আল-হামরার শেষ পুরুষ

মুস্তফা লুতফী আল মানফালুতী
অনুবাদ: ইবরাহীম জামিল

রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও রানী ইসাবেলার বাহিনীর কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর…

গ্রানাডার শেষ শাসক আবু আব্দুল্লাহ জিব্রাল্টার পাদদেশে রোম উপসাগরের তীরে এসে দাঁড়িয়েছেন। তার পাশে স্ত্রী-সন্তান ও মান্যবর ব্যক্তিবর্গের ভীড়। জাহাজ প্রস্তুত। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা আফ্রিকার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। চিরদিনের জন্য। আবু আব্দুল্লাহ পলকহীন চোখে অপহৃত রাজ্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। যখন দৃষ্টি ফেরালেন তখন তার দুই চোখে অশ্রু। হঠাৎ রুমালে মুখ ঢেকে হু-হু করে কেঁদে উঠলেন তিনি। তাকে কাঁদতে দেখে চারপাশের মানুষগুলোও কান্না সংবরণ করতে পারল না। অশ্রু, কান্না আর দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠল সমুদ্র উপকূল।

আবু আব্দুল্লাহ যেন সংবিত হারিয়েছিলেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন, আকাশের উপর থেকে একটি কণ্ঠস্বর তার নাম ধরে ডাকছে। চোখ তুলে দেখতে পেলেন, অনেক উপরে, জিব্রাল্টার গুহামুখে এক বৃদ্ধ দরবেশ লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে উদ্দেশ্য করে বৃদ্ধ দরবেশ চেচিয়ে বলছে, ‘হ্যাঁ, আজ তোমার কান্নার দিন। অপহৃত রাজ্যের জন্য তুমি নারীদের মতো কাঁদো, কেননা পুরুষের মতো করে তুমি একে রক্ষা করতে পারোনি। গতকাল তুমি খুব হেসেছো। আজ তোমার কান্নার দিন। হাসির সমান কেঁদে নাও! কারণ হাসি-উল্লাস জীবনের আলোকিত দিন, আর কান্না হল অন্ধকার রাত। আলোকিত দিনের পরেই রাতের অন্ধকার নেমে আসে।

স্পেনের পতনে তোমার যদি কোনো দায় বা দুর্বলতা না থাকতো, যদি স্রেফ নিয়তির কষাঘাতে বা কালের দুর্বিপাকে স্পেন হাতছাড়া হতো, তাহলে এ আঘাত সহ্য করা সহজ ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হল, তুমি নিজ হাতে একে ধ্বংস করেছো। নিজ হাতে এ ভূমি শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছো। তাই অনুতাপে তুমি শুধু কাঁদতে পারো, এ কান্নার কোনো নিরাময় নেই।

আল্লাহ কারো উপর জুলুম করেন না, কারো ধ্বংস চান না, কিন্তু মানুষ বারবার ভগ্নপ্রায় গর্তের কিনারে গিয়ে দাঁড়ায়, ফলে পা পিছলে তাকে গর্তে পড়ে যেতে হয়। বারবার পাহাড়ের পতনোন্মুখ পাথরের নিচ দিয়ে হাঁটে, তাই তার মাথায়ই পাথর এসে পড়ে।

তোমাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন তা নিয়ে তুমি খুশি হতে পারোনি। তোমার মন-মস্তিষ্ক জুড়ে ছিল ক্ষমতা আর রাজত্বের লালসা। আপন চাচার কাছ থেকে এদেশ তুমি কেড়ে নিয়েছো। চাচাকে পরাস্ত করতে তুমি শত্রুর হাতে হাত মেলাতে দ্বিধা করোনি। সুযোগে শত্রুরা তোমাদের একজনের মাধ্যমে আরেকজনকে ঘায়েল করার পৈশাচিক খেলায় মেতে উঠেছে। পরিণামে পায়ের নিচে রক্তের নদী জমতে জমতে সেই নদীতে তোমরা ডুবে গিয়েছো।

সাত বছর ধরে আমি এই পাহাড়ের গুহায় অপেক্ষা করছি, তোমাদের এই চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন দেখবো বলে।

আমি জানতাম, যে দেশ শাসন করে গণ্ড-মূর্খরা, সেদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কোনো স্থায়িত্ব নেই। তোমরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে উঠেছিলে, নিজেরাই নিজেদের জান কবজ করছিলে। তোমরা মুসলমানদেরকে মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়েছিলে। শত্রু তোমাদের পেছনে ওঁৎ পেতে ছিল চূড়ান্ত পরিণাম দেখার জন্য। তোমরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যকার শত্রুবধের নেশায় বিভোর হয়ে পড়েছিলে। ক্ষমতা দখল ছিল তোমাদের চূড়ান্ত আরাধ্য।

এক সময় শত্রুরা লক্ষ্য করেছে যে, পরস্পর লড়াই করে তোমরা দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে পড়েছো। তখন একযোগে তারা তোমাদের উপর হামলা করেছে এবং এক দুটি আঘাতেই তোমাদেরকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলেছে।

