
রাগিব রব্বানি
৬ এপ্রিল। ২০১৩ সালের এ দিনটায় নাস্তিক্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ছিল পুরো দেশ। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ বাংলাদেশে ‘নাস্তিক-মুরতাদের’ দৌরাত্ম্য বন্ধ ও তাদের বিচারের দাবিতে এ দিনটায় পুরো দেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ডাক দিয়েছিল। লংমার্চে অংশ নিতে দেশের প্রতিটা অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মানুষ রওনা হয়েছিলেন ঢাকা অভিমুখে। হেফাজতে ইসলাম যদিও এ আন্দোলনকে নিরেট ধর্মীয় আন্দোলন বলে আসছিল, কিন্তু সরকারপক্ষ তারপরও আস্থা রাখতে পারছিল না তাদের ওপর। বাম ঘরানার বিভিন্ন সংগঠনও তৎপর হয়ে ওঠে এ সময়।
হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ ও মহাসমাবেশ ঠেকাতে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ ও বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন হরতাল ও অবরোধ ডেকেছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা শহরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সড়ক এবং রেল যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
লংমার্চে অংশগ্রহণের জন্য ভাড়াকৃত গাড়ির মালিকদের আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়, এ দিন ঢাকা অভিমুখে যাওয়া যাবে না। এমনটাই বলছিলেন বগুড়ার জামিল মাদরাসার সাবেক ছাত্র মাওলানা ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে একটি নোহা গাড়ি ভাড়া করেছিলাম। কথা ছিল ৫ তারিখ সন্ধ্যায় আমরা রওনা করব। কিন্তু বিকেলের দিকে নোহার মালিকের পক্ষ থেকে ড্রাইভার জানাল, তারা যেতে পারবে না। ‘নিষেধ’ আছে। আমরা তৎক্ষণাৎ আরও কয়েকটি গাড়িকে অনুরোধ করলাম, কিন্তু কেউই যেতে রাজি হয়নি।’
মাওলানা ইউসুফ বলেন, ‘আমরা তো ক্ষুদ্র কাফেলা ছিলাম, বড় বড় কাফেলাকেও সেদিন যেতে দেওয়া হয়নি। ফলে পরদিন বগুড়ায় আমরা জমায়েত হয়েছিলাম।’
‘সিলেট থেকে এমন একাধিক ক্ষুদ্র কাফেলাও সেদিনকার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফাতেহ টোয়েন্টি ফোরকে জানিয়েছে একই রকম অভিজ্ঞতার কথা। এ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা থেকে বড় বড় অনেক কাফেলা তৈরি হয়েছিল লংমার্চে শরিক হবার জন্য। গাড়িও ভাড়া করে রেখেছিল তারা। কিন্তু প্রশাসনিক বাধার কারণে রওনা করতে পারেননি।’ বলছিলেন সিলেট শহরের আল-হেরা হিজামা কটেজের সত্ত্বাধিকারী সাইফ রহমান।
তিনি বলেন, ‘২০১৩-এর ৫ এপ্রিল সাবেক এমপি মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরীর নেতৃত্বে তওহিদি জনতার বিশাল একটি গাড়িবহর সিলেট শহর থেকে লংমার্চের উদ্দেশে যাত্রা করলে প্রশাসনিক বাধার সম্মুখীন হয়। পরে মাওলানা শাহীনুর পাশা এই বহর নিয়ে পদব্রজে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। অবশ্যি এত দূরের পথ এক রাতে এভাবে পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয় বলে তা স্থগিত করে সিলেট শহরে ফিরে আসেন। নগরীর কোর্ট পয়েন্টে বসে ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে গণজমায়েত। পরদিন তা জনসমুদ্রে রূপ নেয়।’
