আহমাদ সাব্বির
থুতনিতে এক গুচ্ছ দাড়ি নিয়ে স্কুলের সামনে যে লোকটি চা বিক্রি করতো, যাকে আমরা, কেবল আমরা কেন, সবাই মন্ত্রী চাচা বলে ডাকতাম, যার নাম আমাদের কারও কখনও জানা হয়নি। চার বছর পর ফিরে এসে তার আর দেখা পাইনি৷
আমাদের তখন উচ্ছ্বাসভরা জীবন৷ ঝলমলে রোদ্দুরে ছাওয়া থাকতো আমাদের আকাশ৷ সেই নরোমজ্জ্বল রোদ গায়ে মেখে আমরা এসে বসতাম মন্ত্রী চাচার চায়ের দোকানে৷ মন্ত্রী চাচা রক্তের মতো টকটকে লাল লিকারে দু চামচ কনডেন্সড মিল্ক ঢেলে দিয়ে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে ধরতেন আমাদের সমুখে৷ চুমুকেই বিস্বাদে আমাদের চোখের পাতা বুজে আসতো৷ তারপরও ঠিক দুপুর সাড়ে বারোটার খানিক আগে আমরা এসে জড়ো হতাম মন্ত্রী চাচার চায়ের দোকানে এবং মন্ত্রী চাচার বানানো ‘গেলা দুষ্কর’ চায়ের পেয়ালাতে ঠোঁট চুবিয়ে প্রতিক্ষীত অমৃতের অপেক্ষায় থাকতাম৷
আমরা, মানে আমি, নাজমুল, তানভীর, নয়ন মন্ত্রী চাচার চায়ের দোকানের সমুখে যে সেন্ট জেভিয়ার্স হাই স্কুল সেখানকার শিক্ষার্থী ছিলাম৷ আমাদের ক্লাস ছিল সেকেন্ড শিফটে; মর্নিং শিফট ছিল মেয়েদের৷ সাড়ে বারোটা বাজলে রহিম মিঞার ঘন্টা পেটানোর খানিক পরেই মেয়েরা স্কুল থেকে বের হতে শুরু করতো৷ আর ঠিক সেই মুহূর্তে মন্ত্রী চাচার দোকানে চায়ের পেয়ালায় ঠোঁট ছোঁয়ানো আমাদের বুকেও ঘন্টা বেজে উঠতো৷ সে ঘন্টাধ্বনি সামলাতে না পেরে কারও জিহ্বা ঝলসে যেতো, কারও-বা পেয়ালার সবটুকু চা ‘পানের’ অপেক্ষায় বরফ শীতল হয়ে উঠতো, কেউ আবার অসম্পূর্ণ পেয়ালা রেখে অযথাই দোকানের বাইরে এসে পায়চারি শুরু করে দিত৷ একমাত্র তানভীরই সাহস করতো মনিরার পাশাপাশি হেঁটে গিয়ে তার বাড়ির গলিমুখ পর্যন্ত খানিকটা পথ অতিক্রম করতে৷ তবে আমরা জানতাম—তানভীর কেবল ওই পাশাপাশি হেঁটে যাবার সাহসটুকুই দেখাতে পারে৷ মনিরার চোখের দিকে তাকাবার কিংবা একদমই সৌজন্যমূলক দুয়েক বাক্য বিনিময়েরও হিম্মত তার বুকের অন্দরে ছিল না৷
মনিরার কোন বড়ভাই ছিল না, সরকার দলীয় নেতাদের সাথে যার কোন সখ্য আছে৷ কিংবা মনিরার বাবাও এমন কোনো মেজাজি লোক ছিলেন না যার চোখ সারাক্ষণ জ্বলন্ত অঙ্গারসম টকটকে লাল হয়ে থাকে৷ বরং মনিরার মুদি কারবারি বাবা খুবই হাস্যোজ্জ্বল মানুষ ছিলেন৷ সদাই-কারবার করবার সময় আমাদের সাথে খুবই সদ্ভাব দেখাতেন; স্নেহও করতেন৷ মনিরার পিচ্চি যে ভাই ক্লাস ফাইভে পড়তো এবং ক্রিকেট খেলার সময় আমাদের দলের জুনিয়র খেলোয়াড় হিসাবে থাকতো সেও আমাদের খুব শ্রদ্ধা দেখিয়ে চলতো৷ তারপরও মনিরার চোখের দিকে তাকাবার কিংবা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিছক সৌজন্যমূলক দুয়েক বাক্য বিনিময় করবারও কোন হিম্মত আমাদের কারও বুকেই সঞ্চার হতো না৷ অথচ সে অধিকার আমাদের ছিল৷ বেড়ে ওঠবার কালে যে আমাদেরই খেলার সাথি ছিল, ‘শ্যাওড়া গাছের পেত্নী’ সম্বোধনে যাকে আমরা হররোজ কাঁদিয়ে চলতাম এখন এই উচ্ছ্বল কৈশোরে এসে তার সাথে আমাদের একদমই কোন প্রকার আলাপ চলবে না—এমন তো হতে পারে না৷ কেউ ঘোষণা দিয়েও সে অধিকার আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেয়নি৷ কেবল মনিরার চোখে-মুখে কি যেন একটা ছিল যা আমাদের সর্বদা ত্রস্ত করে রাখতো৷ মনে হতো—ওর উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে ঝলসে যাবে আমাদের চোখ৷ তবুও আমরা সাড়ে বারোটা বাজার খানিক আগে মন্ত্রি চাচার চায়ের দোকানে এসে জড়ো হতাম এবং রহিম মিঞার ঘন্টা পেটানোর খানিক পরে মনিরা যখন বান্ধবিদের সাথে স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে চলতো আমরা আনমনে তার চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকতাম৷
প্রাইমারি পর্যন্ত আমরা, মানে আমি, নাজমুল, তানভীর, নয়ন, মনিরা, ঊর্মি, তানজিলা একসাথে একই স্কুলে পড়াশোনা করি৷ প্রাইমারি শেষ করেও আমরা একই স্কুলে ভর্তি হই; কিন্তু একই শ্রেণিকক্ষে আমাদের আর বসা হয় না৷ এই অকস্মাৎ বিভাজন আমাদের কারও জন্যই দুঃখজাগানিয়া ছিল না৷ মনিরা, ঊর্মি, তানজিলা এমনি আরও ক’জন, এই যে আমরা একই স্কুলে পড়ছি একই শ্রেণিকক্ষে বসে একই শিক্ষকের কাছে একই বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করছি তবু এক সাথে নেই; দৈবক্রম ছাড়া কারও সাথে দেখা অবধি হয় না— এটা আমাদের বুকে কোন ক্ষত কিংবা ব্যাথা সৃষ্টি করেনি৷
কিন্তু ক্লাস টেনে ওঠা মাত্র আমরা আবিষ্কার করি এবং এই আবিষ্কারে আমরা নিজেরাই চমকে উঠি যে, স্কুল চলাকালীন মনিরার সংস্পর্শ বঞ্চিত হওয়াটা আমাদের পীড়া দিচ্ছে৷ কেবলই কি তাই? স্মিত হাসি মুখে মনিরার হেঁটে চলা, উতলা বাতাস এসে ওর খোলা চুল এলোমেলো করে দিয়ে যাওয়া আমাদের বুকের বা দিকটাতে চিনচিনে ব্যাথার উদ্রেক করছে; দৈবাৎ কখনও আমাদের মুখোমুখি সাক্ষাতে ওর ভ্রূর নাচন আমাদের তীব্রভাবে বিদ্ধ করছে৷ আর সেই থেকেই মন্ত্রী চাচার দোকানে আমাদের এই গমনাগমন৷
