ধর্মীয় গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা : ইউসুফ সুলতানের মুখোমুখি

মাওলানা ইউসুফ সুলতান। বিশিষ্ট ইসলামি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ। হেড অফ শারিয়াহ এন্ড গভর্নেন্স, এথিস গ্রুপ মালয়েশিয়া; কো-ফাউন্ডার, আইএফএ কন্সাল্টেন্সি ঢাকা। সাবেক সহকারী মুফতি, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ। তরুণ আলেম এ অর্থনীতিবিদের মুখোমুখি হয়েছিল ফাতেহ টোয়েন্টি ফোর। ধর্মীয়ক্ষেত্রে এআই বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্ট ব্যবহারের সুবিধা, অসুবিধা, প্রয়োজনীয়তা, সতর্কতা ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। উঠে এসেছে এ বিষয়ক বিস্তারিত আলাপ। এবং আরও নানান কিছু। ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের সম্পাদক ইফতেখার জামিলের নেওয়া সাক্ষাৎকার শ্রুতিলিখন করেছেন আবদুল্লাহ মারুফ

ফাতেহ: আপনি কওমি মাদরাসা থেকে দাওরা শেষ করেছেন। পরে কীভাবে উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহী হলেন?

ইউসুফ সুলতান: আমি আসলে দাওরা শেষ করেছি জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ থেকে। তারপর ইফতায় ভর্তি হই। ইফতা শেষে বছর-দুয়েক একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করি। তখন একজন সিরিয়ান শায়েখ, তিনি মূলত একজন দাঈ, কুয়েতে থাকতেন, হাদীস শাস্ত্রের পণ্ডিতপ্রবর এই মনীষী বাংলাদেশ সফরে এলেন। তাঁর সঙ্গে অনলাইনে আমার পূর্ব পরিচয় ও যোগাযোগ ছিলো। তিনিই মূলত আমাকে উৎসাহিত করলেন যে, আমি যেন ইসলামিক ফাইন্যান্স নিয়ে পড়াশোনা করি। তাঁর পরামর্শক্রমে একটি অনলাইন একাডেমি থেকে ২০১১ সনে আমি সার্টিফিকেট গ্রহণ করি। এরপর ইসলামিক ফাইন্যান্স নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক বা ফরমাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউশনগুলোর সঙ্গে কথাবার্তার সুযোগ হয়, তাদের সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ হয়।

তখন আমি অনুভব করি, এই বিষয়ে আমাকে আরো বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সে সময় আমি মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাইন্যান্সের বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় ইনসিএফের কথা শুনি। ইনসিএফের পরিচয় পাবার পর ভেতরের জ্বলন এবং স্বপ্নের তাড়নায় আমি ২০১৩ তে ইনসিএফ ভিজিট করি। এরপর এপ্লাই করি। এপ্লাই করার পর স্কলারশিপ নিয়ে ২০১৪ তে মালয়েশিয়ায় আসি। এখানে তারপর মাস্টার্স সমাপ্ত করি, বর্তমানে পিএইচডি চলমান।

ফাতেহ: আপনি যে ইনসিএফে মাস্টার্স ও পিএইচডি করলেন, সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই।

ইউসুফ সুলতান: অভিজ্ঞতা আলহামদুলিল্লাহ খুবই ভালো। তবে, এখানে যেহেতু সমস্তকিছু ইংরেজি মাধ্যমে, সেজন্য ইংরেজি ব্যাকগ্রাউন্ড থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাংলাদেশে কেবল মাদরাসাগুলোতেই নয়, বরং ইংলিশ মাধ্যমগুলো ছাড়া প্রায় সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থাতেই ইংরেজিটা দুর্বল; ফলে, বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়তে গেলে প্রথমদিকে একটু কষ্ট হয়। বাকি, কেউ যদি ব্যক্তি-উদ্যোগে চেষ্টা করেন, অথবা আগে থেকে ইংরেজিচর্চায় পরিশ্রম করে থাকেন, তাদের জন্য সহজ হয়।

