
আবু ত্বোয়াহা
২০০৫ থেকে ২০১৩। বাংলাদেশের সাইবার স্পেসে এই কালকে চিহ্নিত করা যায় ‘ব্লগস্ফিয়ারের কাল’ হিশেবে। ২০০৫ সালে ‘বাঁধ ভাঙার আওয়াজ’ শ্লোগানকে ধারণ করে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাংলা ব্লগ ‘সামহোয়ার ইন ব্লগ’-কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এই ব্লগ কালচারের সূচনা। পরবর্তীতে ‘ব্লগ’ এবং ব্লগকেন্দ্রিক লেখালেখি বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠলে সাইবারস্পেসে ডান, বাম, আওয়ামীপন্থী, জামায়াতপন্থী–এরকম আরো অনেক কম্যুনিটি ব্লগের উত্থান ঘটে। ‘ব্লগার’ শব্দটি এক পর্যায়ে হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম আলোচিত, সমালোচিত, প্রশংসিত, বিতর্কিত ও রহস্যময় শব্দ।
২০০৫ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে গড়ে ওঠা ব্লগ ও ব্লগ কালচার বাংলাদেশের সোশিও-কালচারাল হিস্ট্রির একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের নিকট অতীতের সবচে বড় দুটি রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারক আন্দোলনের জন্ম দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ২০১৩ সালে। এই ব্লগ কালচার নিয়ে বাংলাদেশের অ্যাকাডেমিয়ায় বিশেষ কোনো কাজ হয়নি, যা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ব্যাপার। তবে ব্লগাররা কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু কাজ করেছেন।
বাংলা ব্লগের সেলিব্রেটি ব্লগার জিয়া হাসানের ‘শাহবাগ থেকে হেফাজত : রাজসাক্ষীর জবানবন্দী’ বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। এই বইয়ে শাহবাগ আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামের শাপলা আন্দোলনের পর্যালোচনা করতে গিয়ে বাংলা ব্লগস্ফিয়ার সম্পর্কে একটা প্রাথমিক মূল্যায়ন হাজির করেন জিয়া হাসান। জিয়ার মতে, বাংলাদেশে ব্লগ কালচারের উত্থান ছিল মূলত মূলধারার মিডিয়ার এলিটিপনা এবং বাংলাদেশে একটা ‘গ্লোবাল সিটিজেন’ মানসিকতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্মের উত্থানের যৌথ মিথস্ক্রিয়ার ফল (হাসান : ২০১৪)। হাসানের মতে, বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকে ‘প্রথম আলো’র ওকালতিতে গড়ে ওঠা তুমুল জাতীয়তাবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তরুণদের রাজনীতি, সমাজ ও ধর্মচিন্তা নিয়ে চর্চা ও বাক-বিতণ্ডার জায়গা ছিল এই ব্লগগুলো। ২০১৩-র শাহবাগ আন্দোলনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে জমে ওঠা এই ব্লগস্ফিয়ারের সাথে সমাজের মানুশ খুব একটা পরিচিত ছিল না। কিন্তু ততদিনে ভার্চুয়াল এই অঙ্গনটি বেশ ভালোভাবেই জমে উঠেছিল, এবং ২০১৩-তে যে বিশাল ও সিগনিফিকেন্ট মতাদর্শিক বিভাজন আমরা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে দেখি, বাংলার ব্লগস্ফিয়ার এর নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করেছিল, এবং প্রায় এক দশক ধরে গড়ে ওঠা সেই ভার্চুয়াল বিভাজনই মূলত ২০১৩-তে প্রকাশ্য হয়েছিল শাহবাগ ও শাপলায়। বাংলাদেশে এই কালপর্বের চিন্তা ও চর্চার ইতিহাসেও এই ব্লগস্ফিয়ারের ভূমিকা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