এভাবেই চলছিল৷ একদিন আমাদের কাছে অদৃশ্যের সংবাদ আসে—আমরা যে জানতাম, মনিরার স্কুল ছুটির পর তানভীর নিঃশব্দ মনিরার পাশাপাশি ওর বাড়ির গলিমুখ অবধি হেঁটে যায় কেবল৷ মনিরার চোখের দিকে তাকাবার, কিংবা তার সাথে সৌজন্যমূলক দুয়েকটি বাক্য বিনিময়েরও হিম্মত তানভীরের বুকে নেই—আমাদের এই জানা তথ্যটা ভুল৷ সত্যটা হলো— দেড় বছর যাবৎ মনিরা-তানভীরের ‘সম্পর্ক’৷ একজন অপরজনকে ‘ভালোবাসি’ পর্যন্ত বলে ফেলেছে৷ এই গেল ১৪ই ফেব্রুয়ারী র্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে তানভীর মনিরাকে ২৬টি টকটকে লাল গোলাপ হস্তান্তর করেছে৷ এবং মনিরাও সেই গোলাপের তোড়া সানন্দে গ্রহণ করেছে ও তার পড়ার টেবিলে চিনেমাটির ফুলদানিতে সযত্নে সাজিয়ে রেখেছে যতদিন না গোলাপের সবগুলো পাপড়ি শুকিয়ে ঝরে পড়েছে৷
প্রদত্ত গোলাপের সংখ্যা ২৬টিই কেন—এটা চিন্তা করার মতো বিষয় হলেও ঘটনার আকস্মিকতা আমাদের বুকে এমনই আঘাত হানে যে, আমরা সেসব নিয়ে ভাবার ফুরসত পাই না৷ ক’দিন বাদে আমাদের মডেল টেস্ট পরীক্ষা, সে পরীক্ষাতে কী উপায়ে উতরানো যায়—সেটা নিয়ে ভাববারও অবসর আমাদের হয় না৷ আমরা কেবল ভাবি—মনিরার মতো একটা মেয়ে প্রেমে পড়ে গেল! তাকে তো আমরা ভদ্র মেয়ে জানতাম! প্রেমের মত একটা অনৈতিক সম্পর্কে সেও জড়িয়ে পড়বে এটা তো আমাদের ভাবনার ত্রিসীমানাতেও ছিল না!
এদিকে তানভীরকে দেখে আমরা হিংসেয় পুড়তে লাগলাম৷ অঘোষিতভাবেই ওর আর আমাদের মধ্যে একটি দূরত্বরেখা পড়ে গেল৷ আমাদের কোনো গোপন পরিকল্পনাতে তাকে আর রাখি না; আগে যেভাবে দলবেঁধে কোথাও ঘুরতে যেতাম, এখনও যাই, ওকে আর ডাকি না৷ ও এসবের কিছু বুঝলো কি বুঝলো না জানি না, দেখলাম আমাদের কাছাকাছি আর আসে না৷ মন্ত্রী চাচার চায়ের দোকানেও ওকে আর সেভাবে দেখা যায় না৷ এতে করে আমাদের মর্মজ্বালা আরও দ্বিগুণ হলো৷ আমরা একমত হলাম—‘শালা একটা নেমকহারাম৷ স্বার্থপর৷ ওর মত নেমকহারাম বন্ধুর আমাদের আর প্রয়োজন নেই৷ তাকে কখনই আর আমাদের সঙ্গ দেব না৷’
এত সবের মধ্যে মেট্রিক পরীক্ষা এসে আমাদের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করলো৷ শিক্ষক সম্প্রদায় এবং অভিভাবকদের অনবরত বক্তৃতা-বিবৃতিতে আমরা এ কথা মেনে নিতে বাধ্য হলাম যে, এই পরীক্ষাটি আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়৷ যে কোন পন্থায় সফলতার সাথে এটাতে উতরানো চাই৷ নতুবা জীবনের ধাপে ধাপে মাথা কুটে মরতে হতে পারে আমাদের৷ অতঃপর প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের তাবৎ প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ফেলে রেখে আমরা পড়ার টেবিলে বসতে সম্মত হলাম এবং একসময় মনোযোগী ছাত্র হয়ে ওঠবারও প্রয়াস আরম্ভ করে দিলাম৷
