শাপলার পক্ষে-বিপক্ষে ধর্মীয় চিন্তার প্রভাব

আবদুল্লাহিল বাকি

২০১০ এর জানুয়ারিতে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের প্রায় একশোটি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের সমন্বয়ে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম শাহ আহমাদ শফী দা.বা.। প্রকাশের পর সর্বপ্রথম হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে সেক্যুলারিজমের বিরোধিতা করে। এরই এক বছর পর, বাংলাদেশের সংবিধানে ২০০৯ সালে গৃহিত নারী উন্নয়ন নীতিএর কয়েকটি ধারা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার দরুন এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় হেফাজতে ইসলামের পক্ষ হতে।

বাংলাদেশে ২০১২-১৩ এর দিকে ‘সামহ্যোয়ারইন’, ‘মুক্তচিন্তা’সহ আরো অন্যান্য ব্লগে কিছু তরুণ ব্যাপকভাবে কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে  লেখালেখি শুরু করে, যাতে কোন ভালো-মন্দের বাছ-বিচার ছিল না। তাতে খুবই বাজেভাবে রাষ্ট্র, ধর্ম, প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বদের আক্রমণ করা শুরু হয়, কিছু তরুণের পক্ষ থেকে। ফলে এ ধরণের অকর্ষিত বাকস্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ প্রকাশ পায়। ধর্মীয় মহলে এর প্রভাব পড়ে সবচে’ বেশি। কারণ, বিভিন্ন ব্লগে আল্লাহ, রাসূলসহ ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষঙ্গের প্রতি বিদ্বেষ, আক্রমণ, ঠাট্টা উপহাস সংখ্যাগরিষ্ট সম্প্রদায়ের আপামর মুসলিম জনতাকে ব্যথিত করে। তারা হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে এই বাকস্বাধীনতার প্রতিবাদ জানায়। এবং অবমাননাকারী ব্লগারদের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমী আইন বাস্তবায়নের দাবি জানায়। এর সাথে আরো ১২ টি দাবি যোগ হয়। এই তের দফা দাবি নিয়ে শাপলা চত্বরে তের সালের ৬ ই মার্চ হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি, ভুলবোঝাবুঝির কারণে এপ্রিল মাসে এই ১৩ দফা দাবির ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। এর মধ্যে বলা হয় যে, ‘সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে।’ একই বছরের এপ্রিল ও মে মাসে শাপলা চত্বরে বিপুল তৌহিদী জনতা একত্রিত হয় হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে।

উপরোক্ত ধারাগুলো ও হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ, লংমার্চ সম্পর্কে বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলে বিচিত্র রকমের আলোচনা পর্যালোচনা চলছিল। এর পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছিল। যারা পক্ষে ছিল, তাদের সবাই হেফাজতে ইসলামের আদর্শ লালন করতো, তেমনটা নয়। অনেকের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক পরিপ্রেক্ষিতও পক্ষ-সমর্থনে ভূমিকা রেখেছিল। যেমন ফরহাদ মজহার হেফাজতে ইসলামের বৈপ্লবিক দিক লক্ষ্য করে একে সমর্থন দিয়ে বেশ কিছু লেখা লিখেছিল হাটহাজারী থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক মঈনুল ইসলামে’, অথচ তিনি ক্রিটিক্যাল মার্কসবাদী।

আবার বিরোধী দলীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার পক্ষ থেকে হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে সমর্থন-উক্তি পাওয়া যায়, যদিও তারা হেফাজতে ইসলামের আদর্শিক সমর্থক নয়। কিন্তু তারা হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকে একটা রাজনৈতিক মোকাবেলা হিসেবে স্বার্থ উদ্ধারের মাধ্যম ভেবেছিল। প্রকৃতপক্ষে আদৌও তেমন ছিল না যদিও, তবু তাদের এই পক্ষপাতপূর্ণ সমর্থন হেফাজতে ইসলামের অরাজনৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জামাত-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছে।

