ-স্ত কেঃ মজনু বাশি)
‘লাইলির বাড়ির পথ কণ্টকাকীর্ণ আর বিপদেআপদে ভরপুর। তবে সে-পথে পা ফেলার প্রথম শর্ত হলো ওই পা মজনুর পা হতে হবে!’ (হাফিজ)

No description available.

 

ইসলামকে শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে সুফিরা যেভাবে দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়েছে, এমনকি বর্তমানেও ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা জোরালো প্রমাণ করে ইজেদবেগোভিচের বক্তব্য কতটা সঠিক।

No description available.

 

আলোকবর্তিকা আলাদা, আলো একই

যেকোনো শিল্প বোঝার জন্য প্রথমে শিল্পীকে বোঝা জরুরি। কারণ শিল্প শিল্পকর্মের মধ্যে যতটুকু থাকে তার চেয়ে অনেক বেশি থাকেন শিল্পীর অন্তরাত্মায় ও ব্যক্তিত্বে। সুফি শিল্প সাহিত্যও তা-ই।

আরবি সুফ শব্দ থেকে সুফি শব্দের বুৎপত্তি। সুফ অর্থ পশম বা পশমি কাপড়। তখনকার মুসলিম সাধকগণ সাধারণত পশমি কাপড় পরতেন। বিখ্যাত সুফি আবু আলি আল রুদবারি তাই সুফির সংজ্ঞায় বলেন, ‘সুফি হলেন এমন ব্যক্তি যিনি সর্বোচ্চ পরিশুদ্ধ অবস্থায় পশমি কাপড় পরিধান করেন।’

সুফিজম মুসলমানদের একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। মানবাত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে এর সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহর (আল্লাহর মধ্যে বিলীন হওয়ার) মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহকে চর্মচোখে দেখা যায় না, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য অদৃশ্য শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম।

সুফি দর্শন হিন্দু ও বৌদ্ধ দর্শন দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত। বিশেষ করে ‘ফানাফিল্লাহ’ বৌদ্ধদের ‘নির্বাণ’ ও ‘হিচ’ বা শূন্যতার উপলব্ধি জেন দর্শনের ‘মু’-এর সাথে আংশিক মিল রাখে।

No description available.

 

দর্শন হিশেবে অবশ্যই সুফিদের স্বাতন্ত্রিকতা আছে, এবং অন্যান্য দর্শনের মতো একেও খুব সহজে খণ্ডন করা যায়। কিন্তু সুফিরা বলে থাকেন তাদের দর্শন ‘তত্ত্বনির্ভর’ নয়, বরং ‘প্রায়োগিক’। একমাত্র সুফি নিয়ম অনুসরণের মধ্য দিয়ে সুফিজম বোঝা সম্ভব।

সুফিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি তরিকা আছে। এবং তারা অনেক কর্মকাণ্ড ও ধর্মপালনরীতি গতানুগতিক মুসলমানদের থেকে ব্যতিক্রম। কিন্তু তারপরও তারা মতবৈভিন্নতার মধ্যে ঐক্যতাকে সত্য বলে ধারণ করেন। সব সত্যের ওপর তারা প্রেমসত্যকেই কেবল প্রাধান্য দেন।

ইশকিস্তানের নাও

মজনু আর লাইলির ভালোবাসা, যা কখনোই পূর্ণতা পায়নি, কিন্তু সপ্তদশ শতকের একজন ভারতীয় সুফি শিল্পী চিত্রের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন মজনুর লাইলির সাথে মিলন হয়েছে এবং মজনু লাইলির বাহুতে মাথা রেখে মৃত্যুবরণ করছে। এই চিত্রের ধারণা সুফি কবি ফরিদুদ্দিন আত্তারের একটি কবিতাংশ থেকে নেওয়া, যেখানে বলা হয়েছে— ‘প্রেমের সংস্পর্শে অহমিকা ছাই হয়ে ঈশ্বরের বাহুতে ঢলে পড়ছে’।

সুফি শিল্প ও সাহিত্য পুরাপুরি ইশক বা প্রেমে টইটম্বুর। প্রেম আর প্রেম, অন্তহীন প্রেম। এই প্রেমের নায়ে চড়ে সুফি কবি ফখরুদ্দিন ইরাকি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’কে বদলে বানিয়েছিলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল ইশক’— কোনো প্রভু নাই একমাত্র প্রেম ছাড়া!

