‘সদর সাহেব’ : বাংলাদেশে থানবির প্রতিনিধি

সুমাইয়া মারজান:

কিছু মানুষ সময়ে জন্ম নেন না কেবল, সময় হয়ে থাকেন ইতিহাসের পাতা জুড়ে। সম্ভাবনাময় বীজ থেকে যাদের জন্ম হয়। ধীরে ধীরে পরিণত হন এক বিশাল মহীরুহে। সময়কে বদলে দিতে কালের হাওয়ায় থাকে সে মহীরুহের আধিপত্য। দিকভ্রান্ত উম্মাহর জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকেন যুগের পর যুগ। শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এমনই এক সময়ের নাম। উজ্জ্বলতম আলোকবর্তিকার নাম।

সময়টা ১৮৯৬ সাল। জানুয়ারির ২১ তারিখে বৃহত্তর ফরিদপুরের অন্তর্গত গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা গ্রামে তার জন্ম। কাকতালীয়ভাবে বা বলা যায় কুদরতের কোন এক অপার মহিমায় তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ, মায়ের নাম আমেনা।
ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে আমরা দেখতে পাই তার পূর্ব পুরুষেরা আরব থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য এই দেশে আগমন করেন। হিজরি সাতশো সনে তারা এই দেশে আগমন করেন। বসতি গড়েন ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ার গওহরডাঙ্গায়। তার প্রপিতামহ ইংরেজ বিরোধী বালাকোট আন্দোলনে শরিক হয়ে ‘গাজী’ উপাধিতে ভূষিত হন।
শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর জীবনগল্পের পরতে পরতে রয়েছে বিস্ময় মহাবিস্ময়। কিভাবে গওহরডাঙ্গার মতো অজপাড়াগাঁয়ের একটি ছেলে পরবর্তী সময়ে ইসলামি রেঁনেসার অগ্রদূত হলেন? এ এক আশ্চর্য ও সংগ্রামের ব্যাপারই বটে!

এমন এক সময় থেকে তিনি উঠে এসেছিলেন যখন অজপাড়াগাঁয়ে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া তো দূরের কথা প্রাথমিক বা সাধারণ শিক্ষা অর্জন করাটাও প্রায় বিরল ব্যাপার ছিলো। কিন্তু যার জীবনের আকাশে চমকাচ্ছে সত্যের সূর্য, যার নামের অর্থও এটাই, সে তো অদম্য, দুর্বার হবেই।

তার পিতা ছিলেন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। ছিলেন শিক্ষার ব্যাপারে খুবই সচেতন। তিনি শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতেন। তাই বালক শামসুল হককে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার জন্য পাঠালেন পাটগাতি গ্রামের এক হিন্দু পণ্ডিতের কাছে। সেখান থেকে এসে টুঙ্গিপাড়া স্কুল ও বরিশাল সুটিয়াকাঠি স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।

কৈশোর থেকেই শামসুল হক রহ. একজন আদর্শ ছাত্রের সদগুণাবলীতে বৈশিষ্ট্যময় ছিলেন। তার চারিত্রিক সনদ দিতে বাধ্য ছিলেন তার স্কুলের মুসলিম, হিন্দু সকল শিক্ষকগণ। তারা শামসুল হক রহ.-এর ব্যাপারে বলতেন, শামসুল হকের হাতে পরীক্ষার আগেই পরীক্ষার সকল প্রশ্নপত্র নির্দ্বিধায় ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসে তুলে দেওয়া যায়।

তিনি আর দশটা বালকের মতো অস্থির ও শিশুসুলভ স্বভাবের ছিলেন না। কৈশোরের দিনগুলোতেও ছিলেন না লাগামহীন । তার মধ্যে ছিল নম্রতা, বিনয়, চিন্তাশীলতা ও লাজুকতার মতো মহৎগুণগুলো । বেশি কথা বলতেন না। প্রায় সময়ই একাকী বসে কী যেন ভাবতেন। সত্যের অনুসন্ধানে তার হৃদয় সবসময়ই উদগ্রীব থাকতো।

প্রাথমিক শিক্ষার স্তর কৃতিত্বের সঙ্গে শেষ করার পর তার পিতা তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে বাঘুড়িয়া হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালে নিজের ক্লাসসহ পুরো স্কুলে তিনি প্রথমস্থান অধিকার করেন। তারপর তিনি কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৯ সালে পিতার অনুরোধেই কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ইচ্ছে ছিল পরীক্ষায় ফেল করবেন। তাহলে আর তাকে এখানে ভর্তি হতে হবে না। এই সুযোগে আরবি পড়বেন। তাই, তিন ঘণ্টার পরীক্ষা একঘণ্টায় দিয়ে বের হয়ে এলেন। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেলো পাঁচ বিষয়ে লেটারসহ এক নম্বর স্থান অধিকার করেছেন।