আমার জন্য কিছু বিষয় খুব সহজ হয়েছে। যেমন, ফিকহুল মুয়ামালাত, উসুলূল ফিকহ, বা এই ধরণের ইসলামিক শরীয়াহ সম্পর্কিত বিষয়গুলো আমার জন্য সহজ হয়েছে। কিন্তু যেসব বিষয় নিরেট ফাইন্যান্স ব্যাকগ্রাউন্ডের, যেমন, কর্পোরেট ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স, একাউন্টিং, রিস্ক ম্যানেজমেন্টㅡ এগুলো আমার জন্য শুরুতে যথেষ্ট কঠিন ছিল। পরিশ্রম করতে হয়েছে। পরবর্তীতে আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তাআলা সহজ করে দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

ফাতেহ: উচ্চশিক্ষা কেন ও কাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

ইউসুফ সুলতান: দেখুন, উচ্চশিক্ষা আমাদের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পুরো জীবনটাই আসলে শিক্ষার একটা সফর। এবং আমরা যে-কোনোভাবে উপকারী জ্ঞান শিক্ষায় নিয়োজিত থাকবো, এটাই আমাদের জীবনের অন্যতম চালিকাশক্তিㅡ ফুয়েল। সেই জায়গা থেকে কর্তব্য হলো, যার যেভাবে সুযোগ হয় বিভিন্ন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া উচিত। কমপক্ষে নিজে আজীবন পড়াশোনা ও জ্ঞানার্জনে ব্রত থাকা উচিত।

আমরা যারা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসেছি, আমাদের জন্য অন্যতম একটি সেক্টর হলো ইসলামিক ফাইন্যান্স নিয়ে পড়াশোনা করা। কারণ, এখন ব্যবসা বা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বাড়ছে, মুসলমানদের মধ্যে অর্থনীতি সম্পৃক্ত সচেতনতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে হালাল বা ইসলামিক পদ্ধতিতে ব্যবসা করার চাহিদাও বাড়ছে। সুতরাং যারা এসব বিষয়গুলোকে শরীয়ার আলোকে সমাধান দিতে পারেন, তাদের জন্য বড় ধরণের ভূমিকা রাখার সুযোগ হচ্ছে।

ইতোপূর্বে আমরা ইসলামিক স্কলার বা উলামায়ে কেরামের ভূমিকাটা দেখেছিㅡ তারা দরস-তাদরিস, কিছুটা রাজনীতি, এবং মুসলিম পারিবারিক যে বিষয়াদিㅡ বিয়ে-তালাক-উত্তরাধিকারী বা এইসব বিষয়ে অধিক ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এখন যেহেতু আধুনিক সমাজে ইসলামি অর্থনীতির জায়গাটা ধীরে-ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে, আমি মনে করি, আমরা যারা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছি, আমাদের জন্য বিরাট একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তাই যাদের সুযোগ আছে উচ্চশিক্ষাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময়, অর্থ, শারীরিক-মানসিক সামর্থ্য; এইসবগুলোর সমন্বয়কে আমি ‘সুযোগ’ বলবো।

কারণ এখানে অর্থের একটি ব্যাপার আছে। বিশেষ করে যাদের পরিবার তাদের উপর নির্ভরশীল তাদের যদি স্কলারশিপ না থাকে, তাহলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ তাদের জন্য যথেষ্ট কষ্টদায়ক। এজন্য আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানামুখী স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের মাদরাসাগুলোতেও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরী।

পুরো বিশ্বেই উচ্চশিক্ষার যে মাস্টার্স পিএইচডি, এগুলোতে স্কলারশিপের ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ সেসময় ব্যক্তির পরনির্ভর হওয়াটা কঠিন হয়, আবার যদি নিজে স্বনির্ভর হবার পদ্ধতি গ্রহণ করে, তাহলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের একাগ্রতায় বিঘ্নতা ঘটায়। এজন্য তাদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা রাখা হয়।

ফাতেহ: উচ্চশিক্ষার সাথে গবেষণার সম্পর্কটা ঠিক কেমন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় গবেষণা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ইউসুফ সুলতান: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। উচ্চশিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোনও একটি বিষয়ে বা সাবজেক্টে স্পেশালিষ্ট হওয়া। এই স্পেশালিষ্ট হওয়ার যাত্রায় গবেষণাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হোক সেটা সায়েন্টিফিক কোনো সাবজেক্ট, বা হিউম্যান সাইন্সㅡ অথবা অর্থনীতি। গবেষণার ভূমিকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ধর্মীয় ব্যাকগ্রাউন্ডে মানুষের জীবনমুখী নানা গবেষণার সুযোগ রয়েছে, সেগুলো হতে পারে । যেমন ধরেন, ধর্ম মানুষকে কতটুকু নৈতিকতার উপর রাখতে পারে; আমরা আমাদের সমাজে সুদ-ঘুষ, হত্যা, জুলুম, অন্যের হক নষ্ট ইত্যাদি নানামুখী সমস্যা হতে দেখি – এই সমস্যাগুলো নিরসনে ধর্মীয়শিক্ষার কোনো ভূমিকা আছে কিনা? থাকলে কেমন? আর সেই ভূমিকাটাই-বা কতটুকু ইফেক্টিভ? এসবের ভিত্তিতে পলিসিমেকাররা নানা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