ইসলামী সালতানাতের অধীপতিগণ! শীঘ্রই আল্লাহ তোমাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা যাকে ধ্বংস করেছো ও যার মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছো। তোমাদেরকে আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন সেইসব মুসলমানদের সম্পর্কে যাদেরকে তোমরা শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছো, শত্রুর মাঝে লাঞ্ছিত হয়ে বেঁচে থাকার জন্য। তোমাদেরকে ইসলামী শহর-নগর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, যা তোমাদের পুর্ব-পুরুষেরা রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে ক্রয় করেছিলেন, এরপর তোমাদের হাতে আমানত হিসেবে রেখে গিয়েছিলেন, যেন তোমরা এর সম্মান ও সীমান্ত রক্ষা করতে পারো। কিন্তু দেশরক্ষায় তোমরা সামান্যতম নজর দাওনি। শত্রুরা এই শহর দখল করে নিয়েছে। এখন তোমরা সেখানে অপদস্থের মতো বেঁচে থেকে অপাংক্তেয়ের মতো বিতাড়িত হচ্ছো! যদি আগামীদিন তোমাদেরকে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে কি তোমাদের কাছে এর কোনো জবাব আছে?

ওই তো মিনারে মিনারে আযানের পরিবর্তে গির্জার ঘণ্টা বাজছে!
ওই তো মুসল্লিদের সেজদার জায়গা ক্রুসেডারদের পদাঘাতে পিষ্ট হচ্ছে!

দ্বীন-ঈমান বাঁচাতে মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ী গুহায় ও উপত্যকায় আশ্রয় নিচ্ছে। ইসলামের কোনো বিধান এখন আমার মতো গুহায় লুকিয়ে ছাড়া আদায় করা সম্ভব নয়।

হায়! মুসলমানরা যদি নীড়হারা বেদুইনের মতো জীবন যাপন করতো, যাদের কোনো বাধা নেই, নিয়ম নেই, রাজা নেই, রাজ্য নেই! এইসব লোভী স্বৈরশাসকের অধীনে জীবন যাপনের চেয়ে তা কতই না ভালো ছিল!

এরা সবার গলায় বেড়ি পরিয়ে টানতে টানতে ধ্বংস ও অস্তিত্ব বিনাশের এমন এক গুহায় নিয়ে ফেলেছে, যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো সুযোগ নেই। শরণার্থী জীবন মুসলমানদের সেই ক্ষতি করতে পারতো না, যে ক্ষতি করেছে এসব রাজ-রাজড়াদের স্বৈরশাসন।
হে আলহামরার সন্তানেরা! তোমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা আমার সন্তানদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, যাদেরকে তোমরা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছো। অথচ তাদেরকে তোমাদের চেয়ে আমার বেশি প্রয়োজন ছিল। তাদেরকে তোমরা যুদ্ধের ময়দানে টেনে নিয়েছো মুসলমানদের সাথে লড়াই করার জন্য, যে লড়াইয়ে কোনো সম্মান নেই, মর্যাদা নেই, বীরত্ব নেই। ফলে তারা সবাই অপদস্থের মতো মৃত্যুবরণ করেছে। তোমরা তাদেরকে আমার পাশে থাকতে দাওনি। তারা থাকলে এই নিঃসঙ্গ জীবনে আমি তাদেরকে পাশে পেতাম, বার্ধক্যে তাদের কাছে আশ্রয় নিতাম। তোমরা তাদেরকে মর্যাদাপূর্ণ যুদ্ধেও যেতে দাওনি, তাহলে নিজেকে আমি এই বলে সান্ত্বনা দিতে পারতাম যে, আমার সন্তানেরা ধর্ম ও দেশ রক্ষায় জীবনোৎসর্গ করেছে।

দেখতেই পাচ্ছো, তাদেরকে হারিয়ে আমি এই নির্জন পতোনোন্মুখ পাহাড়ের গুহায় একাকী বেঁচে আছি। তাদের স্মরণে সব সময় কেঁদে চলেছি আর আল্লাহকে বলছি, তিনি যেন তাদের সাথে আমার মুলাকাত করিয়ে দেন। কিন্তু কবে আল্লাহ আমার ডাকে সাড়া দেবেন?”

কান্নায় বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। লাঠিতে ভর করে ধীর পদক্ষেপে গুহার আড়ালে হারিয়ে গেল।

বৃদ্ধের কথা আবু আব্দুল্লাহর হৃদয়ে প্রবলভাবে রেখাপাত করল। আটশত বছরের ক্ষমতা হারানোর যন্ত্রণার চেয়েও বেশি গভীর করে। আবু আব্দুল্লাহ চিৎকার করে বলে উঠল, এ তো মানুষ নয়! এ তো ঐশ্বরিক ন্যায়পরায়নতার কণ্ঠ! সে আমাকে অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতের দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে বেশি শংকিত হতে বলছে। হায়! আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই যেন করেন, কারণ আল্লাহ যা করেন তাই একমাত্র সুবিচার।

আবু আব্দুল্লাহ জাহাজে উঠে পড়লেন। পরিবারবর্গও উঠল। নিস্তরঙ্গ জলের বুক চিরে এগুতে লাগল জাহাজ । ঠিক সেই মুহূর্তে ইতিহাস তার বুকে আরেকটি বাক্য লিখে নিল: ‘স্পেনে মুসলমানদের আটশত বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে।’

