রাকিবুল হাসান নাঈম:
চট্টগ্রাম রাউজান থানার নূরানী মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দিতে মাদরাসার সভাপতি, সেক্রেটারি এবং মুহতামিমদেরকে চাপ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাদরাসা বন্ধ না করলে দেখানো হচ্ছে প্রশাসনের ভয়ও। চলতি বছরের শুরু থেকেই একের পর এক উপর মহল থেকে চাপ আসছে। বিভিন্ন সময় ডাকা হচ্ছে মিটিং, মুহতামিমদের শাসাচ্ছেন প্রাইমারি শিক্ষাকর্মকর্তারাও।
রাউজান থানার বিভিন্ন মাদরাসার মুহতামিমদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তারা বলছেন, চাপটা দেয়া হচ্ছে মৌখিক, ভয়টাও দেখানো হচ্ছে মৌখিক। উপর মহলের লিখিত কোনো নির্দেশনা তাদেরকে দেখানো হয়নি। মিটিংয়ে কর্মকর্তাদের মুখের ভাষা দিনকে দিন শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় আলেমদের তথ্য হলো, রাউজান থানায় প্রায় একশত মাদরাসা রয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধির চাপ
এ প্রসঙ্গে কথা হয় রাউজান থানার হলুদিয়া ইউনিয়নের এক নূরানী মাদরাসার পরিচালকের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই মুহতামিম ফাতেহকে জানান, ‘নূরানী মাদরাসা বন্ধের চাপটা শুরু হয় বছরের শুরুতে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। তখন স্থানীয় চেয়ারম্যান ইউনিয়ন অফিসে মাদরাসার মুহতামিমদের ডাকেন।’
চেয়ারম্যানের বক্তব্য কী ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনি বলেছেন, প্রাইমারি স্কুলে ছাত্রছাত্রী কম। নূরানী মাদরাসায় বেশি। অথচ স্কুল সরকার অনুমোদিত, মাদরাসা সরকার অনুমোদিত নয়। তার নির্দেশনা ছিল, আমরা যেন নূরানীর ছাত্রদেরকে স্কুলে দিয়ে আসি। মাদরাসায় বাংলা-ইংরেজি পড়ানো চলবে না। চলবে শুধু মক্তব।’
শিক্ষা অফিসারের চাপ
ইউনিয়ন পরিষদে ডেকে নিয়ে চেয়ারম্যানের নির্দেশনার পর বিষয়টি নিয়ে তেমন আর উচ্চবাচ্য হয়নি। সর্বশেষ গতমাসে জুলাইয়ে ইউনিয়ন পরিষদে আবারও মিটিং ডাকা হয়। এতে নূরানী মাদরাসার সঙ্গে ডাকা হয় কেজি স্কুলের কর্ণধারদেরও। প্রতিটি মাদরাসার পক্ষ থেকে ডাকা হয় মাদরাসার সভাপতি, সেক্রেটারি এবং মুহতামিমকে। এই মিটিংয়ে নূরানী মাদরাসা বন্ধের নির্দেশনা দেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবদুল কুদ্দুস।
এ প্রসঙ্গে হলুদিয়া নূরানী মাদরাসার মুহতামিম বলেন, ‘মিটিংয়ে বেশ কড়াভাবে কথা বলেন এই শিক্ষা অফিসার। তিনি বলেন, আগামীকাল থেকে নূরানী মাদরাসা বন্ধ করবেন। নয়ত প্রশাসনের ভয়ও দেখান তিনি।’
উপস্থিত প্রতিনিধিদের কেউ সেখানে কথা বলেনি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে কথা বলার সুযোগই দেয়া হয়নি। আমাদের একজন কিছু বলতে যাচ্ছিলো। শিক্ষা অফিসার মুখের ভাষা খারাপ করে বললেন, ‘আপনাকে ত সন্ত্রাসের মতো দেখায়।’ ভাষা খারাপ করার কারণে আর কেউ কথা বলার সাহস করেনি।
স্থানীয় আলেমদের উদ্যোগ
দ্বিতীয়বার মিটিংয়ের পর বেশ চাপে পড়ে যায় স্থানীয় নূরানী মাদরাসাগুলো। করণীয় নির্ধারণে আশু মিটিং ডাকে রাউজান থানার আঞ্চলিক কওমি শিক্ষাবোর্ড জমিয়াতুল উলামা। মিটিংয়ে ৬০টি মাদরাসার মুহতামিম উপস্থিত হন।
মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, নূরানী মাদরাসার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় এমপির সাথে আলেমরা মতবিনিময় করবে। এরজন্য একটি কমিটিও গঠন করে দেয়া হয়। কিন্তু এমপির সঙ্গে পরবর্তীতে আর আলেমদের মতবিনিময় হয়নি।
মতবিনিময় না হওয়া প্রসঙ্গে জমিয়াতুল উলামার মহাসচিব ফাতেহকে বলেন, ‘এপমির সঙ্গে আলাপে যদি হিতে বিপরীত হয়, তাই আর আলোচনা করা হয়নি। বিষয়টি যেভাবে আছে, সেভাবেই রেখে দেয়া হয়েছে।’
চট্টগ্রাম নূরানী শিক্ষাবোর্ড কী বলছে
জমিয়াতুল উলামার পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তারমধ্যে অন্যতম একটি সিদ্ধান্ত হলো, চট্টগ্রাম নূরানী শিক্ষাবোর্ডে বিষয়টি জানানো। এবং তাদেরকে আশু পদক্ষেপ গ্রহণে জোর দেয়া। পরবর্তীতে বিষয়টি নূরানী শিক্ষাবোর্ডের মহাসচিব মুফতি জসিমুদ্দিন সাহেবকে অবহিত করা হয়।
নূরানী বোর্ডের প্রতিক্রিয়া কী ছিল জানতে চাইলে জমিয়াতুল উলামার মহাসচিব বলেন, ‘মুফতি জসিমুদ্দিন সাহেব বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা যেন স্থানীয় এবং উপজেলা পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে যাই এবং তাদেরকে বুঝাই। তারপর বিষয়টি নিয়ে কী করা যায়, বোর্ড ভাববে।’
বেশি চাপ পাহাড়ের নূরানী মাদরাসায়
জুলাইয়ে শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশনার পর আরও দেড়মাস পেরিয়ে গেছে। শহরের মাদরাসাগুলোতে এখন চাপ নেই। তবে পাহাড়ের নূরানী মাদরাসাগুলো বন্ধে এখনও যথেষ্ট চাপ বিদ্যমান বলে জানিয়েছেন জমিয়াতুল উলামার মহাসচিব।
তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘আমাদের সরব হবার কারণে হয়ত আমাদের উপর এখন চাপ নেই। তবে পাহাড়ি নূরানী মাদরাসাগুলোতে যথেষ্ট চাপ আছে। আমাকে সেখানের আলেমরা বলেছেন, তাদেরকে মাদরাসা বন্ধ করে দিতে চাপ দেয়া হচ্ছে। প্রশাসনের ভয় দেখানো হচ্ছে। পাহাড়ের এই নূরানী মক্তবগুলোও চট্টগ্রাম নূরানী শিক্ষাবোর্ডের অধীনে।’
তবে পাহাড়ের নূরানী মাদরাসাগুলোতে এখন চাপ নেই বলে জানিয়েছে নূরানী শিক্ষাবোর্ডের কর্মরত আলেম মাওলানা আনিসুল ইসলাম।
নূরানী শিক্ষাবোর্ড পরিদর্শনে গোয়েন্দারা
আজ, ৩০ আগস্ট নূরানী বোর্ড পরিদর্শনে এসেছেন প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। পরিদর্শন শেষে তারা সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ে সন্তুষ্টিও প্রকাশ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘তারা এসেছিল নূরানী মাদরাসায় কী পড়ানো হয় তা জানতে। আমরা তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রদের হস্তলিপি, ইংরেজি পড়া উপস্থাপন করেছি। তারা মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন।’
নূরানী মাদরাসা বন্ধ প্রসঙ্গে গোয়েন্দারা কী বলেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা নিশ্চয়তা দিয়েছেন, মাদরাসা বন্ধ হবে না। তারা সরকারের উচ্চমহলে জানাবেন। মাদরাসা চালু রাখার জন্য যা করা দরকার করবেন।’
এর আগে নূরানী শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা প্রশাসনের সঙ্গে মাদরাসা বন্ধ করা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন বলেও জানান তিনি।