
ইফতেখার জামিল :
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নজরদারীর ইস্যু বিগত কয়েক বছরে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা ও বহুজাতিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসার স্বার্থে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে ব্যাপক নজরদারী চালাচ্ছে। তাতে লুণ্ঠিত হচ্ছে মানুষের সম্মান, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা। সম্প্রতি উইঘুর অঞ্চলে চীন ব্যাপক নজরদারীর নজিরবিহীন পরীক্ষা চালাচ্ছে। মসজিদও নজরদারী থেকে বাঁচতে পারছে না। মানুষ ও মানুষের চলাফেরা-কর্মকাণ্ডকে ডেটায় রুপান্তরিত করে নিয়ন্ত্রণ ও বিবর্তনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইসলাম মানব জীবনের সামগ্রিক ব্যাখ্যা ও সমাধান দানের চেষ্টা করে। ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, তথ্য-নিরাপত্তা ও নজরদারীকে ইসলাম কীভাবে দেখে, এর অনুসন্ধান চালানো জরুরী হয়ে উঠেছে।
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ব্যাপক নজরদারী : মানুষ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হারাতে চলছে
মানুষের সাথে জন্তু-জানোয়ারের মূল পার্থক্য কী? মানুষের স্বাধীন বিবেচনাবোধ ও ইচ্ছাশক্তি আছে। বিবেচনাবোধের মাধ্যমে মানুষ তার পরিবেশ-প্রতিবেশকে চিনতে পারে। ভালো-মন্দ নির্ণয় করতে পারে। স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগ করতে পারে। মানুষ যদি এই স্বাধীন বিবেচনাবোধ ও ইচ্ছা হারায়, তাহলে তাঁকে আর সুস্থ ও স্বাধীন বলার সুযোগ থাকে না। মানুষ আর আশরাফুল মাখলুকাত থাকে না, জন্ত-জানোয়ারের মতো হয়ে যায়, সত্য চেনা ও বাস্তবায়নের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এর ভিত্তিতেই পবিত্র কোরআনে অনেক জায়গায় কাফেরদেরকে অন্ধ, বধির ও বোবা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অবলা জন্তুর সাথে তুলনা দেওয়া হয়েছে। কেননা বিবেচনা-বোধ-ইচ্ছা হারালে অবলা জন্তুর সাথে তার কোন পার্থক্য থাকে না।
তলিয়ে দেখলে বুঝবেন, আধুনিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ও বহুজাতিক কোম্পানির কাছে মানুষের বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ হুমকির মতো। নিয়ন্ত্রণ, বিদ্রোহ-দমন ও লাভ বাড়াতে চাইলে মানুষের বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ ‘ইঞ্জেনিয়ারিং’ করা জরুরী। তারা মানুষকে মনে করে বস্তুর মতো, যাকে ইঞ্জেনিয়ারিং এর মাধ্যমে রুপান্তরিত ও নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব। তবে এর জন্য দরকার প্রহরা ও নজরদারী প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে মানুষের চিন্তা, সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডকে চিহ্নিত করা হবে। প্রোপাগান্ডা, আবেগ ও ভয়ভীতির মাধ্যমে প্রভাবিত ও রুপান্তরিত করা হবে। তাতে মানুষের আর স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি, বিবেচনা ও ইচ্ছা বলে কিছু থাকবে না। বিবেচনা ও ইচ্ছার মানেই তখন ‘বিগ-ব্রাদারের’ ইচ্ছা, কোম্পানির বিবেচনাবোধ।
গবেষক আলতাফ পারভেজের বরাত টানা যাক। ‘মানুষ ও সমাজকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ ও ‘নজরদারি’ পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের অপরিহার্য নতুন উপাদান এখন মুনাফামুখী চলতি ব্যবস্থাকে বাড়তি গতি দিচ্ছে অত্যাধুনিক প্রহরা-প্রযুক্তি। ফেসবুক, টুইটার, গুগল, উইচ্যাটের ব্যবহারকারীরা আদতে মোটেই এসব কোম্পানির ক্রেতা-ভোক্তা নেই। কাঁচামাল মাত্র। এসব ব্যবহারকারী তাঁদের পছন্দ-অপছন্দ, নড়াচড়া, অভ্যাস, ঘৃণা, হাসি-কান্নার যাবতীয় ‘তথ্য’ জুগিয়ে যাচ্ছেন ‘অন্য’কে। ফেসবুক, টুইটার, গুগল, উইচ্যাটের কাছে ব্যবহারকারীদের সব তথ্যই ‘ডেটা’ মাত্র। সরাসরি বা গোপনে যা চলে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের হাতে; করপোরেটদের হাতেও।’
