ঝুঁকিতে মুসলিম ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রত্নতত্ত্ব : দেখার কেউ নেই

ঝুঁকিতে মুসলিম ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রত্নতত্ত্ব : দেখার কেউ নেই

মুসান্না মেহবুব :

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুসলিম শাসন ও সভ্যতার ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক অসংখ্য স্থাপনা। কিন্তু যথাযথ তত্বাবধান ও পরিচর্যার অভাবে স্থাপনাগুলোর অধিকাংশই প্রাচীনত্বের রূপ ও সৌন্দর্য হারাতে বসেছে।

বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রাচীন মসজিদ স্থাপত্য। রাজধানীসহ দেশের নানা স্থানে রয়েছে শত শত বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত মসজিদ।

সুলতানি আমলের অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনা মসজিদ৷ সুলতান হুসাইন শাহের সময়কালে (১৪৯৩-১৫১৯) পনেরো গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি নির্মিত হয়৷ ইট ও পাথরের তৈরি এই মসজিদে পোড়ামাটির কারুকাজ রয়েছে৷

রাজশাহীর বাঘায় ১৫২৩ সালে নির্মিত বাঘা মসজিদ গুরুত্বপুর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন৷ এ ছাড়া মুন্সিগঞ্জের রামপালে মালিক কাফুর ১৪৮৩ সালে বাবা আদম শহিদের নামে একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করেন৷ রাজশাহী জেলার দূর্গাপুর থানার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে দেখা যায় আমগ্রাম, কিসমত মারিয়া, কাঠালিয়া ও রইপাড়া গ্রামে মোঘলপরবর্তী যুগের ছয়টি মসজিদ স্থাপত্য৷

বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ৷ সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের শাসনকালে সুফি সাধক সেনাপতি খানজাহান আলী ১৮৪২ থেকে ১৪৫৯ সাল মধ্যে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন৷

মুঘল সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকায় অনেক স্থাপত্যকীর্তি নির্মিত হয়৷ কিন্তু কালের বিবর্তনে খুব কম সংখ্যকই আদিরূপে টিকে আছে৷ টিকে থাকা স্থাপত্যগুলোর মধ্যে মসজিদই প্রধান৷ তবে এসব পুরনো মসজিদের সামগ্রিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়৷ অপরিকল্পিত সংস্কার ও সম্প্রসারণের কারণে বিনষ্ট হয়েছে অগণিত মসজিদের মূল বৈশিষ্ট্য৷ অনেক ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে বিলীন করে আধুনিক রূপ দেয়া হয়েছে৷ যেমন ঢাকায় কালের আঘাত সহ্য করে টিকে থাকা সুলতানি আমলের প্রধানতম মসজিদটি হলো বিনত বিবির মসজিদ৷ ঢাকার নারিন্দায় অবস্থিত এই মসজিদটি সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের শাসনামলে জনৈক মারহামাতের কন্যা বখত বিনত ১৪৫৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেন৷ প্রকৃতপক্ষে নির্মাণকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই দীর্ঘসময় মসজিদের এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে, মসজিদের গায়ে শীলালিপিটিই প্রাচীনত্ব বোঝার একমাত্র সম্বল হয়ে পড়েছে৷ বর্তমানে মসজিদটি ত্রিতল ইমারত, যদিও আদিতে এটি ছিল একগম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদ৷ অপরিকল্পিত সংস্কার ও সম্প্রসারণে মসজিদের আদিরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত এই মসজিদ৷

এ ছাড়া মুঘল আমলে ঢাকায় গুরুত্বপুর্ণ স্থান কাওরান বাজারে ১৬৭৭-৭৮ সালে নবাব শায়েস্তা খাঁর প্রধান আমাত্য খাজা অম্বর তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যেটি খাজা অম্বর মসজিদ নামে পরিচিত৷ ১৭০৫ সালে জনৈক খান মোহাম্মাদ মীর্জা লালবাগে খান মোহাম্মাদ মৃধা মসজিদটি নির্মাণ করেন৷ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে নির্মিত মতিঝিলের দিলখুশা মসজিদটি চিরাচরিত মুঘল স্থাপত্যরীতির তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ৷ মসজিদটি মুলত নবাব সলিমুল্লার ওয়াকফ স্টেটের অধীনে হলেও রাজউকের তত্ত্বাবধানে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সংস্কার কাজ করে আধুনিক মাত্রা দিয়ে মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও আবেদন নষ্ট করা হয়েছে৷

অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে আরমানিটোলায় মুঘল স্থাপত্যের অন্যান্য মসজিদের ন্যায়ে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট অলংকরণ বর্জিত সাদামাটা একটি মসজিদ নির্মাণ করেন মীর্জা গোলাম পীর৷ গোলাম পীরের মসজিদ নামে পরিচিত সেই মসজিদটি সংস্কারের পরে বর্তমানে ‘তারা মসজিদ’ নামে পরিচিত৷

ঢাকার প্রাচীন মসজিদগুলোর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় অপরিকল্পিত সংস্কার ও সম্প্রসারণের ফলে মসজিদগুলোর আদিরূপ ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিনষ্ট হয়েছে৷ আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রাচীন মসজিদই স্থানীয় জনসাধারণের উদ্যোগে রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে থাকে৷ ফলে সর্বসাধারণের অসচেতনতায় নানারূপ অপরিকল্পিত সংস্কার ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমে এসব মূল্যবান নিদর্শন বিনষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত৷ এর সাথে যুক্ত হয় সরকারি সংস্থাগুলোর অদক্ষতা, অবহেলা ও নির্লিপ্ততা৷