হেফাজতের বিপক্ষেও অনেকগুলো ধারা সক্রিয় ছিল। কিন্তু বিরোধিতার মাত্রার ক্ষেত্রে তারতম্য ছিল। প্রত্যেক দলের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা ছিল। অনেকে ছিল এর অস্তিত্বেরই বিরোধী। অনেকে আবার এর অস্তিত্বের বিরোধী ছিল না বটে, তবে নির্দিষ্ট নীতিমালার বিরোধী ছিল। অনেকে আবার এর কর্মপদ্ধতির সমালোচক ছিল। কট্টরপন্থি সেক্যুলাররা ছিল এর অস্তিত্বেরই বিরোধী। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘হেফাজতের দাবি অযৌক্তিক এবং বাংলাদেশের অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘এটা বাংলাদেশের জন্য হুমকি হবে যদি এদেরকে প্রশ্রয় দেয়া হয়। কেননা এটা বাড়বে।’ সরকার-পক্ষ দীর্ঘ একটা সময় কট্টরপন্থি সেক্যুলারদের সঙ্গেই ছিল। কিছুদিন পর রাজনৈতিক কারণে তাদের অবস্থান খানিক পরিবর্তিত হয়। সরকার-পক্ষীয় আলেমগণ, যেমন সামিম আফজাল, ফরীদ উদ্দিন মাসউদ ও আলিয়া মাদ্রাসার আলেমগণ, যেমন অধ্যক্ষ আ খ ম আবু বকর সিদ্দীক, হেফাজতের কর্মপদ্ধতির বিরোধী ছিলেন।

কর্মপদ্ধতি হিসেবে তারা বর্তমান যুগে হেফাজতে ইসলামের মিছিল সমাবেশকে বিভিন্ন মুসলিম দেশের রাজনৈতিক ইসলামের সাথে একীভূত করে ফেলেছিলেন। এবং ১৩ দফা দাবীর সরাসরি বিরোধী তারা অবশ্যই ছিলেন না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তাদের ভিন্ন ব্যাখ্যা ছিল, এর কোন কোন ধারাকে তারা উগ্রপন্থা মনে করেছিলেন। বাংলাদেশে ‘স্বশস্ত্র যেসব ধর্মীয় গোষ্ঠী’ আছে, অথবা তাদের সমর্থক আছে, তারাও ছিল হেফাজতে ইসলামের বিরোধী শিবিরে। অবশ্য তাদের বিরোধীতার মূল যুক্তি ছিল, সেক্যুলার সরকারের কাছে ১৩ দফা পূরণের দাবি জানানো। কারণ, এর অর্থই হলো পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বৈধতা দিয়ে কিছু বিষয় সংস্কারের আহ্বান জানানো। আর ‘জিহাদী গোষ্ঠীরা’ আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভেঙে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে চায়।

অনেক চিন্তাবিদ আবার নিছক ঘটনা হিসেবে একে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি গণজাগরণ মঞ্চেরও সমর্থক ছিলেন। বাংলাদেশের উত্তরাধুনিক চিন্তক, সমাজ ও সংস্কৃতি বিশ্লেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান ২০১৩ সালের ২২শে জুন এক বৈঠকে বলেছিলেন,  ‘তারা প্রথম যখন ১৩ দফা প্রকাশ করলেন তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল একটি টিভি সাক্ষাৎকারে যাওয়ার। আমি একজন মওলানাকে বললাম যে আপনারা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন। ৫ ফেব্রুয়ারি যখন ছাত্ররা গণজাগরণ মঞ্চ করল, আর আপনারা ৯ মার্চ থেকে ১৩ দফা নিয়ে নামলেন। এর আগে নামেন নাই কেন?’ রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি হেফাজতে ইসলামের একটা দিক দাঁড় করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তারা বলছে, তারা রাজনীতি করতে চায় না। কিন্তু হেফাজত যা করছে, তা কিন্তু রাজনীতি।… রাজনীতিকে ছোট করার কিছু নেই। আমি মনে করি এই যে হেফাজতে ইসলাম যদি রাজনীতি করে তাহলে তারা কোনো ভুল করছে না। আসলে রাজনীতিটা কী এটাই বলা দরকার।’

এখানে সলিমুল্লাহ খান হেফাজতে ইসলামকে সুশীল অর্থেই রাজনৈতিক বলতে চেয়েছেন, কিন্তু অনেকেই হেফাজতে ইসলামকে রাজনৈতিক বলতে চেয়েছেন বিরোধী দলের সাথে সংশ্লিষ্টতার কথা বলে। এদের কথিত স্বার্থের রাজনীতির সাথে হেফাজতে ইসলামের সংশ্লিষ্টতা উদ্ধার করা কষ্ট। কিন্তু আদর্শ ও বিশ্বাসের জন্য লড়াই করা, ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতনতা, ক্ষমতার সাথে দলের সম্পর্ক কেমন হবে, তা বোঝার চেষ্টা করা যদি রাজনীতি হয়, তাহলে যেকোন সচেতন ও বুদ্ধিবৃত্তিক দল মাত্রই রাজনৈতিক হতে বাধ্য। কারণ, তা সামাজিক সংযোগ রক্ষা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

