আহমাদ সাব্বির:
গল্পটা অংশত নিয়াজ ভাইয়ের।
সেই নিয়াজ ভাই, মাঝরাতে কখনও যার ঘুম ভাঙে না। ঘড়ির কাটা দশটা পেরুলেই কিতাব-পত্তর গুছিয়ে সেই যে বিছানায় যান এক ঘুমেই ফজর। কোনো ব্যাপারেই অনিয়ম সহ্য হয় না তার। নিয়ম-শৃঙ্খলা-সময়জ্ঞান-অধ্যবসায় এসবের পুরোদস্তুর অভিধান যেন তিনি।
প্রসঙ্গত বলে রাখি—আমি, আমরা এবং নিয়াজ ভাই একই কামরাতে থাকি। যে কামরাটিতে নিয়াজ ভাই ও আমাদের দিন সপ্তাহ পক্ষ অতিবাহিত হয়, দেখতে তা কিছুটা ত্রিভূজ সদৃশ। ভবনের কোণার দিককার রুম। দারুল ইকামার কাগজে কলমে তেরোজন থাকবার কথা থাকলেও আমরা থাকি এগারোজন। একজন বছরের শুরুতেই তার ভাগে বণ্টিত সিট ইকামা থেকে বুঝে নিয়ে পূর্বের মাদরাসাতে যায় তার সামান পত্তর আনতে। সে আর ফেরেনি। শোনা যায়—তার মতোন মেধাবী শিক্ষার্থীকে নাকি পূর্বের মাদরাসা কর্তৃপক্ষ হাতছাড়া করতে চান না। এমনটা প্রচারিত হলেও ঘটনার পেছনের সত্যটা আমরা ঠিবই বুঝে নিই। এমন সংকীর্ণ জায়গাতে তার বছরের বাকী দিনগুলো যে বিষিয়ে উঠবে–এটা অনুমান করতে পেরেই হয়তোবা ছেলেটা আর ফেরেনি। প্রথম প্রথম এটা আমাদের নিছক অনুমান হলেও কিছুদিন পর আমাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে এলে কথায় কথায় তার মুখেই আমরা আমাদের অনুমিত ধারণার সত্যতা খুঁজে পাই।
বলতে পারেন—তারপরও তো আমাদের বারোজন থাকবার কথা। কিন্তু না। হিসাবটা সেরকম হয়নি। কারণ, আমাদের অন্যজন, যার নাম আবু জাফর, এবং যে কিনা স্বনামধন্য একটি মাদরাসার মুহতামিম সাহেবের ছেলে, মাস দুয়েক আমাদের সাথে থেকেও আমাদেরই এক উস্তাদের নেক নজরে পড়ে যায়। এবং একদিন সকালে ফজর নামাজ আদায় করে রুমে এলে দেখি—আবু জাফর তার বিছানা পত্তর গুছিয়ে আমাদের সেই প্রিয় উস্তাদ, যার রুমে সিট পাওয়ার জন্য সবাই প্রত্যাশা ও নিয়মমাফিক কসরত দুটোই করতাম, তার রুমের দিকে ছুটছে। বিস্ময়ে আমাদের চোখ তো ছানাবড়া। কিছুটা ক্ষোভও জন্ম নেয় বুঝি আমাদের ভেতর। আমাদের ক্ষোভের একমাত্র কারণ ছিলো হয়তোবা–সে দু’দিন আসা মাত্র কেমন করে উস্তাদজির রুমে সিট পেয়ে যায়? মাস দুয়েকের সংস্পর্শে আমাদের তো এটাও অজানা নয় যে, সে আহামরি কোনো ছাত্র নয়।
কিন্তু আমাদের ক্ষোভ বিস্ময় গোস্বা সব কিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে আমাদের চোখের সমুখ দিয়েই সে আমাদের প্রিয় উস্তাদজির রুমে থিতু হয়ে যায়। আর আমরা সেই অকস্মাৎ গোস্বার ওপর কিঞ্চিৎ পানি ঢালি একে অপরকে এ কথা বুঝিয়ে–যাক, ভালোই হলো। এতটুকুন রুমে আসলে এগারোজনই পারফেক্ট। বারোজন বড্ড চাপাচাপি হয়ে যায়।
অতঃপর তেরোজনের জন্য বরাদ্দকৃত যায়গা দখল করে আমরা এগারজন দিন গুজরান করতে থাকি। তারপরও চৈত্রদিনের ভ্যাপসা গরমে নিয়মিতই আমাদের ঘুম অপূর্ণ রয়ে যায়। মাঘ মাসের হাড় কাঁপানো শীতেও বৈদ্যূতিক পাখা চালিয়ে কক্ষতাপ মাত্রা নিয়ন্ত্রিত রাখতে হয়। আমাদের ভেতর একটু স্বাস্থ্যবান যে রাফি, নিয়ম করে ও দরসে ঝিমোয়। ধমক দিলে বলে—রাতে ওর নাকি ঘুম হয় না ঠিকঠাক। আমরা সবাই যখন নিশুতি রাতের আশ্রয়ে ঘুমের জন্য প্রত্যহ কাতরতা বোধ করে চলি, সেই তখনও দেখি নিয়াজ ভাই তার বাধাধরা নিয়মে রাত দশটা বাজতেই শুয়ে পড়েন। এরপর আরও কিছুটা সময় আমরা হল্লা করে কাটালেও আমাদের সেই হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে, হাতের তালুর মতোন ছোট্ট কক্ষ, যেখানে পিন পড়লেও পতনের আওয়াজ কারুর অগোচর হয় না, নিয়াজ ভাইয়ের নিশ্চিন্ত ঘুমে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। কখনওবা আমরা হিংসেয় পুড়ি—এই দেড় হাত জমিনে, যেখানে লম্বালম্বি দেহটাকে রাখতে পারাটাই সৌভাগ্যের, এতোটা প্রশান্তিতে, এক ঘুমেই তিনি রাত পার করেন কিভাবে!
কিন্তু আজ, এই গভীর রাতে আমরা কতিপয় যখন ঘোলাটে জোছনার মতোন ডিম লাইটের ক্ষীণ আলোয় নিয়াজ ভাইয়ের নড়াচড়া টের পাই তখন অবাক হই। আমরা অবাক হই তাকে প্রথমবারের মতোন এই গভীর রাতে নির্ঘুম দেখতে পেয়ে।
আমাদের মধ্যে নাবিলের সাথে তার সখ্য কিছুটা গাঢ়। নাবিলকে প্ররোচিত করতেই ও নিয়াজ ভাইকে ডেকে আনতে উদ্যোগী হয়। আমরা খানিকটা কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষমাণ থাকি। নাবিলের আহ্বানে নিয়াজ ভাইকে বিছানা ছেড়ে উঠে আসতে দেখে আমাদের দ্রবীভূত কৌতূহল আরও খানিকটা ঘণীভূত হয়ে আসে। কিন্তু আগ বেড়ে ঘটনার কোনো চিত্রায়ণ করতে আমরা সাহস করি না। বরং কেন এই মাঝরাতে নিয়াজ ভাই তার বেডিংএ শুয়ে এপাশ ওপাশ করে নির্ঘুম রাত পার করছেন তার ইতিবৃত্ত নিয়াজ ভাইয়েরই বয়ানে শুনবো বলে আগ্রহী মন নিয়ে অপেক্ষায় থাকি।
নিয়াজ ভাই উঠে এসে আমাদের ঠিক মধ্যিখানে বসে পড়েন। এই মুহূর্তে তাকে মনে হতে থাকে যেন আড্ডার মধ্যমনি। এবং আমরা বেশ অবাক হই তার ছলোছলো আঁখি যুগল দেখে। এই অন্ধকারেও ঠিক বুঝে উঠি—রোদে শুকানো মরিচের মতোন লাল হয়ে আছে নিয়াজ ভাইয়ের চোখের অভ্যন্তর। তবে কি নিয়াজ ভাই কেবল নির্ঘুম রাতই পার করছিলেন না; বরং কাঁদছিলেনও! আমাদের অনুমান সত্য প্রমাণ করতেই হয়তোবা নিয়াজ ভাই আর্তনাদের মতোন শব্দ তুলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। এবং আমাদের বিস্ময় আরও বাড়ে যখন দেখি কোনো প্রকারের সম্পর্ক না থাকলেও এবং নিয়াজ ভাইয়ের কান্নার রহস্য আমাদের কাছে অনুদঘাটিত থাকা সত্ত্বেও তার সে কান্না প্রবলভাবে আমাদের ক’জনকেও স্পর্শ করছে। উথলে ওঠা কান্নার গমক আমরাও টের পাই আমাদের কণ্ঠনালির কাছে। তবে কি কান্না এমনই! ছোঁয়াচে! নতুবা কেন অন্যের বেদনা এমন আলতো করে ছুঁয়ে যাবে আমাদের!
পরিস্থিতি নিমিষেই কেমন ছমছমে হয়ে ওঠে। এই কেমন ছমছম পরিস্থিতিতে কেবল নাবিলের কণ্ঠস্বর শুনি। ‘একি নিয়াজ ভাই! পোলাপানের মতোন কাঁদছেন কেন!’ তারপর আল আমিন, রুহুল কুদ্দুস ভাই, তাসনীম এবং আবদুল খালেক ভাইকেও কথা বলতে শুনতে পাই। তাতে নিয়াজ ভাইয়ের কোনো ভাবান্তর ঘটে না। সবার কৌতূহলের আস্কারা পেয়েই যেনবা তার কান্নার গমক আরও দ্বিগুণ হয়ে ছলকে উঠতে থাকে।
আমি ভাবনায় পড়ি। খানিকটা স্বগত সংলাপেই জড়িয়ে যাই যেনবা। কেন কাঁদছেন! নিয়াজ ভাইয়ের মতোন একজন উজ্জ্বল ছাত্র, যার অনাগত ভবিষ্যত-আয়োজনে কিংবা জীবনের জমা খাতায় অন্ধকার বলে কিছু নেই বলে আমরা জানি, সেই প্রায় মাওলানা একজন মানুষ এরকম হাউমাউ করে কাদবেন কেন? এমন ফুঁপিয়ে কান্নার উৎসমুখ হতে পারে কোন সে দুঃখ নদী তিনি বয়ে চলেন ‘তার পরানের গহীন ভেতর’!
নাবিলের জিজ্ঞাসাটাও খানিক ভাবিত করে তোলে আমাকে। বাচ্চা ছেলের মতোন কান্না! তবে বড়দের কান্না কেমন! বড়দের কান্নার মেজাজ কি আলাদা হয় কিংবা ঢং? বড়দের চোখের পানি কি লবণাক্ত নয়! চিৎকার করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে কান্নার মতোন কোনো অসুখ কী হতে পারে না বয়ঃসন্ধিকাল পেরুনো কোনো তরুণ যুবা কিংবা প্রবীণ বৃদ্ধের!
কান্না বিষয়ক আমার এ ভাবনাকে প্রলম্বিত করবার আর সুযোগ হয় না। কানে এসে পশে নিয়াজ ভাইয়ের কণ্ঠস্বর। কান্না জড়ানো চাপাস্বরে প্রথম তথ্যটা তিনি আমাদের দেন—তার বাবা, যিনি গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব এবং বয়োবৃদ্ধ, আজ বিকালে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। তথ্যটা পীড়াদায়ক। এবং একজন পুত্রের জন্য তো অবশ্যই ব্যাথা জাগানিয়া। কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিপাত করলে আমাদের জন্য ততোটা হৃদয় বিদারক নয়। এমন তো হারহামেশাই ঘটছে আজকাল। পুলিশ তো হররোজই অসংখ্য মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে; কারণে-অকারণে। যাদের কেউ ফিরছে। কারুরবা ফেরার সংবাদ আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে না। আমাদের সমবেদনার পারদ ক্রমেই নিচে নামতে শুরু করে। তবুও, প্রিয় সাথী ভাইয়ের পিতা কারারুদ্ধ হয়েছেন—এতটুকু ব্যাথাবোধ তখনও অবশিষ্ট আছে টের পাই আমাদের বুকের অন্দরে।
আর তখনই দ্বিতীয় ও শঙ্কাজাগানিয়া মারাত্মক তিক্ত তথ্যটা আমাদের সরবরাহ করেন নিয়াজ ভাই। এবং তার কণ্ঠস্বর যথারিতী কম্পমান। নিয়াজ ভাই কথা বলেছেন আর কেঁপে কেঁপে উঠছে তার মুখ-হয়তোবা বুক-নিসৃত শব্দ-ধ্বনি। এবং আমরা নিয়াজ ভাইয়ের কম্পিত কণ্ঠস্বরের বয়ান শুনে নিজেরাও সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠি। আমাদের হৃদয়ভাঙা-ব্যাথার পারদ আবারও একটু একটু করে উর্ধ্বমুখী হচ্ছে বলে আমরা অনুভব করি। এবং নিশ্চিতভাবেই বুঝে নিই যে, নিয়াজ ভাইয়ের এত সময়ের কান্না যথার্থই ছিলো। আর তাতেই হয়তোবা তার সেই কান্না আমাদেরকে জাপ্টে ধরে এবারে আরও প্রবলভাবে। আরও তীব্র ও নির্মমভাবে।
একটু থেমে, কণ্ঠের আর্দ্রতা খানিক শুষে নিয়ে নিয়াজ ভাই বলে চলেন, তার বয়োবৃদ্ধ এবং গ্রামের মসজিদের প্রবীণ ইমাম পিতা, যিনি রোজ সকালে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে একটি মক্তবও পরিচালনা করেন, পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে মক্তবে আগত ছোট্ট একটি মেয়েকে যৌন নিপীড়নের অপরাধে।
নিঃসন্দেহে নিয়াজ ভাইয়ের সরবরাহকৃত এই তথ্য বজ্রের মতোন আঘাত হানে আমাদের মাথার ওপর। নিয়াজ ভাই কতদিন ধরে আছেন আমাদের সাথে। তার প্রবীণ পিতা, যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, বছর দুই আগে খতমে বুখারীর অনুষ্ঠানে এলে তাকেও দেখেছি একবার, আমাদের বিস্ময় তাই কাটে না। এমন সৌম্য কান্তিময় চেহারার একজন মানুষের বিরুদ্ধে এই প্রকারের অভিযোগ! অভিযুক্ত ব্যক্তির ক্ষণিকের সংস্পর্শও আমাদের লাভ হয়নি। কথা হয়নি কখনও তার সাথে। দূর থেকেই একবার দেখেছি কেবল। কিন্তু নিয়াজ ভাইকে যতদূর চিনি, জানি একজন যৌন নিপীড়কের সন্তান তার মতোন হতে পারে না। ক্রমেই আমরা বিস্ময় নাকি ক্রোধের এক ঘোর প্যাঁচে আরও জড়িয়ে পড়তে থাকি।
