সেদিন কী ঘটেছিল নরসিংদী রেলস্টেশনে?

মুনশী নাঈম:

নরসিংদী রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্তা করার অভিযোগ এনে এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-১১। রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে শিবপুর উপজেলার ইটাখোলা এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ওই নারীর নাম মার্জিয়া আক্তার ওরফে শিলা ওরফে সায়মা (৬০)। তিনি পেশায় একজন ঘটক ও শহরের উপজেলা মোড়ের একটি বাড়ির ভাড়াটিয়া ফয়েজ আহমেদের স্ত্রী।

গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ১৮ মে ঘটনার দিন ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে স্টেশনটির ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ওই নারী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এক তরুণীকে পোশাক নিয়ে গালিগালাজ, মারধর ও শ্লীলতাহানি করেন এবং মুঠোফোনে ছবি তুলেন। নিজেকে সামলে দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে চলে যায় তরুণী। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা দুই তরুণকেও মারধর করা হয়। তাঁরাও দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে চলে যায়। পরে ভুক্তভোগী তরুণী জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল দিলে নরসিংদী মডেল থানার পুলিশ রেলস্টেশনে গিয়ে তাঁদের ঢাকার ট্রেনে উঠিয়ে দেয়।

ঘটনার সূত্রপাত কে করেছে?

আসলেই কি শিলা ওই তরুণীর শ্লীলতাহানি করেছে? নাকি ঘটনার সূত্রপাত কথিত তরুণীই করেছে।

শিলার রিমান্ড মঞ্জুরের পর শিলার আইনজীবী এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘দুদিন আগে শিলার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ঘটনার পূর্ণ বিবরণ দিয়েছে শিলা। ঘটনার দিন সকালে শিলা ঘটকালির কাজে ঢাকায় যাবার জন্য রেলস্টেশনে আসে। তখন ঢাকাগামী ট্রেনের অপেক্ষা করছিল ওই তরুণী। তার গায়ে টপস, জিন্স, গলায় ঝুলানো ওড়না। টপস এতটাই শর্ট যে, তার পেট দেখা যাচ্ছিল। স্টেশনে থাকা কয়েকজন সেটা নিয়ে কানাঘুষা করছিল। শিলা তখন মেয়েটিকে নরম স্বরে আবেদন করে, সে যেন ওড়না দিয়ে তার পেটটা আপাতত ঢেকে রাখে। শিলা মেয়েকে মমতার স্বরে এও বলে, বাড়িতে আমারও তিনটি মেয়ে আছে। আমি বুঝি কেমন লাগে।’

আইনজীবি বলেন, ‘তবে শিলার মায়ের মতো বলা কথাগুলো আমলে নেয়নি তরুণীটি। বরং সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। শিলাকে আশালীন ভাষায় গালি-গালাজ করতে থাকে। সে তার ছেলেবন্ধুকেও ডেকে আনে। তখনই স্টেশনে অপেক্ষারত লোকজন শিলাকে রক্ষা করার জন্য তেড়ে আসে। ঘটনার সূত্রপাত এভাবেই। কিন্তু ঘটনাকে প্রবাহিত করা হচ্ছে অন্যদিকে।’

আইনজীবি বলেন, ‘শিলা আমাকে গ্রেফতারের পর বলেছে, তাকে এমনভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, যেন সে কতবড় অপরাধ করেছে। অথচ তার একটি মেয়ের খিঁচুনি রোগ আছে। মাকে ছাড়া সে থাকতে পারে না। এখন মেয়েটি কিভাবে থাকবে?’