বিভিন্ন দলের মতামতের ভিন্নতা যেমন আমাদের বুঝতে হয়, তেমনিভাবে আমাদেরকে আরো বুঝতে হয় একটা আধুনিক মুসলিম সেক্যুলার রাষ্ট্রে একটা নির্দিষ্ট ইসলামী দলের কি অবস্থান। হেফাজতে ইসলামের অবস্থান যদি রাজনৈতিক হয় তাহলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে তার স্বরূপ কেমন, এটা মুফতী মিজানুর রহমান সাইদের একটি বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায়। তিনি ২২শে জুনে অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে এক বৈঠকে বলেছেন, ‘ইসলামি রাজনীতি হল প্রতিষ্ঠিত সরকারকে আল্লাহর বিধিবিধান অনুযায়ী পরিচালনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। এতে যদি কোনো ভুলত্রুটি সরকার করে থাকে, তাহলে জাতি ও জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আল্লাহর গোলামির মধ্যে আবদ্ধ থেকে তার বিধিবিধানে যত প্রকারের দাবি দাওয়া আছে সেটা সরকারের কাছে তুলে ধরে তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করা। এছাড়া ইনসাফ বা সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। সকল প্রকারের জুলুম, অন্যায়, অত্যাচার নিরসন করে অকল্যাণ দূরীভূত করা। আর এসবই কোরআন-হাদিসের মাধ্যমে করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী চলতে হবে। কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসের সর্বশেষ বিষয় হল রাষ্ট্র পরিচালনা করা। আর এটি আল্লাহর গোলামি, যাকে বলে আল্লাহর ইবাদত করা। এটা বেসিক জিনিস। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহকে মানার বিষয় রয়েছে। মোটকথা পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক–প্রত্যেক জীবনে আল্লাহর বিধানকে অনুসরণ করা আমাদের কর্তব্য। এসবই কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসের মধ্যে থাকে।’ এখান থেকে ইসলামী রাজনীতির একধরণের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।

হেফাজতে ইসলামের উত্থানটা আকস্মিক নয়। এটা যদিও চিন্তাবিদদের ভাবিয়েছে, তবুও তার উত্থানটা স্বাভাবিকই ছিল। কারণ, বিশ্ব মুসলমানদের ঐক্য ও সম্প্রীতি উসমানী খেলাফত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর মুসলিম দেশগুলোতে রাজনৈতিক বৈধতার সংকট দেখা দেয়। কারণ, আগে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ফিকহভিত্তিক পরিচালিত হত। এক্ষেত্রে তখন ফিকহের সাথে রাজ-রাজড়াদের ব্যক্তিগত কর্ম-কাণ্ডের বিরোধ কদাচিৎ তৈরি হলেও এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল না, রাষ্ট্রীয় আইনানুগ না হওয়ার দরুন। কিন্তু ফিকহভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় শাসন ও ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না। তবে খিলাফত-বিলুপ্ত পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে ঔপনিবেশিক রাজনীতির প্রভাব পড়ে। কিন্তু মুসলিম দেশগুলো পুরোপুরি সেক্যুলার হয়ে পড়ে না। কারণ তারা আঞ্চলিক ইসলামপন্থিদেরকে শান্ত রাখতে ও ধর্মীয় দিক থেকে সাংবিধানিক বৈধতা রক্ষার ক্ষেত্রে এক ধরণের ধর্মীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করায়, যা ট্রাডিশনাল ধর্মীয় বিবৃতির সাথে মিলে না। এজন্যে এসব রাষ্ট্র সেক্যুলারও না আবার ইসলামীও না। যদি রাষ্ট্র পুরোপুরি সেক্যুলার হতো, তাহলে ফকিহদের সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হত না। আর যদি ট্রাডিশনাল ফিকহভিত্তিক হত তাহলে সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক ছিল না।

আধুনিক রাষ্ট্র ও ধর্মীয় নেতৃত্ব 

ড. ‍মু’তায আল খতিব আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে ফকিহদের যে অবস্থান পরিলক্ষিত হয় তাকে চার ভাগে বিভক্ত করেছেন

. সরকারী ফকিহ : আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রের অধিনে বিভিন্ন মত ও বিবৃতি প্র্রদান করেন যারা। কিন্তু এর একটা ইসলামী তা’বিল ও ব্যাখ্যা তারা দাঁড় করান সর্বদাই। বিভিন্ন দেশে সরকারের অধীনে পরিচালিত বিভিন্ন ফিকহ একাডেমী, ইসলামী ফাউন্ডেশন, ধর্ম ও ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ফকিহগণ এর অধীনে আসবে।