চট্টগ্রামের লালখান বাজার মাদরাসার সেসময়কার ছাত্র মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মদ উমর বলেন, ‘শুধু সিলেটে নয়, দেশের প্রতিটা অঞ্চলেই তওহিদি জনতা এমন বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কোনো কোনো স্থানে ক্ষমতাসীনদের ক্যাডার বাহিনী সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়েছে তাঁদের সঙ্গে।’
চট্টগ্রামের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, হাটহাজারী থেকে নেতৃস্থানীয়রা আগে আগেই রাজধানীর উদ্দেশে রওনা হবার কারণে তাঁরা কোনো বাধার সম্মুখীন হননি। সাধারণ তৌহিদি জনতার অনেকেও এভাবে চলে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁদের বড় একটি অংশ হয়েছিলেন বাধার সম্মুখীন। ফলে তাঁদের আর রাজধানীতে আসা সম্ভব হয়নি। ৫ তারিখ বিকেলে নগরীর ওয়াসা মোড়ে তাঁরা গণজমায়েত করেন। পরদিন এই মোড়সহ জামিয়াতুল ফালাহ ময়দান রূপ নয় জনসমুদ্রে।
বাম ঘরানার হরতাল-অবরোধ এবং প্রশাসন কর্তৃক যোগাযোগ-ব্যবস্থায় এতসবের নিয়ন্ত্রণারোপের পরও ২০১৩-এর ৬ এপ্রিল তৌহিদি জনতার ঢল নেমেছিল রাজধানীজুড়ে। দূর-দূরান্তের পথ পায়ে হেঁটে, ছোট ছোট গাড়ি দিয়ে ভাঙা ভাঙা জার্নি করে তৌহিদি জনতার অনেকে রাজধানীতে এসেছিলেন।
শেরপুরের একটি দর্জি দোকানের মালিক তওহিদুল ইসলাম। ৬ এপ্রিলের লংমার্চে আরও অনেকের সঙ্গে শেরপুর থেকে তিনি ঢাকা এসেছিলেন। তিনি জানান, আমাদের শেরপুর থেকে কোনো দূরপাল্লার বাস সেদিন ছিল না। পরে আমরা ‘ভটভটি’ দিয়ে ভাঙা ভাঙা জার্নি করে ঢাকায় এসেছি। বড় একটি কাফেলা নিয়ে আমরা এসেছিলাম। রাস্তায় স্থানীয় মানুষজন দাঁড়িয়ে ছিল। তাঁরা যে যেভাবে পারে পানি সংগ্রহ করে লংমার্চ অভিমুখী মানুষজনকে পানি পান করাচ্ছিল।’
ফরিদপুরের বাসিন্দা আরেকজনও জানিয়েছেন এমন অনুভূতির কথা। তিনি বলেন, ফরিদপুর থেকে সরকার লঞ্চ বন্ধ করে দিয়েছিল, ফেরি পারাপার বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা লোকাল গাড়িতে চড়ে, চার-পাঁচ জায়গায় পায়ে হেঁটে লংমার্চে শামিল হয়েছিলাম। পথে পথে স্থানীয় লোকজন সোৎসাহে পানি ও বিভিন্ন ধরনের ঠাণ্ডা পানীয় আমাদের মধ্যে বিতরণ করেছিল।’
স্থানে স্থানে নানা ধরনের বাধা পেরিয়ে সিলেট থেকে আসা তরুণ আবু সাঈদ ইয়াহইয়া নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষের কী দরদ আর ভালোবাসা, সেদিন আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা নরসিংদী থেকে পায়ে হেঁটে ঢাকা এসেছি। পথে পথে দোকানদার থেকে শুরু করে ঘরের বৌ-ঝিরা পর্যন্ত লংমার্চ অভিমুখী পদব্রজী পিপাসার্ত মানুষজনকে সোৎসাহে চাপ কলের পানি থেকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঠাণ্ডা পানীয় পান করিয়েছিল।’
