বার্ষিক পরীক্ষা শেষে কোর্সের ছড়াছড়ি : কতটা উপকৃত হচ্ছে ছাত্ররা?

রাগিব রব্বানি 

কওমি মাদরাসাগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে দীর্ঘ ছুটির মওসুম চলছে। যদিও অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে দাওরার পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময়ের পরে এখন শুরু হয়েছে, তবে অন্যান্য ক্লাসের ছাত্ররা পরীক্ষা দিয়ে ছুটি কাটাচ্ছে এই সময়টায়।

ছুটির অলস এই সময়টা যাতে ছাত্ররা কাজে লাগাতে পারে, সেই লক্ষ্যেই বোধহয় বেশ কয়েক বছর যাবৎ নানা উদ্যোগে নানা বিষয়ের ওপর ছুটিকালীন বিভিন্ন কোর্সের আয়োজনের প্রচলন হয়েছে।

আরবি ভাষা, সরফ-নাহু, দাওয়াহ, বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতা—ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর আলাদা আলাদাভাবে স্বল্পমেয়াদী এসব কোর্সের আয়োজন করে কওমি ঘরানার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বুনিয়াদি মাদরাসাগুলোর তুলনায় রাজধানীর প্রাইভেট মাদরাসাগুলোতেই এ ধরনের কোর্সের আয়োজন বেশি হতে দেখা যায়।

সম্প্রতি এ ধরনের কোর্সের সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য হারেই বাড়ছে। যার ফলে এসব কোর্সে ভালো মানের উদ্যোক্তা ও যোগ্য প্রশিক্ষকের সার্বক্ষণিক তদারকির পাশাপাশি এমন অনেক কোর্সও হয়, যেখানে নির্ধারিত বিষয়ের ওপর না থাকেন কোনো ভালো ও যোগ্য প্রশিক্ষক, না কোনো উদ্যোক্তা। ফলে উপকৃত হবার বদলে ছাত্ররা অনেক সময় ধোঁকার শিকারও হন।

কোর্সের এই ছড়াছড়ির ভালো-মন্দ এবং ছাত্রদের উপকৃতির বিষয়ে ফাতেহ টোয়েন্টি ফোর থেকে কথা বলেছিলাম রাজধানীর মারকাজুল লুগাতিল আরাবিয়ার পরিচালক বিশিষ্ট আরবি ভাষা প্রশিক্ষক ও দাঈ মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকীর সঙ্গে।

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী বলেন, ‘বর্তমানে কওমি মাদরাসার বিভিন্ন ছুটির সময়গুলোতে বিভিন্ন মাদরাসা নানা বিষয়ের উপর বিশেষ কোর্সের আয়োজন করে থাকে। এটা অবশ্যই অত্যন্ত ইতিবাচক। এতে সবচেয়ে বড় যে ফায়দাটা হয়, ছাত্ররা ছুটির অলস সময়টা কাজে লাগাতে পারে। একটা চর্চার ভেতর দিয়ে যাপন করে।

‘তবে এ ক্ষেত্রে আয়োজনকারীদের প্রথম যে দুর্বল দিকটা, কোনো একটি মাদরাসা বা কর্তৃপক্ষ একই সময়ে অনেকগুলো কোর্সের আয়োজন করেন, ফলে সবগুলো কোর্স একসাথে তাদের পক্ষে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। একই কর্তৃপক্ষ এক সাথে অনেকগুলো কোর্সের আয়োজন করার এই প্রবণতাটা অনেক জায়গায়ই দেখা যায় এখন, এর মূল কারণ বোধহয়, কোর্সের সংখ্যাধিক্যতা দেখানো। আমি মনে করি, সংখ্যাধিক্যতা বিবেচনায় না নিয়ে ছাত্রদের উপকৃতির কথা চিন্তা করে একেকটা প্রতিষ্ঠান যদি নির্দিষ্ট একটা বা দুটো কোর্সের আয়োজন ভালোভাবে করেন, এবং এ এক-দুটো কোর্সেই নিজেদের সমস্ত মনোযোগ ঢালেন, তাহলে ছাত্রদের যেমন উপকার হবে, কর্তৃপক্ষেরও আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা দাঁড়াবে।’

