স্মৃতির মিনারে মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.

|| শিবলী আহমাদ ||

সময় ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাস। কওমি মাদরাসায় দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা হচ্ছে। চারদিকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বিশেষ করে ওলামায়ে কেরামের ওপর। কেউ গ্রেফতার, কেউ হামলা-মামলার শিকার, কেউ গুম, কেউ গৃহবন্দী। এমনই এক পরিবেশে মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. গৃহবন্দী হয়ে আছেন দীর্ঘদিন ধরে।

গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় সম্ভবত প্রতি বুধবার লালবাগ শাহী জামে মসজিদে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করতেন। আসর থেকে মাগরিবের নামাজের পর পর্যন্ত। আমিও কোন একদিন সে দোয়ায় অংশগ্রহণ করতে লালবাগ জামিয়ায় উপস্থিত হলাম। সেখানে চাচাতো ছোট ভাই শিহাব উদ্দীন পড়তো। ওর সাথে যোগাযোগ করেই যাই। আসরের নামাজ পড়লাম। কিছু মামুলাত আদায় করলাম। তারপর হুজুর দোয়া করলেন। মোনাজাতে সে কি কান্না! মনে হচ্ছিল, ছোট বাচ্চা বাবা মায়ের কাছে আবদার করে জোরজবরদস্তি করে যেভাবে বায়না পূরণ করে নেয় ঠিক তেমনি হুজুরের কান্না ও দোয়ার ভাষায় বোঝা যাচ্ছিল, আল্লাহর থেকে আবদার করেই চেয়ে নিচ্ছেন।

এর এক সপ্তাহ পর! আমি লালমাটিয়া মাদরাসায় কাফিয়া জামাতে পড়ি। কাফিয়ার রুমে মুফতি ইমদাদ সাহেবের নেগরানিতে আমরা থাকতাম। মাদরাসার দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা চলছে। আর সেদিন উসুলুশ শাশী কিতাবের পরীক্ষা ছিল। হঠাৎ মাঝরাতে আশেপাশের কান্নাকাটির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে জেগে যে দুঃসংবাদটি শুনতে পেলাম, তা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কেউ কোনো কথা বলছে না। শুধু কান্নাকাটি করছে। ইমদাদ সাহেবের ছোট ভাই আবুল বাশার ভাই থেকে খবরটি শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। বললেন, মুফতি আমিনী সাহেব আর নেই! বিশ্বাস করতে পারবেন না, কী পরিমাণে শক খেলাম! প্রচন্ড আঘাত পেলাম। যে মানুষটিকে গত সপ্তাহে দেখে আসলাম আজ তিনি নেই! এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী ছেড়ে জগদ্বাসীকে এতিম করে চলে গেছেন আপন চিরস্থায়ী ঠিকানায়। মনের অজান্তেই কান্না চলে আসলো। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। সারা রাতে আর ঘুমাতে পারলাম না।

পরদিন যথা সময়ে উসুলুশ শাশী কিতাবের পরীক্ষা কোন রকম দিয়েই ছুটলাম হুজুরকে শেষবারের মতো দেখার জন্য লালবাগের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে শুনলাম, লাশ জাতীয় ঈদগাহে যাবে লালবাগে যেয়ে লাভ নেই।‌ আবার একটু সামনে এগিয়ে শুনলাম, লাশ লালবাগেই আছে। এখনো বের হয়নি। তো আল্লাহর ওপর ভরসা করেই লালবাগের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আল্লাহর কি দয়া, আমরাও উপস্থিত হলাম আর তখনই লালবাগ শাহী মসজিদের সামনে হুজুরের লাশ উপস্থিত হলো। এখন লাশ দেখার পালা।

সম্ভবত সেদিন হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচি ছিল। এরপরেও মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটে আসছে শেষবারের মতো হুজুরকে এক নজর দেখার জন্য। মানুষের সে কি চাপ! ঐ চাপের মুখে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু হুজুরকে তো দেখতেই হবে। নিজেকে একটু শক্ত করে হুজুরকে শেষবারের মতো দেখেই ঐ ভিড় ঠেলে বের হলাম। এরপর চললাম, জাতীয় ঈদগাহে জানাযার উদ্দেশ্যে। আগেভাগে না গেলে তো মাঠে জায়গা পাবো না তাই।

জাতীয় ঈদগাহে উপস্থিত হলাম। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বড় বড় মনীষীরা হুজুরের স্মৃতিচারণ করলেন।‌ কাঁদলেন। কাঁদালেন। জানাযা সম্পন্ন হলো। পৃথিবী দেখলো হাজারো বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ইতিহাসের পাতায় সোনালী অক্ষরে লেখার মতো জানাযার একটি বিরল দৃশ্য। যা অতীত ইতিহাসে কল্পনাতীত।

আল্লাহ তায়ালা হুজুরকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন করেন। তার কবরকে নূরে নূরান্বিত করুন। তার ফয়জ ও বরকত আমাদের দান করেন। আমীন।

আগের সংবাদআমেরিকাকে সাথে নিয়ে কোনো নৈতিক পৃথিবী সম্ভব নয় : এরদোগান
পরবর্তি সংবাদনতুন পাঠক্রম নিয়ে কেন প্রশ্ন বাড়ছে, সমাধান কী