
মুনশী নাঈম:
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে কওমি মাদ্রাসা বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, সিলেটে বিভাগে ১ হাজার ২৪৬টি কওমি মাদরাসা রয়েছে। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার ২০১৯ সালের তথ্যনুযায়ী সিলেটের রেজিস্ট্রেশনকৃত মাদরাসার সংখ্যা ১০৬১টি।
বেফাকের বাইরে বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত বৃহত্তর সিলেট বিভাগ কেন্দ্রীক একটি কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। নাম ‘আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে প্রাচীন। ১৯৪১ সালে হুসাইন আহমদ মাদানির নির্দেশে ডাক্তার মুর্তজা চৌধুরীর উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, এর অধীনে প্রায় ৭৬৮ টি পুরুষ এবং ১২০টি মহিলা মাদরাসা রয়েছে।
এছাড়া সিলেটের কিছু মাদরাসা তানযীমুল মাদারিস নামে উত্তরবঙ্গের আরও একটি বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দেয়। বোর্ডটি বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত এবং এটি বগুড়া জামিল মাদ্রাসার অধীনে পরিচালিত হয়। ১৯৯৫ সালের ৩ এপ্রিল মুফতি আবদুর রহমানের উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বোর্ডের অধীনে প্রায় ১৫৬৩টি মাদরাসা রয়েছে।
দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর মাদরাসা-প্রতিষ্ঠার যে নবতর বিপ্লব শুরু হয়েছিল, ঊনিশ শতকের শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরু লগ্নে বাংলা অঞ্চলে সে বিপ্লবের ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি মাদরাসা। শতবর্ষ পরও যেগুলো আজও শিক্ষার আলো বিলিয়ে যাচ্ছে মুসলিম সমাজে। সিলেটের এমনই কয়েকটি প্রাচীন মাদরাসার নাম উল্লেখ করা হলো।
১. সিলেট আলিয়া (১৯১৩)
বিশ শতকের শুরুর দিকে সিলেট শহরের নাইওরপুলে স্থানীয় মুসলিম শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ‘আঞ্জুমানে ইসলামিয়া’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। সিলেট জেলা তখন আসাম প্রদেশের অধীন। আসামের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুর আবদুল মজিদ এ মাদরাসাটিকে সম্প্রসারণ ও সরকারিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাদারাসাটিবে কলকাতা আলিয়া মাদরাসার অধিভুক্ত করেন এবং মাদরাসাটির পরিসর আরও বৃদ্ধিকরণের লক্ষ্যে নাইওরপুল থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌহাট্টায় নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে এ মাদরাসাটিই ‘সিলেট আলিয়া মাদরাসা’ নামে জনসমাজে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
মাদরাসাটি যদিও সরকারি অনুদান ও আলিয়া শিক্ষাধারার কারিকুলামে পরিচালিত হয়ে আসছে, কিন্তু দীর্ঘ একটা সময়ব্যাপী দেওবন্দি চিন্তাধারার অনেক আলেম এখানে পাঠদান করেছেন। এবং সিলেটের বরেণ্য অনেক আলেম এ মাদরাসা থেকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপণ করে পরবর্তীতে দেওবন্দে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। অনেকে আবার এমনও আছেন, যাদের সমস্ত পড়াশোনা সিলেট আলিয়াতেই হয়েছে, কিন্তু জীবনভর সহি চিন্তাধারার লালন ও অনুসরণ করে গেছেন।
২. জামিয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা (১৯১৯)