এক

চব্বিশ বছর পর ।

আফ্রিকায় আলহামরার সন্তানেরা একে একে মারা গেছে। শুধু চব্বিশ বছরের একটি যুবক বেঁচে আছে। তার নাম সাইদ। সে গ্রানাডা দেখেনি, আলহামরা দেখেনি, মারাজের সৌন্দর্য দেখেনি, আরিফ উদ্যান দেখেনি, অশ্রু পাহাড় দেখেনি, বরফ পাহাড় দেখেনি। কিন্তু শিশুকাল থেকে শোনা আন্দালুসীয় গানের মোহনীয় সুর তার মনে আছে, যে গান ঘরের নারীরা তার দোলনার পাশে দাঁড়িয়ে গাইতো। সে গানে তার পূর্ব-পুরুষের কথা ছিল, তাদের বিজয় ও বীরত্বের আখ্যান ছিল। সেই ভূবন মোহিনী মর্মভেদী সুর, তার ভাঁজে ভাঁজে সম্মানহারা, রাজ্যহারা আন্দালুসী কবিদের হাহাকার মিশে ছিল। সাইদ একাকী হলে দুঃখের সুরে সেই গান গাইতো। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। মনের মধ্যে অদেখা এক দুঃখ জেগে উঠত। সে শুধু কাঁদতে থাকতো, কাঁদতেই থাকতো।

আল্লাহর কাছে সে শুধু একটি জিনিসই চাইতো, একটিবারের জন্য হলেও সে যেন গ্রানাডা দেখতে পায়। সে শুধু একবার গ্রানাডা দেখে তার মনের পিপাসা মিটাতে চায়। এরপর নিয়তি তার সাথে যে আচরণই করুক, তাতে তার দুঃখ নেই। যখনই সে গ্রানাডা যেতে উদ্যত হয়েছে, একটি চিন্তাই তাকে বারবার বাধা দিয়েছে। তাহল ঘরে একজন অসুস্থ বৃদ্ধা আছেন। তাকে দেখার কেউ নেই। সুতরাং তাকে রেখে সে কোথাও যেতে পারে না।

বৃদ্ধার মৃত্যুর পর সাইদ সাবতা থেকে জাহাজে উঠে মালাকা উপকূলে নামল। সেখান থেকে আরবীয় ডাক্তারের ছদ্মবেশ নিয়ে গ্রানাডার পথে রওনা হল। আন্দালুসের পাহাড় ও সমতল ভূমি অতিক্রম করে সাঁঝের বেলায় গ্রানাডার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছল সে। সালজ পর্বতশ্রেণির একটি টিলায় দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেল বরফ পাহাড়ের উপর থেকে ধীরে ধীরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়ের উপরটা যেন উজ্জ্বল আলোর চাদরে ঢাকা, অথবা যেন সেটা সাগরে ভেসে ওঠা অতিকায় এক বুদবুদ। উপর থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে পাহাড়ের নিচে অসংখ্য নালার সৃষ্টি হয়েছে, যেন অগুনতি সাদা সাপ একেবেঁকে চলেছে মুক্তির আনন্দে।

সাইদ চোখ তুলে তাকাল শহরের দিকে । দূরে আকীক পাথরের লাল বুরূজ দেখা গেল, আকাশছোঁয়া গম্বুজ দেখা গেল, বিগন্ত বিস্তৃত মিনার দেখা গেল। এই অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্যের সামনে সে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দুটি হাত অজান্তে কখন যে বুকের কাছে উঠে এসেছে! দূর থেকে দেখলে মনে হবে পথহারা কোনো দরবেশ ধ্যান করতে দাঁড়িয়েছে। ক্ষণকাল সে নিরব হয়ে রইল, তারপর বনভূমি কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলল, এ আমার পূর্ব-পুরুষের ভূমি। কিন্তু নিজ পরিচয়ে স্মৃতির সামনে দাঁড়ানোর অধিকারও আমার নেই! এই তো তাদের গোরস্থান, অথচ এখানে কবরস্থ হয়েছে শত্রুরা। আর তাদের জন্য মিলেছে মরু-বিয়াবান অথবা সাগরের গহিনতল। এই তো তাদের প্রাসাদ বিস্তীর্ণ ভূমির দিকে তাকিয়ে আছে। যেন অপেক্ষা করছে, তারা আবার ফিরে আসবে বলে। কিন্তু তারা আর ফিরে আসে না! ওই তো আকাশছোঁয়া মিনারগুলো রাত-দিন ডেকে ডেকে বলছে, হে আল্লাহ! আপনি এর নির্মাতা ও রক্ষকদের ফিরিয়ে আনুন! কিন্তু তাদের ডাকে এখন আর সাড়া দেয়া হয় না। এইসব উদ্যানে তারা আনমনে পায়চারী করতেন। এইসব গাছের ছায়ায় শুয়ে বিশ্রাম নিতেন। এইসব নদীর তীরে সকাল-সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াতেন। আজ এখানে তাদের আসা-যাওয়া নেই, ওই আকাশের নিচে এখন আর তাদের বিচরণ নেই।

