সাতক্ষীরায় খতিব-লাঞ্ছনা: অমুসলিম ইউএনও’র বিচার চায় আলেমসমাজ

রাকিবুল হাসান নাঈম:

সালাম না দেয়ায় উপজেলা পরিষদ মসজিদের খতিবকে অপমান-অপদস্থ করেছেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস। শুধু এতটুকুই নয়, পরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক মিটিং থেকেও তাকে বের করে দেন। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই খতিব। তবে এখনো নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এতে ক্ষুব্ধ দেশের আলেমসমাজ। তারা বলছেন, একজন খতিবকে এভাবে অন্যায়ভাবে অপদস্থ করে নির্বাহী কর্মকর্তা অপরাধ করেছেন। তাকে আইনের হাতে তুলে দেয়ারও দাবি জানিয়েছেন তারা।

জানা গেছে, এই নির্বাহী কর্মকর্তা মসজিদের ইমাম-মুআজ্জিনদের প্রতি বরাবরই বিদ্বেষপ্রবণ। মাস খানেক আগে মসজিদের মোয়াজ্জেম হাফেজ মাসুদুর রহমানকেও তিনি অশালীন ও মানহানিকর কথা বলেছিলেন।

খতিবের সঙ্গে কী ঘটেছিল?

খতিব মো. মতিউর রহমান কলারোয়া উপজেলা মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন তিন বছর ধরে। গত ১২ রবিউল আওয়াল মহানবী হযরত মোহাম্মদের সা. জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কীভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা যায় সেটি জানার জন্য গত ৮ অক্টোবর ইউএনও স্যারকে ফোন দেন তিনি। কিন্তু বেখেয়ালে সালাম দিতে ভুলে যান। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন ইউএনও। তিনি রুক্ষ ভাষায় খতিবকে বলেন, আমাকে সালাম করলেন না কেন? আমার স্বাক্ষরে আপনার বেতন হয়। তারপর খতিবকে বেয়াদব বলেও বকাবকি করেন।

এতটুকুতেই শেষ নয়। গণমাধ্যমকে খতিব বলেন, বুধবার (১৯ অক্টোবর) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ইসলামী ফাউন্ডেশন চিঠি দিয়ে আমাকে মিটিংয়ে আমন্ত্রণ জানালে আমি সেখানে উপস্থিত হই। সেখানে ইউএনও স্যার আমাকে পূর্বের দিনের সালাম না দেয়ার কথা তোলেন। তখন আমি বলি, স্যার আমি একটু বেখেয়াল হয়ে গিয়েছিলাম। এছাড়া আমি সবসময় সালাম দেই। তখন তিনি বলেন, আমার চেহারা কি এতো ভালো যে আমার চেহারা দেখলে আপনি বেখেয়াল হয়ে যান? অন্যরা তো কেউ বেখেয়াল হয় না। আপনি বেখেয়াল হয়ে যান। বেয়াদব কোথাকার। বের হন, বের হয়ে যান এখান থেকে। যান, বের হয়ে যান। এর আগে বলেন, ছাগলটা এখনও বের হয়নি! এই বলে সেখান থেকে আমাকে বের করে দেন। এ ঘটনায় আমি জেলা প্রশাসক স্যারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।

মিটিংয়ে উপস্থিত থাকা ইসলামী ফাউন্ডেশনের ফিন্ড সুপার ভাইজার শাহজাহান কবির ফাতেহের কাছে এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, এর আগে মাস খানেক আগে মসজিদের মোয়াজ্জেম হাফেজ মাসুদুর রহমানকে এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, আপনি কি গাঁজা খান?

অমুসলিমকে সালাম দেয়ার বিধান

এ প্রসঙ্গে কথা হয় মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সালাম অর্থ শান্তি। ইসলামের একটি সৌন্দর্য, এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের হক ও অধিকার। মুসলমান পরস্পরকে সালাম দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ হতে তার উপরে শান্তি বর্ষণের দোয়া করে। সালাম এর মধ্যে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি কামনা করা হয়। অমুসলিম তো আল্লাহর উপরই সঠিক বিশ্বাস রাখে না। তাই তার জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা অর্থহীন। অমুসলমান কোন ভাইকে দিতে পারবে না।

তাহলে অমুসলিমকে কিভাবে সম্ভাষণ জানাবে? মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, সম্ভাষণ জানানোর যে বাংলা-ইংরেজি পদ্ধতি রয়েছে, যেগুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না, সেসব পদ্ধতিতে সম্ভাষণ জানানো যাবে।