পুরান ঢাকার মুসলিম ঐতিহাসিক স্থাপনা আহসান মঞ্জিল। ১৮৩০ সালে ঢাকার নবাব খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসিদের কাছে থেকে পুরনো একটি ভবন কিনে নেন৷ ১৮৭২ সালে নবাব আব্দুল গণি এটিকে নতুন করে নির্মাণ করে তাঁর ছেলে খাজা আহসান উল্লাহর নামে এর নামকরণ করেন৷ ঐতিহাসিক এ স্থাপনায় নেই যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ। স্থাপনাটি এখন বুড়িগঙ্গা থেকে দেখাই যায় না৷ এর সামনে বসে ফলের বাজার৷ সম্মুখভাগে তাই টিনের বেড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে৷

পুরান ঢাকার চকবাজারে মুঘল আমলের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি স্থাপনা বড় কাটরা। সংরক্ষণের অভাবে স্থাপনাটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে৷ সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়৷ গেল শতাব্দীর মাঝামাঝিতে হজরত হাফেজ্জি হুজুর রহ.-সহ খ্যাতনামা কয়েকজন বুজুর্গ এখানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন৷ যেটা এখন বড়কাটরা মাদরাসা নামেই প্রসিদ্ধ। মাদরাসার পাশে বেশ কিছু ব্যবসায়ী এ ভবনটি দখল করে আছে৷ স্থাপত্য সৌন্দর্যের বিবেচনায় একসময়ে বড় কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকটি যেন ভগ্নাবশেষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে৷

বড় কাটরার কাছেই আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছোট কাটারা৷ শায়েস্তা খানের আমলে আনুমানিক ১৬৬৩ থেকে ১৬৬৪ সালের দিকে এই ইমারতটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৬৭১ সালে৷ দেখতে অনেকটা বড় কাটরার মতো হলেও এটি আকৃতিতে বড় কাটরার চেয়ে ছোট এবং এ কারণেই হয়তো এর নাম হয়েছিল ছোট কাটরা৷ সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে মুঘল আমলের এ স্থাপনাটিও ধ্বংসপ্রায়৷

নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী ঐতিহাসিক পানাম নগর৷ ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন এই সোনারগাঁওয়ে৷ প্রায় ৫ মিটার চওড়া এবং ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দু’পাশে সুরম্য ৫২টি বাড়ি প্রাচীন এই নগরের অন্যতম আকর্ষণ৷ কিন্তু সঠিক সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ঐতিহাসিক এ শহরটি ধ্বংস হতে চলছে৷

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সিকদার মো. জুলকারনাইন বলছেন, বাংলাদেশে কেবল মুসলিম সভ্যতার প্রত্নতত্ত্বই নয়, বরং সবরকমের প্রত্নতত্ত্বের ব্যাপারেই গাফলতি রয়েছে। এসবের তদারকিতে যেমন ঘাটতি আছে, তেম্নি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণেও রয়েছে অবহেলা।

মি. জুলকারনাইন বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রত্যেক জাতির জন্যই অমূল্য সম্পদ৷ এ সম্পদ আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে৷ অথচ আমাদের দেশের এই মূল্যবান নিদর্শন সংরক্ষণের যথাযথ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি৷ এরই ধারাবাহিকতায় ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের সাক্ষ্য মহামূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রাচীন স্থাপত্য কাঠামো ও প্রত্ননিদর্শন৷ এগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার কাজটি করে থাকে আমাদের জাদুঘরগুলো৷ যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার জন্য যে জাদুঘর আমাদের রয়েছে সেগুলো এখনো উনিশ শতকে পড়ে আছে৷ এগুলোকে প্রকৃত অর্থে জাদুঘর না বলে উন্মুক্ত গুদাম বলা যায়৷ কারণ এগুলোতে কেবল সারিবদ্ধভাবে নিদর্শনগুলো প্রদর্শনের মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখেছে তাদের কাজ৷

তিনি বলেন, জাদুঘরকে আরও বেশি জনগণসম্পৃক্ত করতে হবে৷ নতুন নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকেন্দ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে৷ দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সুরক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও জাদুঘরগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে৷ তাহলে নতুন প্রজন্ম দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে৷ ভালোবাসতে জানবে দেশের মুল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোকে ও এ দেশের আপামর মানুষকে৷

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এ শিক্ষক বলেন, আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা না গেলে আমাদের ঐতিহ্যর ধারক ও বাহক এ সব অমূল্য নিদর্শন অচিরেই বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে৷ তাই এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করার এখনই সময়৷ সে জন্য জনসাধারণকে সচেতন ও সম্পৃক্তকরণ, প্রত্নবস্তু সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট আইনকে যুগোপযোগী করা, পেশাজীবী দক্ষ জনবল তৈরি করা, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণে কাজ করা যেতে পারে৷ সর্বোপরি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের সচেতন ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সুরক্ষায়, সংরক্ষণে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে৷

আগের সংবাদসংকটের এই সময়ে কী করছে ইসলামি দলগুলো?
পরবর্তি সংবাদপেটে গুলি করে ফিলিস্তিনি কিশোরকে হত্যা করল ইসরায়েলি সেনারা