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ও মোগলা বাজার থানার অন্তর্গত এবং বিভাগীয় শহর সিলেট থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরত্বে রেলপথ ও বিশ্বরোড সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী রেঙ্গা এলাকায় মাদরাসাটির অবস্থান।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দেওবন্দের চিন্তাধারা যখন ভারত উপমহাদেশে ক্রমশ বিকাশ লাভ করছিল, সেই সময়টাতেই, ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে, দেওবন্দের অনুসারী আলেম মাওলানা আরকান আলি রহমতুল্লাহ আলায়হি এলাকাবাসীর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাদরাসাটি। প্রতিষ্ঠাকালীন মুহতামিম তিনিই ছিলেন। পরবর্তীতে মুহতামিমের দায়িত্ব পান শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর খলিফা, রেঙ্গা এলাকারই কৃতি সন্তান হজরত বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা রহমতুল্লাহ আলায়হি।
১৯৭৭-৭৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মাদরাসাটি দাওরায়ে হাদিস মাদরাসায় রূপান্তরিত হয় এবং হাজার হাজার আলেমে দীন এখান থেকে শিক্ষা সমাপণ করে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে দীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। সিলেট অঞ্চলে প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
৩. জামিয়া মোহাম্মদিয়া হাড়িকান্দী, জকিগঞ্জ, সিলেট (১৯১৯)
সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জের ৩ নং কাজলসার ইউনিয়নের হাড়িকান্দী গ্রামে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচীনতম এ দীনি বিদ্যাপীঠ।
১৯ শতকের শুরুর দিকে সিলেট অঞ্চলে ধর্মীয় শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখনকার মতো এত ব্যাপক না থাকলেও সাধারণ মানুষদের মধ্যে ধর্মের প্রতি অগাধ ভক্তি এবং জরুরি মাসআলা-মাসায়েল জানতে বেশ আগ্রহ ছিল। স্থানীয় মসজিদগুলোর ইমামদের প্রতিও সে-সুবাদে ছিল অনেক সম্মান ও ভক্তি। কোনো কোনো গ্রামে মসজিদের ইমাম গ্রাম্য সালিশের বিচারকার্যও পরিচালনা করতেন। হাড়িকান্দীর লাগোয়া গ্রাম বর্তমান দরগাহাবাহারপুর। এই গ্রামের মসজিদেই ইমামতি করতেন তৎকালীন আসাম প্রদেশের কাছাড় জেলার এমন এক প্রভাবশালী মৌলভী। নাম তাঁর আবদুল আলী রহ.।
প্রতিবছর শীতের মৌসুমে গ্রামে গ্রামে হতো ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন। সেই ধারাবাহিকতায় হাড়িকান্দী গ্রামে একবছর ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। মাহফিলে স্থানীয় ইমাম হিসেবে মাওলানা আবদুল আলীও ওয়াজ করেন। তাঁর ওয়াজে তিনি প্রস্তাব রাখেন এই এলাকায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। মাদরাসা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি তুলে ধরেন।
এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাঁর প্রস্তাবে তাৎক্ষণিক সাড়া দেন এবং এর ফলশ্রুতিতে জন্ম নেয় শতাব্দীপ্রাচীন হাড়িকান্দী মাদরাসা।
শতবর্ষের নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সেই ছোট্ট মাদরাসাটিতে এখন দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত ক্লাস নেওয়া হয়। খোলা হয়েছে মেয়েদের জন্য পৃথক শাখাও। সেখানেও দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। মাদরাসাটির অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয় সিলেটের প্রখ্যাত ও প্রয়াত আলেম মাওলানা আবদুল গণী হাড়িকান্দীর হাত ধরে। ইন্তেকালের আগ অবধি দীর্ঘদিন তিনি এ মাদরাসার দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে পুরুষ-মহিলা উভয় শাখা দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত উন্নীত হয়।
বর্তমানে প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্রছাত্রী সীমান্তবর্তী এলাকার প্রাচীনতম এ দীনি বিদ্যাপীঠ থেকে ইলমে দীন অর্জন করছে।
৪. জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম হেমু, জৈন্তাপুর (১৮৭৯)