সাইদ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে দেখল, পশ্চিমে সূর্য ঢলে পড়ছে, রাতের অন্ধকার দিনের আলোকে হটিয়ে দিতে ব্যতিব্যস্ত। তার হৃদয়ে হাহাকার উঠল, মনে মনে বলল, এভাবেই রাজ্যের পরিবর্তন ঘটে, রাজ-মুকুট স্থানান্তরিত হয়, এভাবেই আলোর জায়গা অন্ধকার দখল করে নেয়, জীবনের মুখে মৃত্যুর ছায়া পড়ে। এসব ভাবতে ভাবতে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল, মাটির কোলে আকাশ মুড়ি দিয়ে। রাত কেটে গেলে তার ঘুম ভাঙল। পাহাড়ের পাদদেশে বহমান নদীর পানিতে অযু করে নিল সে। তারপর নদীর পাড়েই ফজর পড়তে দাঁড়িয়ে গেল। নামাজের পর সরাইখানার খোঁজে শহরের দিকে রওনা হল। পথে সরাইখানা দেখিয়ে দেয়ার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। অগত্যা সুনীল নদীর তীরে আনমনে হেঁটে হেঁটে বাতাসের হিল্লোলে ফসলের ওড়াউড়ি দেখতে লাগল আর সুপ্তির অতল হতে শহরবাসীর জেগে উঠার অপেক্ষা করতে লাগল।

সে হাঁটছিল। হঠাৎ তার সামনে এক বিশাল প্রাসাদের সিংহদ্বার খুলে গেল। সাইদ দরজার ওপাশ থেকে এক স্প্যানিশ তরুণীকে বের হয়ে আসতে দেখল। তার চেহারা একখণ্ড মিহি কাপড়ে ঢাকা। বুকের উপর ছোট্ট একটি সোনালী ক্রুশ ঝুলছে। একটি দাস-শিশু বাইবেল হাতে মেয়েটিকে অনুসরণ করছে। স্প্যানিশ মেয়েটি সাইদকে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাইদের কাছে এসে অবগুণ্ঠন সরাতেই মনে হল যেন একটি সূর্য তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে ঝলমল করে উঠেছে।

ভাঙা ভাঙা আরবীতে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এই শহরে নতুন?
সাইদ বলল, হ্যা, এইমাত্র এলাম। সরাইখানার রাস্তা চিনি না। জিজ্ঞাসা করে নেয়ার মতো কাউকে পাচ্ছি না।

সাইদের কন্ঠস্বরে মেয়েটি আভিজাত্যের আভাস পেল। চেহারায়ও সৌখিনতার ছাপ সুস্পষ্ট। মেয়েটি সাইদকে তার সাথে আসতে বলল। সে-ই সরাইখানা দেখিয়ে দেবে। তারা দুজন হাঁটতে হাঁটতে সরাইখানার কাছে এসে থামল। মেয়েটি স্মিত হেসে বিদায় নেয়ার সময় বলল, বিদেশী! যখনই কোনো প্রয়োজন হবে, আমাকে জানাতে ভুলবে না। নিঃশব্দে সে গির্জার দিকে চলে গেল।

দুই

রাতের অন্ধকারে নীরব আকাশে নক্ষত্রের আগমন ঘটে। নক্ষত্রের উপস্থিতিতে আকাশের চিত্রপট কিছুটা আলোকিত হয়। উল্কার পতনে আকাশের প্রান্তে হঠাৎ-ই উজ্জ্বলতা দেখা দেয়। এভাবেই রাতের আকাশে ক্ষীণ আলোর আনাগোনা চলতে থাকে। এরপর যখন সূর্যের আগমন ঘটে তখন এইসব ছোট ছোট আলোর কণাগুলো আকাশের পট থেকে মুছে যায়।

মনুষ্য হৃদয়ও এমন। এখনেও আবেগ ও কল্পনারা কখনো দলবেঁধে আসে, কখনো একটা দুটো করে আসে। এরা আসতেই থাকে। এরপর মানুষ যখন সাবালক হয়, হৃদয়ে প্রেমের সূর্য জ্বলে ওঠে, তখন অকস্মাৎ অন্যসব আবেগ-অনুভূতি হৃদয়ের পট থেকে মুছে যায়।

আমাদের সাইদ-আলহামরার শেষ উত্তর পুরুষ-এখন গ্রানাডাকে নতুন চোখে দেখছে। আগের দৃষ্টিভঙ্গী আমূল বদলে গেছে। তার চেহারায় এখন ঘৃণার পবিবর্তে প্রেমের ঝিলিক, অন্ধকারের পরিবর্তে আলোর সন্তরণ। মৃত চেহারায় যেন জীবন জেগে উঠেছে। আগের উত্তেজনা একদম নেই। মন বরফ-শীতল হয়ে গেছে। জন্মভূমি হারানোর যে অশান্ত ক্রোধ তার রক্তে-পাঁজরে ঢেউ তুলে চলেছিল তা অকস্মাৎ নিস্তরঙ্গ জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। এখন সে গির্জায় পরিণত হওয়া মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় স্প্যানিশ তরুণীটিকে গির্জায় ঢুকতে বা বের হতে দেখার আশায়। সুউচ্চ মিনারের চূড়ায় কোনো ক্রুশ জ্বলতে দেখলে তার রাগ হয় না, বরং মেয়েটির বুকের সেই সোনালী ক্রুশটির কথা মনে পড়ে যায়। সেই দৃশ্যটির আড়ালে এই দৃশ্যটি অদৃশ্য হয়ে যায়। যখন সে গির্জার ঘণ্টাধ্বনি শোনে, তার মনে পড়ে যায় যে, কিশোরীটির সাথে সাক্ষাতের সময় এমনই ঘণ্টা বেজে ছিল।

