.jpg)
ইমরান আব্দুল্লাহ:
৩১ আগস্টের পর দেশ হারিয়েছে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের ১৯ লাখের বেশি মানুষ। এনআরসি তথা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন তালিকায় নাম আসেনি তাদের। তাই এখন তাদের কোনো দেশ নেই, পতাকা নেই। যে ঘর বেঁধেছিল তারা পরম মমতায়, সে ঘর ভেঙে এখন তাদের আশ্রয় নিতে হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। ‘মহান’ ভারত তাদের নাম দিয়েছে ‘অনুপ্রবেশকারী’। তার মানে—আসামে এখন তাদের কোনো অধিকারই নেই। ৩০ আগস্টও তারা আসামের নাগরিক ছিল। কিন্তু ৩১ আগস্ট এনআরসির তালিকায় নাম না আসায় নাগরিকের মর্যাদা থেকে তাদের নেমে গেছে অনুপ্রবেশকারীর অভিধায়। যেন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নিজ ঘর থেকেই বের করে দিল কোনো অজাতশত্রু।
ভারতের দাবি এই ১৯ লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের দাবি, আসামে তাদের কোনো নাগরিক নেই। মূলত পুলসিরাতের মতো চিকন একটা সুতোয় ঝুলছে তারা; তাদের পায়ের নিচে না আছে মাটি, না আছে রাষ্ট্র।
এনআরসির দীর্ঘ যাত্রা
আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বা এনআরসির প্রথম তালিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। সেটা ছিল ভারত ভাগের চার বছর পর। সে সময় তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর লক্ষ লক্ষ লোক সীমান্ত অতিক্রম করে নবগঠিত ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিপুল সংখ্যক মুসলমানের আগমন হিন্দু-প্রধান আসামের জনসংখ্যার ভারসাম্যকে বদলে দিতে পারে এই আশঙ্কায় সেখানকার অসমিয়া জাতীয়তাবাদী দলগুলো আন্দোলন শুরু করে এবং নাগরিকত্বের প্রথম তালিকাটি তৈরি হয়।
এই সমস্যা আবার দেখা দেয় ১৯৭০-এর দশকে যখন বাংলাদেশে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে যায়। এদের একাংশ আসামে আশ্রয় নেয়।
অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) ১৯৭৯ সালে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৩ সালে আসু চালায় ভয়ংকর গণহত্যা, যাতে ৬ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান।
আসু এবং কয়েকটি আঞ্চলিক দল এই প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে একটা চুক্তিতে আসে। চুক্তিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চের আগে থেকে আসামের বাসিন্দা–এমনটা কেউ প্রমাণ করতে না পারলে তাকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে এবং তাকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
কিন্তু চুক্তিটি কখনই বাস্তবায়ন করা হয়নি। অভিজিৎ শর্মা নামে এক ব্যক্তি ২০০৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কাছে এক পিটিশন দায়ের করেন এবং এনআরসি তালিকা হালনাগাদ করার আবেদন করেন। ২০১৪ সালে আদালত ঐ তালিকা ২০১৬ সালের ৩১শে জানুয়ারির মধ্যে হালনাগাদ করার জন্য কেন্দ্র সরকারকে আদেশ দেয়। তবে দুঃসাধ্য এই কাজ, যাতে তিন কোটি ২০ লক্ষ মানুষের দলিলপত্র যাচাই করার ব্যাপার রয়েছে, তা সম্পন্ন করে সরকার ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম খসড়া তালিকা প্রকাশ করে।
প্রথম খসড়া তালিকায় ১ কোটি ৯০ লাখ অধিবাসীকে নাগরিক তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ২০১৮ সালের জুনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা ৩ কোটি ২৯ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ২ কোটি ৮৯ লাখকে সংশোধিত নাগরিকত্ব তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। রয়টার্স নিবন্ধন-সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে সে সময় জানিয়েছিল, রাজ্যের ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ মানুষ তালিকায় স্থান পায়নি। এদের অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী কিংবা মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এ বছর জুনে তালিকায় আরেক দফা সংশোধনী আনা হয়। ২০১৮ সালে সংশোধিত তালিকায় স্থান পাওয়াদের মধ্যে থেকে ১ লাখেরও বেশি মানুষকে বহিষ্কার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সবমিলে বাদ পড়ার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০ লাখেরও বেশি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এরপর আসামে চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায় (এনআরসি) স্থান পেতে আবেদন করেন ৩ কোটি ৩০ লাখ ১৭ হাজার ৬৬১ জন। এরমধ্যে ৩১ আগস্ট, ২০১৯ সালে প্রকাশিত চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায় স্থান পেয়েছেন ৩ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জন। বাদ পড়েছেন রাজ্যের প্রায় ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন মানুষ।
এনআরসিতে কাদের নাম উঠেছে, কাদের নাম ওঠেনি?