এদিকে শৈশব থেকেই তার ইচ্ছা ছিলো ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন। জীবনকে বিলিয়ে দিবেন ইলমের তরে। কিন্তু পরিবারের কারণে তা সম্ভবপর হচ্ছিলো না।

তাই তিনি স্কুলে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আরবি শেখতেন। সেই সময় তিনি নিজ আগ্রহে উর্দু ও ফার্সি শেখার শুরু করেন। নওয়াবপাড়া স্কুলে পড়াকালীন সময়ে আরবির প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েন। তিনি নিজেই বলেন নওয়াবপাড়া পড়াকালীন আমার ভিতরে কুরআন হাদিস বুঝার ইচ্ছাটা প্রবল আকার ধারণ করে। যার ফলে আমি স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে আরবি পড়া শুরু করে। কলকাতা আলিয়ায় পড়াকালীন তার দেখা হয় বিখ্যাত সিরাতগ্রন্থ ‘আসাহহুস সিয়ার’-এর লেখক মাওলানা আবদুর রউফ দানাপুরী রহ. এর সাথে। তিনি তারপর থেকে দানাপুরীর কাছেই আরবি পড়া শুরু করেন। কলকাতায় থাকাকালেই একদিন হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. সেখানে সফরে এলে তিনি তার সাথে সাক্ষাত করেন। তখন থানভী রহ. এর কাছে তার আদ্যোপান্ত খুলে বলেন। সব শুনে থানভী রহ. অনেক দুঃখ পান মনে এবং তার জন্য মন খুলে দোয়া করেন। পরবর্তী জীবনে ফরিদপুরী রহ. নিজেই বর্ণনা করেন, ‘থানভী রহ. এর সাথে সাক্ষাত লাভ করার পর ইলম অর্জনের আগ্রহ এতোই বেড়ে যেতে যে, তা আর দমন করে রাখতে পারতাম না। তাই কুরআন হাতে জঙ্গলে চলে যেতাম। সেখানে গিয়ে আল্লাহর কাছে অঝোরে কাঁদতাম। দোয়া করতাম কেবল। একটা সময়ে এসে তার এই দোয়া কবুল হয়েছিলো । ১৯২০ সালের দিকে ভারতবর্ষে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হয়। প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি কলকাতা থেকে থানভী রহ.-এর দরবারে উপস্থিত হন। এখানে বেশকিছু দিন অবস্থান করে থানভী রহ.-এর কাছে আধ্যাত্মিকতার তালিম গ্রহণ করেন। অতপর নিজের শায়েখ ও মুর্শিদ থানভী রহ.-এর পরামর্শে মাজাহিরুল উলুমে সাহারানপুরে ভর্তি হয়ে যান। গভীর মনোযোগের সাথে চার বছর লেখাপড়া করেন। অতপর দেওবন্দে চলে যান। দেওবন্দেও চার বছর পড়ালেখা করেন। তিনি সেখান থেকে হাদিস, ফিকাহ, তাফসির, মানতেক, নাহু-সরফসহ সব বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

দারুল উলুম দেওবন্দের পড়াশুনা শেষ করে ১৯২৮ সালে দেশে ফেরার পর থেকে আমৃত্যু সারা বাংলার আনাচে কানাচে ইলমে দ্বীন হাসিলের কেন্দ্র হিসেবে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়া, হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম বড়কাটারা,ফরিদাবাদ জামিয়া, দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম গওহরডাঙ্গা প্রভৃতি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজও তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে। নিজেও তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাদীস, তাফসীর, ফিক্‌হ, আকাইদ প্রভৃতি শিক্ষা দিয়েছেন হাজার হাজার ছাত্রকে। গড়ে তুলেছেন আব্দুল হাই পাহাড়পুরী ও আল্লামা আজীজুল হক রহ.এর মতো ছাত্রদের। তবে দেশে ফেরার পর সর্বপ্রথম ফরিদপুরী রহ. নিজের ওস্তাদ শাইখুল হাদিস মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর নির্দেশক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাদরাসায় সদরুল মুদাররিসিন পদে নিযুক্ত হন। সে সময় তার সহকর্মী হিসেবে ছিলেন ফখরে বাঙাল মাওলানা তাজুল ইসলাম, পীরজি হুজুর মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব ও হাফেজ্জী হুজুর মাওলানা মুহাম্মাদল্লাহ রহ.। সেখান থেকেই তিনি সদর সাহেব নামে পরিচিতি লাভ করেন। আমৃত্যু এই নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন।

সাধারণ জনগণের মধ্যে দ্বীনি জ্ঞান প্রচার-প্রসারের জন্য তিনি ব্যাপক ভাবে সভা-সমিতি, ওয়াজ-নসিহত ও আত্মার সংশোধনের মহান খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন নিরলসভাবে। আর তা করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও দ্বীনি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছেন।