হতভাগা মুসলিম রাজপুত্রের গির্জার ঘন্টা শুনতে ভালো লাগে।

এখন প্রতিদিন সকালে সে সুনীল নদীর তীর ধরে হেঁটে বেড়ায়। তার অনুসন্ধানী চোখ প্রতিটি বাড়ির দরজায় আছড়ে পড়ে, হয়তো সে কিশোরীর প্রাসাদ-বাড়িটি খুঁজে পাবে। কিন্তু খুঁজে পায় না। ঠিক চিনে উঠতে পারে না। সকাল-সন্ধ্যায় পথে হেঁটে যাওয়া কিশোরীদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, হয়তো বা তাদের ভীড়ে তাকে খুঁজে পাবে, কিন্তু পায় না। যখন সে একদম নিরাশ হয়ে যায়, তখন চলে যায় শহরের উপকণ্ঠে পিতৃপুরুষের কবরস্থানে। কোনো এক কবরের শিয়রের কাছে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কিন্তু এ কান্না কি তার অতীত স্মৃতির কান্না নাকি নতুন স্মৃতির কান্না তা ঠিক বুঝে ওঠা যায় না।

তিন

গত দুই বছরে ফ্লোরিন্ডা এতো কষ্ট পেয়েছে যে, কষ্টের নির্মম কষাঘাত এখনো তার বুকের সাথে লেপ্টে আছে। ফ্লোরিন্ডার বাবা ছিল ‘পবিত্র বন্ধন’ সংঘের প্রধান। তারা অনেক বছর ধরে সর্ব-ধর্ম ও ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করছিল। সবাই যেন নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার পায় এটা নিশ্চিত করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আমলাদের কাছে তার এ আন্দোলন পছন্দ হয়নি। তাই রাতের অন্ধকারে একদিন তারা তাকে হত্যা করে ফেলে। স্বামীর শোকে স্ত্রী মারা যায় কয়েকদিনের ভিতর।

বাবা-মা হারিয়ে ফ্লোরিন্ডা যেন অনিঃশেষ দুঃখের মাঝে পথ হারিয়ে ফেলে। রাত কি দিন, সকাল কি সন্ধ্যা–এই বেদনা তার পিছু ছাড়ে না।
এখনো আঠারো বছরে পা দেয়নি সে। অনিঃশেষ দুঃখ বুকে নিয়ে সন্নাসিনী বেশে একটি বাড়িতে তার দিন কাটে, রাত কাটে। পথচারীরা তাকে শুধু ক্রিতদাসের সাথে গির্জায় যেতে বা গির্জা থেকে ফিরে আসতে দেখে। অথবা তাকে মুসলিম শাসনামলের স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, এখান থেকে সে কিছু শিখতে চায়, কিছু বুঝতে চায়। অথবা তাকে গ্রানাডার তৃণভূমি ও উদ্যানের মাঝে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায়। রাতের পর্দা নেমে এলে সে ঘরে ফেরে। এটাই তার দৈনিকের রুটিন। এসব দেখে দেখে গ্রানাডার মানুষ তার নাম দিয়েছে ‘সুন্দরী নান’।

ফ্লোরিন্ডা একদিন আলহামরার মুসলমানদের কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখনই তার চোখ পড়ে এক আরব যুবকের উপর। উপুড় হয়ে কবরের মাটিতে চুমু খাচ্ছে সে। চোখের পানিতে সিক্ত হয়ে উঠছে কবরের মাটি ।

ফ্লোরিন্ডা উদ্বিগ্ন হয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। যুবকটি কারো আগমন টের পেয়ে মাথা তুলেই খানিকটা হকচকিয়ে গেল। দুজন দুজনকে চিনতে পারল।

ফ্লোরিন্ডা বলল, অতীতের শাসকদের জন্য কাঁদছো? মন ভরে কাঁদো। তাদের জন্য এখন কেউ কাঁদে না বলে কবরের মাটি শুকিয়ে গেছে।
সাইদ বলল, তুমি কি তাদের জন্য সহানুভূতি অনুভব করছো?
ফ্লোরিন্ডা বলল, হ্যা, তারা ছিল শাসক, মহাকাল তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছে। আর অধঃপতিত শাসকেরাই মানুষের অশ্রুজলের বেশি হকদার।
সাইদ বলল, তোমাদের দেশে পা রাখার পর এই প্রথম আমি একটু সান্ত্বনা অনুভব করছি।
ফ্লোরিন্ডা বলল, এদেশে তাদের যে প্রাসাদ ও স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে তা কি তুমি ঘুরে দেখেছো?
সাইদ কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা উঁচু করল। তার দুই চোখ অশ্রুতে টলমল।
সে বলল, না আমি যতবার ওগুলোর কাছে যেতে চেয়েছি, প্রহরীরা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ওরা তো জানে না যে, দুনিয়ার মধ্যে ওগুলোর কাছে যাওয়ার সবচেয়ে বড় হকদার আমিই।
ফ্লোরিন্ডা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি তাদের কারো উত্তর পুরুষ বা রক্তের আত্মীয়?
সাইদ উত্তর দিল, না, আমি তাদের দাসানুদাস, আযাদকৃত গোলাম। আমি তাদের রোপন করা বৃক্ষেরই একটি শাখা। তাদের অনুগ্রহ যেহেতু পেয়েছি তাই যতদিন বেঁচে থাকি, আমি তাদের অবদানের কথা মনে রাখতে চাই।
ফ্লোরিন্ডা বলল, আগামীকাল ঠিক এই সময় তুমি এখানে থেকো, আমি তোমাকে স্মৃতিস্তম্ভগুলো দেখাতে নিয়ে যাবো।
সাইদ বলল, তুমি যদি এটা করো তাহলে দুনিয়ার মধ্যে তোমার প্রতি আমার চেয়ে কৃতজ্ঞ আর কেউ হবে না।