এনআরসিতে যাদের নাম রয়েছে তারা প্রমাণ করতে পেরেছেন যে ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চের আগে তারা আসামে এসে হাজির হয়েছেন। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য রাজ্যের সব অধিবাসীকে তাদের জমির দলিল, ভোটার আইডি এবং পাসপোর্টসহ নানা ধরনের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়েছিল। যারা ১৯৭১ সালের পর জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে তাদের বাবা-মা কিংবা তাদের বাবা-মা ঐ তারিখের আগে থেকেই আসামের বাসিন্দা।
আশ্চর্যের হলো, এনআরসিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা, বর্তমান রাজনৈতিক নেতা এমনকি কিছু সরকারি কর্মকর্তাও ঐ তালিকায় তাদের নাম খুঁজে পাননি। সামান্য বানান ভুলের জন্য আবেদনকারীদের দলিলপত্র খারিজ করে দেয়া হয়েছে। দেখা গেছে, কোন পরিবারের এক সদস্যের নাম তালিকায় রয়েছে। কিন্তু বাদ পড়েছেন অন্য সদস্য। আসামে নিয়মিতভাবে বন্যার শিকার হয়। একারণে বহু পরিবারের সরকারি কাগজপত্র নষ্ট হয়েছে। দলিলপত্র সংরক্ষণের দুর্বলতা, অশিক্ষা এবং অর্থ না থাকায় মামলা করতে পারেনি বহু পরিবার। পরিবার ও আন্দোলনকারীরা বলছে, এই অনিশ্চয়তার চাপ নিতে না পেরে অনেকেই আত্মহত্যা করেছে।
এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিরা কী করছেন?
আসামের জাতীয় নাগরিক পঞ্জী থেকে (এনআরসি) যে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে, তাদের সামনে এখন একটাই রাস্তা–আর সেটা হলো নিজেকেই প্রমাণ করা, যে, তিনি অবৈধ বাংলাদেশি নন–ভারতের নাগরিক। আর এই প্রমাণের জন্য তাদের এখন পাড়ি দিতে হবে একটি দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পথ।
আইন অনুযায়ী, এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য ১২০ দিনের মধ্যে বিদেশি ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানাতে হবে। বলা হয়েছে বিশেষভাবে তৈরি ট্রাইবুনাল ছাড়াও তারা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টেও আপিল করতে পারবেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে আদালতে গিয়ে দীর্ঘ, জটিল এবং ব্যয়বহুল আপিল প্রক্রিয়ার সুবিধা কতজন নিতে পারবেন?
নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ে অনেকদিন ধরে নানা গুরুত্বপূর্ণ মামলায় কাজ করা গুয়াহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী আমান ওয়াদুদ বিবিসিকে বলেছিলেন, নাগরিকত্ব প্রমাণের ব্যাপারে আপিল করার জন্য ১২০ দিন সময় দেয়া হয়েছে। সরকার এজন্য সব ধরনের আইনি সহায়তা দেয়ার কথাও জানিয়েছে। কিন্তু এটা আদৌ কতটা কাজে আসবে সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। অনেক সময় ব্যক্তির নাম, বয়স, কেইস অব রেসিডেন্সের ভুলের জন্য, এমনকি দুজন ব্যক্তির ছোটখাট পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বা অসঙ্গত বক্তব্যের কারণে অনেকেই নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হন।
যদিও নিম্ন আয়ের মানুষদের ট্রাইব্যুনালে মামলা লড়ার সব খরচ সরকারই বহন করবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই সব ঘোষণা এনআরসি থেকে বাদ পড়া ১৯ লাখ মানুষের সবার কাছে এখনও পৌঁছায়নি বলে জানানো হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে। তাহলে যারা জানেই না এরপর তাদের কী করতে হবে, তারা মামলা লড়বে কীভাবে নিজেকে ভারতীয় প্রমাণের জন্য?