সুফি সঙ্গীত— সেমা কিংবা কাওয়ালি সেই প্রেমেরই দুর্দান্ত প্রকাশ। সুফিরা সঙ্গীতশিল্পে এত বেশি কাজ করেছেন যে, প্রাচ্যের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত তাদের বাদ দিয়ে কল্পনাও করা যায় না, এবং এক্ষেত্রে তাদের অবদান দুই চার বাক্যে সম্পন্নও করা যায় না। সঙ্গীতশাস্ত্রের রাগ থেকে শুরু করে অনেক বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভাবক সুফিরা। সুফিদের আখড়ায় সঙ্গীত একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। সেমা শুনতে শুনতে আল্লাহর ধ্যান বা জিকির করা তাদের রিচুয়ালের অংশ। সেমার তালে তালে নৃত্য অবশ্য একমাত্র মওলবিয়া তরিকার অনুসারীরাই করেন। পশ্চিমারা তাদেরকে ‘Whirling Dervishes’ বলে। তারা মূলত মওলানা রুমিকে গুরু মানেন। তাদের নৃত্যশৈলী অনেকটা এমন : ‘শুরুতেই একজন দরবেশ অন্য একজন দরবেশের সামনে এসে চোখে চোখ রেখে সম্মান প্রদর্শন করেন। এরপর একজনকে গুরু মনোনীত করা হয়, যাকে অনুসরণ করে অন্যেরা নিজেদের পথ খুঁজে পাবে। এরপর তারা কয়েক মিনিটের জন্য একটি কেন্দ্র তৈরি করে তার চারদিকে বৃত্তাকারে আবর্তিত হতে থাকেন। এভাবে ঘূর্ণনের ফলে সুফি নৃত্য সর্পিলাকারে মহাজাগতিক ছন্দের আকার ধারণ করে। সুফির দুই হাত আড়াআড়িভাবে অবস্থান করে সৃষ্টিকর্তার একাত্মবাদের জানান দেয়। কখনো আবার তারা আরবি হরফ আলিফের সাদৃশ্যে দু’হাত কাঁধের কাছে নিয়ে রাখেন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে হাত ছড়িয়ে ওপরের দিকে তোলেন। ঘূর্ণনের সময় দরবেশের ডান হাত প্রসারিত হয় সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ অর্জন আর বাম হাত প্রসারিত হয় ধরণীর সাথে যোগসূত্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে। বাম পা একই জায়গায় রেখে, ডান পায়ের সাহায্যে ঘুরতে থাকেন তারা। এভাবে দুই হাত প্রসারিত করে ক্রমাগত ঘূর্ণনের ফলে দরবেশরা আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা অর্জন করেন।’

No description available.

 

এই নৃত্যের উদ্দেশ্য জাগতিক সবধরনের অহম থেকে মুক্ত করে নিজেকে ‘হিচ’ বা শূন্য বানানো, অতঃপর নিজের মধ্যে পরমসত্যকে খোঁজা। কবি যেমন বলেন, ‘হে খোদা, আমাকে আমা থেকে আলাদা করো, যেন আমার মাঝে আমি পাই তোমাকে।’

শরাবে রঙিন জায়নামাজ

সুফি-ধারণা পৃথিবী জুড়ে এমনভাবে ছড়িয়েছে যে, বেশি দূরে নয়, আমরা যদি আমাদের ভাষা সাহিত্যে নজর বুলাই, দেখতে পাব প্রথিতযশা সব শিল্পীদের শিল্পসাহিত্যের ছত্রেছত্রে সুফি প্রভাব। বৈষ্ণব পদাবলির রাধা-কৃষ্ণ তো লাইলি-মজনুরই বাঙলায়ন৷ লালন কী হাসন রাজা— তাদের রক্তমাংসও সুফিবাদী। মধ্যযুগ থেকে বর্তমান, প্রত্যেকেই পানে মাতাল হয়েছে সুফি কবিতার শরাব।

সুফি কবিতায় বহুল ব্যবহৃত আরেকটি উপমা হলো শরাব-সাকি। শরাব বলতে তারা বোঝান আল্লাহর প্রেম, যা শরাবের মতোই মানুষকে উন্মত্ত করে তোলে। আর সাকি হলেন যিনি সেই শরাব পেয়ালায় ঢেলে দেন, অর্থাৎ যিনি ঐশ্বরিক প্রেমের দিশারী। আর পানশাল সেই ঐশ্বরিক প্রেমের লীলা-নিকেতন। সুফি কবি হাফিজ যেমন বলেন :

সাকি যে পেয়ালা আনে, শান্তি সেই লাল মদিরায়।
এতেই যা কিছু ‘আজ’, যদি এতে সব ডুবে যায়।
কেবল একটি সাধ, ভালো যেন ভেসে যেতে পারি—
কিছুতে না ভুলি যেন তার প্রেম, আলিঙ্গন তারই।
(অনুবাদ : সৈয়দ শামসুল হক)

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রভাব সৃষ্টিকারী সাহিত্যশিল্পী বলা হয় যে চারজনকে : তলস্তয়, গ্যোটে, রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়ার। এর মধ্যে দুইজন স্পষ্ট হাফিজ থেকে প্রভাবিত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন— তারা হলেন রবীন্দ্রনাথ ও গ্যোটে।

রবীন্দ্রনাথ যখন ইরান সফরে হাফিজের কবর জিয়ারতে যান, তখন তিনি বলেছিলেন : ‘আজ কত-শত বৎসর পরে জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।’ (পারস্য যাত্রী)

No description available.

 

জর্মন মহাকবি গ্যোটে তো হাফিজ দ্বারা এত বেশি প্রভাবিত হন যে, হাফিজের কবিতা ফারসিতে পড়বার জন্যে তিনি ৬৪ বছর বয়সে ফারসি শিখেন, এবং হাফিজের দিওয়ানে আদলে তিনিও দিওয়ান লিখেন। তার ‘প্রতীচ্য-প্রাচ্য দিওয়ানের’ একটি কবিতা এমন :

কোরান অনাদি কিনা সে প্রশ্ন আমার নয়
কোরান সৃষ্ট কিনা জানি না সে তত্ত্ব
এ যে মহাগ্রন্থ মানি সেকথা মুসলমান হিসেবে।
কিন্তু শরাব যে অনাদি তাতে নেই আমার সন্দেহ
ফেরেশতা সৃষ্টির পূর্বে সৃষ্টি হয়েছিল শারাব
সত্য যা-ই হোক আল্লাহর মুখের পানে
তাকাতে বেশি সক্ষম শরাবি।…

পাশ্চাত্যে ফিটজেরাল্ড অনূদিত ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত এবং মওলানা জালালুদ্দিন রুমির ‘মসনবি’ প্রতিনিয়ত পাত্রের পর পাত্র ভরে যাচ্ছে প্রেমের শরাব।

তুমি সাগরে এক বিন্দু পানি নও

পঞ্চদশ শতকে সুফি ফরিদুদ্দিন আত্তারের গ্রন্থ মান্তিকুত তয়িরের একটি চিত্রিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যা পাখপাখালির আশ্চর্য সব ছবিতে রঙিন ছিল।

সপ্তদশ শতকে উসমানি খলিফা চতুর্থ মুরাদের আমলে শিল্পী মাহমুদ পেদের ‘মেনাকিব-ই হজরত মওলানা’ চিত্রিত করেন, যেখানে মওলানা রুমির কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করেন। একই সময়ে সোহরাওয়ার্দী আঁকেন ‘জামিউস সিয়ার’। ঊনিশ শতকে বড় ক্যানভাসে আঁকা একটি ছবি, যা ব্রুকলিন মিউজিয়ামের ইসলামিক গ্যালারি সংরক্ষিত আছে, সেখানে কারবালা ও হুসাইন ইবন আলি (রাুত.)এর শাহাদাতের দৃশ্য চিত্রায়ণ করা হয়েছে। ক্যালিগ্রাফি শিল্পেও সুফিদের বেশ দখল ছিল।

সুফি শিল্পের সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়েছিল শিয়া মুসলিমদের প্রতিষ্ঠিত সাফাবি সাম্রাজ্যে। কিন্তু সেসবের নিদর্শন বর্তমান সময় পর্যন্ত খুব কমই পৌঁছেছে। প্রেম ভুলে যাওয়ায় আমরা পারিনি সেসব উত্তরাধিকার যথাযথ রক্ষা করতে।