‘কাজে লাগছে সেসব কখনো ব্যবসায়ের প্রসারে, কখনো নজরদারির প্রয়োজনে। এভাবে ‘মানুষ’ অজান্তেই শান্তিপূর্ণ পথে বেদখল হচ্ছে। সার্ভিল্যান্স ক্যাপিটালিজমের শক্তির জায়গা এটাই। পুঁজিতন্ত্রের আগের অধ্যায়ে দখল-বেদখল হতো প্রাকৃতিক সম্পদ। আজকের অর্থনীতি আগ্রহী মানবপ্রকৃতি নিয়ে। খোদ মানুষকে নিয়ে। এত দিনকার ইতিহাসে পুঁজি ও তার পেশিশক্তি উপনিবেশিত করেছে বিভিন্ন অঞ্চলকে। এখন উপনিবেশ হওয়ার কাল মানবশরীর ও মনের। সার্ভিল্যান্স ক্যাপিটালিজমে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের পাশাপাশি খুন হচ্ছে বিশেষভাবে মানুষের সার্বভৌমত্ব।’ (চীন: সবাই যখন উইঘুর, আলতাফ পারভেজ)।
মানুষ তার সার্বভৌমত্ব হারালে আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি- গণতন্ত্র ও বাজারব্যবস্থার আর কোন অর্থ বাকী থাকবে না।
ইসলামের দৃষ্টিতে ‘সতর’ : যে কারণে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা জরুরী বিষয়
ইসলাম সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা। জীবন-জগতের সকল বিষয়ে ইসলামের নৈতিক অবস্থান আছে। আমরা যেহেতু আধুনিক পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে ইসলামের পর্যালোচনা প্রস্তাব করি। তাই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ব্যাপক নজরদারী প্রশ্নে ইসলামি বুঝাবুঝি পেশ করা জরুরী হয়ে উঠে। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা কেবল ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গের দায়িত্ব নয়, খোদ রাষ্ট্র ও সমাজের কাঁধে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব অর্পিত। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা অনৈতিক, অবৈধ ও গুনাহের কাজ। অনৈতিক অর্থাৎ কোনভাবে এর লঙ্ঘনকে ‘কৌশল’ আখ্যা দেওয়া যাবে না, অবৈধ মানে রাষ্ট্র ও সমাজ এর শাস্তির ব্যবস্থা করবে ও গুনাহের অর্থ আখেরাতে আজাবের মুখোমুখি হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ জীবন ও জগতের কেন্দ্রীয় প্রাণী। মানুষ মহাবিশ্ব ও মহাকালের প্রধান পুরুষ ; কোরআনের ভাষায় যাকে বলা হয়েছে খলিফা। হাদিস শরীফে নবীজি বলেছেন, পৃথিবীর ধ্বংসের সাথে মানুষের খেলাফত ও নেতৃত্বের গভীর সম্পর্ক আছে। যোগ্য মানুষরা নেতৃত্ব হারালে নৈতিকতা নষ্ট হবে। নৈতিকতা নষ্ট হলে কেয়ামত কায়েম হবে ; পৃথিবীর সকল আয়োজন শেষ হবে। এ কারণেই নৈতিকতা রক্ষার প্রশ্নে ইসলাম মানুষের বিবেচনা ও ইচ্ছাশক্তি হেফাজতের ওপর অনেক গুরুত্বআরোপ করে। কেননা বিবেচনা ও ইচ্ছাশক্তি ছাড়া যোগ্য নেতৃত্ব দান করা, খেলাফত ও প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব নয়। এই সম্ভাব্যতার সাথেই যুক্ত হক-হাক্কানিয়াতের ধারাবাহিকতা।
আল্লাহ মানুষকে বিবেচনাবোধ দান করেছেন, যাতে মানুষ হককে চিনতে পারে। ইচ্ছা ও শক্তি দিয়েছেন যাতে হক বাস্তবায়ন করতে পারে। প্রহরা প্রযুক্তি ও ব্যাপক নজরদারীর মূল উদ্দেশ্যকে মানুষকে ‘ইঞ্জেনিয়ারিং’ করা ; নিয়ন্ত্রণ ও রুপান্তর ঘটানো। আমরা দেখেছি, এতে মানুষের মৌলিক সক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ইসলামের কাছে মানুষ ও তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা পবিত্র বিষয়। কেউ আপনার পক্ষে বা বিপক্ষে থাকুক, আপনার লাভে আসুক বা না আসুক, কারো ব্যক্তিগত ‘সার্বভৌমত্ব’ লঙ্ঘন করা ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। ইসলামের ভাষায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সতর হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