সে সময় গত হয়েছে। ২০১৩-তে বাংলা ব্লগের সেই ভার্চুয়াল মতাদর্শিক বিভাজন দেশের রাজনীতিতে তৈরি করেছিল এক অভূতপূর্ব অস্থির সময়, ২০১৩-র ফেব্রুয়ারি থেকে মে–এই মাত্র চার মাসে সময়কালে বাংলাদেশের মানুশ প্রত্যক্ষ করেছিল স্মরণকালের সবচে বড় এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া দুটি আন্দোলন। ‘যুদ্ধাপরাধ’, ‘নাস্তিক-মুরতাদ’, ‘শাহবাগ’ বা ‘শাপলা’র মতো, ‘ব্লগার’-ও ছিল সেই আন্দোলনের অন্যতম কী-ওয়ার্ড। ভার্চুয়াল স্পেসের বায়বীয় জগতে বেড়ে ওঠা ব্লগ-কালচার তখন রাজপথে গণমানুশের শ্লোগানের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।
কেউ কেউ অখুশি হলেও, সত্যের খাতিরে বলা সঙ্গত যে, ২০১৩-র সেই উত্তাল সময়ে যেই জিতুক বা হারুক, ব্লগ, ব্লগার ও ব্লগ-কালচারের পতন সেসময় নিশ্চিত হয়েছিল। বাংলার ব্লগস্ফিয়ার যেমন ঠিক শূন্য থেকে উদয় হয়ে একটা হইরই কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি শূন্যেই মিলিয়ে গেল ভোজবাজির মতো। এর একটা বড় কারণ হলো, বাংলার ব্লগস্ফিয়ারের অনেকটাই ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদী ও মুক্তচিন্তার নামে উৎকট ধর্মবিরোধী একটা অপরিণামদর্শী গ্রুপের দখলে। তাদের ভেতরেও ছিলেন অনেক মেধাবী ও সত্যিকারের চিন্তাশীল তরুণ, কিন্তু তারা কখনোই নিজেদের সেখানে ডোমিনেন্ট করে তুলতে পারেন নাই। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ২০১৩ সালে হেফাজতের আন্দোলন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুশের ব্লগ সম্পর্কে কিছু সরল মনোভঙ্গি (এর যৌক্তিক কারণও ছিল) এবং দেশের রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া এক অরাজক জাতীয় বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল ও নীতির কাছে বাংলাদেশের ব্লগস্ফিয়ার ও ব্লগ কালচারের পরাজয় ঘটেছিল। পরবর্তীতে ব্লগের বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ঘটনা, ব্লগে চূড়ান্তরকম আইডিয়াল ও মোরাল আর্গুমেন্ট নিয়ে হাজির হওয়া অনেক নিকের বিহাইন্ড দ্য সিন যৌন কেলেঙ্কারি, বিদেশে এসাইলেমের উদ্দেশ্যে এক্টিভিজম ইত্যাদি ঘটনা ফাঁসের কারণে ভেঙে যাওয়া সেই হাট আর জমে উঠতে পারে নাই। ধীরে ধীরে অনেক ব্লগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, যার সর্বশেষ ধারাবাহিকতা হলো বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ও সবচে জনপ্রিয় ব্লগ ‘সামু ব্লগ’।
ব্লগ কালচারের সেই রমরমার যুগেই, ‘মুক্তচিন্তা’ চর্চার নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘মুক্তমনা ব্লগ’। ব্লগস্ফিয়ারে মূলত রাজনীতি ও ধর্মই ছিল সবচাইতে বড় ক্যাচালের টপিক, দ্বিতীয়টি ছিল মুক্তমনা ব্লগের প্রধান লক্ষ্য। ব্লগের রমরমার যুগে ‘মুক্তমনা ব্লগ’ সবসময়ই আলোচনায় ছিল এর উগ্র ধর্মবিদ্বেষ এবং এন্টি ইসলাম নীতির কারণে। বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার প্রসারের কথা বললেও, মূলত উগ্র ধর্মবিদ্বেষ এবং বিশেষত ইসলামবিদ্বেষ এই ব্লগটিকে সেসময় বেশ আলোচিত-সমালোচিত করেছিল।
‘মুক্তমনা ব্লগ’ এবং বাঙাল ব্লগস্ফিয়ারের নাস্তিক্যবাদের চর্চাকারীদের কিছু ভয়াবহ চিন্তাগত সংকট ছিলো। প্রথমত, এই দলের লোকেরা ইওরোপের এনলাইটেনমেন্টের অন্ধ ভক্ত ছিলেন। ঊনবিংশ শতকের লজিক ও র্যাশনালিটিতে তাদের ছিল অটল ঈমান। দ্বিতীয়ত, ভারত উপমহাদেশের হিস্ট্রির পরিপ্রেক্ষিতকে এই উগ্র নাস্তিকেরা নিছক ধর্মীয় বাইনারির ভেতর দিয়ে ধরতে চেয়েছেন। ফলে, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া উপমহাদেশে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মানুশ এবং রাজনীতিই তাদের চোখে ছিল আল্টিমেট ভিলেন, যেকারণে পরে ব্লগে তাদের দেয়া হয়েছিল সেই বিখ্যাত নাম–‘ভাদা’ (ভারতের দালাল)। এটি তাদের চূড়ান্তরকম ‘এন্টি-ইসলামিস্ট’ আইডেন্টিটি তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের মানুশ, সভ্যতা ও কালচারের ব্যাপারে এদের মনে ছিল এক ধরণের ওয়েস্টার্ন এনলাইটেনমেন্টজাত ঘেন্না, যেটা বাংলার নাস্তিকদের অন্যতম পঠিত ও অনুস্রৃত ব্যক্তিত্ব হুমায়ুন আজাদেরও ছিল। চতুর্থত, উগ্র নাস্তিকতার চর্চা করতে গিয়ে কোথাও কোথাও তারা এমনকি লিবারেল মানবতাবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, মানবাধিকারের ডিসকোর্সেরও বিরোধিতা করেছেন, কেবলমাত্র ধর্মের বিরুদ্ধে বলার প্রয়োজনে। ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কিন্তু লিবারেল মূল্যবোধ লালনকারী একটা বড় গোষ্ঠী তাদের প্রতি বিতৃষ্ণ বোধ করেছেন। পঞ্চমত, এই নাস্তিক্যবাদের চর্চাকারীরা যখন ধর্ম নিয়ে উনিশ শতকি এপ্রোচে কথা বলছেন, বিজ্ঞানের বেদীতে চড়াচ্ছেন যাবতীয় নৈবেদ্য, ‘উন্নত বিশ্ব’ বা ইওরোপের মূল্যবোধের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছেন, বিশ্ব রাজনীতি ও চিন্তাজগত তখন সেই উনিশ শতকের ধর্ম-বিতর্ক পেরিয়ে এসেছে। এরা যখন হিজাবের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন, ততদিনে এদেশের তরুণরা মুগ্ধ হওয়া শুরু করেছেন মালেক আল্লুলা বা আসিয়া দিসবারে। তারা যখন মডার্ন র্যাশনালিটির দিকে তরুণদের ডাকছেন, তরুণেরা ততদিনে মজে গেছে পোস্টমডার্ন, পোস্ট-কলোনিয়াল তত্ত্ববিশ্বে। সেই আপডেটেড তত্ত্ববিশ্ব ও চিন্তাজগতের কাছে গ্রহনযোগ্য ভাষা ও চিন্তা এদের ছিল না; ফুকো, চমস্কি, সাঈদ, ফানোঁ পড়া তরুণদের কাছে হুমায়ুন আজাদের মত এরাও ছিল ‘ওল্ড ফ্যাশন’। উপমহাদেশের ইতিহাস, পার্টিশানের নানান নতুন আসপেক্ট জানা তরুণেরা এদের একতরফা পাকিস্তান বা জিন্নাহ-বিরোধিতায় সহজেই খুঁজে পেতেন মুসলমান-দ্বেষ। ষষ্ঠত, সকল সমস্যার জন্য ধর্মকে দায়ী করা এই দলটির মধ্যে রাজনীতিচেতনা থাকত প্রায়ই অনুপস্থিত। সাধারণত সকল সমস্যার জন্য মৌলবাদী দল ও তার দোসর বিএনপিকে দোষ দিয়েই তারা খালাস হয়ে যেতেন। বাংলাদেশে বর্তমানে যে দুঃশাসনের কাল ‘ফ্যাসিবাদ’ নামে হাজির আছে, তার নেপথ্যেও এই দলটির রাজনৈতিক পক্ষপাত ও হঠকারিতা কিছু হলেও দায়ী। এসব কারণ বাঙলা ব্লগে নাস্তিক্যবাদের চর্চাকারীদের একটা বড় অংশের ভেতরেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
২.