একইভাবে ধর্মীয়শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামাজিক ভূমিকাটা কী? তারা কী ধরণের ভূমিকা রাখছে মানুষের কাছে? মোটকথা, ধর্ম-রিলেটেড জীবনঘনিষ্ঠ নানামুখী গবেষণা হতে পারে।

আবার ধর্মের ভেতরে, অর্থাৎ ধর্মীয় বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ তো থাকছেই। যুগে-যুগে উলামায়ে কেরাম তাদের যুগের সমস্যাগুলোকে কুরআন-সুন্নাহ-ইজমা-কিয়াসের ভিত্তিতে গবেষণা করে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। এই চাহিদা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেই। আমাদের যাপিতসময়েও আলোচিত-সমালোচিত যে বিষয়গুলো, সেগুলো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা করা, মানুষের সামনে নিয়ে আসা আমাদের কর্তব্য।

যেমন ধরেন, এখন কোভিড চলছে, এর কারণে পৃথিবীর অনেক দেশে লকডাউন চলছে, কোথাও কোথাও মসজিদও বন্ধ, এই পরিস্থিতিতে শরীয়াহ কি বলে? অথবা রাষ্ট্রীয় পলিসি কী হবে, অর্থনীতি পলিসি কী হবে, অথবা সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ㅡ সবকিছুই ধর্মীয় আলোকে গবেষণা হওয়া যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ আমরা মুসলমান। আমাদের বিশ্বাস ইসলামধর্ম একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। ইসলাম মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। অতএব জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ধর্ম থেকে সমাধান খোঁজা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আর আমরা যখন ধর্মের বাইরে গিয়ে গবেষণা করতে চাই, তখন দেখব, সেটি ঘুরেফিরে একটি সার্কেলের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে। কিন্তু যখন ধর্মীয় প্রিন্সিপলের ভিত্তি থেকে গবেষণা করা হয়, তখন দেখবো, আধুনিক অনেক সমস্যার ইনসাফপূর্ণ সমাধান ভিন্ন-আঙিকে বেরিয়ে আসছে। আউট-অফ-দা-বক্স বা বাক্সের বাইরে চিন্তার করার সুযোগ বেরিয়ে আসছে। এটা হয়তো ধর্মকে বাহিরে রেখে গবেষণা করার সময় আসছে না। কেন আসছে না? কারণ ধর্মকে বাহিরে রেখে যখন গবেষণা করা হয় তখন সেটা জাস্ট মানব মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায়। কিন্তু ধর্মকে যখন নিয়ে আসা হয়, বিশেষত আমাদের ইসলামধর্মকে নিয়ে আসা হয়, তখন স্রষ্টার যে সৃষ্টি-মাহাত্ম্য তাও সেখানে চলে আসে। এর ফলে নতুন ও প্রকৃত একটি আঙিক আমাদের সামনে বেরিয়ে আসে।

ফাতেহ: বাংলাদেশে ধর্মীয় ধারায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ কতটুকু?

ইউসুফ সুলতান: ধর্মীয় ধারা বলতে যদি আমরা কওমী মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলি, তাহলে উচ্চশিক্ষা যথেষ্ট লিমিটেড। কারণ হলো, সার্টিফিকেটের ইকোসিস্টেম ব্যালেন্সড না থাকাㅡ সার্টিফিকেটের সমমান পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত না করা, এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে কোলাবরেশন না থাকা। এই কারণে ধর্মীয়পরিবেশ থেকে যারা উচ্চশিক্ষায় যেতে চান, তাদেরকে ভীষণ পরিশ্রম করতে হয়। কাউকে হয়তো অন্য কোথাও পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট কুড়াতে হয়, অথবা নানাভাবে বিভিন্ন জটিলতায় তাকে পড়তে হয়। অথচ এটাকে নানাভাবে সমাধান করা সম্ভব।

