হেফাজতে ইসলামের সূচনা ও বিকাশ

রাকিবুল হাসান

যে সময়ে বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের জন্ম, উপযুক্ততার বিচারে ইসলামের স্বপক্ষে কথা বলার জন্য তখন এমন একটি সংগঠনের বড্ড প্রয়োজন ছিল। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের পর এর একটা জ্বলন্ত প্রমাণ আমরা দেখতে পেয়েছি। ২০১০ সালে জন্ম নেয়া হেফাজতে ইসলাম একটু একটু করে পরিণত হয়েছে। নয়ত নাস্তিকদের বিরুদ্ধে এত বড় আন্দোলন হুট করেই সম্ভব ছিল না। এই লেখায় হেফাজতে ইসলামের সূচনা এবং ৬ এপ্রিল পর্যন্ত এর বিকাশকালের সরল বিবরণ তুলে ধরবো। তুলে ধরবো দলীয় কমিটিতে ভাঙা-গড়া ও মান-অভিমানের খণ্ডচিত্র। কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, ইতিহাসের কাছে একটা বয়ান রেখে যাবার সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র।

যেভাবে তৈরি হলো প্রেক্ষাপট

২০০৯-১০ সালে বাংলাদেশে জাতীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় বড় তিনটি ঘটনা ঘটে। তিনটি ঘটনাই এদেশের মুসলমানদের জীবনাচার এবং ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

১. জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সর্বপ্রথম শিক্ষানীতিটি (১৯৭২-৭৪) প্রণয়ন করেছে ডা. কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশন। কিন্তু ধর্মীয় ভাবধারার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে জনগণ কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যাত, ধিকৃত ও নিন্দনীয় হয়। এ শিক্ষা কমিশন নব্বইটি প্রশ্ন সম্বলিত একটি প্রশ্নমালা, শিক্ষামালা—শিক্ষক, ছাত্র ও এমপিসহ মোট ৯৫৫১ জনের কাছেকাছে প্রেরণ করেন। উত্তর দেন ২৮৬৯ জন। উত্তরদাতাদের মাঝে ২২৮৫ জনই মাধ্যমিক অথবা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ধর্ম শিক্ষাকে বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। ধর্ম শিক্ষাকে তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন মাত্র ১১৬ জন। অন্যরা এ ব্যাপারে কোনো মতামত দেন নি। একইভাবে মাদরাসা শিক্ষার প্রয়োজন নেই, এ মত দেন মাত্র ৭৬ জন। ৭২২ জন মাদরাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে একীভূত করার পক্ষে মত দেন। অন্যরা মত দেন মাদরাসা শিক্ষাকে বহাল রাখার পক্ষে। তবে মজার ব্যাপার হল, এর কোনোটারই প্রতিফলন ঘটেনি ড. কুদরতে খোদা কমিশনের রিপোর্টে।

২০০৮ সালে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রণয়ন করে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি। এই শিক্ষানীতি প্রণীত হয় ১৯৭২ এর ডা. কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশনের ওপর ভিত্তি করে। এতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কৌশল ৪-এ বলা হয়, ‘মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায় ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত সকল ধর্মের শিশুদেরকে ধর্মীয় জ্ঞান, অক্ষর জ্ঞান-সহ আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিকতা শিক্ষা প্রদানের কর্মসূচি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে’। এ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূলত ধর্ম শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাদরাসা ও স্কুলে ধর্ম না পড়িয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা প্রভৃতি উপাসনালয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রদানের কথা বলা হয়েছে। বস্তুত, এর মাধ্যমে ধর্ম শিক্ষাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার কৌশল অবলম্বন করা হয়।