ফ্লোরিন্ডা তাকে কুর্নিশ করে চলে গেল। সাইদও আশা নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে সরাইখানার পথ ধরল।

চার

ফ্লোরিন্ডা আরব বন্ধুকে দেয়া ওয়াদা রেখেছে। প্রথম দিন তাকে কিছু জায়গা ঘুরিয়ে এনেছে, দ্বিতীয় দিন আরো কয়েকটি জায়গা, তৃতীয় দিন আরো কয়েকটি। এভাবে চলতে লাগল। প্রতিদিন তারা একসাথে হয়, প্রতিদিন আবার আলাদা হয়ে যায়। গ্রানাডার মানুষ তাদেরকে দেখে ভাবে, সুন্দরী নান ক্রুশের উপর আরব যুবকের আস্থা নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সাইদের প্রতি ফ্লোরিন্ডার সহানুভূতি দিনে দিনে প্রচন্ড ভালোবাসায় রূপ নিল। এভাবেই সহানুভূতি সব সময় প্রেমের পথ খুলে দেয়। অথবা সহানুভূতিই বোধহয় প্রেম, অন্য নামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। দুজনের কেউ-ই নিজের মনের কথা অন্যকে বলার সাহস করে উঠতে পারল না। অবশেষে চলে এল সেই দিন, যেদিন তারা আলহামরা পরিদর্শনে যাচ্ছে। এরপর দেখার মতো আর কিছু বাকি নেই। সুতরাং আজকের পর তাদের মিলিত হওয়ারও কোনো উপলক্ষ্য নেই। আজকের পর দুজনকেই দুজনের গন্তব্যে ফিরে যেতে হবে।

রাজ্যহারা রাজপুত্র সাইদ আলহামরার সামনে এসে দাঁড়াল। সে আকাশের চেয়ে বিশাল এক আকাশ দেখতে পেল। কালপুরুষকে টেক্কা দেয়ার মতো সুউচ্চ পাহাড় দেখতে পেল। মেঘের উপরে মেঘ দেখতে পেল। এ যেন অতিকায় এক পাহাড়, যার চূড়া থেকে অসংখ্য ঝর্ণা নেমে আসছে, যার সৌন্দর্যের সামনে কল্পনারা খেই হারিয়ে ফেলে।

আলহামরা যেন একটি দূর্গ। কালের দুর্বিনীত হাত যার সামান্য ক্ষতি করতে পারেনি। এর পায়ের কাছে মহাকাল আছড়ে পড়েছে। শতাব্দির পর শতাব্দি এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। সাইদ আলহামরার ভিতরে প্রবেশ করল। এ এক বিশাল দুনিয়া। এখানে উদ্যান আর ঝর্ণার মিলনমেলা। আলহামরার সুউচ্চ মিনার, যেখানে নক্ষত্রেরা তাদের রহস্য জমা করে রাখে। আকাশছোঁয়া খিলান, যেখান থেকে নিয়তি নিচে নেমে আসে। হরেক রঙের পাথর-খঁচিত সুবিশাল আঙিনা, যেন শুয়ে থাকা একটি পুষ্পোদ্যান। পলিশ করা দেয়ালের বুকে অনেক লেখা ভেসে উঠেছে, যেভাবে আয়নায় রূপসী মেয়ের মুখ ভেসে ওঠে। প্রতিটি দেয়ালে খাঁজ কাটা গর্ত। দেখলে মনে হয় ঢেউয়ের উপরে ঢেউ চলেছে। সেগুলোকে ভেসে যেতে বাধা দিচ্ছে এক টুকরো কাঁচের ফলক।

সাইদ অভিভূত হয়ে দেখছিল আর হাঁটছিল। এইসব স্মৃতি-চিহ্নের মাঝে হেঁটে যেতে যেতে আনমনে আবৃত্তি করছিল-

‘আলহামরার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি
কতকিছু ভাবতে চাই আর কতকিছু ভাবছি!
আলহামরাকে ডেকে বললাম, ফিরে আসার কি সুযোগ আছে?
সে বলল, মৃতরা কি ফিরে আসতে পারে?
আমি তাকে হারিয়ে কাঁদছি, হায় কান্নাই যদি সব সমস্যার সমাধান হতো!
স্মৃতিস্তম্ভ হল ভাড়াটিয়া ক্রন্দনকারী
মৃতদের জন্য শুধু তারাই অবিরাম কেঁদে যায়।’