এখন যেহেতু হাইআতুল উলয়ার মাধ্যমে সরকার একটি মান দিয়েছে, এর পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। দেশে তো বটেই, বিদেশেও যেন আমাদের সার্টিফিকেট গ্রহণযোগ্য হয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

আমার মতামত হলো, আমাদের কওমিপড়ুয়া অনেক আলেম এখন বহির্বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে অবস্থান করছেন, তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এবং তাদের মাধ্যমে সেসব দেশের অন্তত একটি-দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করা যেতে পারে। তখন দেখা যাবে, যারা উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য ‘শিক্ষাসফর’টা সহজ হবে। নাহয় অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছতে হয়।

দেখা যায়, মাস্টার্স সমমানের পড়াশোনা শেষ করার পর আবারও তাদেরকে নতুন করে ব্যাচেলরসে চার-পাঁচ বছর পড়াশোনা করতে হচ্ছে। এতে শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই জটিলতা এড়ানো সম্ভব বোর্ড থেকে কোনও পদক্ষেপ নিলে। অথবা কমপক্ষে এটি করতে হবে, যারা এসব বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হবেন, তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। তাহলেই ধর্মীয় ধারায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি হবে।

আমি ইনসিএফে একবার কথা বলেছিলাম, তারা বলেছিল, আমাদের বোর্ডের বিস্তারিত তথ্য জমা দিতে, একই সঙ্গে কী কী বিষয় পড়ানো হয়, কীভাবে পরীক্ষা হয়, সেগুলো দিতে। বোর্ডের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এ কাজ আঞ্জাম দেয়া কঠিন।

ফাতেহ: তাখাসসুস বা বিশেষায়িত বিভাগগুলো কতটুকু চাহিদা পূরণ করতে পারছে। সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতাগুলো জানতে চাই।

ইউসুফ সুলতান: তাখাসসুস বলতে আমার ক্ষুদ্র ধারণা মতে, জেনারেল লাইনে যেমন পিএইচডি করা হয়, সাবজেক্ট মেটারে এক্সপার্ট করা হয়, অনেকটা তেমনই। বাকি, আধুনিক মেথডলজিগুলো, উপায়-উপকরণগুলো আমরা আমাদের এখানে যুক্ত করতে পারিনি। তাই মানুষেরর কাছে এখনও গহণযোগ্য হয়নি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা যখন কোনও বিষয়ে গবেষণা করি, সেটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হওয়া দরকার। কারণ, গবেষণা যদি পিয়ার রিভিউড না হয় – পিয়ার রিভিউ বলতে, আরো কয়েকজন নিরীক্ষক সেটি নিরীক্ষা করবেনㅡ যদি এমনটি না থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে সেই গবেষণার গুরুত্ব থাকে না।

ধরুন, আমরা ধর্মীয় জায়গা থেকে একটি গবেষণা করলাম, কিন্তু সেই গবেষণাটি দেশীয় বা আন্তর্জাতিক কোনও জার্নালে প্রকাশিত হবার মত মানোত্তীর্ণ হলো না, তাহলে কিন্তু এই গবেষণাটা তথাকথিত একাডেমিশিয়ানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

অবশ্য এটা খুব কঠিন কিছুও না; জাস্ট কিছু ফরমেটিং, কিছু প্রোসেস, কিছু নীতিমালাㅡ এসব বিষয়ে যদি আমাদের এখানে যুক্ত করা থাকে, তাহলে আমাদের একজন শিক্ষার্থী বা গবেষকের গবেষণা হয়তো মিশর-সৌদিআরব-ইউএস বা অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর জার্নালগুলোতে প্রকাশ হতে পারে।

ধর্মীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে যদি বলি, আরবিতে যৎসামান্য কিছু গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে পাওয়া গেলেও, ইংরেজিতে নেই বললেই চলে। সেসব জার্নালে যাদের লেখা বা গবেষণা স্থান পায় তারা নিয়মতান্ত্রিক কোনও তাখাসসুসে পড়াশোনা করেননি। ধর্মীয়বিষয়ে অনেকে স্বশিক্ষিত। এটি যথেষ্ট ভয়ংকর। দেখা যায়, তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় নানারকম ফিতনায় জড়িয়ে যায়। যেমন, আহলে কুরআন ফিতনা; আমি অনেককে দেখেছি, তারা মনে করেন কুরআনই সবকিছু, হাদীসের কোনো ভেল্যু নেইㅡ একটা সময় তারা হাদীসকে অস্বীকার করার মত পর্যায়ে চলে যান! নাউযুবিল্লাহ।

