
আবু জর
স্বজন কিংবা বন্ধুর খবর পেতে এখন আর অপেক্ষায় থাকতে হয় না দিনের পর দিন। যেটা এক সময় হতো হাতের লেখা চিঠির কল্যাণে। চিঠির স্থলে এসে গেল এসএমএস। যোগাযোগ মাধ্যমের এই পরিবর্তনে মানুষের জীবনযাত্রা এখন সহজ হয়ে গেলেও হারিয়ে যাচ্ছে চিঠি।
আজকাল গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র প্রযুক্তির প্রভাবে চাপা পড়েছে চিঠির অধ্যায়। ডাকঘরগুলো শুধু সরকারি নথিপত্র পাঠানোর কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া প্রিয়জনের কাছে পাঠানো কোনো ব্যক্তিগত চিঠি এখন আর মেলে না ডাক বিভাগে।
একটা সময় ছিল। এটা সম্ভবত বাংলাদেশে শেষ দেখা গেছে নব্বইর দশকে। অফিসের খাকি পোশাকের পিয়ন দরজায় কড়া নেড়ে যখন উচ্চস্বরে হাক দিত চিঠি… তখন কে আগে চিঠি নেবে এই ভেবে ঘরের শিশুদের মাঝে দৌড় প্রতিযোগিতাও হয়ে যেতো। মা-বাবা তার সন্তানের হাতে লেখা চিঠি যখন পড়তেন লেখার মধ্যে তখন হৃদয় দিয়ে সন্তানের মুখ দেখতে পেতেন। আবার যে মা-বাবা নিজে পড়তে পারতেন না, তারা চিঠিটি গ্রামের পড়তে পারা লোকদের কাছে নিয়ে যেতেন একটু পড়ে দেওয়ার জন্য। দীর্ঘদিন ঘরের দরজায় পিয়নের কড়া নাড়া না শুনলে পিতা মাতার মন সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তার মেঘ জমে কালো হয়ে যেত। আমাদের ভালবাসা নিয়ন্ত্রণ করত চিঠি।
এই চিঠিই ছিলো আগের দিনের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। নানা ধরণের কথোপকথন হতো এই চিঠির মাধ্যমে। আর চিঠি পত্র আদান প্রদানের সকল ব্যবস্থায় ছিলো পোষ্ট অফিস নির্ভর। ফলে সেই সময় পোষ্ট অফিসের সামনে দেখা যেতো মানুষের উপচে পড়া ভিড়। হাতে কলম আর টেবিলে রাখা সাদা কাগজে চেয়ারে বসে লেখা পত্রগুলো পড়ে কখনো আনন্দে মুখে হাসি ফুটত। আবার কোন চিঠি পড়ে চোখের পানিও গড়িয়ে পড়ত।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা যখন অভ্যস্ত ছিলাম না তখন চিঠিই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এই চিঠিই কখনও বিনোদনের খোরাক যোগাত, কখনও ব্যথাতুর হৃদয়ে কান্না ঝরাতো, কখনও উৎফুল্ল করত, কখনও করত আবেগে আপ্লুত। কী যে সেই অদ্ভুত টান কালি ও কাগজে লেখা চিঠিতে। কিছু কিছু চিঠি বারবার খুলে পড়া হত। যেন কোনদিনই পুরান হবেনা হৃদয়ের এই ভাষা। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে সেসব আনন্দ আজ ম্লান।
ইন্টারনেটের এ যুগে কাগজ-কলমে লেখা চিঠির প্রচলন অনেক কমে গেলেও তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। অনেক অফিসিয়াল চিঠি এখনও প্রতিদিন ডাক বিভাগের মাধ্যমেই আসে। তবে সেখানেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। ফেসবুক টুইটার কিংবা মেইলে চিঠি বা তথ্যের আদান-প্রদান যত দ্রুত হোক না কেন কাগজে লেখা চিঠির সেই আবেগময়তা যেন আজও ভুলবার নয়।
বিজ্ঞান আমাদের অনেক এগিয়ে দিয়েছে। নিত্য নতুন সব প্রযুক্তি। সকলের পকেটে মোবাইলফোন। নিমিষেই প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে যায় হৃদয়ের কথা। বিজ্ঞান আমাদের শ্রম বাচিয়েছে। খরচ বাচিয়েছে। এবং বাচিয়েছে সময়৷ চিঠি বয়ে নিয়ে ডাকবক্সে ফেলতে হয়না। ভুল করে বারবার কেটে দিতে হয়না। অনেক নতুনত্ব সংযুক্ত হয়েছে আমাদের জীবনে। তবে চিঠির জবাবের আশায় পথ চেয়ে বসে থাকা সেই সময়টুকুও আজ আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।
প্রযুক্তির ধারাক্রম এখন অজপাড়াগাঁয়েও পৌছে গেছে। তাই এসএমএস, মেইল আর ফেসবুকে চ্যাটই প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। পরিবারের কেউ দেশের বাইরে কিংবা অন্য কোথাও অবস্থান করলে তার খোঁজ নেওয়া হতো চিঠির মাধ্যমে। তাকে বাড়ির ‘অবস্থা’ জানানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল এই চিঠি। তখন মোবাইলের মতো দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না। জনপ্রিয় ছিল চিঠি। ২০০৪ সালেও দেশে ২৩ কোটি চিঠি লেনদেন হয়েছে। অথচ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সাধারণ চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে ৫ কোটি আর ২০১৪-১৫ সালে হয়েছে ৪ কোটি। এভাবেই প্রতিবছর ব্যক্তিগত চিঠির ব্যবহার দিন দিন কমছে। পুরনো দিনের চিঠি আজও প্রবীণ ও মধ্য বয়সীদের জীবন অধ্যায়ের পাতা। একটা সময় ডাকপিয়নেরও কদর ছিল যথেষ্ট। তাদের সঙ্গে নানা মজার ঘটনা এখনো অনেকের স্মৃতিতে অমলিন। অনেক ডাকপিয়ন প্রণয়ঘটিত অনেক বিয়ের নীরব সাক্ষী। পিঠে চিঠির বস্তা নিয়ে ঝুনঝুন ঘণ্টা বাজিয়ে রাতের আঁধারে রানার ছুটত দূরের পথে।
আজ সেই রানারের কেবল হারিয়ে যাওয়াই নয়৷ প্রভাব ফেলেছে দেশের লাভ-লোকসানের খাতেও। গত পাঁচ বছরে ডাক বিভাগকে লোকসান গুনতে হয়েছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাক বিভাগের দিকে সরকারি নজরদারি না বাড়ালে সামনে লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে। একসময়ের জনপ্রিয় যোগাযোগের মাধ্যমটি এখন অনেকটাই সরকারের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিঠির লেনদেন নেই বললেই চলে। যারা চিঠি লেনদেন করেন, ডাক বিভাগের আওতা থেকে প্রায়ই তা হারিয়ে যায়। ফলে ডাক বিভাগের বদলে জনগণের আস্থার জায়গাটি নিয়েছে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো। তথ্যমতে ২০০২-০৩ অর্থবছর থেকে বাৎসরিক লোকসান বেশি মাত্রায় শুরু হয় ডাক বিভাগে। ওই বছর লোকসান ছিল ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা। ২০০৩-০৪ অর্থবছরই লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ২২৯ কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ক্ষতি হয়েছে ২৩৪ কোটি টাকা।
আমাদের শতবছরের এই ঐতিহ্যের একটি সফল সুরাহা হোক, এই প্রত্যাশা।