তো পড়তে পড়তে যখন আমাদের আর ভালো লাগে না, একঘেয়েমি এসে যায়—আর এমনটাই বেশি হতো— তখন আমরা মন্ত্রী চাচার চায়ের দোকানে এসে জড়ো হই৷ আমি এসে দেখি নয়ন গোল্ডলিফ ফুঁকছে৷ দুজন মিলে সে শলাকা পুড়িয়ে নিঃশেষ না করতেই নাজমুল এসে দোকানে ঢুকে পড়ে৷ নাজমুলের কণ্ঠে ঝরে পড়া খেদবাক্য ‘ধুর শালা, পড়তে ভাল্লাগে না৷ মাথা ধরে যায়৷’ আমাদের কানে আসে৷ আসলে আমরা বুঝি—আমাদের কারোরই পড়তে ভালো লাগে না; কেবলই মাথা ধরে আসে৷ ঝিম লেগে যায়৷ আমাদের সমুখে মনিরার ফর্সা মুখখান ভেসে ওঠে বারবার৷ মনে হয়—বইয়ের কালো হরফগুলো ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে কেউ তুলে নিয়েছে৷ সেখানে লিখে রেখেছে কেবল মনিরার নাম-বংশ-গোত্র-পরিচয়৷ আমরা সিগারেট ফুঁকে ধোঁয়ার প্রাচীর নির্মাণ করে চলতাম; চেষ্টা করতাম সে ধোঁয়ার আবরণে মনিরার মুখখান ঢেকে দিতে৷ লাভ হতো না; সিগারেট পোড়ানোই সার হতো৷ মনিরার মুখাবয়ব আমাদের সমুখ থেকে ভ্যানিশ করবার কোন যাদুমন্ত্র আমরা খুঁজে পেতাম না৷
একদিন এভাবে ধোঁয়ার কুন্ডলীর মাঝে আমরা, মানে আমি, নাজমুল, নয়ন বসে আছি৷ দেখলাম— ধোঁয়ার প্রাচীর ঠেলে তানভীর এসে ঢুকলো মন্ত্রী চাচার দোকানে৷ আমরা অগ্রাহ্য করলাম৷ ও এসে আমাদের সমুখের বেঞ্চিটাতে বসলো৷ অনেকটা সময় বয়ে গেল কেউ কথা বললাম না, কিংবা বলার মতো কথা খুঁজে পেলাম না৷ তবে নেমে আসা সন্ধ্যার সেই আলো-আঁধারিতে তানভীরের চেহারার বর্ণহীনতা আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম৷ বন্ধুর মুষড়ে যাওয়া চেহারা আমাদের হৃদয়কে কি আদ্র করে ফেলেছিল? তা না হলে আধপোড়া সিগারেট তানভীরের দিকে আমরা এগিয়ে ধরবো কেন! তানভীর সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ফুসফুস-ভর্তি ধোঁয়া আমাদের সমুখে ছুঁড়ে দিল৷ ধোঁয়ার কুণ্ডলী শূন্যে মিশে যেতে তানভীর কথাটি বললো আমাদের৷ যে কথাটি আমাদের মনে করিয়ে দিল—আমরা মনিরাকে কামনা করেছিলাম৷ কিন্তু তানভীর তাকে ‘ভালোবাসি’ বলে আমাদের তৃষ্ণার্ত চোখের আড়াল করতে চাইছে৷ হিম হতে হতে গোপন প্রতিশোধ স্পৃহায় আমাদের ভেতরটা আবারো তপ্ত হয়ে উঠলো; আরো তীব্র ও ভয়ঙ্করভাবে ফুটে উঠলো আমাদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ৷
তানভীর আমাদের জানালো—‘মনিরাকে নিয়ে পালাতে চাই।’