পোস্ট-ব্লগ সাইবার জগতে, কেমন আছে ‘মুক্তমনা ব্লগ’? তাদের চিন্তা, লেখালেখির ধরণ, লেখার বিষয়বস্তু, যুক্তি-তর্কের কাঠামো, লেখার পরিচিত ভাষা ও এক্সপ্রেশান কি ঠিক আগের মতই আছে? দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে তাদের চিন্তা ও চর্চায় কোন পরিবর্তন এসেছে কী? সবগুলি প্রশ্নের উত্তরই সম্ভবত ‘না’। বিগত সেই সময়ের সাথে বর্তমান মুক্তমনা ব্লগের পার্থক্য এটুকুই যে, সেসময় অন্তত নিয়মিত কিছু বিশ্লেষণধর্মী খাটাখাটুনি করে লেখা পোস্ট আলোচিত হতো। বর্তমানে তার ছিটেফোঁটাও নাই। অন্তত গত একমাসের পোস্ট বিশ্লেষণে এমনই চিত্র পাওয়া যায়।
পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পোস্টগুলো আকারে খুব ছোট, আর্গুমেন্ট ও যুক্তিতর্ক খুবই দুর্বল, ভাসা ভাসা ও একপেশে, রাজনীতি ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বারবার আলাপের টপিক হলেও, আক্রমণের মূল লক্ষ্য মূলত ধর্ম ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠী। সমাজের নানান অসঙ্গতি ও সংকটের প্রশ্নে আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তুও তারাই। এছাড়া এই একমাসে হওয়া পোস্টগুলো এমনকি ফেসবুকের অনেক চিন্তাশীল তরুণের লেখা ওয়ান লাইনারের চেয়েও দুর্বল। এতটাই দুর্বল যে, যেকোন চিন্তাশীল মানুশ এই পোস্টগুলোতে কোন চিন্তার খোরাক পাবে না।
পোস্টগুলোর যুক্তিতর্কের ধরণ খুবই ভাসাভাসা ও ক্লিশে। ফড়িং ক্যামেলিয়ার ৯ জুলাইয়ের ধর্ষণ বিষয়ক পোস্টটির কথাই ধরা যাক। রেপের জন্য পোশাক বা পর্নোগ্রাফি দায়ী কিনা এই ক্লিশে বিতর্কটিই ছিল এই পোস্টের বিষয়বস্তু। লেখিকার মতে, রেপের জন্য মানসিকতা দায়ী। কিন্তু এই ‘মানসিকতা’ কী বস্তু, তা কীভাবে গড়ে ওঠে এ নিয়ে লেখিকার কোন আর্গুমেন্ট নাই। লেখিকার মতে, ‘মানসিকতা’ তৈরি হয় মেয়েদের সেক্স অবজেক্ট হিশাবে সমাজে ট্রিট করার কারণে। কিন্তু সমাজে মেয়েদের ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিশাবে ট্রিট করার পেছনে মিডিয়া, কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি, এমনকি এই পর্ন ইন্ডাস্ট্রির যে কী বড় ভূমিকা, তা লেখিকার লেখায় নাই। তিনি ‘সমাজ’ নামের বায়বীয় একটা ধারণার উপর সব দোষ চাপাচ্ছেন, কিন্তু সমাজের নানান ইন্সটিটিউশন নিয়ে তার কোন কথা নেই। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মেয়েদের ছোট কাপড় পরিয়ে কাপড়কেন্দ্রিক যে নানান ডার্টি জোকস তৈরি করা হয়, এবং এভাবে তাকে সেক্স অবজেক্ট বানানো হয়, সেদিকে তার মনোযোগ নাই।