আর দশটা জনগোষ্ঠীর শিল্প-সাহিত্যের মতো মুসলমানরাও শিল্পচর্চায় অন্যদের থেকে প্রভাব গ্রহণ করেছে যেমন অন্যদের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করেছে তেমন। প্রভাব গ্রহণের বেলায় রোমান, সাম্প্রতিক খ্রিষ্টীয় শিল্প, বাইজানটাইন শিল্পগুলো মুসলিম শিল্পে প্রভাব বিস্তার করেছে। মুসলমানদের পারস্য বিজয়ের আগে যে সাসানিয়ান শিল্প ছিল, সেই শিল্পের প্রভাবও মুসলিম শিল্পে কম নয়; এছাড়া মধ্য এশিয়ার শিল্পের প্রভাবগুলো হঠাৎ করেই এলোপাথারিভাবে মুসলিম শিল্পে প্রভাব বিস্তার করেছে। এছাড়া আঁকাআঁকি, পটারি বা টেক্সটাইলে চীনা শিল্পের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সুফিদের ছবি সংবলিত বইগুলো মানুষের ফিগার ও রঙের ব্যবহার চীনাদের সাথেই বেশি মিলে। এই প্রভাব গ্রহণ শিল্পকে সমৃদ্ধ বৈ অন্য কিছুই করেনি।

প্রভাব বিস্তার প্রসঙ্গে যদি বলা হয় বিশ শতকের আধুনিক শিল্পকলার ভিত্তি-কাঠামো মুসলিম সুফিদের শিল্পকর্ম থেকে অনুপ্রাণিত, অত্যুক্তি হবে না। ‘বিশ শতকের সূচনায় (১৯০৫ সালে) যে-বিমূর্ত শিল্পের শুরু হয়েছিল, তার উদ্বোধন করেছিলেন ফরাসি শিল্পী আঁরি মাতিস ও তার ‘লে ফভ’ সঙ্গীরা। তারা বস্তুর অবিকল প্রতিচিত্রণের দায় থেকে মুক্তি দেন শিল্পকে, দেখালেন—চিত্র বা ভাস্কর্যের বিষয়বস্তুর ওপর তার শিল্পসফলতা নির্ভর করে না; বরং করে প্রকরণ বা বর্ণ ব্যবহারের ওপর।’ আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেন, ‘মুসলিম দেশগুচ্ছে ব্যাপক ব্যবহার হতো এই রীতির, কেননা সেসব জায়গায় নিষিদ্ধ ছিল অবিকল ছবি আঁকা— সেদিক থেকে ওই দেশগুলোতেই বিমূর্ত শিল্পের সূচনা।’

No description available.

 

ফভিজম ধারার বাইরেও আঁরি মাতিস তার অনেক ছবির অনুপ্রেরণা পান সুফিদের থেকে। তার ছবির রঙ ও ফর্ম পারসিক গালিচা থেকে নেওয়া। চিত্রশিল্পের কিউবিজম আন্দোলনের অন্যতম দিকপাল পাবলো পিকাসোর চিত্রে প্রচ্ছন্নভাবে মুসলিমদের জিওমেট্রিক ফর্মের প্রভাব দেখা যায়, ইংরেজিতে যাকে ‘অ্যারাবেস্ক ফর্ম’ বলে। বিশ শতকের আরেকজন শিল্পী, ইশার, তিনিও জিওমেট্রিক ফর্ম দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র:
১) প্রাচ্য পাশ্চাত্য ও ইসলাম/ আলিয়া ইজেদবেগোভিচ
২) যার যা ধর্ম/ পীর হাবিবুর রহমান
৩) বিংশ শতাব্দীর শিল্প-আন্দোলন/ আবদুল মান্নান সৈয়দ
৪) কবিগুরু গ্যেটে/ কাজী আবদুল ওদুদ
৫) হাফিজের কবিতা/সরাই শরাব সাকি : তৃষিতের ঠোঁট (অনুবাদ : সৈয়দ শামসুল হক)
৬) Roar Media Bangla/সুফি নৃত্য : ভালোবাসার রহস্যময় অভিব্যক্তি
৭) The New York Times/ The many voices of enlightenment
৮) The Met/ Art of the Sufis
৯) The Enduring Legacy of Muslim Civilization/ Salim T. S. Al Hassani (Editor)
১০) Wikipedia/ Sufi Poetry

আগের সংবাদপশ্চিম আফ্রিকা : ফ্রান্সের মানবতাবিরোধী অপরাধ
পরবর্তি সংবাদপাপ