.jpg)
রাগিব রব্বানি :
বিগত ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের সরকারি শিক্ষাধারায় স্বাস্থ্যশিক্ষা পাঠের আওতায় শিক্ষার্থীদের যৌনশিক্ষার জন্য শুরু হয় ‘জেনারেশন ব্রেক থ্রু’ প্রকল্প। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের মেয়াদ ছিল ২০১৮ সাল পর্যন্ত। প্রথম পর্যায়ে ঢাকাসহ চারটি জেলার তিনশ’ হাইস্কুল এবং ৫০টি সরকারি মাদরাসায় এই যৌনশিক্ষা ক্লাসের পাঠদান করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে চলতি বছর থেকে। এ পর্যায়ে আরও পাঁচটি জেলার দুইশ’ হাইস্কুল এবং ৫০টি সরকারি মাদরাসাকে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের নয় জেলায় মোট পাঁচশ’টি হাইস্কুল এবং ১০০টি মাদরাসায় যৌনশিক্ষার এ ক্লাস চালু রয়েছে।
জেনারেশন ব্রেক থ্রু প্রকল্পের পরিচালক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, লৈঙ্গিক বৈষম্য দূর করে নারী-পুরুষের সমতা বিধান এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার সম্পর্কে ধারণা দেওয়াই যৌনশিক্ষা ক্লাসের মূল উদ্দেশ্য। এন্টারটেইনিং পদ্ধতিতে ১৫ থেকে ১৯ বছরের শিক্ষার্থীদের এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মেয়েদের জন্য নারী এবং ছেলেদের জন্য পুরুষ প্রশিক্ষক থাকেন।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত কনসার্নড উইমেন ফর ডেভেলপমেন্টের টেকনিক্যাল অফিসার ইয়াসমিন আক্তার জানান, আমরা রিপ্রোডাকটিভ হেলথ-এর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্নার তৈরি করে দিই৷ সেখানে এ সংক্রান্ত তথ্য থাকে৷ শিক্ষার্থীরা ক্লাবের মতো এখান থেকে নিজেরাই শেখে৷ আর সমতা বিধানে সচেতনতার জন্য ক্লাসেই নানা গেম, রোল ও ক্যারেক্টারের মাধ্যমে কাজ করি৷
এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এভাবে যৌনশিক্ষার ক্লাস চালু করার বিরোধিতা করছেন দেশের আলেম সমাজ এবং সচেতন অভিভাবকবৃন্দ। তাঁরা বলছেন, যৌনাচারের বিষয়টা একান্তই নিজস্ব, প্রাকৃতিকভাবেই মানুষ এ সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যায়। ব্যাপারটা লাজ-লজ্জারও। আবশ্যিক কিছু মাসআলা-মাসায়েল আছে, এগুলো জানার জন্য তাদেরকে ক্লাস করানো যেতে পারে, যেটা মাদরাসাগুলোতে হয়। কিন্তু কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে এভাবে ঢালাওভাবে যৌনতা সম্পর্কে ক্লাস করিয়ে অশ্লীলতারই চর্চা করা হয় মূলত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কাজ নিতান্তই অশোভনীয়।
তাছাড়া এটার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবাধ যৌনতার প্রতি একপ্রকারের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
দেশের প্রাচীনতম ইসলামি রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের এক বিবৃতিতে বলা হয়, যৌনবিষয়ে সচেতনতার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। কেননা, এটা জটিল কোনো বিষয় না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবেই তারা এই শিক্ষা পেয়ে যায় এবং অবশিষ্ট শিক্ষা ছেলে-মেয়েরা বয়সে কিছু সিনিয়রদের কাছ থেকেও পেয়ে থাকে। পশ্চিমাদেরকে যৌনশিক্ষা ও অবাধ যৌনাচার পরিবার ও সমাজ ভেঙে দেওয়াসহ অসংখ্য প্রাণঘাতী যৌনরোগে ডুবিয়েছে। আমরা চাই না তাদের মতো আমাদের পরিবার ও সমাজব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়ুক এবং অনাচার ও প্রাণঘাতী রোগে মানুষ ডুবে মরুক।
একই কথা বলছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও রাজধানীর শায়খ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ। তিনি বলেন, যৌনশিক্ষার নামে মূলত বেহায়াপনা ছড়ানো হচ্ছে। এর দ্বারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে নির্লজ্জ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা স্পষ্ট ইসলাম-বিরোধী। লজ্জা ঈমানের অন্যতম একটা অনুষঙ্গ। যৌন শিক্ষার ক্লাস করিয়ে শিক্ষার্থীদের ঈমানের এই অন্যতম অনুষঙ্গটি বিনষ্ট করা হচ্ছে। তাছাড়া গণমাধ্যমের খবরে দেখেছি, ছেলেমেয়েদের একসাথে বসিয়ে এই ক্লাস করানো হয়, এটা রীতিমতো আত্মঘাতী। এম্নিতেই নানা ধরনের যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই ক্লাসের মাধ্যমে এসব বিষয়কে আরও উস্কে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, হ্যাঁ, যৌনতা বিষয়ক কিছু মাসআলা-মাসায়েল আছে, যেগুলো প্রতিটা মুসলিমের জানা জরুরি। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এগুলো সম্পর্কে বেখবর। তাঁদেরকে এগুলো শিক্ষা দেওয়া অপরিহার্য। তা না করে যৌনশিক্ষার নামে অশ্লীলতার চর্চা করানো সত্যিই দুঃখজনক। এবং এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যতপ্রজন্মের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবে।
তবে এ বিষয়ে একটু ব্যতিক্রমী মতামত জানিয়েছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আলেম ও ইসলামিক স্কলার ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, দেশের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌনশিক্ষার ক্লাস চালু করা হয়েছে, আমি শুনেছি। তবে ক্লাসের সিলেবাসটা আমার দেখা হয়নি। যৌনশিক্ষার নামে ঠিক কী বিষয় তারা শেখাচ্ছেন, আমি জানি না। তবে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা আমি জরুরি মনে করি। কারণ, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার অনেক বেশি, মায়েরা প্রজনন বিষয়ে অসচেতন থাকবার ফলেই এমনটা ঘটছে। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের মা-বাবা, তাদেরকে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে নির্দিষ্ট একটা বয়সের পর সচেতন করা জরুরি।
তিনি বলেন, যৌনশিক্ষার ক্লাসে ছেলে-মেয়েকে পৃথকভাবে ভাগ করে যদি এরকম জরুরি বিষয়ের ক্লাস নেওয়া হয়, তাহলে সেটা ইতিবাচক একটা দিক। কিন্তু এর বাইরে শিক্ষার নামে অবাধ যৌনতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা, নারীপুরুষের সমানাধিকারের চর্চা, ছেলেমেয়েকে একত্রে বসিয়ে যৌনবিষয়ে ক্লাস নেওয়া ইত্যাদি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় কানুনের সঙ্গে যেমন সাংঘর্ষিক, তেম্নি এ অঞ্চলের চিরায়ত সংস্কৃতির সঙ্গেও বিরোধপূর্ণ।