স্বল্পমেয়াদী এসব কোর্স থেকে ছাত্ররা কতটা উপকৃত হতে পারে জানতে চাইলে মাওলানা ফারুকী বলেন, ‘যেকোনো কোর্সে ছাত্রদের অংশগ্রহণের মানে এই নয় যে, সে এখান থেকে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর একদম পারদর্শী হয়ে বের হতে পারবে। বরং এসব কোর্সের উদ্দেশ্য হলো নির্ধারিত বিষয়ের ওপর ছাত্রদেরকে পথ দেখানো। এই বিষয়ে সে কীভাবে পাণ্ডিত্য অর্জন করবে, কয়দিনের প্রশিক্ষণে এটাই কেবল শেখানো হয়। আর এটা ছাত্ররা কতটা শিখতে পারল, তা নির্ভর করবে প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এবং প্রশিক্ষকদের যোগ্যতা ও মেহনতের ওপর। ছাত্রদেরকে তো অবশ্যই মেহনত করতে হবে, কিন্তু প্রশিক্ষণ যিনি বা যাঁরা দিচ্ছেন তাঁদেরকেও নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর যোগ্য, প্রশিক্ষিত এবং মেহনতি হওয়া একান্তই আবশ্যক। তাছাড়া প্রশিক্ষণের পদ্ধতি কতটা ছাত্রদের উপযোগী, নির্ধারিত বিষয়ে কী কী কিতাব তাদের সামনে রাখা হবে, এটা পরিকল্পনা করে সাজানোর ওপরও অনেকখানি নির্ভর করে ছাত্রদের উপকৃতির ব্যাপারটা। যে যত উন্নত পরিকল্পনায় এটা সাজাতে পারেন, তাঁর ছাত্ররাই তত বেশি উপকৃত হয়।’

নিজের পরিচালিত মারকাজুল লুগায় আরবি ভাষা প্রশিক্ষণের বিশেষ কোর্সে দিন-রাত ছাত্রদের পেছনে মেহনত করেন মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী 

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী আরবি ভাষার প্রশিক্ষক হবার পাশাপাশি মদিনা ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েটও। তাঁর পরিচালিত মারকাজুল লুগাতিল আরাবিয়ায় তিনি মাদরাসার ছুটির সময়ে আরবি ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করেন। স্বল্পমেয়াদী এসব কোর্সে নিজের সবটুকু যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে মেহনত করেন ছাত্রদের পেছনে। প্রশিক্ষণের দিনগুলোতে আর সব ব্যস্ততা বাদ দিয়ে দিনরাত তিনি ছাত্রদের পেছনেই লেগে থাকেন। তো বর্তমানে কোর্সের যে ছড়াছড়ি, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেবল ব্যবসায়িক চিন্তাধারা থেকেই এসব কোর্স চালু করা হয়, যেখানে ভালো মানের নিয়মিত কোনো প্রশিক্ষক যেমন থাকেন না, তেম্নি কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যও খুব একটা মহৎ হয় না; মাওলানা ফারুকীকে জিগেশ করেছিলাম, এ ধরনের কোর্সকে কীভাবে দেখেন তাঁরা, এবং তাঁদের উদ্দেশ্যে তাঁর কিছু বলার আছে কি না।

উত্তরে মাওলানা ফারুকী বলেন, ‘আসলে ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে এই সমস্ত কোর্সের আয়োজন করা দুঃখজনক। তখন আর কোর্সের উদ্দেশ্য খুব একটা ঠিক থাকে না। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ বিবেচনা করে ভালো মানের নিয়মিত কোনো প্রশিক্ষকও রাখা হয় না। বা যারা প্রশিক্ষণ দেন, তারা ওইভাবে খুব একটা মেহনত করেন না, ফলে ছাত্ররা নিজেদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এখান থেকে নিতে পারে না। আমাদেরকে এই বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে, একটা ছাত্র তাঁর ছুটির সময়টা ঘোরাঘুরি করে কাটাতে পারত, কিন্তু সে তা না করে কোর্সে অংশগ্রহণ করেছে, এটা কিন্তু ইলমের প্রতি তার নিখাঁদ ভালোবাসা ও মনোযোগিতারই প্রমাণ। এবং এটা তাঁর জন্য অনেক বড় একটা কুরবানি। এখন তাঁকে যদি আমরা নামকাওয়াস্তে কিছু দরস দিয়ে বিদায় করে দিই, আশানুরূপ উপকার যদি সে এখান থেকে না পায়, তবে তাঁর এই কুরবানির সঙ্গে আমাদের ধোঁকাবাজি করা হলো। কোর্স যাঁরা পরিচালনা করেন বা আয়োজন করেন, এই ব্যাপারটা তাঁরা একবার ভেবে দেখবেন বলে আমি আশা রাখি।

আগের সংবাদরেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি রোধে ব্যবস্থা
পরবর্তি সংবাদজিপিএ-৫ অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বের হয়ে আসার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর