উইঘুরদের ওপর ভয়াবহ নজরদারি : বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ

উইঘুরদের ওপর ভয়াবহ নজরদারি : বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ

সাজ্জাদ আকবর:

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে চীনের জিনজিয়াং। পঁচিশ লক্ষের অধিক নিরীহ উইঘুর মুসলিমদের বন্দী করা হয়েছে কারাগারে। চীনের ভাষায় সেগুলো কারাগার নয়, ‘প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। উইঘুররা ‘পশ্চাৎপদ’, সে কারণেই তারা ‘বিপজ্জনক’, এজন্য ‘প্রশিক্ষণ’ দিয়ে চীন তাদেরকে ‘উন্নত’ করছে মাত্র। ‘উন্নয়ন’-এর কাছে মাথা নোয়াতে শেখানোই এসব শিবিরের পাঠ্যসূচি। ভুয়া অজুহাতে উইঘুর যুবকদের গ্রেপ্তার করে পুরে দেয়া হচ্ছে বন্দীশিবিরে। পাশাপাশি বাছাই করা হচ্ছে উইঘুর শিল্পী, লেখক, অধ্যাপকদের। কারণ, উইঘুরদের মুসলিম জাতিসত্তাকে ভুলিয়ে দিতে হবে। বদলাতে হবে সংস্কৃতি আর ধর্মবিশ্বাস।

শুধু উইঘুর নয়, এ যেন বিশ্বের সব ছোট ছোট জাতিসত্তার নিয়তি ও পরিণতি। শাসক এবং করপোরেট—সবাই তাদের ‘আধুনিক’ ও ‘উন্নত’ করতে চায়। কিন্তু উইঘুররা চাইছে নিজেদের অতীত ও ভবিষ্যতের ওপর সার্বভৌমত্ব। চাইছে সংস্কৃতি আর ধর্মকর্ম পালনের অধিকার। আর এ অধিকারের চেতনার কারণেই তাদের ওপর লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে সন্ত্রাসের তকমা। কথিত এই ‘সন্ত্রাস’ দমনের জন্য যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার দেওয়া আছে জাতিসংঘের চার্টারে। সুতরাং পথ উন্মুক্ত। কারও কিছু বলার নেই। বাগানের আগাছার মতো করে পরিষ্কার করা হচ্ছে ইসলামের চেতনাকে। একে বলা হচ্ছে কট্টরপন্থার দমন। মানবতা ও মানবাধিকারের চারাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে বলা হচ্ছে ‘প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন’!

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্যমতে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নজরদারি করতে চীন সরকার একটি অ্যাপ ব্যবহার করছে। যেখানে প্রত্যেককে বায়োম্যাট্রিক পদ্ধতিতে করা আইডিকার্ডের মাধ্যমে নিবন্ধিত করা হয়েছে। অতিরিক্ত নজরদারির জন্য প্রত্যেকের মোবাইলে একটি করে বিশেষ চিপও বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

মুখাবয়ব দেখে পরিচয় শনাক্তকারী ক্যামেরাসহ নজরদারি ক্যামেরা ও পুলিশে ভরে আছে জিনজিয়াংয়ের শহরগুলো। সেখানে প্রতি ১৫০ ফুট পর পর বসানো হয়েছে একটি করে ক্যামেরা। এই ক্যামেরাগুলো প্রতিনিয়ত ফুটেজ সংগ্রহ করে পাঠাচ্ছে পুলিশের সেন্ট্রাল কমান্ডে এবং এ থেকে প্রত্যেক উইঘুর মুসলিমকে রাখা হচ্ছে সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে। বর্তমান পৃথিবীর প্রযুক্তির ড্রাগনে পরিণত হওয়া চীন নিরীহ নিরস্ত্র উইঘুরদের সাংস্কৃতিক নিধনযজ্ঞের কোনো পন্থাই বাকি রাখেনি। জিনজিয়াংয়ের বন্দীশিবিরগুলোতে আটকে রাখা ২৫ লাখ উইঘুরের বাইরে আরও যে এক কোটি উইঘুর মুসলিম রয়েছে, বাহ্যত তারা উন্মুক্ত হলেও চারপাশে তাদের ঘিরে আছে অদৃশ্য দেয়াল। ইটপাথর নয়, বরং প্রযুক্তি দিয়ে গড়া হয়েছে এসব দেয়াল। শুধুমাত্র কাশগড় শহরটিতে আছে হাজারেরও অধিক চেকপয়েন্ট। যার সবগুলোতেই রয়েছে বিশেষ নজরদারি ক্যামেরা। শহরের যে কোনো স্থানে চলাচল করা সবার বিস্তারিত তথ্য পুলিশের কাছে রয়েছে। প্রয়োজনমততো পুলিশ চাইলেই যে কারো বিষয়ে জেনে নিতে পারে। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে ওই ব্যক্তির নাম, কোথায় থাকেন, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন, তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কিনা এমনকি সম্প্রতি সে কোন হোটেল বা ক্যাফেতে গিয়েছিল তাও। এটিই চীনা সরকারের সেই সিস্টেম যা দিয়ে তারা সব দেখে, সব জানে। এর পেছনে চীনের নেতারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। সমগ্র জিনজিয়াংকে তারা নিয়ে এসেছে নজরদারির আওতায়। কাশগড়ের জন্য বিশেষ এই সিস্টেমটি তৈরি করেছে চায়না ইলেক্ট্রনিক্স টেকনোলজি করপোরেশন (সিইটিসি)। এটি একটি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। সরকার যাতে উইঘুরদের ওপর নজরদারি চালাতে পারে সে-জন্য বিশেষভাবে এই ব্যবস্থাটি গড়ে তুলেছে সিইটিসি।

চীনা সরকার যদিও জননিরাপত্তার কথা বলছে কিন্তু গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দিনদিন স্পষ্ট হচ্ছে চীন সেখানে যুদ্ধকালীন অবস্থার মতো নিয়ন্ত্রণ রাখছে। সেখানে নজরদারি করতে এ সময়ের সর্বোচ্চ প্রযুক্তির ব্যবস্থা স্থাপন করছে। নজরদারিতে যাদের সন্দেহ হয় তাদেরকে এসব পুনঃপ্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। এখানেই নানাভাবে তাদেরকে নতুন করে রাষ্ট্রের জন্য নিরাপদ করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। চালানো হয় নানা ধরনের নির্যাতন। অমানবিক এসব বন্দীশিবির থেকে ‘প্রশিক্ষণ’ শেষে যাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থাও আছে এই সিস্টেমে। শুধু জিনজিয়াং নয়, চিনের বাইরে তুরস্ক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানসহ যত দেশে উইঘুররা ছড়িয়ে আছে, সবখানেই আছে চীনা গোয়েন্দাদের উপস্থিতি। উইঘুররা কী পরিমাণ ভয়াবহ নজরদারির শিকার, তার অনুমান করা যায় শুধু এক কাশগড় থেকেই। সাড়ে সাত লাখ জনগোষ্ঠীর এই শহরের জন্য চীনের যে ডাটাবেজ আছে তাতে প্রায় ৬৮ বিলিয়ন রেকর্ড আছে! অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এর কাছে ২০১৮ সালে জমা হওয়া রেকর্ডের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৯ মিলিয়ন। সে হিসেবে উইঘুরদের জন্য তৈরি চীনের ডাটাবেজকে একটা সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই রেকর্ডগুলোতে প্রতিটি উইঘুর মুসলিমের আদ্যোপান্ত জমা করা হয়েছে।

জিনজিয়াং প্রদেশের পুলিশ নজরদারির জন্য বিশেষ যে মোবাইল অ্যাপটি ব্যবহার করছে এর মাধ্যমে সরাসরি এই বিশাল ডাটাবেজে যুক্ত হওয়া যায়। ফলে যে কোনো উইঘুরের সকল তথ্য মুহূর্তেই চলে যায় পুলিশের হাতে। কেউ যদি চীনের বাইরে ভ্রমণে যায় তাহলে সন্দেহজনক কিছু পেলে তার পেছনের সকল রেকর্ড মুহূর্তের মধ্যে চলে আসে পুলিশের কাছে। স্মার্টফোন আর বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্রের পাশাপাশি এখন আরও যুক্ত করা হয়েছে ডিএনএ, আঙুলের ছাপ, ‘ভয়েস রেকর্ড’-সহ বিভিন্ন ব্যবস্থা। ২৫ লাখ উইঘুর ইতিমধ্যে নজরদারি প্রযুক্তির আওতায় এসেছে। এমনিভাবে সোয়া কোটি উইঘুর মুসলিমকে অদ্ভুত এক শিকলে বন্দী করে রাখা হয়েছে। খামারে বেঁধে রাখা প্রাণীর চেয়ে কোনো অংশে বেশি স্বাধীনতা তাদের নেই।