. ট্রাডিশনাল ফকিহ : যারা সাধারণত কোন পরিবর্তিত পরিবেশ-পরিপ্রেক্ষিত, রাজনৈতিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হন না। যুগ পরস্পরায় চলে আসা ফিকহের আদলেই তারা সিদ্ধান্ত প্রদান করে থাকেন। তারা অনেক ক্ষেত্রে সেক্যুলার রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন না থাকার ফলে, নিজেরাও এক ধরণের ধর্মনিরেপেক্ষতা লালন করেন বলে মনে করেন ড. বাশশার ইসাম। কারণ, তারা ইসলামের ফিকহ সম্পর্কে অবগত থাকলেও ‘দাওলাহ’ সম্পর্কে সচেতন নন।

. রাজনৈতিক ফকিহ : এই ধারায় আছেন বিভিন্ন মুসলিম দেশে যারা রাজনৈতিক ইসলামকে লালন করেন। এবং কোন না কোন ইসলামী রাজনীতির দলের সাথে যুক্ত আছেন। তারা আধুনিক ইসলামী রাজনীতির স্বরূপ কি হবে, তা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। এর অধীনে আছেন ড. ইউসুফ কারদাভী ও তার প্রতিষ্ঠিত ফিকহ সংগঠন আল ইত্তেহাদুল আলামিয়্যু লি-উলামায়িল মুসলিমিন (International Union of Muslim Scholars)।

. জিহাদী ফকিহ : এই পক্ষে আছেন তারা, যারা স্বশস্ত্র আন্দোলনের সমর্থক। তাদের কাছে আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রের কোন ধরণের সাংবিধানিক বৈধতা নেই। এজন্য তারা প্রচলিত রাষ্ট্রকে উৎখাত করতে চায়। এরা উপরোক্ত তিন ধারারই বিরোধী। সরকারী ফকিহের বিরোধী, কারণ এর কোন বৈধতা নেই তাদের কাছে। ট্রাডিশনাল ফকিহের বিরোধী, কারণ তারা ‘নাফিরে আম’ তথা সকল মুসলমানের যুদ্ধে বেড়িয়ে যাবার ফতোয়া দেয় না। বিপ্লবী ফকিহের বিরোধী, কারণ, সে ডেমোক্রেসি ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসতে চায়।

হেফাজতের পক্ষে বিপক্ষে যারা ধর্মীয় ধারায় কথা বলেছেন, তাদের মাঝে এই চারের কোন একটি দেখতে পাই। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে সরাসরি বিভাজন করা যায় না। ফলে তার মধ্যে উপরোক্ত দু’তিনটি ধারার ছাপ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে মাওলানা ফরিদুদ্দিন মাসুদ সাহেবসহ অন্যান্য সরকারী ও আলিয়া মাদ্রাসার আলেমগণ ছিলেন ট্রাডিশনাল ও সরকারী– এই দুই ধারার মাঝামাঝি। সে হিসেবে তার অবস্থান সিরিয়ার ড. রামাদান আল-বুতির সাথে অধিক মিল রাখে, সিরিয়ায় যিনি ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে সম্পূর্ণ প্রাচীনপন্থী হলেও আসাদের সমর্থক ছিলেন। তার যুক্তি ছিল, শাসককে অনুসরণ করার হাদিস, যতক্ষণ না সে পাপের আদেশ দেয়। একইভাবে ফরিদ উদ্দিন মাসুদ সাহেব যেমন ‘দেওবন্দ’ ট্রাডিশনকে ভুলতে পারেন নি, তেমনি রাষ্ট্রকে তার মর্জি-মোতাবেক ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিতে সর্বাত্বক চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু আহমাদ শফি সাহেবসহ হেফাজতে ইসলামের অন্যান্য আলেমগণ প্রকৃতপক্ষে ছিলেন ট্রাডিশনাল আলেম। তবে এর পাশাপাশি রাজনৈতিক আলেমও হেফাজতের সাথে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। ড. মু্’তায আল খাতিব বলেছেন, ‘ট্রাডিশনাল ফকিহগণ যদি রাষ্ট্র সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে, তাহলে ক্ষমতায় আসতে না চাইলেও, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের দাবি তোলে।’ সে হিসেবে তাদের চরিত্র রাজনৈতিক হয়ে উঠলেও তারা মূলত রাজনৈতিক বলতে যেটা বোঝায়, হেফাজতে ইসলাম তা ছিল না। তা ছিল বেশ কিছু সংস্কারের দাবি। এই সংস্কারপদ্ধতি সম্রাট আকবরের সময়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানির দাওয়াত-পদ্ধতির সাথে সাজুয্য রাখে। উপরে মুফতি মিযানুর রহমান সাইদের যে বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে এ বিষয়ের ছাপ আছে। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক চরিত্র ফুটে উঠবেই। কারণ, দাবী জানাতে হলে রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়, যদিও ক্ষমতা লাভের কোন ইচ্ছা না থাকে। মু’তায আল খাতিব বলেছেন, ‘প্রায়শই দেখা যায়, রাজনীতিবিদ ফকিহদের দমন করার জন্যে রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাডিশনাল আলেমদের দাবিদাওয়া আংশিক পূরণ করে থাকে। এতে করে ট্রাডিশনাল আলেমদের সহযোগিতা লাভ করা যায়।’