তার মতে সমস্যা হলো, ছেলে মেয়েকে একসাথে মিশতে না দেওয়া। কিন্তু একসাথে মিশতে দেওয়ার পরেও কি রেপ হচ্ছে না? যদি একসাথে মিশলেই যৌন অত্যাচার কমত, তবে চাচা তার কন্যাকে রেপ করেন কীভাবে? ‘উন্নত বিশ্বের’ প্রতিও লেখিকার ঈমান ষোল আনা। তিনি লিখছেন, ‘এর পরেও রেপের বিভিন্ন কারণ আছে কিন্তু শুধু দৃষ্টিভঙ্গি আর শিক্ষার কারণে উন্নত দেশগুলোতে রেপের হার এত কম’। কথিত উন্নত বিশ্বে রেপের হার কত কম, তা অবশ্য এই ইন্টারনেটের যুগে কারোরই অজানা নয়। কিন্তু লেখিকার ঈমান তাতে টলে নাই। তিনি এখনও উন্নত বিশ্ব ও তার ‘আধুনিক শিক্ষা’র উপর ষোল আনা ঈমান নিয়ে বসে আছেন।
২২ জুলাই ধর্ষণ বিষয়ক আরেক লেখায় কাজল কুমার দাস নামক আরেক লেখক’ও সেই বায়বীয় ‘সমাজ’কেই দুষছেন। তার মতে, ধর্ম আর ‘জন্মগত সমাজ’ই ধর্ষণের জন্য দায়ী। তিনি লিখেছেন, ‘ধম্ম আপনাকে মানুষ করতে না পারলেও বর্বর পুরুষ তৈরি করেছে ঠিকভাবেই। নইলে সীমাহীন ধর্ষণ দেখে আপনার মাথায় আসে কী করে; এসব বন্ধ করতে পতিতালয় চাই!’ কোন ধার্মিক ধর্ষণ বন্ধ করতে পতিতালয় দাবি করেছেন তা আমাদের জানা নাই। কিন্তু এটা সকলের জানা যে, স্বঘোষিত নারীবাদী ওয়েবসাইট ‘উইম্যেন চ্যাপ্টার’-এ এক লেখিকা ধর্ষণ বন্ধে পতিতালয়ের কথা বলেছিলেন। এছাড়াও সেক্যুলার ঘরানার আরো অনেকেই এই মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি আরো লিখেছেন, ‘…তাদের সেই সন্তানরা (ছেলে হোক বা মেয়ে) মাদ্রাসায় বসে যৌন নির্যাতনের শিকার বা শারিরিক অত্যাচারেরও শিকার হয় বা তাদের হত্যাও করা হয় তাতে তাদের আফসোস নেই। কারণ, মূলকথা “আখেরাত”!’ যেন মাদ্রাসায় কাউকে পড়ালে ধর্ষণ অবধারিত! বরং আমরা দেখি, সেক্যুলার পুঁজিবাদী সমাজে নারীর এম্পাওয়ারমেন্টের প্রতিতা ধাপই নৃঃশংস যৌন নিপীড়নে ঢাকা। পড়াশোনায় ভালো করা থেকে ভালো চাকরি পাওয়া, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে চান্স পাওয়া থেকে ফুটবল দলে জায়গা পাওয়া–সব ক্ষেত্রেই নারীকে আগে শরীরের পরীক্ষা দিতে হয়। এ এমন এক সিস্টেম, যা নারীকে মেনে নিতেই হয়।
