জাহিদ মেহজাদ
গওহরডাঙ্গা মাদরাসার হেফজখানার পাশে দাফন করা হয়েছে ‘ছদর সাহেব হুজুর’ খ্যাত আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-কে। তাঁর তো এখন নিরিবিলি শুয়ে থাকার কথা। কিন্তু না, তিনি এখনও খুশবু ছড়িয়ে যাচ্ছেন—যার যা অভ্যাস আর কী! ‘খুশবুওয়ালা তো খুশবুওয়ালাই!’ ইহলোকে থাকতে দীনের ফুল বাগিচার কোকিল হয়ে মানুষকে বসন্তের পয়গাম শুনিয়েছেন। জুঁই, চামেলী, রজনীগন্ধা হয়ে ফুলের সৌরভ ছড়িয়েছেন। পরলোকে গিয়ে এখন জান্নাতী খুশবুতে সবাইকে মাতোয়ারা করে দিচ্ছেন। কবরের মাটি আর থাকছে না। থাকে কী করে! ‘দীনহীন দীনদরদী’ এই ব-দ্বীপের মানুষগুলো তো ‘শামছুল হক ফরিদপুরী’ বলতে এমনিতেই পাগল! তাঁরা ইতিমধ্যে এই মাটিকে আবার রোগের প্রতিষেধক হিসেবেও আবিষ্কার করে ফেলেছে। হিন্দুদের কাছে তিনি ছিলেন ‘দেবতা।’ মৃত্যুর পরও দেবতার এই ম্যাজিক্যাল পাওয়ারে তাঁরা মুগ্ধ, সুতরাং তাঁরাও দলে দলে ছুটে আসছেন কবরের মাটি নিতে।
অবস্থা বেগতিক দেখে কবরের পাশে এসে দাঁড়ালেন আব্দুল হক সাহেব। হাফেজ আব্দুল হক। গওহরডাঙ্গা মাদরাসার হিফজুল কুরআন বিভাগের প্রধান। গওহরডাঙ্গা, টুংগীপাড়াসহ পুরো গোপালগঞ্জ অঞ্চলে তিনি ‘বড় হুজুর’ নামে খ্যাত ছিলেন। আমি তাঁর কাছে পড়েছি। ইয়া বড় রাগি রাগি চোখ। সবাই ভয় পেত। আমিও পেতাম। এবং শুধু আমরা না, ছোটবেলায় তাঁর মাও নাকি তাঁর চোখ দেখে ভয় পেত। তিনি একথা আমাদেরকে অনেকবার বলেছেন।
তিনি গওহরডাঙ্গা মাদরাসার অত্যন্ত প্রভাবশালী শিক্ষক ছিলেন। গওহরডাঙ্গার কোন দেন-দরবার তাঁকে ছাড়া হত না। পুরো গওহরডাঙ্গা অঞ্চল যেন তাঁর ভয়ে থর থর করে কাঁপত। এক কথায় তিনি ছিলেন ‘কিংডম অফ গওহরডাঙ্গা’র অঘোষিত ‘কিং।’ আর গওহরডাঙ্গা মানে তো শুধু ‘গওহরডাঙ্গা’ নয়। গওহরডাঙ্গা মানে বৃহত্তর ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, যশোরসহ পুরো বাংলাদেশ।
বড় হুজুরের কথা এত বলছি কেন? কারণ, তিনি এই লেখার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি ছল ছল চোখে রাজ্যের অভিমান নিয়ে বললেন, ‘ছদর সাব! আপনি কবরে শুয়ে শুয়ে কেরামতি দেখাইতেছেন, কিন্তু আমরা তো থাকতে পারতেছি না, ছেলেরা ঘ্রাণে পড়াশোনা করতে পারতেছে না, বন্ধ করেন আপনার কেরামতি! এরপর আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল ঘ্রাণ।
‘বড় হুজুর’ আর ‘ছদর সাহেব হুজুর’। একজন ইহলোকের বাসিন্দা, অন্যজন পরলোকের। তবে তাঁরা শুয়ে থাকেন প্রায় একই জায়গায়। সামান্য দুই-চার হাতের ব্যবধান। আর পার্থক্য এতটুকু যে, বড় হুজুর ঘুমান বিল্ডিংয়ে, আর ছদর সাহেব ঘুমান বিল্ডিং এর বাইরে। মাঝখানে তাঁদের আলাদা করেছে শুধু একটা দেয়াল। তবে সেই দেয়ালের জানালাটা খুলে দিলে দুজন আবার মিশে যান দুজনে। আমি বড় হুজুরকে সব সময় জানালাটা খোলা রাখতে দেখেছি। তবে কখনো জানালা দিয়ে কথা বলতে দেখিনি। অথবা হয় তো বলেছেন, আমি বুঝিনি। কারণ, তখন ওই ধরণের কথাবার্তা বুঝার বয়স আমার ছিল না। তবে বড় হুজুরের বলা একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে—
‘১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। দেশজুড়ে মার মার কাট কাট অবস্থা। অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষশক্তি রাজাকার আর স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধারা একে অপরকে যে যেভাবে পারছে মারছে। এদিকে এসে পড়েছে মাহে রমজান। গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় কর্মজীবন শুরু করার পর থেকে প্রতি বছর মাদরাসার মসজিদে বড় হুজুরই খতমে তারাবীহ পড়িয়ে আসছেন। কিন্তু এবার তিনি খুব চিন্তিত, খতমে তারাবীহ হবে কিনা? হলেও কীভাবে? মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকার, দু’দলই তো এখানকার মুসল্লি। একদল আরেকদলকে দেখলেই তো একদম জানে মেরে ফেলবে! তাহলে কী দিয়ে কী হবে?