কারো সতর দেখা বা দেখার চেষ্টা করা কোনভাবে বৈধ নয়। সতর বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার মাত্রাভেদে এর শাস্তি নির্ধারিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একে কবিরা বা বড় গুনাহ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। আগেই যেমন বলেছি, ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ ও মানুষের সতর পবিত্র বিষয়। একে ইঞ্জেনিয়ারিং করার চেষ্টার অর্থ মানুষকে জন্ত বানানোর চেষ্টা, যা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। ইসলাম যদিও নির্দিষ্ট হক ও হাক্কানিয়াতে বিশ্বাস করে, তবে সেটা মানতে কাউকে বাধ্য করা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। খাদ্য ও নিরাপত্তার মতই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মানুষের মৌলিক অধিকার। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা পেলেই রক্ষা পাবে বিবেচনাবোধ ও ইচ্ছাশক্তি ; ফলে মানুষ হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে। এটাই ইসলামের মূল কাঠামো ; নিয়ত ইবাদতের মৌলিক শর্ত, স্বাধীন বিবেচনাবোধ ও ইচ্ছায় মানুষ হককে গ্রহণ করলে প্রতিদান পাবে, বাতিলকে গ্রহণ করলে শাস্তি হবে।
মাকাসেদে শরিয়ার দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ব্যাপক নজরদারী
আমরা দেখিয়েছি, ব্যাপক নজরদারীর মাধ্যমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করলে মানুষের বিবেচনাবোধ ও স্বাধীন ইচ্ছা ব্যাহত হয়। মূলত এই উদ্দেশ্যেই আধুনিক নজরদারী ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। এতে প্রধানত মানুষের বুদ্ধির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়, ক্রমশ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করা হয়, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়, অসম্মান ও অনিরাপত্তার আশঙ্কা তৈরি হয়। বস্তুত ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানুষের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেবার চেষ্টা করা হয়। এতে দেখা যায়, ব্যাপক নজরদারীর মাধ্যমে মাকাসেদে শরিয়া বা ইসলামের মৌলিক উদ্দেশ্যের সবগুলোই ব্যাঘাতপ্রাপ্ত হয়।
আধুনিক নজরদারী ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য মানুষের বুদ্ধিকে অকার্যকর করে দেওয়া। অথচ বুদ্ধি মানুষের মৌলিক ভিত্তি। এর মাধ্যমেই মানুষ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়, ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে সক্ষম হয়। বুদ্ধির কার্যকারিতার জন্য ইসলাম অন্ধ অনুসরণ করতে নিষেধ করেছে। চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করেছে। খাহেশাতের অনুসরণ নিষিদ্ধ করেছে। মাদক ও গাফেলকারী বস্তু নিষিদ্ধ করেছে। অর্থহীন বিষয় থেকে বেঁচে থাকাকে ঈমানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আধুনিক নজরদারী ব্যবস্থায় বুদ্ধির এই কার্যকারিতা নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। মানুষের আচার-আচরণ চিহ্নিত করে তাকে ‘ব্যবহার’ করার চেষ্টা করা হয়। এতে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক, স্বাধীনতা ও পবিত্রতা নষ্ট হয়।