এইখানটাতে এসে অন্য কারুর মনের খবর আমি ঠিক দিতে পারব না; তবে নিজের সম্বন্ধে বলে রাখতে পারি। আমার যে সামান্যও সংশয় হয়নি তা কিন্তু নয়। আমাদের সমাজে এমন ঘটনা তো ঘটতেই দেখি। আরও কতশত ভদ্র চেহারা আরও কতগুণ জঘন্য কাজ করে উঠছে। আরও কত ফেরেশতা চেহারার মানুষ নির্দ্বিধায় শয়তানের সহায়কের ভূমিকা পালন করে চলেছে। কত দরবেশ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে বিষাক্ত দাঁত বসিয়ে তাকে ভেতর থেকে ফোঁকলা করে দিচ্ছে; হররোজ। আমি তাই একদমই সংশয়হীন হতে পারি না। যদিও নিয়াজ ভাই জানিয়েছেন—এটা তার পিতার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র। গ্রামের সদ্য মারা যাওয়া চেয়ারম্যান সাহেবের দলের লোকেরা গ্রামের হাটখোলার মধ্যিখানে যে ভাষ্কর্য নির্মাণ করতে চাইছিলো তিনি তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ভাষ্কর্য ও মূর্তির ভেতর কোনো পার্থক্য নেই বলে তিনি স্থানীয় সভা মাহফিলে বয়ান বক্তৃতা রাখছিলেন। আর তাতেই সেই চেয়ারম্যানের দলের লোকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে এমন অপবাদে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
এমনটা যদিওবা বলছেন নিয়াজ ভাই। তবু ব্যক্তি আমার সংশয় দূরই হয় না। একজন প্রবীণ ইমামের বিরুদ্ধে যদি ষড়যন্ত্র করতেই হয় তাহলে এমন অভিযোগ কেন তৈরী করতে যাবে! একজন তরুণ ইমাম মুয়াজ্জিন কিংবা খাদেম সাহেবের বিরুদ্ধে হলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবার একটা সম্ভাবনা ছিলো। একজন প্রবীণ ইমাম কী আর মক্তবের ছোট্ট মেয়েকে যৌন নিপীড়ন করতে যাবে! ষড়যন্ত্র হলে ষড়যন্ত্রীরা নিশ্চয় নাট্যকল্পের এই দুর্বল দিকটি নিয়ে ভাবিত হতো। এবং তারা প্রবীণ ইমামকে ফাঁসাতে অন্য কোনো কৌশলের আশ্রয় নিতো। এ থেকেও সংশয় আমার রয়েই যায়—এ ঘটনা হয়তোবা পূর্ব পরিকল্পিত নয়।
অন্য আর সবাই যখন নিয়াজ ভাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, সমবেদনা জাহির করছে; তার চোখের আগুণ নিজেদের বুকেও আগলে রাখার প্রস্তুতি সারছে, আমি তখন এসব ভাবছি। আমার মন আমার কল্পিত সংশয়-সন্দেহের নানান দিক নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে। হঠাৎই কী হলো–আমার মনের জমিনে বহুকাল আগে গেঁথে যাওয়া, হৃদজমিনের একদম গহনে তলিয়ে যাওয়া একটা ভোঁতা স্মৃতি অঙ্কুর যেমন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে ঠিক তেমনই যেন আমার মনঃস্থিত সবকিছু ঠেলে একেবারে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো।