হেফজখানার দোতলার চিলেকোঠায় বসে বড় হুজুর কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে এসব সাত-পাঁচ ভাবছেন। হঠাৎ তাঁকে চারিদিক থেকে অন্ধকার ঘিরে ধরল। সাথে সাথে তিনি কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। আর ঠিক তখনই ছদর সাহেব হুজুর এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। অভয় দিয়ে বললেন, ‘হাফেজ সাহেব! কোনো চিন্তা করবেন না, বিকালে গ্রামের মুরব্বীদের ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, এবার খতমে তারাবীহ হবে কিনা? শুধু এ টুকুই বলবেন, আর কোনো কথা বলবেন না।’
এটুকু বলেই ছদর সাহেব উধাও হয়ে গেলেন। সাথে সাথে আবার চারিদিক পরিষ্কার হয়ে গেল। মুহূর্তে বড় হুজুরের তন্দ্রাভাবটাও কেটে গেল। বিকালে মাদরাসার পক্ষ থেকে সকল মুরব্বীকে ডাকা হলে মুরব্বীরা বললেন, অবশ্যই খতমে তারাবীহ হবে। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে মাতব্বর জনাব আলেম মিয়া আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘সবাই নিশ্চিন্তে খতমে তারাবীহ পড়তে আসবেন, আমাদের পক্ষথেকে কাউকে কিছু বলা হবে না।’ আওয়ামী লীগের পক্ষথেকে খলিলুর রহমান খাঁন সাহেবও ওই একই কথা বললেন, ‘মুসলিম লীগের (রাজাকাররা) সবাই নিশ্চিন্তে খতমে তারাবীহ পড়তে আসবেন, মুক্তিবাহিনীর কেউ আপনাদের কোনো ক্ষতি করবে না।’
এই ঘটনা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার আসল উদ্দেশ্য—শামছুল হক ফরিদপুরী নামের উম্মাহ দরদী এই মানুষটি চিরনিদ্রা থেকে আবার একাত্তরে কেন জেগে উঠলেন, এই চিন্তাকে উস্কে দেওয়া। তিনি কি শুধুই খতমে তারাবীর সমাধান দিতে এসেছিলেন, নাকি একাত্তরের আতুড় ঘরে যে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হচ্ছে সেটাও শান্তিপূর্ণভাবে চালাবার পদ্ধতি বাতলে গেলেন?
আমার তো মনে হয় সেটাই। তিনি বলে গেলেন, ‘আরে ভাই, মারামারি কাটাকাটি নয়, পরামর্শের ভিত্তিতে সবকিছুর সমাধান করার চেষ্টা করো। পরমত সহিষ্ণু হও। ব্যক্তি, পরিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করো। মনে রাখবে, স্বেচ্ছাচারী মনোভাব নিয়ে কোনোদিন সাফল্যের বন্দরে পৌঁছা যায় না।’
যে মানচিত্রের প্রতি ইঞ্চি জমিনে তিনি জীবদ্দশায় ইসলামের সোনালী ফসল ফলাতে চেয়েছেন, শান্তি, সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও মানবতার ঝান্ডা উড্ডীন করতে গিয়ে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন, সেই মানচিত্রের নতুন পরিচয় নির্মাণ মুহূর্তে তাঁর কোনো অবদান থাকবে না এটা হয় কী করে?
সুতরাং তিনি জেগে উঠলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আধ্যাত্মিক রাহবার হিসেবে জেগে উঠলেন। বাংলাদেশে ইসলামের জনক, ইসলামের স্থপতি হিসেবে জেগে উঠলেন।
ইসলামের স্থপতি? হ্যাঁ, তিনিই বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের স্থপতি। কারণ, তিনিই এদেশে ইসলামের সহীহ চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। তাঁর লিখিত বই পুস্তক, তাঁর গড়া মাদরাসা মসজিদ, তাঁর করা মেহনতের উপর ভর করেই এদেশে ইসলাম দাঁড়াবার শক্তি পেয়েছে। আমার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে জিজ্ঞেস করে দ্যাখেন, জ্ঞানীজন মাত্রই বলবেন, ‘হ্যাঁ, আলো ঝলমল এই ঢাকা আজ মাদরাসার শহর হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরীর মেহনতে। এই তিলোত্তমা ঢাকা আজ মসজিদের শহর আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরীর মেহনতে। এদেশ আজ ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নামে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঈমানী জলসার আয়োজক- এই অবদান আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরীর। এদেশ আজ ইসলামের দুর্গ- এই অবদান আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরীর। এদেশে ইসলামের বিশুদ্ধ চর্চার ঝান্ডা এখনো স্বগৌরবে পত পত করে ওড়ে- এই অবদান আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরীর। এদেশে এখনো আল্লাহু আকবারের সুরে সূর্য ওঠে- এই অবদান আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরীর। এদেশে এখনো আল্লাহু আকবারের সুরে সূর্য ডোবে- এই অবদান আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরীর। এদেশে এখনো শায়খুল হাদীস, মুফতি আমীনীদের জন্ম হয়- এই অবদান আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরীর। এদেশ এখনো ক্ষণে ক্ষণে নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার স্লোগানে কেঁপে ওঠে- এই অবদান আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরীর।