২০২০: মুসলমানদের ওপর করোনার দায় চাপাতে চেয়েছে ভারত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

বছরের শেষ প্রান্তে এসে ফিরে তাকানো যাক পেছনে ফেলে আসা ২০২০ সালে ভারতের ঘটনা পরম্পরার দিকে। বাকি দুনিয়ার মতো ভারতেও করোনাভাইরাস মহামারি এবছর বাকি সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। বস্তুত গোটা দুনিয়ায় এখনও পর্যন্ত ভারতেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছেন।

এর পাশাপাশি বছরের শুরুতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা বছরের শেষে কৃষক আন্দোলনেও উত্তাল হয়েছে ভারত। ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয়েছে রাজধানী দিল্লি। এই প্রতিবেদনে নজর দেওয়া মুসলিম বিরোধী ঘটনার দিকে।

নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

করোনাভাইরাসের সঙ্গে তখনও ভারতের পরিচয় হয়নি – এদেশে ২০২০ সাল শুরু হয়েছিল তখন সদ্য পাস-হওয়া নাগরিকত্ব আইন আর প্রস্তাবিত এনআরসি-র বিরুদ্ধে দেশব্যাপী উত্তাল প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে।

এই উদ্যোগকে অনেকেই দেখেছিলেন সমাজের একটা শ্রেণীকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা হিসেবে – যারা শপথ নিচ্ছিলেন কিছুতেই সরকারের কাছে নিজেদের পরিচয়ের নথিপত্র পেশ করবেন না, কাগজ দেখাবেন না!

দিল্লির শাহীনবাগ হয়ে উঠেছিল নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এপিসেন্টার। আট থেকে আশি বছর বয়সী মুসলিম নারীরাই সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তারা বলছিলেন, ‘আমাদের দেশদ্রোহী বা পাকিস্তানি বলে চিহ্নিত করার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও ভারতীয়রা কিন্তু সেই চেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।’

জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রী তবাসসুম বিবিসিকে বলছিলেন, ‘কাশ্মীরের অবরোধ, এনআরসি-র ঘোষণা বা মুসলিমদের পিটিয়ে মারার ঘটনা যখন ঘটেছে তখন কিন্তু দেশ পথে নামেনি। আজ অবশেষে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশের সঙ্গে দিল্লি রাজপথে নেমে এসেছে – আমি এখন কীভাবে ঘরে আটকে থাকতে পারি?’

দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে এই বিক্ষোভকারীরাই যখন উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদে পথ অবরোধ করে অবস্থান বিক্ষোভে বসলেন, পরিস্থিতি দ্রুত অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল।

বিজেপির বিতর্কিত নেতা কপিল মিশ্র পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে দাঁড়িয়েই হুমকি দিলেন, ভালোয় ভালোয় রাস্তা খালি না-করা হলে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না এবং পরিণতির জন্যও দায়ী থাকবেন না।’

পরবর্তী প্রায় চারদিন ধরে রাজধানীর এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক তান্ডব চলল, তাতে কম করে ৫৩জন নিহত হলেন – যার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ছিলেন মুসলিম।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন দিল্লি সফরে, এরই মধ্যে জ্বালিয়ে দেওয়া হল শহরের অসংখ্য মসজিদ। নালা থেকে উদ্ধার হল দাঙ্গায় নিহতদের লাশ।

মুস্তাফাবাদে ভস্মীভূত ফারুকিয়া মসজিদে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা সেদিন বিবিসিকে বলছিলেন, আরএসএসের গুন্ডারা কীভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে আর লুঠতরাজ করেছে। তাদের অভিযোগ ছিল, “হামলার সময় দিল্লি পুলিশ ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। আর এই হামলা থেকে রেহাই পায়নি মাদ্রাসার ছোট ছোট ছাত্ররাও।”

সম্পন্ন একজন মুসলিম ব্যবসায়ীর বাসার ড্রয়িংরুমে সেদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন শত শত মুসলিম নারী-শিশু-পুরুষ, ভয়ার্ত সেই মানুষগুলোকে প্রশাসন দেখতেও আসেনি।

মাসকয়েক পরে দিল্লি পুলিশ যখন এই দাঙ্গার চার্জশিট জমা দিল, তারা কিন্তু দায়ী করল নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, তাদেরই।

করোনায় মুসলিম বিদ্বেষ

করোনা পরিস্থিতি ভারত জুড়ে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছিল মুসলিম বিদ্বেষ (Islamophobic)। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য দায়ী করা হয় মুসলিমদের। করোনা ছড়িয়ে দিচ্ছে মুসলিমরা এই অজুহাতে দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় আক্রমণ করা হয় মুসলমানদের।

হাফিজ মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন (৪৪) দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের রাজ্যের বিদার জেলার হুমনাবাদে তার বন্ধুর বাড়ি থেকে কিছু শাকসবজি তুলতে গিয়েছিলেন। পথে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার স্কুটারে থামিয়ে দিয়েছিল। নাসিরুদ্দিন বলেন, একজন পুলিশ অফিসার তাকে মুসলমান বলে লাঞ্ছিত করে এবং করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তাকে দোষারোপ করে, তাকে প্রায় এক ঘন্টা আটকে রাখা হয়েছিল। সে সময় অন্যান্য যানবাহনও রাস্তায় ছিল, তিনি বিশ্বাস করেন যে, শুধু ধর্মের কারণে তাকে থামানো হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি একজন ইমাম, তাই টুপি, জোব্বা পরে থাকি এবং আমার দীর্ঘ দাড়ি আছে। পুলিশ আমাকে মারতে শুরু করে এবং বলতে থাকে যে আমার এবং আমার সম্প্রদায়ের কারণেই এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে।’

নাসেরুদিন একা নন। ভারতে বিস্তৃত করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে মুসলিমদের দায়ী করে প্রচারণা চালানোয় রাস্তায় এবং অনলাইনগুলিতে ইসলামফোবিক আক্রমণের টার্গেট হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ রাজধানী নয়াদিল্লিতে মুসলিম পরিবারগুলিতে রেশন কিট বিতরণকারী স্বেচ্ছাসেবীরা বলেছেন যে, তারা পুলিশের কাছ থেকে হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছে এবং তারা বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছে। পাঞ্জাবে, মুসলিম দুধ উৎপাদকরা বলছেন যে তাদের গ্রামবাসীরা হুমকি দিয়েছে, তাদের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে এবং লোকেরা তাদের পণ্য কিনতে কিনতে ভয় পাচ্ছে।

আগের সংবাদবিএনপির কমিটি নেই কয়েকটি জেলায়
পরবর্তি সংবাদভোট দেখতে এসে মারা গেলেন নৌকার সমর্থক সুজন