রাসুলের কর্মপদ্ধতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাসুল অমুসলিম রাজা-বাদশাহদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তাদেরকে সালাম দেননি। বিসমিল্লাহ বলে শুরু করেছেন। প্রেরকের নাম উল্লেখ করতেন। তাই অমুসলিমদের সালাম দেয়া যাবে না। যদি কোনো প্রয়োজনে দিতে হয়, ‘আসসালামু আল মানিত্তাবাআল হুদা’ বলবে। আর অমুসলিমরা সালাম দিলে তদুত্তরে শুধু ‘ওয়া আলাইকুম’ বলবে।

এখনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রূপা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কবে ব্যবস্থা নেয়া হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ইসলামী ফাউন্ডেশনের ফিন্ড সুপার ভাইজার শাহজাহান কবির ফাতেহকে বলেন, খতিব সাহেব ডিসি স্যারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। তিনি বিষয়টি অবগত আছেন। আমিও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছি। গতকাল এ বিষয়ে একটি মিটিংও হয়েছে। তবে মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, আমাকে জানানো হয়নি।’

সাতক্ষীরা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ফাতেহকে বলেন, ‘ডিসি স্যারের কাছে খতিব সাহেব আবেদন করেছেন। ডিসি স্যার দেখবেন বিষয়টি। আমরাও চাই, তদন্ত করে বিষয়টির সুরাহা হোক।’

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির ফাতেহকে জানান, ‘এ বিষয়ে মসজিদের খতিব একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ তবে গতকালের মিটিং বিষয়ে কেউ মুখ খুলেননি।

আলেমদের ক্ষোভ

একজন ইমামকে অপমান অপদস্ত করায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ। পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল্লামা নূরুল হুদা ফয়েজী ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা গাজী আতাউর রহমান গণমাধ্যমে একটি বিবৃতিও দিয়েছেন।

গাজী আতাউর রহমান ফাতেহকে বলেন, সালাম প্রজাতন্ত্রের কোনো ‘কোড অব বিজনেস’ নয়, বরং সালাম ইসলাম ধর্মের একটি ধর্মীয় বিধান। রাসুল সা. মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন অন্য মুসলমানকে বেশি বেশি সালাম দিতে। আর ইমাম ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় এবং সামজিক নেতা। তাই সমাজের প্রতিটি শ্রেণিপেশার মানুষের উচিত ইমামদের আগে সালাম দেওয়া। সালাম যেহেতু একটি ধর্মীয় বিধান সেহেতু সালামের কিছু ধর্মীয় নির্দেশনাও আছে। একজন মুসলমান একজন অমুসলিমকে মুসলমানের মতো সালাম দিতে পারে না। পুরুষদের জন্যও মহিলাদের সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা পরিষদের ইমাম একজন যোগ্য আলেম হিসেবে ইসলামে সালামের বিধান ভালোভাবেই জানেন। এ জন্য তিনি ইউএনও রূপা বিশ্বাসকে সালাম না দিয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিতে অত্যন্ত সঠিক কাজ করেছেন।

রুলী বিশ্বাসের শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, রুলী বিশ্বাস ওই ইমামকে যে অপমান অপদস্ত করেছেন, তা চরম শিষ্টাচারবহির্ভূত এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তিনি দেশের সব ধর্মীয় নেতা এবং ইমামকেই অপমান করেছেন। তিনি দেশের বৃহত্তর ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন। এ ধরনের অপরাধের জন্য আমরা ইউএনও রূপা বিশ্বাসের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

রুলী বিশ্বাসকে আইনের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘ইমাম মানে নেতা। ইমামগণ নামাজের যেমন নেতা সমাজেরও নেতা। আর সমাজের নেতা হলো সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি। সমাজের মানুষ যেমন তাদেরকে সম্মান করেন, শ্রদ্ধা জানান, সমিহ করেন তেমনি রাষ্ট্র এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরাও তাদেরকে সম্মান করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইউএনও খতিবের সঙ্গে যা করলেন, তা অপরাধ। কারণ , ইসলামের দৃষ্টিতে খতিব সাহেব তাকে সালাম না দিয়ে কোনো অপরাধ করেননি। বরং সঠিক কাজই করেছেন। আমি মনে করি, এই কর্মকর্তাকে আইনের হাতে তুলে দেয়া উচিত।’

আগের সংবাদসংবাদের উৎস জানাতে সাংবাদিকদের চাপ দেওয়া যাবে না: হাইকোর্ট
পরবর্তি সংবাদএটা মহাবিপদ সংকেত পর্যন্ত যেতে পারে: দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী