
মাহবুব ওয়াসেল:
৪ জুলাই, ২০২০। শনিবার সকাল ৯টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের তেলকূপি সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে ঘাস কাটতে যান জাহাঙ্গীর। বেলা নয়টার দিকে ভারতের গোপালনগর বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। নিহত জাহাঙ্গীর (৪৫) তেলকূপি লম্বাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। স্থানীয়দের কাছ থেকে ও তার পরিবার সূত্রে জানা যায়, শনিবার সকালে তেলকূপি সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে ঘাস কাটতে যান জাহাঙ্গীর। বেলা নয়টার দিকে ভারতের গোপালনগর বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। পরে নিহতের পরিবার ও স্থানীয়রা জাহাঙ্গীরের মরদেহ উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসে।
এর আগের দিন ৩ জুলাই, শুক্রবার। যশোরের বেনাপোল সীমান্তের বাহাদুরপুর মাঠে রিয়াজুল ইসলাম রিয়া মোড়ল (২৬) নামে আরেক বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। দুপুর ১২টায় পোর্ট থানা পুলিশ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বাঁশঘাটা ক্যাম্পের সামনে থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে। নিহত রিয়া বেনাপোল পোর্ট থানার বাহাদুরপুর গ্রামের কাঠু মোড়লের ছেলে।
তার চারদিন আগে ২৮ জুন, শনিবার। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে জুয়েল মিয়া (২৯) নামে আরেক বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। নিহত বাংলাদেশি তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের আফাজুদ্দিনের ছেলে। সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবি ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মাকসুদুল আলম জানান, ভারতের পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ের মাটি ধসে গাছপালা পানিতে ভেসে যাচ্ছে। প্রবল স্রোতে সেই ভাসমান গাছপালা নিম্নাঞ্চলের দিকে আসতে দেখে শনিবার দুপুরের দিকে অন্যান্যদের সাথে জুয়েল মিয়াও নৌকা নিয়ে যাদুকাটা নদীতে স্রোতে ভেসে আসা গাছপালাগুলো আনতে যায়। এসময় সে আন্তজার্তিক সিমারেখা অতিক্রম করে ভারত সীমান্তের ১০০-১৫০ গজ ভেতরে প্রবেশ করে। দেখামাত্রই তার ওপর গুলি চালায় বিএসএফ।
এভাবে একের পর এক বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দেশটির সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশিদের প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলছে। নানা অজুহাতে সীমান্তে বাংলাদেশিকে গুলি কিংবা নির্যাতন করে হত্যা নিয়মতি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের প্রথম ছয়মাসে সীমান্তে যতগুলো হত্যাকাণ্ড হয়েছে, এই বছরের প্রথম ছয়মাসে সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ১৮ জন বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল, আর নির্যাতনে মারা গেছেন দুই জন। অথচ ২০২০ সালের প্রথম ছয়মাসে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ জনে। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১৯ সালের পুরো সময়টায় ভারতের সীমান্তরক্ষা বাহিনী বা বিএসএফ’র হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪৩ জন বাংলাদেশি – যাদের মধ্যে ৩৭ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন গুলিতে, আর বাকি ৬ জনকে নির্যাতন করে মারা হয়।
এসব তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সীমান্তে ২৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২১ জনেরই মৃত্যু হয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফের সৈন্যদের গুলিতে। আর ৪ নির্যাতনে মৃত্যু বরণ করেন।
উইকিপিডিয়ার দেয়া তথ্য দেওয়া তথ্য মতে, ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩ জন, ১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১ জন, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩ জন, ১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩ জন, ২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯ জন, ২০০১ সালে ৯৪ জন নিহত হন, ২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন, ২০০৬ সালে ১৪৬ জন, ২০০৭ সালে ১২০ জন, ২০০৮ সালে ৬২ জন, ২০০৯ সালে ৯৬ জন, ২০১০ সালে ৭৪ জন, ২০১১ সালে ৩১ জন, ২০১২ সালে ৩৮ জন, ২০১৩ সালে ২৯ জন, ২০১৪ সালে ৩৩ জন, ২০১৫ সালে ৪৫ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন, ২০১৯ সালে ৩৮ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ।
২০০৮ সালে ভারত সরকার ও বিএসএফ বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল যে, সীমান্তে প্রাণঘাতী কোনও অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। পরবর্তীতে ২০১১ সালে বিএসএফ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তিও করে৷ ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হয় বার বার৷ কিন্তু এরপরও চলছে সীমান্তে বেসামরিক নাগরিক হত্যা।
গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক, মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেছেন, ভারত সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন, গণমাধ্যম বিভিন্নভাবে সরকারের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছে। দ্বিপাক্ষিক সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ভারত বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেটি রাখেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে নেপাল, চীন ও পাকিস্তানের সীমান্ত রয়েছে। ওইসব সীমান্তে মাসের পর মাস, দিনের পর দিন এধরনের হত্যার ঘটনা ঘটে না। তাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমি মনে করি, এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে অর্থাৎ জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যদি প্রতিবেশির সঙ্গে সমস্যা সমাধান না করা যায়, তাহলে আমাদের জাতিসংঘে যেতে হবে। এর বিকল্প কিছু দেখা যাচ্ছে না।’