কি এমন ঘটে গেছে যে এই পরীক্ষার অল্প ক’দিন থাকতে তোদের পালাতে হবে—এমন জিজ্ঞাসা চেহারাতে এঁকে আমরা তানভীরের দিকে তাকালাম৷ চরম বিস্ময় কিংবা তীব্র ক্ষোভে আমরা কিছু সময়ের জন্য বাকহারা হয়ে পড়েছিলাম৷ তানভীর আমাদের অভিব্যক্তি পড়তে পেরে ঘটনার বিস্তার করে—‘পরীক্ষার পরই ওর বাবা ওকে বিয়ে দিতে চান৷’
আমরা তানভীরের এই কথা প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করলাম৷ বললাম—‘আরে নাহ, এত অল্প বয়সে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রীদের বিয়ে হয় নাকি! তোকে কেউ ভুলভাল জানিয়েছে৷’
তানভীর দেখলাম ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনেই এসেছে৷ ও আমাদের কিছুটা ভয়ার্ত কণ্ঠে জানালো—‘ওর এক চাচাতো ভাই আর্মিতে ঢুকেছে৷ মনিরাকে নাকি ছোট থাকতেই পছন্দ৷ কথাবার্তা পাকাপাকি করে রেখেছিল দুই পরিবার৷’
‘তাহলে ওর পড়াশোনার কী হবে? ও না ডাক্তার হতে চায়!’ আমরা তানভীরকে দ্বিধান্বিত করতে উদ্যোগী হই৷ তানভীর দ্বিধাগ্রস্ত না হয়ে বলে চলে—‘শ্বশুরবাড়ি থেকেই কলেজে যাওয়া-আসা করবে৷ রাজিব, ওর চাচাতো ভাই, সেও নাকি মনে প্রাণে চায় তার বউ ডাক্তার হবে৷’
এত সব শোনার পর আমাদের আর কোনো জিজ্ঞাসা থাকে না৷ কেবল কৌতূহলী হয়ে উঠি—তানভীর মনিরাকে নিয়ে পালাতে চায়–এ তথ্য সে আমাদের জানাচ্ছে কেন! তানভীরের পরবর্তী কথায় আমাদের এ সামান্য কৌতূহলও মিটে যায়৷ তানভীর বলে—‘তোদের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের পালানো সম্ভব না৷’ দেখলাম কথাটি বলতে পেরে তানভীরের অন্ধকারাচ্ছন্ন অবয়ব ঝলমল করে উঠলো৷ ভারী কোনো বোঝা কাঁধ থেকে নামিয়ে নির্ভার হয়ে ওঠার আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো মন্ত্রী চাচার চায়ের দোকানের দেয়াল জুড়ে৷
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরে আমার ছোটমামা থাকতেন ফ্ল্যাট নিয়ে৷ খোঁজ নিতে জেনেছিলাম—তিনি পরিবারসহ গ্রামে গেছেন বেড়াতে৷ তবে তার কলেজ-পড়ুয়া ছেলে রাতুল, যে কিনা আমাদেরই বয়সী, সে ফ্ল্যাটে আছে৷ আমরা তার সাথে যোগাযোগ করে আমাদের চুয়াডাঙ্গা ভ্রমণের সংবাদ জানালাম৷ কিন্তু আমাদের পঞ্চম সদস্য যে একজন কিশোরী এ তথ্য চেপে গেলাম৷ হোটেল নেয়ার কথা একবার ভাবনাতে এসেছিল৷ কিন্তু কিশোরী সমেত একদল কিশোরকে হোটেল দিবে কিনা এ আশঙ্কায় সে ভাবনা দূর করে দিই৷ শেষমেষ মামার বাসাই আমাদের ভরসা হয়ে ওঠে৷
পরদিন দুপুরের ট্রেনে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে আমরা বেরিয়ে পড়ি৷ সন্ধ্যা নাগাদ ট্রেন আমাদের স্টেশনে নামিয়ে দেয়৷ বান্ধবীর বাড়িতে অঙ্ক বুঝতে যাচ্ছে—এই অজুহাতে মনিরাকে বাসা থেকে বেরোতে হয়েছিল বিধায় প্রয়োজনীয় কাপড় সঙ্গে আনতে পারেনি৷ প্রথমে আমরা তার জন্য কিছু কাপড় এবং তাদের উভয়ের জন্য একটি লাল বেনারসি ও বাহারি ডিজাইনের পাঞ্জাবি কিনি৷ তানভীরকে জানিয়েছিলাম—সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে৷ আজ রাতেই তাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে৷
রাতুল কলেজ-পড়ুয়া ছেলে ছিল এবং অবুঝ ছিল না৷ বাসায় গিয়ে খুলে বলতেই সব বুঝে নিল এবং আমাদের সহযোগিতার জন্য সে-রাতটি সে তার বন্ধুর বাড়িতে কাটিয়ে দেয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লো৷ খাওয়া-দাওয়া শেষে তানভীর এবং মনিরাকে প্রস্তুত হতে বলি আমরা৷ তাদেরকে জানাই—‘রাতুল কাজী ডাকতে গেছে৷ কিছু সময়ের মধ্যেই কাজী সাহেব উপস্থিত হয়ে যাবেন৷ সুতরাং প্রস্তুতি সারতে তারা যেন বিলম্ব না করে ফেলে৷’
দু’জন দু’জনকে আপন করে নেয়ার তাড়নায় তাদেরও কোন ইচ্ছে ছিল না বিলম্ব করার৷ আমাদের কথা শেষ হতেই দুজন দু কামরাতে চলে গেল প্রস্তুতির জন্য৷ তাদের প্রস্থান ভঙ্গিই আমাদের জানিয়ে দিয়ে যায়—কত নিবিড়ভাবে তারা কামনা করে একে অপরকে৷
কিছু সময় বয়ে যায়৷ আমরা, মানে আমি, নাজমুল, নয়ন এসে ঢুকি মনিরার কামরাতে৷ দেখি টকটকে লাল বেনারসি গায়ে জড়িয়ে বিছানার কিনারে যে বসে আছে সে মনিরা নয়; যেন স্বর্গের অপ্সরী৷ আমাদের ভেতর অকস্মাৎ জ্বলে ওঠে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ৷ আমাদের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় উপচে পড়া কামনা৷ নিজেদের উপর আমাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না৷ মনিরার দীপ্তিমান আঁখি যুগল আমাদের ঝলসে দিতে পারে এ শঙ্কায় প্রথমে আমরা তার চোখ বেঁধে ফেলি৷ হাত বাঁধার কোন প্রয়োজন অনুভব করি না৷ প্রথমে আমিই ঝাঁপিয়ে পড়ি; প্রবল বিক্রমে৷ এখনো আমার অজানা—অসুরের মত শক্তি কোত্থেকে সেদিন এসে জড়ো হয়েছিল আমার বাহুতে৷ নিজেকে সম্পূর্ণভাবে লুকিয়ে ফেলি মনিরার শরীরের ভেতর৷ নাজমুল এক টুকরো কাপড় গুজে দিতে চেয়েছিল মনিরার মুখের গহ্বরে৷ আমি ওকে আটকাই৷ কারণ, ওর কান্নাজড়িত চিৎকার আরও হিংস্র করে তুলছিল আমাকে; সম্ভোগসুখে চোখ বুজে আসছিল আমার৷ নিজেকে নিস্তেজ মনে হতে যখন আলাদা হয়ে যাযই মনিরার দেহ থেকে দেখি নাজমুল তার বুকের উপর চেপে বসেছে৷ আর নাজমুল নিথর হয়ে এলে নয়ন৷
একসময় আমরা মানে আমি নাজমুল নয়ন এবং মনিরা নিস্তেজ নিথর পড়ে থাকি চারজন পাশাপাশি৷