আনমনে ভাবতে ভাবতে সাইদ সবচেয়ে বড় আঙিনায় এসে পৌঁছল। হলুদ মর্মরে বাঁধানো বিশাল চত্বর। চারপাশে বৃত্তাকারে দাঁড়ানো উঁচু পিলার। চত্বরের মাঝ থেকে চারটি রেখা চারদিকে চলে গেছে। চারপাশেই মুখোমুখি অনেকগুলো হুজরা। হুজরার উপরে গম্বুজ। সাইদ বুঝে ফেলল, এগুলো তারই পরিবারের আমীর-উমারাদের ঘর। তার হৃদয়ে স্মৃতির ভীড় জমল। মনে হল যেন দুঃখে হৃদয় চৌচির হয়ে যাবে। ভিতর থেকে কান্না উথলে উঠল, কিন্তু ফ্লোরিন্ডার সামনে কাঁদা যাবে না। সে অলক্ষ্যে দেয়ালের নকশা দেখার ভান করে সরে এল। একটি হুজরার পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় নামফলকের উপর দৃষ্টি আটকে গেল। লেখাটি পড়তেই ‘বাবা!’ বলে চিৎকার করে সে জ্ঞান হারাল। দীর্ঘ সময় পর জ্ঞান ফিরলে সে দেখল, তার মাথা ফ্লোরিন্ডার কোলের উপরে রাখা। ফ্লোরিন্ডার চোখে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ।

ফ্লোরিন্ডা বলল, আমি আগেই ধারণা করেছিলাম নিজের ব্যাপারে তুমি কিছু লুকোচ্ছো। আজকে বুঝতে পারছি, তুমি আলহামরার সন্তানদের আযাদকৃত দাস নও, বরং তুমি তাদেরই একজন। তুমি তোমার পিতামহের প্রাসাদে পিতার কুঠুরির সামনে দাঁড়িয়ে আছো। হে আলহামরার উত্তর পুরুষ! তোমরা কতই না হতভাগা! হে মিসকিন রাজপুত্র! তোমাদের কতই না দুঃখ!

এরপর নিজেকে গোপন রাখার আর কোনো সুযোগ রইল না। সাইদ ফ্লোরিন্ডার সামনে তার গল্প, তার পরিবারের গল্প, স্পেন থেকে বিতাড়নের পর থেকে আজ অবধি তাদের পরিবারের সব কথা খুলে বলল। এরপর ফ্লোরিন্ডাকে উদ্দেশ্য করে কাতর কন্ঠে বলল, ফ্লোরিন্ডা! সামনে আমার জন্য যে দুঃখ অপেক্ষা করছে তার তুলনায় অতীতের দুঃখ একদম তুচ্ছ।
ফ্লোরিন্ডা বলল, এই দুর্ভাগ্যের চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?
সাইদ বলল, আমি সব কষ্ট সহ্য করতে পারব, কিন্তু তোমার সাথে চিরস্থায়ী বিচ্ছেদের কষ্ট সহ্য করতে পারবো না।
ফ্লোরিন্ডা বলল, রাজপুত্র! তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?
সাইদ বলল, হ্যা, যেভাবে মলিন পুষ্প অঝোর বৃষ্টিকে ভালোবাসে।
ফ্লোরিন্ডা বলল, তুমি কি এমন নারীকে ভালোবাসতে পারবে, যে তোমার ধর্মের নয়?
দুর্ভাগা রাজপুত্র-যার পুর্বপুরুষেরা নারীর মোহে পড়ে সবকিছু হারিয়েছে-সে অকপটে বলে দিল, হ্যা, পারবো, কারণ হৃদয়ের জায়গা আর প্রেমের জায়গা আলাদা। আমি তোমার মাঝে আমার প্রেমকে দেখেছি, তাই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এখন তোমার বিশ্বাস আমার কাছে গৌণ।
ফ্লোরিন্ডা বলল, তুমি আমাকে পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে কি আমাকে ভালোবাসতে পারবে?
সাইদ বলল, যদি ভালোবাসা পাই তাহলে একেই চাওয়া-পাওয়ার সবটুকু ভেবে নিতে দোষ কী? যেহেতু এ জীবনে সুখের একটি সীমাবদ্ধতা আছে, তাই এর শেষ মাথায় না পৌঁছতে পারলে আমি শান্তি পাবো না।

রাতের আঁধার নেমে এসেছে। তারা দুজন উঠে পড়ল। প্রতিদিন হাঁটতে হাঁটতে যেখানে এসে তারা বিদায় নেয়, সেখানে থামল। সাইদের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ফ্লোরিন্ডা বলল, হে রাজপুত্র! তুমি আমাকে যেমন ভালোবাসবে, আমিও তোমাকে তেমনই ভালোবাসবো। আমার ভালোবাসা তোমার ভালোবাসার মতোই নিখাঁদ হবে। নিয়তি আমাদের দেহকে আলাদা করেছে কিন্তু প্রেম আমাদের হৃদয়কে এক সুতোয় বেঁধে রাখবে। ফ্লোরিন্ডা বিদায় নিল।

এরপর অনেকগুলো সুখের দিন কেটে গেল। অতীতের দুঃখের কথা দুজনই ভুলতে বসল। তারা হয়ে উঠল গ্রানাডার আকাশের নিচে অনিন্দ্য সুন্দর দুটি পাখি। যেখানে ইচ্ছে উড়ে বেড়ায়। বাতাসের রেণুতে গানের সুর ছড়িয়ে দেয়। যেখানে ইচ্ছা সেখানে গিয়ে থামে। হায়, নিয়তি যদি তাদেরকে উপেক্ষা করে যেত! অনেক অশ্রু ও বেদনার বিনিময়ে কেনা এইটুকু সুখ যদি না আসত তাহলে কতই না ভালো হতো! কারণ এইটুকু হারালে তো পাওয়ার আর কিছু নেই।

একদিন অশ্রু নদীর কোনো এক উপশাখার তীরে তারা বসে ছিল। গ্রানাডার শাসকের পুত্র এলডন রডারিক সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে দেখে একটুখানি থমকে দাঁড়াল।

এলডন আগেই ফ্লোরিন্ডার প্রেমে পড়েছিল। একাধিকবার সে ফ্লোরিন্ডার বাড়িতে গিয়ে প্রেম নিবেদন করেছে, বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু ফ্লোরিন্ডা তার কথায় কর্ণপাত করেনি। সে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, বাবার খুনির পুত্রের সাথে সে বিয়ে বসবে না। এলডন যে ক্ষোভ নিয়ে ফিরে এসেছে তা এখনো তার বুকে ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। ফ্লোরিন্ডাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে তার মনে সন্দেহ জাগল যে, ফ্লোরিন্ডা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে ওই সুদর্শন আরব যুবকটির জন্য। ফ্লোরিন্ডা তার জন্য হৃদয়ের দুয়ার বন্ধ রেখেছে, কারণ ওই যুবকটি তার হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে। পরের দিন এলডন কথাগুলো বলার জন্য ফ্লোরিন্ডার বাড়িতে এল। কিন্তু ফ্লোরিন্ডা তাকে মুখ দেখাতেও রাজি নয়।
এলডন প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। মনে মনে ভয়ংকর প্রতিশোধের ছক আঁকতে আঁকতে সে ঘরে ফিরে গেল।

পাঁচ

কয়েকদিন পর।

যারা এদেশের শাসক ছিল, যারা এ সভ্যতা গড়ে তুলেছে, যারা এই দুর্গ ও প্রাসাদের নির্মাতা, যারা এই পুষ্পোদ্যানের মালিক তাদের শেষ পুরুষ আমীর সাইদ বিন ইউসুফকে গুরুতর অভিযোগে লাঞ্ছিত অপদস্থ অবস্থায় আদালতে হাজির করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে একজন খ্রিস্টান তরুণীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছে। গ্রানাডার আদালতের চোখে এরচেয়ে বড় অপরাধ আর নেই।

আসামীর কাঠগড়ায় নির্বিকার চিত্তে সাইদ দাঁড়িয়ে আছে। প্রধান বিচারক অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সাইদ অস্বীকার করল, কিন্তু তার অস্বীকারের প্রতি কেউ কর্ণপাত করল না।

বিচারক বলল, তুমি নিরাপরাধ সেটা প্রমাণের একটামাত্র উপায় আছে, তাহল তুমি তোমার ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে যাও!

প্রস্তাবটি শোনার সাথে সাথে সাইদের মাথায় খুন চেপে গেল। সে চিৎকার করে বলল, তোমাদের কোন্ কিতাবে আছে, তোমাদের কোন্ ধর্মগুরু বলেছেন যে, কেউ খ্রিস্টান না হলে তাকে মেরে ফেলতে হবে? এদেশে পা রাখার সময় তোমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে যে, স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনে কাউকে বাধা দেবে না। তোমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে যে, আমাদের অনুভূতিতে আঘাত করবে না, আমাদের ধর্মীয় চিহ্নকে মুছে ফেলার চেষ্টা করবে না। কোথায় তোমাদের সেই প্রতিশ্রুতি? কোথায় প্রতিশ্রুতি পূরণের দায়বদ্ধতা? শক্তির দাপটে প্রতিশ্রুতির কথা তোমরা ভুলে গেছো, তাই আজ যা ইচ্ছা তাই করতে পারো। হ্যা, যত ইচ্ছা আমাদের রক্ত ঝরাও! আমাদের অধিকার কেড়ে নাও! আমরা শক্তিশালী হতে পারিনি, এই আমাদের অপরাধ। সুতরাং ভীরু-কাপুরুষের পরিণতিই আমাদের প্রাপ্য।

সাইদ আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু বিচারক তাকে থামিয়ে দিল। তাকে সেই মৃত্যু উপত্যকায় নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়া হল, যেখানে দশ হাজার মুসলমানকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।

খ্রিস্টান নারী-পুরুষে চত্বর পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জল্লাদ তরবারি উঁচু করতেই ভীড়ের ভিতর থেকে কোনো নারী কন্ঠের আর্ত-চিৎকার শোনা গেল। উপস্থিত মানুষ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে চিৎকারের উৎস খুঁজে পেল না। চোখের পলক ফেলতেই আলহামরার শেষ পুরুষের মাথা খোলা চত্বরে গড়াগড়ি খেল।

গ্রানাডার উপকূলে আলহামরার সন্তানদের কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পথচারীরা একটি নতুন কবর দেখতে পায়। একটি অতিকায় সবুজ মার্বেল খোঁদাই করে বানানো কবর। বুকের উপর একটুখানি গর্ত। সেখানে বৃষ্টির সময় পানি জমে। গৃষ্মের শ্রান্ত পাখিরা সেখান থেকে তৃষ্ণা নিবারণ করে। কবরের গায়ে খোঁদাই করে লেখা:

‘এটা আলহামরার শেষ পুরুষের সমাধী
ফ্লোরিন্ডা ফ্লেবের পক্ষ থেকে, যে জীবন দিয়ে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে।’

আগের সংবাদআশ্রয়
পরবর্তি সংবাদমরিয়ম