২. নারী নীতি ২০১১

২০১১ সালের ৮ মার্চ সরকারের নিয়মিত মন্ত্রীসভায় মহাজোট সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ (National Women Development Policy, 2011) নামক নীতিটি অনুমোদন করে। এই নীতিটি প্রণীত হয় ১৯৯৭ সালের নারী নীতির আলোকে। ১৯৯৭ সালে নারী উন্নয়ন নীতিতে নারী-পুরুষের সমান উত্তরাধিকার দেয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। ২০০৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার এতে কিছুটা পরিবর্তন করে। যেমন-সম্পত্তি, ভূমি ও উত্তরাধিকারে সমঅধিকার (equal rights) শব্দগুলো বাদ দেয়া হয়। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭-এর নীতিকে আবার প্রায় অক্ষরে অক্ষরে গ্রহণ করা হয়। তবে সমঅধিকারের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার (Inheritance) শব্দের স্থলে স্থাবর-অস্থাবর (Moveable and Immoveable Property) সম্পত্তি কথাটি যোগ করা হয়।

৩. সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস’ তুলে দেয়া

সমাজতন্ত্রবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র এ চারটি মূলনীতির আলোকে ১৯৭২ সালে প্রণীত হয় বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। এরপর সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ নীতিটি বাদ দিয়ে তার স্থলে আনা হয় ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। কিন্তু ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়। তারপর ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৫ম সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ এই বাতিল ঘোষণার মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধানে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ছুঁড়ে ফেলা হয় ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’-এর নীতিটি।

হেফাজতে ইসলামের জন্ম

একদিকে জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে ধর্মশিক্ষাকে আলাদাকরণ, অন্যদিকে কুরআনবিরোধী আইন প্রণয়ন, তার সঙ্গে সংবিধানের সূচনা থেকে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তুলে ফেলার ষড়যন্ত্র—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মুসলিম উম্মাহর আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এর বিরুদ্ধে আলেমদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদও হচ্ছিল জায়গায় জায়গায়। কিন্তু রাজনৈতিক ময়দানে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ খুব উল্লেখযোগ্য হয়ে কখনোই দেখা দেয় না। আর সব রাজনৈতিক দাবির মতোই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বিশেষ বিশেষ দাবিগুলো। ঠিক এই সময়, ১৭ জানুয়ারি ২০১০, আল্লামা আহমদ শফির আমন্ত্রণে হাটহাজারি মাদরাসায় একত্রিত হন চট্রগ্রামের বড় বড় মাদরাসার শিক্ষক এবং মুহতামিমগণ। এই প্রেক্ষাপটে কিভাবে প্রতিবাদ জানানো যায়, কিভাবে ধেয়ে আসতে থাকা অধার্মিকতার স্রোতকে ঠেকানো যায়, তা-ই আলোচ্য বিষয়। কিন্তু সেদিন চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। প্রাথমিক আলোচনার পর শেষ হয় বৈঠক।

১৯ জানুয়ারি আবারো বৈঠক আহ্বান করা হয়। বৈঠকে আল্লামা আহমদ শফি প্রস্তাব করেন, ‘লালদিঘির ময়দানে আমরা একটি সমাবেশ করতে চাই। সমাবেশ থেকে প্রতিবাদ জানানো হবে।’ মাওলানা আবদুল হালিম বুখারী তখন জানতে চান, ‘কোন ব্যানারে সমাবেশ করা হবে। যেকোনো একটি ব্যানারে তো সমাবেশ করতে হবে।’ আলোচনায় একটি সংগঠনের প্রস্তাব উঠে আসে। যেটি হবে নিরেট অরাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনের ব্যানারেই ২৪ জানুয়ারি লালদিঘির ময়দানে সমাবেশ হবে।

হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘সংগঠনের নাম হিসেবে প্রথমে পুরাতন ইসলামি সংগঠনের নামগুলো প্রস্তাবে উঠে আসে। তার মধ্যে অন্যতম ‘ইসলামি আইন কমিটি’। কিন্তু প্রস্তাব প্রস্তাবই থেকে যায়। সবাই তখন একমত হয়, নতুন নাম হলেই ভালো হয়। তাহলে পুরাতন সংগঠনের নেতিবাচক প্রভাবগুলো থাকবে না। নিখুঁত নতুন একটি নাম হলে উদ্যম এবং উদ্দেশ্যেও দৃঢ়তা এবং দৃপ্ততা পাওয়া যাবে। মাওলানা আবদুল হালিম বুখারি সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন, ‘সংগঠনের নাম হোক হেফাজতুল ইসলাম।’ মাওলানা সুলতান যাওক নদভি বললেন, ‘হেফাজতুল ইসলাম নামটি আরবি। মানুষের উচ্চারণে সমস্যা হতে পারে। যদি নামটি ফার্সিতে ‘হেফাজতে ইসলাম’ বলা হয়, তাহলে সমস্যাটা থাকবে না।’