এই বিষয়গুলো তখনই ঘটেㅡ যখন যারা ধর্মীয় বিষয়ে এক্সপার্ট নন, যাদের ধর্মীয় বিষয়ে ফান্ডামেন্টাল জ্ঞান নেই তারা ইসলামের মৌলিক বিষয়াদিতে কলম তুলেন। তারা কলম তুলছেন কেন? কারণ, যারা এই বিষয়ে এক্সপার্ট তাদের আসলে খুব বেশি অবদান নেই; ফলে যারা এক্সপার্ট নন তারা সেখানে কলম ধরতে পারছেন।

এই জায়গায় আমার মনে হয়, বাংলাদেশে আমাদের তাখাসসুস বিভাগগুলোর অবদান রাখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি বর্তমানে যেসব একাডেমিক প্রতিষ্ঠান বা ইউনিভার্সিটিগুলো আছে, তাদের সঙ্গে যৌথভাবে বিভিন্ন গবেষণা, কর্মশালা, বা কনফারেন্সে যুক্ত হওয়া দরকার। কারণ তাখাসসুস বা বিশেষায়িত বিভাগগুলোর মূল উদ্দেশ্যই হলোㅡ বিশেষায়িত লোকজন তৈরি করাㅡ যারা বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রাখতে পারবে। এজন্য বিভিন্ন সেক্টরে গিয়ে আমাদের সরেজমিনে কথা বলতে হবে, তাদের সঙ্গে উঠতে-বসতে হবে, তাদের সমস্যাগুলো জানতে হবে, এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সেগুলোর আধুনিক সমাধান বের করতে হবে।

এই বিষয়গুলো সম্ভাবনার দিকে থেকে আমি মনে করি যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা করেছি। আরো সীমাবদ্ধতা হয়তো আছে, তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ।

ফাতেহ: বাংলাদেশে মাদরাসাশিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন বিদেশে যেতে চান। তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?

ইউসুফ সুলতান: আসলে আপনি যেমন বললেন, অনেকেই এখন বিদেশে যেতে চান, ঠিক। তবে জটিলতার জায়গাটা হলো, অনেক জায়গায় আমাদের সার্টিফিকেট একেবারেই রিকডনাইজড না, অনেকখানে হয়তো গ্রহণীয়, তবে সেখানে আবার ব্যাচেলরস সমাপ্ত করতে হয়। এটা একটা লম্বা জার্নি। অনেকের জন্যই এই জার্নিটা সম্ভবপর হয় না। সেই ভাইদের জন্য সহমর্মিতা ছাড়া আমি আর কিছুই প্রকাশ করতে পারছি না। তারপরও যারা যেতে চান তাদের বলবো, আপনারা চেষ্টা করুন, যেসব দেশে যেতে চাচ্ছেন সেখানে যদি আমাদের মাদরাসাপড়ুয়া কোনও ভাই থাকে, অথবা কোনও বাংলাদেশি ভাই থাকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুনㅡ কীভাবে এডমিশন ফরম সাবমিট করবেন, এবং অন্যান্য যা-যা ফর্মালিটি, সেসব তাদের থেকে সহযোগিতা নিয়ে করতে পারেন।

কিন্তু এটি একটি সাময়িক সমাধান। পূর্ণাঙ্গ সমাধান বের হবে তখনই, যদি বোর্ড থেকে এ-ধরণের উদ্যোগ নেয়া হয়।

ফাতেহ: আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য অনেক অনেক শুকরিয়া।

ইউসুফ সুলতান: আপনাকে ও ফাতেহ টিমকে অনেক ধন্যবাদ। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। অনেক ভালো থাকুন, সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন। আসসালামু আলাইকুম।

আগের সংবাদকরোনার টিকা গ্রহণে শরঈ দৃষ্টিকোণ
পরবর্তি সংবাদ‘কবিতাই আমার অস্ত্র’ : মাহমুদ দারবিশের সাক্ষাৎকার