আমাদের দেহে প্রাণ ফিরে এলে আমরা উঠে দাঁড়াই৷ পাশের কামরার ছিটকিনি খুলে দিই৷ ছিটকিনি খুলে দিতেই হুড়মুড় করে তানভীর বেরিয়ে এসে আমাদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়—‘কিরে, আটকে রেখেছিলি কেন? মনিরা কই? কাজী সাহেব আসতে আর কতক্ষণ!! আমরা সরে গিয়ে পাশের কামরায় যেতে তানভীরকে সুযোগ করে দিই৷
এতক্ষণ যা ঘটছিলো তা আমাদের গোপন পরিকল্পনার অংশ ছিল৷ কিন্তু তানভীরের চিৎকার শুনে মনিরার কামরাতে ঢুকে যে দৃশ্য আমাদের হতবিহ্বল করে দেয় তা আমাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোন পরিকল্পনাতেই ছিল না৷ রক্তে ভেসে গেছে বিছানা৷ আশ্চর্য! এত রক্ত কোত্থেকে এলো! একজন কিশোরী মেয়ে নিজের ভেতর এত রক্ত ধারণ করতে পারে কিভাবে, যা ভাসিয়ে দিয়ে যায় সবকিছু! আমাদের ভাবনাতে কিছুই আসছিলো না৷ কিছুই না৷
এ সময় তানভীর বোকার মত একটা কাজ করে বসলো৷ গুগল থেকে চুয়াডাঙ্গা পুলিশের নম্বর বের করে বাজারের অদূরেই যে সাদা পাঁচতলা বাড়িটা তার তিন তলাতে ওদের আসতে বলে দিলো৷ তানভীরের মনে থাকল না—আজ দুপুরে ওর হাত ধরেই মনিরা এই এতদূর চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর পর্যন্ত এসেছে এবং ওকে বিয়ে করতেই লাল বেনারসিতে নিজেকে সযত্নে মুড়েছে৷
রক্তে ভেসে যাওয়া মনিরার নিথর দেহ তানভীরের মতিভ্রম ঘটিয়ে থাকতে পারে৷ কিন্তু আমরা সজাগ রইলাম৷ পুলিশ আসতে এবং ঘটনাস্থল খুঁজে পেতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবার কথা৷ এ সময়টাতে আমরা আমাদের করণীয় নির্ধারণে উদ্যোগী হলাম এবং আমরা, মানে আমি, নাজমুল, নয়ন পুলিশ উপস্থিত হওয়ার পর আমাদের কর্তব্য কি তা ঠিক করে ফেললাম৷ এই এতোটুকু সময়ে এত নিখুঁত পরিকল্পনা সাজালাম যে আমরা নিজেরাই বিস্ময় বোধ করে উঠলাম৷
ঘন্টাখানিক পর পুলিশ এসে আমাদের মানে, আমি, নাজমুল, নয়ন এবং তানভীরকে নিয়ে যায়৷ আর প্রয়োজনীয় পরীক্ষার জন্য মনিরার মরদেহ ফরেনসিতে পাঠিয়ে দেয়৷ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে আমাদের পরিকল্পনা মাফিক স্বীকারোক্তি প্রদান করি আমরা৷ বলি—তানভীর মনিরাকে ভালবাসার প্রলোভন দেখিয়ে এখানে এনেছে এবং বিয়ের কথা বলে পুনঃপুনঃ ধর্ষণ করেছে৷ ঘনিষ্ঠ বন্ধুতার খাতিরে কেবল সহযোগিতা করেছি আমরা৷ আমাদের বয়স কম হওয়াতে ঘটনা এতদূর গড়াবে ভাবনাতে আসেনি৷