হেফাজতে ইসলাম নামটিই গৃহীত হলো। সবাই আল্লামা আহমদ শফি দা.বা.কে আবেদন করল, ‘আপনি হবেন হেফাজতে ইসলামের আমীর।’ তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার বয়স পড়ে গেছে। গায়ে এত শক্তিও নেই এবং সংগঠন পরিচালনার তেমন অভিজ্ঞতাও নেই। মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী হোক আমির।’ মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী রাজি হলেন না। বরং বললেন, ‘হজরত, আপনিই আমির হবেন। আমি না হয় আপনার সহকারী হিসেবে থাকব।’ এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না মুফতি আবদুর রহমান রহ.। তাকে বৈঠক থেকে ফোন করে জানানো হল, ‘আল্লামা আহমদ শফির নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন করা হয়েছে। সিনিয়র নায়েবে আমির হিসেবে আপনাকে রাখতে চাচ্ছি।’ তিনি বললেন, ‘আল্লামা আহমদ শফি সাহেব হুজুর যে কাজই করেন, আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে তার সঙ্গে কাজ করব।’

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হল। আমির আল্লামা আহমদ শফি। নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল হালিম বুখারী, আল্লামা জমিরুদ্দিন নানুপুরী, মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, আল্লামা আবদুল মালেক হালিম। সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি আবদুর রহমান। মহাসচিব মাওলানা সুলতান যাওক নদভি। যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি।

প্রথম ভাঙন, প্রথম সমাবেশ

২৩ জানুয়ারি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় লালখান বাজার মাদরাসার মুহতামিম মুফতি ইজহারুল হকের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের সমালোচনা করেন এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমর্থন ব্যক্ত করেন। তখন তিনি আওয়ামীলীগের সঙ্গেই ছিলেন এবং দলীয় প্রতীক নৌকাকে নূহ আ. এর নৌকা বলে সমালোচিতও হয়েছিলেন আগে। আচমকা তার এই প্রত্যাবর্তন ও সমর্থনে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন মাওলানা আবদুল হালিম বুখারী ও সুলতান যাওক নদভি। তারা আল্লামা আহমদ শফিকে বলেন, দৈনিক পত্রিকায় তার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে । বিবৃতিতে বলা হবে, মুফতি ইজহারুল হককে আমরা আওয়ামীলীগ থেকে আসতেও বলিনি এবং হেফাজতে ইসলামে যোগ দিতেও বলিনি। কিন্তু আল্লামা আহমদ শফি সাহেব বললেন, ‘মুফতি ইজহারের সঙ্গে আমার বাক-বিতণ্ডা হয়নি। সে তার জায়গা থেকে বিবৃতি দিয়েছে। তার ওপর সে আমার ছাত্র সমতুল্য। এভাবে তার বিরুদ্ধে মাঠে-ময়দানে আমি বিবৃতি দিতে পারব না। আপনারাই দেন বিবৃতি। কারণ সে আপনাদের সমবয়সী এবং সমতুল্য।’

মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, মাওলানা আবদুল হালিম বুখারী এবং সুলতান যওক নদভি চাচ্ছিলেন আল্লামা আহমদ শফি সাহেব যেন বিবৃতি দেন। তাদেরকে সমর্থন করেন মুফতি আবদুর রহমান রহ.। তাদের কথা না রাখায় ২৩ ফেব্রুয়ারি তারা হেফাজতে ইসলাম থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে তারা জানিয়ে দেন, তারা হেফাজতে ইসলাম থেকে পদত্যাগ করেছেন। ২৪ তারিখ হেফাজতে ইসলাম লালদিঘির ময়দানে যে সমাবেশ ঘোষণা করেছে, ‘তা মূলত জামায়াতে ইসলামির ইন্ধনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’ এরপর সরকার ২৪ জানুয়ারির সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অবস্থার প্রেক্ষিতে ২৪ জানুয়ারি ফজরের পর হাটহাজারি মাদরাসায় একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়। বৈঠকে নতুন মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে। সিনিয়র নায়েবে আমির হিসেবে যুক্ত করা হয় মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে। সিদ্ধান্ত হয়—সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও সবাই সমাবেশের উদ্দেশ্যে বেরুবে।