সিলেট অঞ্চলের জৈন্তাপুর উপজেলার ধর্মীয় সংস্কৃতি আলাদা এক মহিমায় প্রস্ফুটিত সেই প্রাচীন কাল থেকেই। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এই উপজেলার বর্তমান ফতেহপুর ইউনিয়নের হেমু মৌজায় প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের শতাব্দীপ্রাচীন মাদরাসা জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম হেমু। দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুকাল পরেই দেওবন্দের আদর্শ অনুসরণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠান। বর্তমান বাংলাদেশে শতবর্ষী মাদরাসাগুলোর মধ্যে এ মাদরাসাটাই সবচেয়ে প্রাচীন হিসেবে বিবেচ্য।
স্থানীয় দুই শিক্ষানুরাগী আলেম মাওলানা মাহফুজুর রহমান ও মৌলভী হাফিজুল্লাহর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় এ মাদরাসাটি।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে খলিফায়ে মাদানি হজরত কৌড়িয়া রহ.-এর দরসদানের মাধ্যমে এখানে সর্বপ্রথম দরসে হাদিসের সূচনা হয়। তারপর দীর্ঘদিন এ প্রতিষ্ঠানটিতে শায়খুল হাদিস হিসেবে দরস দিয়েছেন হেমু এলাকার কীর্তিমান আলেম ও সিলেটের জামিয়া গহরপুরের সদ্য প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আবদুস সাত্তার (হেমুর হুজুর) রহ.।
মাদরাসাটি বর্তমানে পুরুষ ও মহিলা দুটো শাখায় সমৃদ্ধ। উভয় শাখাই দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত। প্রায় সাত শো ছাত্র-ছাত্রী প্রতিবছর এখানে অধ্যয়ন করেন।
৫. ইছামতি ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসা, ওসমানীনগর সিলেট (১৯০৫)
সিলেট জেলার বর্তমান ওসমানীনগর উপজেলার প্রাচীন এ মাদরাসাটির অবস্থান শায়খুল হাদিস আল্লামা গহরপুরী রহ.-এর জন্মস্থান বৃহত্তর গহরপুর এলাকার পাশেই, ইছামতি গ্রামে।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় আলেম মৌলভী হুরমতুল্লাহ রহ. গ্রামবাসীর সার্বিক সহযোগিতায় মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশের অসংখ্য মনীষী আলেমের সুহবত ও পদচারণায় ধন্য হয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে মাদরাসাটি বৃহৎ কোনো জামিয়ায় রূপলাভ করতে পারেনি। বর্তমানে কওমি মাদরাসা শিক্ষাধারার সানাবিয়া আম্মাহ পর্যন্ত পাঠদান করা হয় এখানে।
৬. জামেয়া কাসিমুল উলুম দরগাহ হযরত শাহজালাল রহ. (১৯৬১)
এর প্রথম নাম মাদরাসায়ে তা’লিমুল কুরআন, ১১.০৫.১৯৭৫ ঈসায়ি তারিখে নামকরণ করা হয়- মাদরাসায়ে ক্বাসিমুল উলূম, অত:পর ০৫.০৪.১৯৮৪ ঈসায়ি তারিখে নামকরণ করা হয় জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম। ২৭.০৫.১৩৮১ হিজরি মোতাবেক ০৭.১১.১৯৬১ ঈসায়ি সনে মাদারাসাটি নির্মিত হয়।প্রতিষ্ঠাতা আরিফ বিল্লাহ হাফিজ মাওলানা আকবর আলী রহ. (মৃত্যু : ২০০৫ ঈসায়ি)।
প্রতিষ্ঠায় আরও যাদের অবদান আছে : জামেয়া প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণাদাতা মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ.। অতঃপর মাজারের মোতাওয়াল্লী এ.জেড. আব্দুল্লাহ চৌধুরী দরগাহ প্রাঙ্গণে জামেয়ার জন্য ভূমি দান করেন। এছাড়াও বিশেষ অবদান রাখেন, সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসার প্রবীণ শিক্ষক মাওলানা আরশাদ আলী ও মাওলানা সায়্যিদ আলী কাছাড়ী প্রমুখ।
৭. ঢাকা উত্তর রানাপিং আরাবীয়া হুসাইনিয়া মাদরাসা : স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে এটি প্রতিষ্ঠা করেন রিয়াসত আলী শায়খে চৌঘরী। এটি সিলেটের অতি পুরাতন ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা। হাফেজ জাওয়াদ রহ. ঢাকা উত্তর রানাপিং মাদরাসায় ১৯৭২ ইং. সালে প্রথম সারির মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন।
৮. জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম দারুল হাদিস কানাইঘাট (১৮৯৩)
১৮৯৩ সনে শাইখুল ইসলাম আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরি রহ. প্রতিষ্ঠা করেন কানাইঘাট ইসলামিয়া মাদরাসা। যা পরবর্তিতে দারুল উলূম নামে অভিহিত হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জামাতে শরহে জামী পর্যন্ত শিক্ষা-দীক্ষা চলতে থাকে। ১৯৫৪ সনে আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী রহ. এর প্রচেষ্টায় দাওরায়ে হাদীস এর সূচনা হয়। অতঃপর ২০১৬ সালে তাখাস্সুস ফি উলূমিল হাদীস খোলা হয়। এবং ২০১৮ সালে ইফতা বিভাগ ও খোলা হয়।
৯. বীরদল আনওয়ারুল উলুম মাদরাসা: ১৪ ফেব্রুয়ারি,১৯৭০ ইংরেজি। ০২ ফাল্গুন, ১৩৭৬ বাংলা। মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন আলহাজ হযরত মাওলানা গোলাম ওয়াহিদ।
১০. জামেয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর (১৯৬১): ১৫ এপ্রিল ১৯৬১ ঈসায়ী, ১৭ সফর- ১৩৮১ হিজরী মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন শায়খ মাওলানা শিহাবুদ্দীন রহ.।
১১. ঐতিহ্যবাহী জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম দেউলগ্রাম: ১৩৬৪ হিজরি মোতাবেক ১৯৪৩ ঈসায়ি সনে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন আল্লামা ফযলে হক্ব রাহ. (জিঙ্গাবাড়ী,কানাইঘাট)।
১২. ঢাকাউত্তর মুহাম্মাদপুর জামিয়া দ্বীনিয়া আসআদুল উলূম রামধা: ১৯৪৯ ইংরেজী সনে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন হাফিজ মকবুল হুসাইন রহ.। ১৯৯০ সালে দাওরায়ে হাদীস উদ্বোধন হয়।
১৩. জামিয়া ইসলামিয়া হুসাইনিয়া গহরপুর সিলেট: সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার গহরপুর এলাকায় বড়বাঘা নদীর তীরে ১৯৫৭ ইং সনে উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক রাহবার বরেণ্য বুযুর্গ শাইখুল হাদীস আল্লামা হাফিজ নূরুদ্দীন আহমদ (গহরপুরী রহ.) এলাকাবাসীর আন্তরিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া হুসাইনিয়া গহরপুর।
১৪. শাহবাগ জামিয়া মাদানিয়া ক্বাসিমুল উলূম: ১৯৭৫ সালে হজরত মাওলানা শায়খ মুঈন উদ্দীন রহ. এ মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১২ সালে দাওরায়ে হাদীস উদ্বোধন হয়।
এছাড়াও ঐতিহ্যবাহী মাদরাসাগুলোর মধ্যে মাদরাসায়ে নিছারিয়া ফয়জে আম, জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার, সিলেট, সুবহানিঘাট মাদরাসা, জামেয়া মদীনাতুল উলূম দারুস সালাম, জামিয়া ইসলামিয়া মাদরাসাতুল উলুম দারুল হাদিস হরিপুর বাজার অন্যতম।
মসজিদ
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে ৫৮৬২টি মসজিদ রয়েছে। এরমধ্যে সিলেট সদরে ৭৭৪টি, দক্ষিণ সুরমায় ৪০১টি, গোলাপগঞ্জে ৬০৭টি, ফেঞ্চুগঞ্জে ১৯৮টি, বিশ্বনাথে ৫০২টি, বালাগঞ্জে ৬২৩, কোম্পানীগঞ্জে ২৫৫টি, বিয়ানীবাজারে ৫৭৬টি, গোয়াইনঘাটে ৪৩২টি, জৈন্তায় ৩৪৯টি, কানাইঘাটে ৬০৩টি, জকিগঞ্জে ৫৪২টি। এখানে জামে মসজিদের সংখ্যাই বেশি। পাঞ্জেগানা মসজিদ তার তুলনায় এক চতুর্থাংশের চেয়েও কম।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রাচীন মসজিদের পরিচিতি তুলে ধরা হলো।
১. সবচে প্রাচীন মসজিদ
জেমস ওয়াইজ বলেন, শাহজালালের সমাধিতে কমপক্ষে চারটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সবচে প্রাচীন শিলালিপিতে সুলতান ইউসুফ শাহের শাসনামলে (১৪৭৪-১৪৮১) মজলিস উজাল কর্তৃক নির্মাণের কথা উল্লেখ রয়েছে। শিলালিপিটি আরাবি হরফে তুঘরারীতিতে উৎকীর্ণ। এত ইউসুফ শাহের নাম আছে, কিন্তু তারিখের অংশটি ভেঙে গেছে। শিলালিপিটি প্রোথিত ছিল চৌকি দিঘি মসজিদে। দরগায় আস্তানা করার আগে শাহজালাল সেখানে থাকতেন। ১৬৫৮ সালে তখনকার ফৌজদার ইস্ফেন্দিয়ার খান মসিজিদটি ভেঙে ফেলেন।
২. পীর মোকাম মসজিদ: হিজরি ১০৬৩/ইং ১৬৫৩ সনে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, পাঁচ পীর মোকাম নামক স্থানে একটি মসজিদ নির্মিত হয়।
৩. দরগাহ মসজিদ: এটি হিজরি ১১৫৭/ইং ১৭৪৪ সনে ফৌজদার বাহরাম খান নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মুঘল আমলের এই মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরে শ্রীহট্টের ম্যাজিস্ট্রেট মি. জন ওয়ালিস এটির সংস্কার করেন।
৪. বড় গম্বুজ: দরগাহ মসজিদের উত্তরে অবস্থিত এই ভবনটি ১০৮৮ হিজরি/১৬৭৭ ইং সনে ফৌজদার ফরহাদ খান নির্মাণ করেন। চতুষ্কোণাকার ভবনটি একটিমাত্র গম্বুজ দ্বারা আবৃত। অভ্যন্তরে কোনো মেহরাব দেখা যায় না।
৫. মুঘল মসজিদ: বড় গম্বুজের পাশে তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি মুঘল আমলের মসজিদ দেখা যায়। এটি মিস্টার ওয়ালিস সংস্কার করেন। মসজিদটিতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত মেহরাব রয়েছে।
৬. আদিনা মসজিদ: সিলেটের মধ্যভাগে একটি ছোট টিলার ওপর একটি প্রাচীন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এখানে অসংখ্য ভাঙা ইটের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এ.কেেএম. যাকারিয়া মনে করেন, এখানে একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে এটি আদিনা মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদের ভগ্ন প্রাচীর এবং কিয়দাংশ এখনও আছে।
৭.আনাইর হাওর মসজিদ: কে. এন. দিক্ষিত আনাইর হাওরে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমরতে একটি শিলালিপি পান। এটি হিজরি ৮০৮/ইং ১৪৬০ সনের। এতে বলা হয়েছে, সুলতান বরবক শাহের রাজত্বকালে রাজকীয় হারেমের পরিচালক খান মুয়াজ্জেম খুরশিদ খান একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে মসজিদটির চিহ্ন নেই।
৮. গায়েবী মসজিদ
গায়েবী দিঘি মসজিদ বাংলাদেশের সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বারঠাকুরী ইউনিয়নে অবস্থিত একটি অতি প্রাচীন মসজিদ। এখানে ৪০০ বছরের পুরাতন পাথরের শিলালিপি পাওয়া গেছে, যা বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে রাখা আছে। পাথরের শিলালিপি থেকে ধারণা করা হয় এটি ১৭ শতকে নির্মিত হয়েছিল।
৯. শাহ পরাণের মসজিদ ও দরগাহ
হজরত শাহ্ পরাণ রহ. শায়িত আছেন সিলেটের খাদিম পাড়ায়। সিলেট শহরের প্রায় ৮ কি: মি: পূর্ব দিকে সিলেট-তামাবিল সড়ক থেকে প্রায় ০.৩ কি: মি: ভিতরে সু-উচ্চ ও মনোরম টিলায় অবস্থিত হজরত শাহ পরাণ মসজিদ ও দরগাহ্। মসজিদের পূর্ব দিকে রয়েছে সমাধিটি। শাহ পরাণ মসজিদটি আয়তকার তিন গম্বুজবিশিষ্ট এবং এর দেয়াল চার ফুট চওড়া, মসজিদটির বহির্ভাগে চার কোণে চারটি অর্ধগোলাকৃতির পার্শ্ব বুরুজ রয়েছে। এ মসজিদটির শিলালিপি ভিত্তিক নির্মাণকাল পাওয়া যায়নি। তবে সপ্তদশ শতাব্দীতে এটি নির্মিত বলে অনুমিত।
১০. শাহ আবু তোরাব মসজিদ : এটি সিলেট জেলখানার দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। শাহ আবু তোরাব ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি একটি বর্গাকার চত্বরের ওপর স্থাপিত এবং তিন গম্বুজ বিশিষ্ট।
১১. নবাবী মসজিদ
কালের সাক্ষী ঐতিহাসিক পৃথিমপাশা নবাববাড়ি মসজিদ। পূর্ব সিলেটের তৎকালীন জমিদার নবাব আলী আমজদ খানের বাড়ি কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সুদূর পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য পৃথিমপাশায় আসেন ইসমাইল খান ওরফে খান জাহান আলী। ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করার জন্য নবাববাড়ির সামনে শান বাঁধানো বিশাল দীঘির পশ্চিম পাড়ে মুঘল ও পারস্যের স্থাপত্যের আদলে নির্মিত হয় এই মসজিদটি। তিন গম্বুজবেষ্টিত এই মসজিদটিতে রয়েছে নানা কারুকার্য ও শৈল্পিক নিদর্শনের ছোঁয়া।
তথ্যসূত্র:
কওমিপিডিয়া
বাংলাদেশে মুসলিম পুরাকীর্তি, আহমেদ মাহমুদুল হক, মাওলা ব্রাদার্স
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি: সিলেট, বাংলা একাডেমি