ঘটনার পর থেকে শিলা পলাতক ছিল। এর কারণ উল্লেখ করে আইনজীবি বলেন, শিলা অতি সাধারণ একজন মহিলা। ঘটকালি করে তার সংসার চলে। ঘটনায় পুলিশ জড়িয়ে যাওয়ায় সে ভয় পেয়ে যায়। পাশাপাশি পুলিশ তাকে বারবার ফোন দেয়ায় সে সিম বদলে ফেলে নিজেকে রক্ষা করতে।’

ছেলেবন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা জানত না পরিবার

ওই তরুণী ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অনলাইনে রাস্তায় তৈরি করা বিভিন্ন খাবারের ভিডিও দেখে ১৭ মে এক বন্ধুকে নিয়ে ঢাকা থেকে নরসিংদীতে গিয়েছিল সে। রাতে নরসিংদিতেই ছিল। ফেরার পথে পরদিন ভোরে নরসিংদী রেলস্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষার সময় ঘটনাটি ঘটে।

তবে ছেলেবন্ধুর সঙ্গে মেয়েটির ঘুরতে যাওয়ার খবর জানত না পরিবার। নরসিংদীর ওই ঘটনা এত দিন পরিবারের কাছে চেপে গিয়েছিল মেয়েটি। গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মেয়েটি বলে, ঘটনাটি মাকে বলবে কি না, তা নিয়ে এ কয়েক দিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। সোমবার রাতে সাহস করে মাকে বলে। মা প্রচণ্ড অবাক হয়েছেন, ভয়ও পেয়েছেন। তবে তিনি বকাঝকা করেননি। তবে ঘটনাটি এখন পর্যন্ত পরিবারে তাঁর মা ও ছোট বোন জানেন। বাবাকে জানানো হয়নি।

প্রতিবাদীকে সাধু হতে হবে?

অসামাজিক পোশাকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শিলাকে গ্রেপ্তারের পর একদল নেটিজেন বলছেন, এই মহিলার প্রতিবাদের ধরন ঠিক ছিল না, ভাষা ভাল ছিল না, এই প্রতিবাদ ইসলামসম্মত ছিল না। মহিলার গায়ে হিজাব ছিল না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রশ্নের জবাবে লেখক ও সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘নরসিংদী রেলস্টেশনে সেদিন যা ঘটেছে, সেটা কোনো পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া প্রতিবাদ ছিল না। শিক্ষিত ইসলামী মেজাজের মানুষেরা প্রতিবাদের কাজটি করেনি। প্রতিবাদ করেছে নিতান্তই সাধারণ মানুষেরা, তাৎক্ষণিক সামাজিক প্রতিবাদের ধরনে। অবশ্যই কিছু ভুল-ত্রুটি তাদের হয়েছে। এটার মধ্যে অনেক নিয়ম-কানুন খুঁজতে যাওয়া বেকার। আর খোলামেলা আপত্তিকর পোশাকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে পুরুষদের পুরাপুরি নামাজী দ্বীনদার হতে হবে এবং নারীদেরকে পূর্ণ হিজাবে ঢাকা হতে হবে, এছাড়া দুর্বল ও সামাজিক মুসলিম হিসেবেও অশ্লীল এবং আপত্তিকর পোশাকের প্রতিবাদ করা যাবে না, এটা কেমন কথা! অর্ধনগ্ন পোশাকের প্রতিবাদ করতে হলে বোরকা পরা থাকতে হবে, সেলোয়ার কামিজ পরে অর্ধনগ্ন পোশাকের প্রতিবাদ করা যাবে না-এটা কি কোনো যুক্তির কথা?’

তিনি আরও বলেন, এদেশে যত জায়গায় ভিন্নমত, তর্ক কিংবা প্রতিবাদের উত্তপ্ত ব্যাপার দাঁড়ায়, প্রতিটা জায়গায় প্রতিবাদীকে শতভাগ শুদ্ধ মানুষে উত্তীর্ণ হয়ে প্রতিবাদ করতে হয় নাকি! সামাজিক ন্যায্যতা, সাধারণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ এবং দৃশ্যমান অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলেও দরবেশ কিংবা তাপসী হয়ে তারপর মুখ খুলতে হবে, এটা তো একদমই নতুন কথা; এদেশের সাথে মিলে না।’

আগের সংবাদ‘জাতীয় কবি’র গেজেট চেয়ে দশ আইনজীবীর নোটিশ
পরবর্তি সংবাদশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বোরকা পরা শিক্ষার্থী হেনস্তার তদন্তের নির্দেশ