পরদিন সকালে আমার ছোটমামা, যার ফ্ল্যাটে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, যিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের পার্সোনাল সেক্রেটারি, তিনি থানা হাজতে এসে আমাদের সাথে দেখা করলেন এবং সবকিছু বিস্তারিত শুনতে চাইলেন৷ আমরা তার থেকে কিছু গোপন করলাম না৷ শয়তানের প্ররোচনায় এমনটা হয়েছে বলে শয়তানের সমুখে আমরা যে কতটা দুর্বল সেটাও প্রকাশ করলাম৷ মামাকে আমাদের সমুখেই দারোগা সাহেবকে বলতে শুনলাম—‘এই বয়সে একটা ভুল করে ফেলেছে৷ কি করা যায় একটু দেখবেন৷’
এরপর কোথায় কি ঘটে গেল আমরা জানতে পারলাম না বটে৷ তবে এক সপ্তাহ পর যখন আমাদের আদালতে হাজির করা হলো দেখলাম সমস্ত কাগজপত্র, পুলিশের জবানবন্দী, ফরেনসিক রিপোর্ট এ কথাই বলছে যে, আমরা মানে, আমি, নাজমুল, নয়ন ধর্ষণের মতো একটি গর্হিত অপরাধে তানভীরকে সহায়তা করে অপরাধের অংশীদার হয়ে গেছি৷ তানভীরের সাথে তাই আমাদেরও শাস্তি পেতে হবে৷ তবে আদালত আমাদের বয়স বিশেষ বিবেচনায় এনেছে৷ আমাদেরকে, মানে আমি, নাজমুল, নয়নকে চার বছর কারাগারের সংশোধন সেলে কাটাতে হবে৷ আর ধর্ষক ও মূল হন্তারক হিসেবে তানভীরকে থাকতে হবে দশ বছর৷
বিচারক যখন এ ফায়সালা শুনিয়ে তার চেয়ার ছেড়ে উঠে যাচ্ছিলেন তখন তানভীরের জন্য আমাদের কোথাও কি হু হু করে উঠেছিলো? কি জানি? হয়তো-বা! তা না হলে কেন আমরা তানভীরের উদ্দেশে নিজেদের বলতে শুনলাম—‘ভয় করিস না৷ দশ বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে৷’
চার বছরের কারাজীবন শেষ করে আমরা, মানে আমি, নাজমুল, নয়ন ফিরে আসি আমাদের চেনা শহরে৷ সবকিছু প্রায় অপরিবর্তনীয় থাকলেও মন্ত্রী চাচা, যার দোকানে আমরা নিত্য জড়ো হতাম, যার নাম কোনওদিন আমাদের জানা হয়নি তার আর দেখা পাইনি৷
স্কুলের সামনে গিয়ে দেখি মন্ত্রী চাচার দোকানটি যেখানে ছিল, যেখানে বসে আমাদের উৎকীর্ণ মন রহিম মিঞার ঘণ্টাধ্বনির অপেক্ষাতে অপেক্ষমাণ থাকতো সেখানে একটি আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট দাঁড়িয়ে৷ অ্যাপার্টমেন্টটার শরীর জুড়ে আকাশ ছোঁয়ার তীব্র দুঃসাহস৷
খোঁজ নিতে জানতে পেলাম— কমিশনারের ছোটভাই সরকারি খাস জমি দখলে নিয়ে বিল্ডিং তুলেছে৷ আবশ্যকীয়ভাবে তাই মন্ত্রী চাচার দোকানটা তুলে দিতে হয়েছে৷ তার দোকানটা দখলকৃত জমির সীমানাতে পড়েছিল৷ আমাদের ভীষণ গোস্বা হয় কমিশনারের ছোট ভাইয়ের উপর৷ গালিও দিয়ে বসলাম৷ একজন দুঃস্থ অসহায় লোকের সংসার চলতো এই চায়ের দোকানের সামান্য উপার্জনে; বিকারগ্রস্ত, নিঃসন্তান স্ত্রীর চিকিৎসাও৷ তার পেটে এভাবে লাত্থি মারতে হলো! আসলে হারামির বাচ্চাতে ভরে গেছে দেশ৷ কোথাও ভালো মানুষ নেই৷ কোত্থাও নেই৷