দ্বীনি ইলম প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী মাধ্যম হল লেখালেখি । এর দ্বারা সুশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই ঘরে বসে দ্বীনি শিক্ষা লাভ করতে পারে। শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.এর যুগে বাংলা ভাষায় খাঁটি ও প্রয়োজনীয় দ্বীনি কিতাবাদি ছিল না বললেই চলে।
তখনকার যুগে মীর মশাররফ হোসেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, এস. ওয়াজেদ আলী, মাওলানা আকরাম খাঁ প্রমুখ বাংলা ভাষায় ইসলামী ভাবধারা ও চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটালেও তার কোনটাই ইসলামের ব্যবহারিক দিক সম্পর্কিত ছিল না। ছিল না আমল-আখলাক, মাসআলা-মাসাইল ও আত্মশুদ্ধির দিক নির্দেশনামূলক কোনকিছু। বরং তাদের লেখা সাহিত্যিক মানোত্তীর্ণ তথা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সম্বলিত হওয়ায় তা স্বল্প শিক্ষিত সাধারণ জনগণের জন্য সহজবোধ্য ছিল না। বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান ও দ্বীনদার জনগণ এ অভাব মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে আসছিল যুগ যুগ ধরে। সময় যেন অপেক্ষাই করে আসছিলো এমন এক মহামনীষীর যিনি তাদের এ অভাব দূর করে সহজ থেকে সহজতরভাবে দ্বীনের অমিয় সুধা পান করিয়ে ধন্য করবেন।

অবশেষে মহান আল্লাহর মেহেরবানীতে তাদের এ অভাব দূরীকরণে এগিয়ে এলেন এক যোগ্যব্যক্তি। যিনি মুজাহিদে আ’যম হযরত সদর সাহেব রহ.। অনুবাদ ও মৌলিক লেখনীর মাধ্যমে বাংলা ভাষায় তিনি ইসলামকে তুলে ধরলেন পূর্ণাঙ্গরূপে। ঈমান ও ইসলামের পরিচয়, ইসলামের ব্যবহারিক ও আত্মশুদ্ধি সম্পর্কিত বিষয়াদির বিস্তারিত বিবরণ তিনি তার রুহানি উস্তাদ মুজাদ্দিদে যামান হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর উর্দু রচনাবলী অনুবাদ করে বাংলা ভাষা-ভাষীদের খেদমতে পেশ করলেন। বেহেশতী জেওর, তালীমুদ্দীন, ফুরূউল ঈমান, হায়াতুল মোছলেমীন, ক্বসদুসসাবীল, মোনাজাতে মকবুল প্রভৃতি গ্রন্থ তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য, যা পড়ে দ্বীন সম্পর্কে একজন নিরেট গন্ডমূর্খও পর্যাপ্ত ধারণা লাভ করতে পারে এবং এই অনুযায়ী আমল করে দুনিয়া ও আখেরাত সফলতা লাভ করতে পারে।

মুসলিম উম্মাহর হেদায়াতের পথ নির্দেশক মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম সহজভাবে বুঝার জন্য তিনি রচনা করেছেন সাড়ে ষোল হাজার পৃষ্ঠা সম্বলিত অমর তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফসীরে হাক্কানী’ যা তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি।

এছাড়াও ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের পথ নির্দেশক বহু কিতাব তিনি রচনা করেছেন। প্রায় দুইশত গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ করে এবং অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে তিনি একদিকে যেমন বাংলা ভাষী মুসলমানদেরকে ইলমে দ্বীন শিক্ষা করার পথকে সুগম করেছেন তেমনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ। এত প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় তিনি লিখেছেন যে, সামান্য শিক্ষিত লোকেরও তার লেখা বুঝতে মোটেও বেগ পেতে হয় না।
তার লেখা বইগুলো মুসলিম সমাজে এতই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে যার তুলনা বিরল। আজও বাংলার নিভৃত পল্লীতেও তার অনূদিত বেহেশতী জেওর ও অন্যান্য বই আলো বিলিয়ে যাচ্ছে।

এমন বিরলপ্রজ মনীষী ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। তার ও তার শিষ্যদের অনুসৃত পথ ধরেই বাংলাদেশের আলেম সমাজের অনেকেই লেখালেখির ময়দানে বিচরণ করা শুরু করেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে তার বিশাল কর্মযজ্ঞ ও মূল্যবান রচনাসম্ভারের যথাযথ মূল্যায়ন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

আগের সংবাদসামর্থ্য থাকলে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বেতন বাড়ানো উচিত: উবায়দুর রহমান খান নদভী
পরবর্তি সংবাদপ্রশ্নফাঁসের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা : শিক্ষামন্ত্রী