প্রায় বছর পনেরো আগেকার কথা। আমরা তখন হেফজাখানার ছাত্র। আমাদের হেফজ বিভাগের দুজন শিক্ষক। একজন নবীন। যাকে আমরা সম্বোধন করতাম ‘ছোটো হুজুর’। আরেকজন ছিলেন প্রবীণ। যাকে আমরা বলতাম ‘বড় হুজুর’। অন্যেরা শ্রদ্ধার সাথে যাকে ‘প্রধান শিক্ষক’ বলে পরিচয় দিতো। হেফজখানার বড় হুজুর হলেও আমাদের এই প্রবীণ ‘প্রধান শিক্ষক’ ছিলেন সকলের কাছে বরিত। সর্বজনমান্য। এমনকি আমরা শুনতাম যে, শিক্ষকদের মাঝে মুহতামিম সাহেবের কথার চাইতেও হেফজ বিভাগের প্রবীণ আমাদের ওই প্রধান শিক্ষকের কথারই গুরুত্ব ছিলো বেশি। এমনকি বহুবার শিক্ষকদের মিটিংয়ে মুহতামিম সাহেবের মত সিদ্ধান্ত হিসাবে স্থির হয়নি বিপরীতে হেফজ বিভাগের প্রবীণ প্রধাণ শিক্ষকের মতামত থাকবার কারণে। হেফজ বিভাগের প্রধান শিক্ষক যেনবা মুহতামিম সাহেবের প্রতিপক্ষ হয়ে দেখা দিলেন। আসলে দেখা দিলেন নয়; মুহতামিম সাহেব এবং তাকে পরিবেষ্টিত আরও কতিপয় শিক্ষক এমনটা কল্পনা করে নিতে আরম্ভ করলেন।
তাদের সেই কল্পনা এবং আরও কিছু পরিকল্পনার পরিণতিতে আটত্রিশ বছরের শিক্ষক হেফজ বিভাগের বড় হুজুর কারী আবদুর রউফকে অভিযোগের বোঝা কাঁধে নিয়ে মাদরাসা ছেড়ে চলে যেতে হয়। অভিযোগ—কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাথে তিনি অনৈতিক কাজ করেন। তিনি অনৈতিক কাজ আদৌ করতেন কিনা, কারুর সঙ্গে কোনোদিন করেছেন কিনা—সুনিশ্চিতভাবে তা আমার আজও অজানা। তবে এতটুকু বেশ নিশ্চিতভাবেই আমার জানা যে, মাদরাসা কমিটির উপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে বিচার কার্যের যে এজলাস বসেছিলো তাতে প্রদত্ত সকল সাক্ষীর সাক্ষ্য সত্য নয়। অন্তত একজন সাক্ষীর ব্যাপারে তো নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ঘরভর্তি মানুষের সমুখে সেদিন যা কিছূ সে বলেছিলো তার এক বর্ণও সত্য নয়। বড় হুজুর কোনোদিন তাকে নির্জন কোনো কক্ষে ডেকে নিয়ে যাননি। কোনোদিন তাকে দিয়ে যেখানে সেখানে তেল মালিশ করাননি। কোনোদিন তার লজ্জাস্থান স্পর্শ করেননি। এই সাক্ষী সেদিন কেবল হেফজ বিভাগের ছোটো হুজুরের মুখস্থ করানো স্ক্রিপ্টই আউড়ে গিয়েছিলো। আর কেন, কিসের ভয়ে কিংবা লোভে সেদিনের সেই ছোট্ট আমি এমন অনর্গল মিথ্যা বলে যেতে পেরেছিলাম শত চেষ্টাতেও তা আমার স্মৃতিতে আর জাগরূক হয় না। কিছুই মনে পড়ে না। কেবল মিথ্যার নাট্যমঞ্চে নিজের মুগ্ধকর অভিনয়টুকু ছাড়া।
এতদিনের ভুলে থাকা সুপ্ত দৃশ্যকল্প চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আমি যেন কেমন আউলে যাই। কেমন বিস্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। আমার মস্তিষ্কে কিছুই যেনবা স্থির আর থাকে না। নিয়াজ ভাইয়ের কান্না জড়িত হাহাকার, তাকে উদ্দেশ করে নাবিলের সৌহার্দ্যমাখা সান্ত্বনাবাক্য কিংবা আল আমিন, রুহুল কুদ্দুস ও আরও আরও বন্ধুর ফিসফিসানি কিছুই আমার কানে ঢোকে না। কিংবা ঢোকে; তবে আমার মস্তিস্ক ও বোধ তা ধরে রাখতে পারে না। আমি কিছুই যেনবা বুঝে উঠি না আর। কেবল এতটুকুই বুঝি–এখন অনেক রাত। আর সেই রাতের নিশীথ অন্ধকারের ভেতর আমরা ক’জন ঝিম মেরে বসে আছি। এবং বসেই থাকি।
মে, দশ, দুই হাজার একুশ।
নিউ টাউন, দিনাজপুর।