তাই বলে এটা ভাবা ভুল, রাষ্ট্র যে রাজনীতিবিদ আলেমদের দমন করতে চায় এটার কারণ, তারা ‘সিরাতুল মুস্তকিম’এর উপর আছে। আর কেউ নেই। এই ধারণা খণ্ডন করে ড. মুহাম্মদ মুখতার আশ-শানকিতী বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র একটা ইসলামী রাজনৈতিক দলকে যতটা ভয় পায় তারচে’ বেশি আশংকা রাখে একটা সমাজতান্ত্রিক উগ্রবাদি দলের প্রতি। সুতরাং সরকার পক্ষ থেকে জেল-জুলুম-জবরদস্তি এটা প্রমাণ করে না যে, ইসলামি রাজনৈতিক দল মাত্রই সত্যের উপর আছে, আর অন্য দল বিপথে।’

মু’তায আল খাতিব যেমন বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাডিশনাল আলেমদের দাবিদাওয়া আংশিক পূরণ করে থাকে’, তেমনই আমরা বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের ক্ষেত্রে দেখতে পাই। ২০১৬ সালে পাঠ্যবইয়ে ১৭টি বিষয় সংযোজন ও ১২টি বিষয় বাতিলের সুনির্দিষ্ট দাবিতে আন্দোলন করেছিল হেফাজতে ইসলাম। ২০১৭ সালে নতুন পাঠ্যবই প্রকাশের পর দেখা গেছে এসব সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। হেফাজত এজন্য সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ‌ও জানিয়েছে।

হেফাজতে ইসলামের দাবি দাওয়া নিয়ে সরকারের অবস্থান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ. টি. ইমাম বলেছেন, “রাজনীতিতে বলুন, সরকার পরিচালনায় বলুন সবসময়ই ছোটখাটো অনেকসময় আপোষ করতে হয় বৃহত্তর স্বার্থে। যেমন, এর আগে নারী নীতি নিয়ে কথা হয়েছিল তখন আমি নিজেই আলেম ওলামাদের সঙ্গে বসেছি, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি।” তিনি আরো বলেছেন, “তারপর শিক্ষানীতি নিয়ে যখন কথা হয়েছে তখন আমাদের সরকারের থেকে ক্যাবিনেটেই সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে যে, এই নীতিমালাগুলোতে এমন কিছুই থাকবে না যেটি শরিয়া পরিপন্থী, কোরান হাদিসের পরিপন্থী।”

এরকম সংস্কারবাদী ট্রাডিশনাল ধারা সম্পর্কে স্টেটের ইতিবাচক অবস্থান তৈরি হলেও রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় তাদের হস্তক্ষেপের ভয়ে প্রায়ই তটস্থ থাকে সরকার-পক্ষ। এ্ররই প্রতিরণন হিসেবে মি. ইমাম বলেন, “দেখতে হবে যাতে এমন কোনো অবস্থানে তারা না যায় যাতে রাষ্ট্রীয় কাঠামোই বিপন্ন হয়।’

বাংলাদেশের ট্রাডিশনাল আলেমগণ রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে সচেতন হয়ে উঠেছেন। ‍মু’তায আল খাতিবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী বোঝা যায় যে, এরকম দল প্রায়ই নিয়মিত পরিবর্তিত হয়। তাই দেখা যাক, সামনে তাদের সচেতনতা কোন দিকে প্রবাহিত হয়।

আগের সংবাদহেফাজতে ইসলামের সূচনা ও বিকাশ
পরবর্তি সংবাদফরিদ উদ্দিন মাসুদের শাহাবাগ যাত্রা : তাত্ত্বিক মূল্যায়ন