প্রায় ৭০টি প্রাইভেটকারে হাটহাজারি মাদরাসা থেকে সমাবেশের উদ্দেশ্যে বের হয় হেফাজতে ইসলামের কাফেলা। কিন্তু অক্সিজেন পার হয়ে বালুচরা নামক স্থানে পুলিশি বাঁধার সম্মুখীন হন তারা। পুলিশ আল্লামা আহমদ শফি সাহেবের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এদিন তেরো-চৌদ্দজন আহত হয়, রক্তাক্ত হয়। রক্তের নজরানা দিয়ে শুরু হয় হেফাজতে ইসলামের পথচলা। এই ঘটনার পরই পুরো বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের নাম ছড়িয়ে পড়ে।

মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম একদম শুরু থেকে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান পর্যন্ত কেবল চট্রগ্রাম-ভিত্তিক একটি সংগঠন ছিল। তা-ও বৃহত্তর চট্রগ্রামের নয়। তবে দেশের প্রতিটি ধর্মীয় ইস্যুতে সংগঠনটি কথা বলেছে। চট্রগ্রাম প্রেসক্লাবে প্রেস কনফারেন্স করেছে, মিছিল-মানববন্ধন করেছে। দৈনিক পূর্বকোনসহ চট্রগ্রাম-ভিত্তিক বিভিন্ন পত্রিকায় হেফাজতের আমির হিসেবে আল্লামা আহমদ শফির বিবৃতি প্রকাশ হতো।’

শাহবাগ ও হাটহাজারি

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, দুপুর বারোটায় ঘোষিত হয় যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতের আমির আবদুর কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়। আদালতের এই রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আন্দোলনে নামে কতক ব্লগার। তারা দাবি জানায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হোক। ব্যাপারটা এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলত। কিন্ত আন্দোলনে মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের ঔদ্ধত্য। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির সঙ্গে তারা তাদের আক্রমণের লক্ষ্য বানায় ইসলাম এবং মুসলমানদের। আন্দোলনের শুরুর দিকে দাড়ি টুপি পরিহিত কোন লোক তাদের পাশ দিয়ে গেলেও তাদের তল্লাশী করা হতো, বোরখা পরা মহিলা দেখলে তাদেরকেও তল্লাশী করা হতো। তাদের ঔদ্ধত্ব এতটাই বেড়ে গিয়েছিলো— তারা শাহবাগে নাটকের আয়োজন করেছিলো। নাটকে দাড়ি এবং টুপি পরিহিত এক অভিনেতার মাথায় জুতো দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো। এটার মাধ্যমে মূলত মুসলামানদের ধর্মীয় পোশাককেই অবমাননা করে হয়েছে। তাছাড়াও তারা একটা ডামি কুকুরের মাথায় টুপি এবং গালে দাড়ি লাগিয়ে সেটাকে নিয়েও নাটক মঞ্চস্থ করেছিলো।

ক্রমান্বয়ে যখন তারা ইসলামকে আঘাত করতে থাকে, খুঁজতে গিয়ে বের হয় আসল তথ্য। এই আন্দোলনের লিডিং রুলে যারা কাজ করছে, তারা একেকজন নস্তিক্যবাদের প্রচারক। ইসলামকে কটাক্ষ করাই যাদের একমাত্র টার্গেট। বাড়তে থাকা তাদের ঔদ্ধত্য শংকিত করে তুলে বাংলাদেশের মুসলমানদের। ১৪ ফেব্রুয়ারি উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারির বার্ষিক মাহফিলে একযোগে সব বক্তাগণ শাহবাগের ঔদ্ধত্য আচরণের প্রতিবাদ জানান।

মাহফিলে সভাপতির বক্তব্যে জামিয়ার মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, ‘জাতির আবেগ-অনুভূতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নাস্তিক ও ইসলামের দুশমনরা তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করে ইসলামের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। দেশব্যাপী বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা, ব্যভিচার ছড়িয়ে দিয়ে মুসলমানদের ঈমান-আমল ও সভ্যতা-সংস্কৃতি ধ্বংসে নতুন আরেক ষড়যন্ত্র শুরু করছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার হাজারবার হোক, তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে আলেমসমাজ, মাদ্রাসা, দাড়ি-টুপি, পর্দা তথা দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে যে কোন ষড়যন্ত্রে এদেশের আলেমসমাজ ও তৌহিদী জনতা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না।’ তিনি সরকারের প্রতি অবিলম্বে ইসলাম, মুসলমান, নামাযী, দাড়ি-টুপিধারীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সকল অপতৎপরতা বন্ধের আহবান জানান।

সম্মেলনে হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সংযোজনের পর থেকে নাস্তিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একের পর এক যেভাবে দুঃসাহস দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক মসজিদে হামলা ও ভাংচুর চালাচ্ছে, আমাদের প্রাণের স্পন্দন হযরত মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে, বয়োবৃদ্ধ দাড়ি-টুপীধারীদের ওপর উঠতি তরুণরা যেভাবে বর্বর আচরণ করছে, তাতে আমরা হতভম্ব ও বিস্মিত না হয়ে পারছি না। নাস্তিক-মুরতাদ ও ক্ষমতাসীন মহলের ইসলাম বিদ্বেষী এ আচরণের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

চট্টগ্রাম বাবুনগর মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা মুহিববুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, কলেজ পড়ুয়া এক তরুণ পুলিশের সামনে একজন বয়স্ক মুরুব্বিকে দাড়ি ধরে যেভাবে মারধর করেছে, এরকম অবস্থা সমাজে আরও ঘটতে থাকলে জমিনে সরাসরি আল্লাহর গযব নেমে আসবে।

চট্টগ্রাম হাইলধর মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা আব্দুল মালেক হালিম বলেন, চরম ইসলাম বিদ্বেষী শাহরিয়ার কবীর, ফতোয়া নিষিদ্ধকারী বিচারপতি গোলাম রববানী, ধর্মহীন শিক্ষানীতির অন্যতম প্রবক্তা জাফর ইকবাল গং এবং মহানবী সা. সম্পর্কে অশ্লীল ও অত্যন্ত ঘৃণ্যভাবে কটূক্তি ও গালিগালাজকারী আসিফ মহিউদ্দীনসহ আরও অনেক নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষীরা তাদের নীল-নকশা বাস্তবায়নে এদেশকে ইসলাম শূন্য করার শপথ নিয়ে সরলমনা তরুণ প্রজন্মকে বিভিন্ন এজেন্সীর মাধ্যমে প্ররোচনা দিয়ে তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করে বিপদগামী করার ঘৃণ্য মানসে শাহবাগের নাটকের খলনায়ক বনেছে।

এই মাহফিলের পর শাহবাগের নাস্তিক্যবাদ-বিরোধী প্রতিবাদ আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেন, ‘এই মাহফিলে লক্ষ মানুষের সামনে প্রমাণসহ শাহবাগ আন্দোলনের নাস্তিক লিডারদের গোঁমর ফাঁস করেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। তারপর থেকেই সারাদেশে জাগরণ শুরু হয়।’

মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘হাটহাজারি মাদরাসার বার্ষিক মাহফিল চলাকালীন, ১৪ ফেব্রুয়ারি সবাই বৈঠকে বসেন। বেঠকে শাহবাগের নাস্তিকদের আস্ফালনের প্রতিবাদ জানানোর কৌশল ও পন্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়।’

হেফাজতে ইসলামের খোলাচিঠি এবং ১৩ দফা

১৫ ফেব্রুয়ারি আকস্মিকভাবে নিহত হয় ইসলাম এবং মহানবিকে নিয়ে কটূক্তি করে লেখালেখি করা ব্লগার রাজিব ওরফে থাবা বাবা। তার মৃত্যুর পর ইসলামকে আক্রমণ করে শাহবাগের আস্ফালন আরও বেড়ে যায়। এদিকে দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় থাবা বাবার লেখাগুলো প্রকাশের ফলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সর্বত্র। বিভিন্ন সংগঠন বিবৃতি দিয়ে এর তীব্র নিন্দা জানায়। শুরু হয় সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং। ২২ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেইটে হেফাজতে ইসলাম এবং সমমনা ১২টি ইসলামী দলের পক্ষে প্রথম বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশি বাধায় তা পণ্ড হয়ে যায়।

এসময় জাতির উদ্দেশ্যে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফির পক্ষ থেকে একটি খোলা চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু সুশীল মিডিয়া এই খোলা চিঠি নিয়ে নোংরা হৈচৈ শুরু করে। একাত্তর টিভিতে প্রচারিত পলাশ রহমানের ডকুমেন্টারি ‘হেফাজতনামা’য় বলা হয়, ‘খোলা চিঠিটি আহমদ শফির নয়। বরং আমার দেশ পত্রিকার অফিসে চিঠিটি লিখে আহমদ শফির নামে চালিয়ে দেয়া হয়।’ আসলেই কি তাই? আমাকে মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘খোলা চিঠিটি একদম নিরেট। আল্লামা আহমদ শফি এই চিঠি লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনজনকে। আমি, মাসিক মুঈনুল ইসলামের সম্পাদক মাওলানা মুনির এবং হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদি। আমরা এই তিনজন পরামর্শ করে চিঠিটি লিখেছি। আল্লামা আহমদ শফি চিঠিতে নিজে সাইন করেছেন। এরপর কোনো পত্রিকা এতে একটি শব্দও যুক্ত করেনি।’

এভাবেই সুশীল মিডিয়া মিথ্যাচার করে থামিয়ে দিতে চেয়েছে হেফাজতে ইসলামের অগ্রযাত্রা। কিন্তু ততদিনে মানুষ জাগতে শুরু করেছে। চারদিকে শুরু হয়েছে হেফাজতের শানে রিসালাত সম্মেলন। বিভিন্ন জেলার আলেমগণ হেফাজতের কেন্দ্রীয় অফিসে ফোন করে স্বেচ্ছায় শানে রিসালাত সম্মেলনের প্রোগ্রাম নিচ্ছেন। চট্টগ্রাম-ভিত্তিক হেফাজতে ইসলাম হয়ে উঠছে পুরো বাংলাদেশের। অঘোষিতভাবেই হেফাজতে ইসলাম নাস্তিক্যবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে আসনে উঠে আসে। মানুষের আস্থা ও ভরসার জায়গায় পরিণত হয়।

৯ মার্চ হাটহাজারি মাদরাসায় ওলামা সম্মেলনের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। সম্মেলনে সরকারের কাছে ১৩ দফা পেশ করা হয়। এই ১৩ দফা রচনা করেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘আমাকে দেয়া হয়েছিল দফা লেখার দায়িত্ব। সম্মেলনের আগেরদিন রাত তিনটায় দফাগুলো লেখা শেষ হয়। টাইপ এবং প্রিন্টিং করেন মাসিক মুঈনুল ইসলামের সম্পাদক মাওলানা মুনির। তিনি আমাকে বললেন, ‘দাবি বেশি হয়ে গেলো না?’ আমি বললাম, ‘যেহেতু ২০১৩ সালে আন্দোলন করছি, তাই ১৩ দফা দেয়া হয়েছে।’