নিরীহ উইঘুর জনগোষ্ঠীর ওপর এই যে অমানবিক নজরদারি ও নিগ্রহ, তার পেছনের কারণ তাদের মুসলিম পরিচয়। সমকালীন পৃথিবীতে এতটা সাংস্কৃতিক নিধনযজ্ঞের শিকার হয়নি আর কোনো জনপদ ও জনগোষ্ঠী। তবে শুধু ধর্ম নয়, প্রযুক্তিতে নিজেদের আধিপত্যের জানান দিতেও এসব করে যাচ্ছে চীন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষায় যাকে বলা হয় সার্ভিল্যান্স ক্যাপিটালিজম। এসবের মাধ্যমে চীন আসলে প্রযুক্তিগত উপনিবেশ কায়েম করতে চাচ্ছে। একটা সময় ছিল, যখন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো বিভিন্ন দেশ দখল করত। গ্রাস করত বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু সময় পাল্টেছে এখন। আধুনিক পৃথিবীর নব্য ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ভূখণ্ডের পরিবর্তে মানুষের মন ও শরীরের প্রতি বেশি লালায়িত। ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথে সাথে তারা এখন মানুষের অস্তিত্ব আর সার্বভৌমত্বকেও গ্রাস করে নিচ্ছে। মানুষের দেহমনে প্রযুক্তিগত উপনিবেশ কায়েমের যে ধারা চালু করেছে চীন, তারই প্রধান পরীক্ষাকেন্দ্র আজকের জিনজিয়াং।

সান্ত্বনাশূন্য অশ্রু আর বেদনার তীব্র স্রোতে ভেসে যাচ্ছে জিনজিয়াং-এর মানচিত্র। নিরীহ উইঘুরদের জীবনকে বানানো হয়েছে বীভৎস বধ্যভূমি। বিনা অজুহাতে গ্রেপ্তার, অপহরণ আর মায়ের বুক থেকে সন্তান কেড়ে নেওয়ার অমানবিক ‘আইন’ তাদের প্রহরগুলোকে করে তুলেছে আতঙ্কের ভূতুড়ে রাত। এই যখন উইঘুরদের পরিণতি, তখন নির্বিকার স্বার্থান্বেষী মুসলিম শাসকরা। ইসরায়েলি আগ্রাসনের সমর্থক পশ্চিমা ইউরোপ থেকে মাঝে-মধ্যে শোনা যাচ্ছে দুয়েকটা হুমকি। প্রতিকার চেষ্টার শতগুণ বেশি স্বার্থের দ্বন্দ্ব জড়িয়ে থাকে সেই হুমকিতে। আসলে অদ্ভুত এক আঁধার ঢেকে ফেলেছে সারা বিশ্বকে। অন্ধরা এখানে পথপ্রদর্শক। যারা মনুষ্যত্বহীন, তারাই এখানে মানবতার ঠিকাদার। যারা বিবেকবর্জিত, তারাই এখানে বিবেকের বাণী ফেরি করে চারদিকে। সমস্ত নিষ্ঠুরতা ও পশুত্ব নিয়ে তারা হামলে পড়েছে মানবতার গৌরবের সবগুলো উদ্যানে। জটিলতা ও কূটিলতায় পৃথিবীকে হাঁকিয়ে নিচ্ছে ধ্বংসের কিনারায়।

এই নিবন্ধে বিপন্ন উইঘুরদের দুঃখগাঁথা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি না। তবে শুধু এইটুকু বলে রাখছি– ভাগ্যবিড়ম্বিত জিনজিয়াং-এর মুসলিমরা যে করুণ পরিণতির শিকার, তা ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিশ্বাসী বান্দারা এরকম ত্যাগের ওপর দিয়েই বুকে বুকে লালন করেছেন ইসলাম। তা কি বোঝে চীনের শাসকেরা? তারা কি জানে সহস্র বছর আগে চীনা মাটিতে কেমন করে শিকড় গেড়েছে ইসলাম! এত সহজ ইসলামের আলোকে নিভিয়ে দেওয়া? আগুনের উপর ছাই-চাপা দিয়ে তারা তৃপ্তির যে ঢেঁকুর তুলছে, সেটা তাদের নির্বুদ্ধিতারই প্রমাণ বৈ আর কী হতে পারে!

আগের সংবাদবাংলাদেশে উইঘুর আল্লামা : আব্দুর রহমান কাশগড়ির ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবন
পরবর্তি সংবাদসতর ও সিসিক্যামেরা : ইসলামের দৃষ্টিতে নজরদারী ব্যবস্থা