তবে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল জানিয়েছেন, এনআরসি’র চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়া বাসিন্দারা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবেন। যতক্ষণ আপিল চলবে ততক্ষণ কাউকে বিদেশি বলা যাবে না। কারণ কাউকে বিদেশি বলার এখতিয়ার শুধু ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রয়েছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়াদের সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিদেশি ঘোষণা করা যাবে না। বাদ পড়া ব্যক্তি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন এবং আবেদনের সময়সীমা ১২০ দিন করা হয়েছে।
এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়াদের জন্য ডিটেনশন ক্যাম্প
পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিল করেও এনআরসি থেকে বাদ পড়বেন অনেকে। বাদপড়াদের বেশিরভাগই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের ফর্মূলা অনুযায়ী বাদ পড়া এসব মানুষদের ভারত থেকে বিতাড়ন করা হবে। এসব মানুষকে অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে বিজেপি নেতারা বহু দিন থেকেই বলে আসছেন, তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তবে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষকে বাংলাদেশে পাঠানো সহজ হবে বলে মনে করেন না বিশ্লেষকরা। সেক্ষেত্রে তাদের ভারতের অভ্যন্তরেই আটক রাখতে হবে। মার্কিন সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিনের এক বিশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আসামে দশটি ডিটেনশন সেন্টার (আটক কেন্দ্র) নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
ক্যাম্পের চারপাশে বাইরের প্রাচীর থাকবে ২০ ফুট উঁচু, ভেতরের প্রাচীর থাকবে ৬ ফুট উঁচু। এত উঁচু প্রাচীরের বাইরে চোখ যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া লাখ লাখ অসমীয় হয়ে যাবেন একেবারে ভিন্ন জগতের মানুষ। তবে সরকার বলছে, ভেতরে গড়ে তোলা হবে একটি স্কুল, একটি হাসপাতাল, একটি বিনোদনকেন্দ্র এবং অবৈধ অভিবাসী আর নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য আলাদা আবাসন। নারী এবং পুরুষ অবৈধ অভিবাসীদের জন্য গড়ে তোলা হবে আলাদা ঘর।
আসামের ডিটেনশন সেন্টারের জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার রবীন দাস বলেন, ভারত সরকারের নির্দেশে অনুপ্রবেশকারীদের জন্য বন্দীশিবির বানানোর কাজ শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। পুরো প্রকল্পের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি রুপি। মোট ১৫টি চারতলা বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। তার ১৩টি পুরুষদের জন্য, দুটি নারীদের জন্য।
তবে এর আগে থেকেই আসামের শিলচর, কোকরাঝাড়, গোয়ালপাড়া, তেজপুর বা জোড়হাটে অবৈধ বিদেশিদের জন্য মোট ছটি ডিটেনশন সেন্টারে বাংলাদেশি সন্দেহে শত শত ব্যক্তি বছরের পর বছর ধরে আটক আছেন। কিন্তু এই ‘অমানবিক ও বেআইনি প্রথা’ রদ করতে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেওয়ার পর আসামের বিজেপি সরকার স্থির করেছে, যারা তিন বছরের বেশি সময় ধরে সেন্টারগুলোতে বন্দী আছেন তারা এখন মুক্তি পেতে পারেন। তবে তার জন্য তাদেরকে মোট দুলক্ষ টাকার বন্ডে দুজন জামিনদার রাখতে হবে, আর একটি যাচাই করার মতো ঠিকানাও পেশ করতে হবে–যেখানে স্থানীয় থানায় তারা প্রতি সপ্তাহে হাজিরা দেবেন।
এই সহায়-সম্বলহীন ও গরিব মানুষগুলো, যাদের কাগজপত্রের ঠিকঠিকানা নেই বলেই তারা আজ ডিটেনশন ক্যাম্পে–কে তাদের হয়ে জামিনদার হবে, আর কে-ই-বা এতগুলো টাকা দেবে?
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এই কথিত বিদেশিদের মুক্তির জন্য যেভাবে দুলক্ষ টাকা দিয়ে দুজন জামিনদার রাখার কথা বলা হয়েছে তা জোগাড় করা এদের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
তাহলে সর্বশেষে নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করতে পারল না যে ১৯ লাখ মানুষ, তাদেরও কি একই পরিণতি ভোগ করতে হবে?