অন্যদিকে আধুনিক নজরদারী ব্যবস্থায় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নিশ্চিতভাবে সীমিত হয়, যেটা আমরা চীনে দেখছি। একইভাবে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়, অসম্মান ও অনিরাপত্তার আশঙ্কা তৈরি হতেও দেখেছি। চীনে মসজিদে মসজিদে সিসিক্যামেরা লাগানো হয়েছে। তাতে আসলে অসম্মান ও অনিরাপত্তাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কেননা এগুলো আসলে বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। শুধু চীনেই নয়, সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের যুগে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে আন্তর্জাতিক সংস্থা, মুসলিম বিদ্বেষী সেকুলারের এজেন্সি ও বহুজাতিক কোম্পানি, সবাই আসলে আমাদের ডাটা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়মিত লঙ্ঘন করছে। শুধু জমিনেই নয়, আকাশের পেটেও আছে বহু ‘সন্ত্রাস বিরোধী’ স্যাটেলাইট।
কিছু আয়াত ও হাদিস : সতর প্রশ্নে
সূরা হুজুরাতে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা অন্যদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ, ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান ও অনুপস্থিতে দোষ বর্ণনা করো না। ( সূরা হুজুরাত, ১২, আয়াত ) একে আল্লাহ তাআলা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা দিয়েছেন। এই আয়াতের মাধ্যমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান সম্পর্কে একটা মৌলিক ধারণা পাওয়া যায়। অন্যের সম্পর্কে মন্দ ধারণা রাখলে তার স্বাভাবিক কাজকেও অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক মনে হতে থাকে, যেখান থেকে অনর্থক নজরদারী ও অনুসন্ধানের সৃষ্টি হয়, সেখান থেকে সৃষ্টি হয় অনুপস্থিতিতে দোষ বর্ণনা। এভাবে একজন মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ধংস করে দেওয়া হয়।
সূরা নূরের মধ্যেও আল্লাহ তাআলা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কেউ কারো বাড়িতে অনুমতি ছাড়া ঢুকতে পারবে না। অপরিচিত নারী-পুরুষের দিকে অপ্রয়োজনীয় দৃষ্টিবিনিময় করতে পারবে না। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের দেহ তার ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয়। একে অবৈধ উপায়ে লঙ্ঘন বা ব্যবহার করার সুযোগ নেই। এখান থেকেই ইসলামের দৃষ্টিতে সুন্দরী প্রতিযোগিতা, দেহব্যবসা ও বিজ্ঞাপন-রিসিপশনে নারীর সৌন্দর্য বিক্রির সুযোগ নেই। কেননা মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয় পণ্য হতে পারে না। মানুষের শরীর, বিবেচনা ও ইচ্ছার স্বাধীনতা অনেক পবিত্র বিষয়। একে যেমন বিক্রি করা বৈধ নয়, তেমনি প্রহরা ও নজরদারীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনারও সুযোগ নেই। ( সূরা নূর, ২৮, ৩০, ৩১, আয়াত )।
শুধু অপরিচিত মানুষের সাথেই নয়, নিজের ঘরের মধ্যেও পারস্পরিক অনুমতি ও সম্মতি ছাড়া একে-অপরের ঘরে যাবার অনুমতি নেই। ( সূরা নূর, ৫৮, ৫৯, আয়াত )। খোদ স্বামী দীর্ঘদিন পর সফর থেকে বাড়ি ফিরলে নবীজি আগে জানিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে বলেছেন। কেননা অনুপস্থিতিতে স্ত্রী তার নিজ পরিবেশে থেকেছেন, পারস্পরিক বুঝ-বিবেচনা-পছন্দের পরিবেশের দিকে অতটা হয়তো মনোযোগী ছিলেন না। তাতে পারস্পরিক ভুল-বোঝাবুঝির আশঙ্কা থেকে যায়। বস্তুত ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার সুযোগ দিলে আমাদের সম্পর্ক ও বুঝাবুঝিও শক্তিশালী থাকে, এতে অসুস্থতা বা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় না। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট করে খারাপ ধারণা পোষণ, অযাচিত অনুসন্ধান ও দোষ বর্ণনায় আসলে কারো ফায়দা নেই। এতে বরং মানুষের সম্পর্ক, স্বাধীনতা ও পবিত্রতা নষ্ট হয়।
নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি অপর ভাইয়ের ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করে, আল্লাহ খোদ তার ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করেন এবং লাঞ্চিত করেন। ( আবু দাউদ )। নবীজি আরও বলেন, কেউ যদি এমন লোক সমষ্টির কথা শুনার চেষ্টা করে, যারা তার ‘কান-লাগানো’কে পছন্দ করে না, তাহলে আল্লাহ তার কানে শিশা ঢেলে দিবেন। ( মুসনাদে আহমদ )। আরেক হাদিসে নবীজি বলেন, যে ব্যক্তি অপর ভাইয়ের লেখায় চোখ রাখল, সে যেন আগুনে চোখ রাখল। ( আবু দাউদ )। এসব হাদিস থেকে ব্যক্তিগত গোপনীয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
রাষ্ট্রও সামগ্রিক নজরদারী করতে পারে না
এটা শুধু ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। নবীজি বলেছেন, শাসকরা যখন জনগণের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করে অনুসন্ধান চালায়, তখন আসলে তাদের স্বভাব-চরিত্র নষ্ট করে দেয়। ( আবু দাউদ ) কেননা মানুষ ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় নানা কিছুই করে, যা অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ ভুল থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। শাসক যখন সন্দেহ ও নজরদারী শুরু করে, তখন মানুষের জীবনের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়। এতে বিশৃঙ্খলা ও জটিলতা বাড়ে, তাতে মানুষের স্বাভাবিক নৈতিকতা নষ্ট হয়ে যায়। এর ভিত্তিতেই ইবনে মাসউদ রাঃ বলেছেন, মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়ে ‘খুঁজাখুঁজি’ ও ভুল অনুসন্ধান করা নিষিদ্ধ, অবশ্য গুনাহ প্রকাশ্য হয়ে গেলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। ( আবু দাউদ )।
ওমর রাঃ খলিফা থাকা অবস্থায় রাতে এক ব্যক্তির ঘরে ঢুকে দেখেন, তার সামনে মদ ও গায়িকা। শক্ত আচরণ করতে যেতেই লোকটা বলে বসল, ওমর আমার ঘরে অনুমতি ছাড়া ঢুকেছেন, মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয় ‘অনুসন্ধান’ করছেন, এটা তো নিষিদ্ধ। ওমর রাঃ বিষয়টা বুঝতে পেরে কাপড় ধরে অনুতপ্তের মতো কান্না করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। নিজেকেই বললেন, এটা কি করলে ওমর, আল্লাহ যদি তোমাকে ক্ষমা না করেন? ঐ লোক কিছুদিন ওমরের মজলিস এড়িয়ে যেতে থাকেন। একদিন পেছনে এসে বসলে ওমর তাঁকে ডাকলেন এবং অনুচ্চস্বরে বললেন, আপনার কথা আমি কাউকে বলিনি। আমার সাথে ঐদিন ইবনে মাসউদ ছিল তাকেও বলিনি। ঐ লোক এবার কসম খেয়ে বলল, আমি এমন কাজ আর করিনি। ( কানযুল উম্মাল, জামেউল আহাদিস )
সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের যুগে রাষ্ট্রীয় নজরদারীর প্রশ্ন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রীয় ইসলামোফোবিয়ার অংশ হিসেবে এই নজরদারীর প্রসঙ্গ অত্যন্ত জরুরী। কেননা সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের যুগে রাষ্ট্রীয় নজরদারীর ভিত্তি হচ্ছে, ইসলাম ও মুসলমানদের বিষয়ে সন্দেহ, ঘৃণা, দোষ চর্চা ও অহেতুক অনুসন্ধান, বস্তুত পশ্চিমা সভ্যতার জন্য এটি একটি মৌলিক সঙ্কট। বর্তমান বাস্তবতায় পশ্চিমা প্রভাবাধীন দেশ ও সংখ্যালঘু মুসলিম জনপদ ও গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কের প্রশ্ন এই অস্তিত্ববাদী সঙ্কট এড়িয়ে যেতে পারে না। আমাদের এই অঞ্চলে রোহিঙ্গা, উইঘুর ও এনআরসির বিপর্যয় আসলে এই অস্তিত্ববাদী সঙ্কটের সাথে জড়িত অর্থাৎ ইসলাম ও মুসলমানদের বিষয়ে সন্দেহ, ঘৃণা, দোষ চর্চা ও অহেতুক অনুসন্ধান। অবশ্য এটি শুধু তাদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নয়, যারা ইসলামকে বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করেন, তাদের জন্যও জরুরী প্রশ্ন।