চট্টগ্রামে ইমরান এইচ সরকারকে বাধাদান

ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলায় গণজাগরণ মঞ্চ তৈরী করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৩ মার্চ চট্টগ্রামে আসার ঘোষণা দেয় শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠক ইমরান এইচ সরকার। তখনই প্রেস ব্রিফিং করে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘ইমরান এইচ সরকারকে চট্টগ্রামে আসতে দেয়া হবে না। সে এলে আমরা যেকোনো উপায়ে প্রতিহত করব।’ এই ব্রিফিংয়ের পর চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের অফিসে ডাক পড়ে আলেমদের। ছয়-সাতজন আলেম উপস্থিত হন। তখন চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার ছিলেন বর্তমানে ঢাকার ডিআইজি শহিদুল হক। তিনি বললেন, ‘ইমরান এইচ সরকার এদেশের নাগরিক। এই দেশের সব জায়গায় যাওয়ার তার অধিকার আছে। আপনি বাধা দিতে পারেন না।’ মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বললেন, ‘দেশের নাগরিককে বাধা দিচ্ছি না। বাধা দিচ্ছি আল্লাহর নবির দুশমনকে। তবুও যদি সে আসে, মদিনা থেকে ডেকে আল্লাহর নবিকে নিয়ে আসব। তিনি এসে তার ইজ্জত তিনিই রক্ষা করবেন।’

আলেমদের অনঢ় অবস্থান এবং বিস্ফোরণ্মুখ পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে পুলিশ কমিশনার চট্টগ্রামে কারফিউ জারি করে দিলেন। ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম আসার পথে দুই গাড়ি অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয় ইমরান এইচ সরকারককে।

হেফাজত-চরমোনাই বিতর্ক

৯ মার্চ হাটহাজারি মাদরাসায় অনুষ্ঠিত হয় হেফাজতে ইসলামের ওলামা সম্মেলন। এ সম্মেলনেই ৬ এপ্রিল পুরো দেশ থেকে ঢাকামুখী লংমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ সম্মেলন থেকেই হেফাজত-চরমোনাই বিতর্ক শুরু।

মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘ওলামা সম্মেলনে বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে চরমোনাই পীর মুফতি রেজাউল করিম একটু অসংযত এবং অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করেন। ফলে সম্মেলনে শোরগোল শুরু হয়। এমনকি এই শোরগোল হাতাহাতি পর্যায়ে চলে যায়। তখন আল্লামা আহমদ শফির নির্দেশেই মাইক বন্ধ করে দেয়া হয়।’

তবে ইউটিউবে প্রকাশিত ওলামা সম্মেলনের ভিডিওতে দেখা যায়, চরমোনাই পীর সাহেবের বয়ানের সময় কোনো অযাচিত শোরগোল ঘটেনি। বরং মুফতি রেজাউল করিম আল্লামা আহমদ শফি সাহেব যে কর্মসূচি দিবেন, তা সবাইকে মেনে নেয়ারও আহ্বান জানান।

মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘এরপর চরমোনাই পীর কার্যত হেফাজতে ইসলামের বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়ে যান। আল্লামা আহমদ শফি এক ধরণের বিবৃতি দেন, তিনি দেন আরেক ধরণের। সর্বশেষ তিনি হেফাজতের লংমার্চের বিপরীতে ৬ এপ্রিল কুয়াকাটামুখী লংমার্চের ডাক দেন।  ৬ এপ্রিল হেফাজত ঘোষণা করেছে ঢাকামুখী লংমার্চ, আর চরমোনাই পীর ঘোষণা করেছেন কুয়াকাটামুখী লংমার্চ। এমন সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়েও আল্লামা আহমদ শফি চাইছিলেন, তবুও যেন হেফাজতের সঙ্গে চরমোনাই পীর থাকেন। এ উদ্দেশ্যেই ৫ এপ্রিল, লংমার্চের আগের দিন মাগরিবের পর, ইসলামি আন্দোলনের অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহমাদসহ চারজনের সঙ্গে লালবাগে একটি বৈঠক হয়। হেফাজতের পক্ষে বৈঠকে ছিলেন—মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমি, মাওলানা মাহফুজুল হকসহ আরও কয়েকজন।

বৈঠকে চরমোনাই পীরকে চারটি শর্ত দেয়া হয়। তারমধ্যে অন্যতম তিনটি হলো—১. হেফাজতের বিবৃতির বিপরীত বিবৃতি না দেয়া। ২. আগামিকাল দৈনিক পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে হেফাজতের সঙ্গে সমর্থন ব্যক্ত করা। ৩. কুয়াকাটামুখী লংমার্চ বাতিল করা। কিন্তু শর্তগুলোর একটিও পালন করেননি তিনি। তাই লংমার্চের মঞ্চে দাঁড়িয়ে জুনায়েদ আল হাবিব ঘোষণা করেছিলেন, ‘আপনি শর্ত মানেননি। আপনাকে স্টেজে আসতে দেয়া হবে না।’

এই জায়গায় একটা নোট যুক্ত করতে হয়। ২৯ মার্চ, ২০১৩ ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় মহাসমাবেশে যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন চরমোনাই পীর—তা বলছে অন্যকথা। কর্মসূচি লিখিত লিফলেটে দেখা যায়—তিনি সর্বপ্রথম ৬ তারিখে হেফাজতের লংমার্চে সমর্থন জানানোর কথা বলেছেন। এদিন অন্যকোনো কর্মসূচি রাখেননি। তারপর ১৯, ২০ এবং ২১ এপ্রিল লংমার্চ নয়, বরং কুয়াকাটার অভিমুখে রোডমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ৮ এবং ৯ মে ঘোষণা করেছেন মায়ানমার অভিমুখে লংমার্চ।

হেফাজতে ইসলামের নৈতিক বৈধতা

নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার পর সুশীল মিডিয়াগুলো বরাবরই চেয়েছে হেফাজতে ইসলামের নৈতিক বৈধতা ধ্বসিয়ে দিতে। একযোগে তারা প্রচার করেছে—যুদ্ধাপরাধের দাবিতে শাহবাগের আন্দোলন দমাতেই হেফাজতে ইসলামের নাস্তিকবিরোধী আন্দোলন শুরু। শাহবাগ আন্দোলনের লিডিং রুলে যারা, তারা নাস্তিক নয়। এমনকি ব্লগার আরিফ জেবতিক বলেছিল, ‘ব্যক্তগতভাবে কেউ যদি নস্তিক হয়েও থাকে, তার দায় এই আন্দোলনের ওপর পড়বে না। শাহবাগের আন্দোলন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আন্দোলন।’ (একাত্তর টিভি)

প্রখ্যাত আলেম এবং লেখক মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে—হেফাজতে ইসলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে শাহবাগের আন্দোলন থামাতে মাঠে আসেনি। বরং এই আন্দোলন থেকে ক্রমাগত যখন ইসলামকে আক্রমণ করা হয়েছে, টুপি-দাড়িকে অপমান করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছে হেফাজত। আন্দোলনের লিডিং রুলে থাকা কেউ ব্যক্তিগতভাবে নাস্তিক হলে তার দায় শাহবাগ আন্দোলনের নেতারা নিবেন না, তা বলে পার পাওয়া যাবে না। কারণ, তারা বারবার প্রমাণ করেছে, তারা নাস্তিকদের পক্ষে। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে কিছু বলা হলেই শাহবাগ তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। নাস্তিকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এমনকি পত্রিকায় বিবৃতিও দিয়েছে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে—তর্কের খাতিরে যদিও ধরা হয় শাহবাগের আন্দোলন থামাতেই হেফাজত মাঠে নেমেছে, তবুও হেফাজতের আন্দোলন বৈধ। কারণ, শাহবাগের আন্দোলনের জন্মই হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে অসম্মান করে। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।

আবদুল কাদের মোল্লার শাস্তি বাড়ানো কিংবা কমানো নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। আমি শুধু বলছি—এমন তো নয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছিল না। বিচার না হলে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো কিভাবে? সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন—এটা একটা ফাঁপা বুলি ছিল। মানুষকে বিভ্রান্ত করার ভেলকিবাজি ছিল। যারা আদালতকে অসম্মান করে রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেছে, তাদের দমাতে হেফাজত আন্দোলন করে থাকলেও হেফাজতের আন্দোলন বৈধ। হেফাজত মূলত রাষ্ট্রের পক্ষে, আদালতের পক্ষে লড়াই করেছে।’

আগের সংবাদআল্লামা আহমদ শফী : দুর্দিনের দিশারী
পরবর্তি সংবাদ শাপলার পক্ষে-বিপক্ষে ধর্মীয় চিন্তার প্রভাব