‘ভোর থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে আসতে থাকে তৌহিদি জনতার বড় বড় কাফেলা। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ‘আল্লাহু আকবর’, নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি এবং শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত করতে থাকেন আশপাশ। শাপলা চত্বরে তৈরি বিশাল মঞ্চ থেকে সারাদিন ধরে বক্তৃতা দেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ। দুপুরের পর শাপলা চত্বরকে ঘিরে পুরো এলাকাটি এক বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে বায়তুল মোকাররম পর্যন্ত রাস্তাটি ছিল মানুষের ভিড়ে ঠাসা। মতিঝিলকে ঘিরে আশপাশের রাস্তাগুলোতেও ছিল মানুষের স্রোত।’ ৬ এপ্রিলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছিলেন আলেম সাংবাদিক ও ত্রৈমাসিক জীবন্তিকার সম্পাদক এহসান সিরাজ।
তিনি বলেন, ‘দল-মত নির্বিশেষে আপামর মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল সেদিনকার কর্মসূচিতে। রাজধানীর ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যার যার মতো করে এ আন্দোলনে সমর্থন জানাচ্ছিল। গরমের সময় ছিল, কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া পিপাসার্ত মানুষকে বিভিন্ন কোমল পানীয় সরবরাহ করছিল তারা দেদারসে।’
এহসান সিরাজ বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের এটা ছিল প্রথম বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি। এবং তা ছিল নিতান্তই ধর্মীয় দাবি-দাওয়া নিয়ে। প্রথম প্রথম তৃণমূলের অনেক আওয়ামী সমর্থকেরও অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল এর প্রতি। ৬ এপ্রিলের লংমার্চে তা প্রত্যক্ষ করা গেছে। সরকার বিভিন্নভাবে বাধা দিলেও লংমার্চের সময় মারমুখো ছিল না। কিন্তু পরবর্তী এক মাসে দৃশ্য সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের ক্যাডার বাহিনী ব্যাপকভাবে মারমুখো অবস্থান গ্রহণ করে। এর পেছনে মূল কারণটা আমি মনে করি জামায়াত-বিএনপির অতিউৎসাহ এবং হেফাজত নেতৃত্বের ভেতর থেকে কারো কারো সরকার-পতনের আহ্বান-মূলক রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান। বিএনপি চেয়েছিল অতীতের মতো তৌহিদি জনতার কাঁধে সওয়ার হয়ে ক্ষমতায় যেতে। এসব কারণে সরকার এ আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে নিয়েছে এবং ৫ই মের নৃশংস ঘটনার জন্ম দিয়েছে।’
এহসান সিরাজ আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, সরকার তখন আন্দোলনটাকে ভুলভাবে বুঝেছিল, এবং এ ভুলের মাশুল গুনতে হয়েছিল ৬ এপ্রিল থেকে ৬ মে অবধি বিভিন্নভাবে আহত হওয়া ও শাহাদতবরণকারী ধর্মপ্রাণ নিরীহ মানুষকে।’
তবে দিনশেষে এ আন্দোলন বৃথা যায়নি বলেই মনে করেন এহসান সিরাজ। তিনি বলেন, ‘হেফাজতের আন্দোলনের পরে কিন্তু ধর্মবিদ্বেষী ব্লগারদের উৎপাত ও উস্কানি লোপ পেতে শুরু করে। নারীনীতি ও শিক্ষানীতিতে ইসলাম-বিরোধী দ্বারাগুলোর বিলোপ এ আন্দোলনেরই ফসল। এবং সর্বশেষ কওমি মাদরাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি এ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই এসেছে। সরকার এখন যেমন হকপন্থী নেতৃত্বের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে, সে-সম্পর্কটা ওই সময়ও হয়তো গড়ে উঠতে পারত, যদি-না জামায়াত-বিএনপির অতিরিক্ত সম্পৃক্তি আর সভা-সমাবেশে সরকার-বিরোধী কোনো বক্তব্য না দেওয়া হতো। আজকের সম্পর্কটা সেই সময়ে গড়ে উঠলে নির্মমভাবে এত এত প্রাণ আর রক্তের বিসর্জন হয়তো দেওয়া লাগত না।’