২৪ জুলাই গুজব নিয়ে লেখা একই লেখকের নিবন্ধটা পড়লে বোঝা যায়, বর্তমানের রাজনৈতিক অবস্থাও এই গোষ্ঠীটিকে তাদের সেই সনাতন ক্লিশে ধর্মবিদ্বেষ থেকে তাদের মুক্ত করতে পারে নাই। গুজবের উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখক একাত্তরে রাজাকারদের ভূমিকা আর হেফাজতে ইসলামের ৫ই মের লংমার্চের কথা বলেছেন। তার মতে, হেফাজত মানুশ হত্যার গুজব ছড়িয়েছে, নিজেরা কোরান পুড়িয়ে সরকারের ঘাড়ে তার দোষ চাপানোর মত গুজবও তারা তৈরি করেছে। অর্থাৎ, যে ‘গুজব’-এর দোহাই দিয়ে বিগত দুটি ছাত্র আন্দোলনে দমন-পীড়নসহ অসংখ্য অন্যায়-অত্যাচার জায়েজ করছে ক্ষমতাসীন সরকার, সেই গুজব নিয়ে লিখতে গিয়েও লেখক যাবতীয় দোষ ধর্ম ও ধর্মপন্থীদের উপর চাপাচ্ছেন। আবার মাদ্রাসাশিক্ষাকেও লেখক গুজবের জন্য দায়ী করেছেন! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক যেকোন সমস্যা নিয়ে আলাপ করার কালে এই লেখকেরা ইসলাম ও মাদ্রাসা শিক্ষার সমস্যা খুঁজে পান। অথচ দেখুন, ভারতে বিজেপির রামমন্দির তৈরি এবং বাবরি মসজিদ ভাঙার মত খুব স্পষ্ট ও প্রকাশ্য সত্যকেও লেখক বলছেন ‘গুজব’, বিজেপির রামমন্দির বানানোর ঘোষণা নাকি গুজব, আর এদেশের মানুশ সেই গুজবে কান দিয়েই নানা আন্দোলন করেছে! হাউ ফানি!
৩.
রাজনৈতিক বা সামাজিক বিভিন্ন টপিকের যেকোন লেখায়ই ধর্ম আর এদেশের ধর্মপ্রবণ জনগোষ্ঠীকে দোষ দেওয়ার সেই পুরাতন কালচার এরা আজও বহন করছে। গত একমাসের লেখাগুলোতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম জনপদের অসংখ্যা খারাপির কাহিনি পেলেও, ভারতে গোটা একটা জাতির সাম্প্রদায়িকীকরণ নিয়ে কোন একটা শব্দও আপনি এই ব্লগটিতে পাবেন না। ‘মুক্তচিন্তা’র যে ব্যানার ব্লগটিতে ঝোলে, তা যে ব্যানারমাত্র, সে ব্যাপারে গত একমাসের লেখাগুলো পড়লেই নিঃসন্দেহ হওয়া যায়।
এদেশের মানুশের মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থান নষ্ট করার পেছনে এই ধরণের চিন্তাগুলি কাজ করে আসছে বহুদিন ধরেই। বাংলাদেশে ব্লগে যারা মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানের বিকাশের কথা বলেছিলেন একদা, আজ তাদের চিন্তা ও চেতনার স্থবিরতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব খুবই স্পষ্ট। মুক্তমনা ব্লগের গত একমাসের লেখাগুলিই এর জ্বলন্ত প্রমাণ।